গণ-অভ্যুত্থানের পর কেউ কেউ আওয়ামী লীগকে অগ্রাহ্য করতে চেয়ে পুরো মুক্তিযুদ্ধকেই মামুলি একটি ইতিহাসের অংশ বলে ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একটি জাতি তো তার ইতিহাস বহন করে, রক্তে সেটা থেকে যায়। কেউ একজন নতুন একটা তত্ত্ব নিয়ে হাজির হলেই জনগণ তাতে সায় দেবে, এমন মনে করার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ নেই।
জাহীদ রেজা নূর

এবারের মার্চ মাসটাকে কীভাবে দেখা হবে? কে কীভাবে দেখবে? উন্মাতাল এই শহরের ফুঁসে ওঠা দেখে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ৩ মার্চের ইত্তেফাকের শিরোনাম করেছিলেন ‘বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন’। এর নিচেই ছিল ‘আমি শেখ মুজিব বলছি’। সেই সময়ের নায়ক শেখ মুজিবুর রহমান।
সে সময়টি পাড়ি দিয়েছে আমাদের ইতিহাস, তাকে কোনো ধরনের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে অবমূল্যায়ন করা যাবে না। ইতিহাসের নানা দিক থাকে, নানা ভাবনায় জারিত হয় মানুষ, কিন্তু বাঙালির ইতিহাসে ১৯৭১ সালের অর্জন ও অঙ্গীকার সবকিছুর ওপরে স্থান নিয়েছে। এই ইতিহাস ভুলিয়ে দিয়ে নব নব তরিকা হাজির করলে ইতিহাসই তা প্রত্যাখ্যান করবে।
স্বাধীন বাংলাদেশ তার অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারেনি। একটি ন্যায়বিচার-সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ে ওঠেনি, বরং নিজের সংস্কৃতি নিয়ে আবারও দ্বিধায় পড়েছে তারা। যে যৌবনের উজ্জীবন হয়েছিল বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনে, তার ধারাবাহিকতাকে এখন অগ্রাহ্য করছে কেউ কেউ। তারা ভুলে যাচ্ছে, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিরা যে বৈষম্যের সৃষ্টি করে রেখেছিল, তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। গুটিকয়েক সরকারি দালাল ছাড়া সবাই সেদিন পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল ঘৃণাভরে।
সেই ইতিহাস কি জানে আজকের প্রজন্ম? তখন প্রত্যেকেই হৃদয়ে বয়ে বেড়াত একটি স্বপ্ন, স্বাধীনতা যার নাম। আমাদের স্বাধীনতার মাসে লেখাটি লিখতে গিয়ে বেশ কিছু প্রশ্নের উদয় হচ্ছে মনে। তারই কিছু কথা বলব আজ।
২. সম্প্রতি উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলাম। নানা রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে দেশের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে মনে হলো, ঢাকা মহানগরীতে যত ধরনের বিভাজন ও সহিংসতা বিদ্যমান এই মুহূর্তে, গ্রামের মানুষ সেগুলো বহন করতে রাজি নয়। একটি সুন্দর নিরাপদ রাষ্ট্রে তারা বসবাস করতে চায়। তবে তাদের সেই নিরবচ্ছিন্ন শান্তির তৃষ্ণা নিবারণ হয় না সব সময়।
উত্তরবঙ্গের একেবারে শেষ মাথায় একটি ছোট শহরে অনেক মমতা দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল একটি পাঠাগার। কেন, কী কারণে ৫ আগস্টের পর সেই পাঠাগার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং বইগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তার কোনো ব্যাখ্যা স্থানীয় কেউ দিতে পারে না। একটি পাঠাগার কার চক্ষুশূল হতে পারে, তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে।
কিছুক্ষণ আগেই বলেছি, এই ভূখণ্ডে হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা। এ কথাও বলেছি, এই স্বাধীনতা লাভের ব্যাপারে নানা ধরনের বয়ান দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেসব বয়ান যাঁরা দাঁড় করাতে চাইছেন, তাঁরা ইতিহাসের কাছে না গিয়ে ধরি মাছ না ছুঁই পানি ধরনের একটা মানসিকতা বহন করে চলেছেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই ভাষার প্রশ্নে বাঙালি প্রথম যে ধাক্কাটা খেয়েছিল, তাতেই নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা ও অঙ্গীকারবোধে জারিত হয়েছিল এই ভূখণ্ডের মানুষ। সেই চেতনা নিয়েই পাকিস্তানি জান্তাদের বৈষম্যের দীর্ঘ পথকে চ্যালেঞ্জ করেই এগিয়ে গেছে এ দেশের জনগণ। এই মানুষেরা যে আত্মপরিচয় গড়ে তুলেছে, তাতে ধর্ম-বর্ণে কোনো ভেদাভেদ থাকার কথা নয়। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, সেই আত্মপরিচয় গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা যেমন এসেছে, তেমনি যাঁরা সেই অঙ্গীকার করেছিলেন, তাঁরা তা বেমালুম ভুলে গিয়ে কেবল সুবিধাবাদী কিংবা সুবিধাভোগী একটি শ্রেণিতে পরিণত হয়েছেন। তার চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, কোনো ধরনের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এসে যখন এই খেটে খাওয়া মানুষকে স্বপ্ন দেখায়, তখন কিছুদিন অতিক্রান্ত হলেই বোঝা যায় একইভাবে প্রতারিত হতে হবে। ব্যাপারটিকে দুঃসহ স্বপ্ন বললে ভুল হয় না।
আমি উত্তরবঙ্গের কয়েকটি শহরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। তারা প্রথমে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করে বুঝে নিতে চেয়েছেন যে আমি কোন মানসিকতার মানুষ। আরও সহজ করে বললে বলতে হয়, তারা জানতে চায় আমি কোনো রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব করছি কি না। যে রকম ভাঙচুর, লুটপাট ইত্যাদি হয়েছে, তাতে মানুষকে বিশ্বাস করা যে কঠিন হয়ে পড়েছে, সে কথা স্পষ্ট বোঝা গেল। মব ভায়োলেন্স যেভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে, তাতে মনে হচ্ছে শুভবুদ্ধি দিয়ে এর নাগাল পাওয়া কঠিন এখনো। পুলিশ বাস করছে ভয়ের রাজত্বে, হঠাৎ একদল লোক এসে চিৎকার-চেঁচামেচি করলেই তার দাবি পূরণ করে দেওয়া হবে—এ রকম একটা মানসিকতা গড়ে উঠছে। ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, স্বপ্নের কোনো সফল পরিণতি আসবে কি না, তা নিয়ে সবাই সন্দিহান, অন্তত যাদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি।
তেঁতুলিয়ায় পৌঁছানোর পর স্মৃতি রোমন্থন করে বললাম, যখন বছর ১৫ আগে ডাকবাংলোয় থাকার সময় একটা ফ্যান নিয়ে বাজারের পাশ দিয়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম আমরা। পথটি পাড়ি দেওয়ার সময় বারবার দেখতে হয়েছে গরুর পাল ভারত সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে বাংলায়। এটা যে চোরাকারবারি, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু এটাও বোঝা যাচ্ছিল যে সীমান্তের দুই দিকের মানুষেরই এতে লাভালাভ বণ্টনের পরিকল্পনা রয়েছে।
এবার যখন সে কথা বলছিলাম, তখন আমাদের গাড়ির চালক সতর্ক করে দিয়ে বললেন, রাতের বেলায় ভুলেও ভ্যানে করে ঘুরবেন না। কে কখন কোন দিক থেকে এসে চাপাতি কিংবা ছুরি ধরবে, সে-কথা আগে থেকে বলা যায় না। সুতরাং সাবধান থাকবেন।
তার পরও বাজার বসছে, হাট বসছে, মাঠে খেলছে শিশু-তরুণেরা, মেলা হচ্ছে এবং এই সবকিছু নিয়ে ও না নিয়েই জীবন একরকম বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যে অঙ্গীকারের কথা একটু আগে বলেছি, সেই অঙ্গীকারের ব্যাপারে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। রাজনৈতিক মাঠটি কে কীভাবে দখল করবে, তা নিয়েই বর্তমান রাজনীতির ভূগোল এগোচ্ছে।
৩. যাত্রাপথে যে স্কুল কিংবা কলেজ সামনে পড়েছে, দুরু দুরু বক্ষে তাকিয়ে দেখেছি সেখানে শহীদ মিনারটি অক্ষত আছে কি না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আশ্বস্ত হয়েছি। আমাদের ইতিহাসের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে কেউ যদি কোনো সময় মনে করেন, বায়ান্ন সালে ভাষা আন্দোলন করা উচিত হয়নি কিংবা একাত্তর সালে মুসলমান-মুসলমান ভাইদের মধ্যে অকারণে যুদ্ধ বেধে গিয়েছিল এবং সেই ইতিহাস যদি জাতিকে গেলানোর চেষ্টা করা হয়, তাহলে কোন ধরনের রাজনীতির সূচনা হবে, সে-কথা এই মুহূর্তে ভাবা যাচ্ছে না। তবে সেটা যে একটি অশ্বডিম্ব হবে, সে কথা বলাই বাহুল্য।
আশার দিক হলো, গণ-অভ্যুত্থানের পর কেউ কেউ আওয়ামী লীগকে অগ্রাহ্য করতে চেয়ে পুরো মুক্তিযুদ্ধকেই মামুলি একটি ইতিহাসের অংশ বলে ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একটি জাতি তো তার ইতিহাস বহন করে, রক্তে সেটা থেকে যায়। কেউ একজন নতুন একটা তত্ত্ব নিয়ে হাজির হলেই জনগণ তাতে সায় দেবে, এমন মনে করার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ নেই। মানুষের কাছে যেতে হবে তার প্রত্যাশিত রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে।
ভাষাসংগ্রামী মোহাম্মদ সুলতানের নামে একটি পাঠাগার উদ্বোধন হলো তাঁর জন্মভূমি বোদায়। সেখানে বিশিষ্টজনেরা কথা বললেন এবং সেই পাঠাগার ধীরে ধীরে আলোর পথ দেখাবে বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেন। বক্তৃতামালার মাঝে ছোট্ট একটি মেয়ে একুশের একটি ছড়া আবৃত্তি করল। সেই আবৃত্তিতে চর্চার স্পর্শ ছিল। তাতে মনে হয়েছে, একুশের চেতনা তো শিকড়ের ব্যাপার। কিন্তু যেকোনো কিছুর মতোই তার পরিচর্যা প্রয়োজন। নিজের লাভালাভের খেয়ালে উন্মত্ত হয়ে উঠলে সেই পরিচর্যা করার সুযোগ থাকে না। তাই মনগুলো হয়ে থাকে অকর্ষিত। সেই সুযোগটা নেয় বিভিন্ন রকম অন্ধের দল। তারা অকর্ষিত মনে পশ্চাৎপদতার বীজ বোনে। মর্ম না বুঝে মুখস্থ বিদ্যাকে হৃদয়ে ঢোকানোর চেষ্টা করে। তাতে যে প্রজন্মের সৃষ্টি হয়, সেই প্রজন্ম যৌক্তিকতার ধার ধারে না এবং তাদের মধ্যে মননচর্চা থাকে না। আমরা যেন জেনে-বুঝে সেই অন্ধতাকে ফিরিয়ে আনার শপথ নিয়েছি।
৪. বাংলাবান্ধায় জিরো পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেল উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠার মতো এক ঘটনা। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার বিকেলের আলোয় পতাকা নামানোর সময় বিজিবি ও বিএসএফ সীমান্তের দুই দিক থেকে এসে এমন কিছু মহড়া করে, যা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।
এ সময় সেই পতাকা নামানো প্রদর্শনী শেষে বাংলাদেশের মানুষ ভারতের জিরো পয়েন্টে গিয়ে তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে পারে। ভারতীয়রাও বাংলাদেশের জিরো পয়েন্টের ভেতরে ঢুকে কথাবার্তা বলতে পারে, ছবি তুলতে পারে। এই দৃশ্য দেখার জন্য বাংলাদেশ-ভারত উভয় সীমান্তেই গ্যালারি তৈরি করে রাখা হয়েছে। সেখানে বসে এই দৃশ্য দেখা যায় এবং প্রদর্শনী শেষ হলে সবার সঙ্গে মিলেমিশে ছবি তোলা যায়।
এই প্রদর্শনী দেখব বলে আধা ঘণ্টা আগেই আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টে। পঞ্চগড় থেকে এক প্রৌঢ় দম্পতি বসে ছিলেন আমাদের পাশেই। সবাই যখন বিজিবি ও বিএসএফের সঙ্গে ছবি তুলছে, আনন্দ করছে, তখন দেখা গেল এক অনন্য দৃশ্য। সীমান্তের ওপারে থুত্থুড়ে দুই বুড়ো-বুড়ি হাজির হয়েছেন ছোট্ট এক নাতি ও নাতির মাকে নিয়ে। আর পঞ্চগড় থেকে আসা ওই দম্পতি সীমান্তের কাছে এসে জড়িয়ে ধরছেন ভারতে থাকা মা-বাবাকে, কাঁদছেন। বহুদিন পর এখানে এসে মিলন হলো তাঁদের। এই ঘটনার কি কোনো ব্যাখ্যা হয়?
ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক উত্তপ্ত থাকার মূল কারণ রাজনৈতিক। নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন করে প্রতিবেশীসুলভ মনোভাব ফিরিয়ে আনতে না পারলে সমূহ বিপদ। নইলে ধর্মব্যবসায়ীরা আমাদের আত্মপরিচয় ভুলিয়ে দেবে। আমাদের কূটনীতির মূল কথা যে ‘কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুতা’, সেটা বোঝার জন্য খুব বেশি মেধাবী হতে হয় না। কিন্তু আমরা নিজেরা নিজেদের সম্মান করি না বলে একে অন্যের সঙ্গে হানাহানি করি। ভারতে যেমন এ ধরনের উগ্রপন্থা রয়েছে এবং রয়েছে দাদাগিরি করার খাসলত, তেমনি আমাদের দেশেও রয়েছে উগ্র ধর্মান্ধতা।
মিলনেই মুক্তি—এ কথা বোঝার মতো পরিস্থিতি কি এখন বিরাজ করছে? কিংবা কিছুদিন আগেও কি বিরাজ করেছিল? দেশের জনগণকে এ রকম শাস্তি দেওয়ার অধিকার এসব ক্ষমতাধর লোককে কে দিয়েছে? এরাই কিন্তু মুখে বলে—জনগণই ক্ষমতার উৎস। এত বড় পরিহাস পৃথিবী কমই দেখেছে।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

এবারের মার্চ মাসটাকে কীভাবে দেখা হবে? কে কীভাবে দেখবে? উন্মাতাল এই শহরের ফুঁসে ওঠা দেখে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ৩ মার্চের ইত্তেফাকের শিরোনাম করেছিলেন ‘বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন’। এর নিচেই ছিল ‘আমি শেখ মুজিব বলছি’। সেই সময়ের নায়ক শেখ মুজিবুর রহমান।
সে সময়টি পাড়ি দিয়েছে আমাদের ইতিহাস, তাকে কোনো ধরনের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে অবমূল্যায়ন করা যাবে না। ইতিহাসের নানা দিক থাকে, নানা ভাবনায় জারিত হয় মানুষ, কিন্তু বাঙালির ইতিহাসে ১৯৭১ সালের অর্জন ও অঙ্গীকার সবকিছুর ওপরে স্থান নিয়েছে। এই ইতিহাস ভুলিয়ে দিয়ে নব নব তরিকা হাজির করলে ইতিহাসই তা প্রত্যাখ্যান করবে।
স্বাধীন বাংলাদেশ তার অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারেনি। একটি ন্যায়বিচার-সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ে ওঠেনি, বরং নিজের সংস্কৃতি নিয়ে আবারও দ্বিধায় পড়েছে তারা। যে যৌবনের উজ্জীবন হয়েছিল বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনে, তার ধারাবাহিকতাকে এখন অগ্রাহ্য করছে কেউ কেউ। তারা ভুলে যাচ্ছে, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিরা যে বৈষম্যের সৃষ্টি করে রেখেছিল, তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। গুটিকয়েক সরকারি দালাল ছাড়া সবাই সেদিন পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল ঘৃণাভরে।
সেই ইতিহাস কি জানে আজকের প্রজন্ম? তখন প্রত্যেকেই হৃদয়ে বয়ে বেড়াত একটি স্বপ্ন, স্বাধীনতা যার নাম। আমাদের স্বাধীনতার মাসে লেখাটি লিখতে গিয়ে বেশ কিছু প্রশ্নের উদয় হচ্ছে মনে। তারই কিছু কথা বলব আজ।
২. সম্প্রতি উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলাম। নানা রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে দেশের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে মনে হলো, ঢাকা মহানগরীতে যত ধরনের বিভাজন ও সহিংসতা বিদ্যমান এই মুহূর্তে, গ্রামের মানুষ সেগুলো বহন করতে রাজি নয়। একটি সুন্দর নিরাপদ রাষ্ট্রে তারা বসবাস করতে চায়। তবে তাদের সেই নিরবচ্ছিন্ন শান্তির তৃষ্ণা নিবারণ হয় না সব সময়।
উত্তরবঙ্গের একেবারে শেষ মাথায় একটি ছোট শহরে অনেক মমতা দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল একটি পাঠাগার। কেন, কী কারণে ৫ আগস্টের পর সেই পাঠাগার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং বইগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তার কোনো ব্যাখ্যা স্থানীয় কেউ দিতে পারে না। একটি পাঠাগার কার চক্ষুশূল হতে পারে, তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে।
কিছুক্ষণ আগেই বলেছি, এই ভূখণ্ডে হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা। এ কথাও বলেছি, এই স্বাধীনতা লাভের ব্যাপারে নানা ধরনের বয়ান দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেসব বয়ান যাঁরা দাঁড় করাতে চাইছেন, তাঁরা ইতিহাসের কাছে না গিয়ে ধরি মাছ না ছুঁই পানি ধরনের একটা মানসিকতা বহন করে চলেছেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই ভাষার প্রশ্নে বাঙালি প্রথম যে ধাক্কাটা খেয়েছিল, তাতেই নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা ও অঙ্গীকারবোধে জারিত হয়েছিল এই ভূখণ্ডের মানুষ। সেই চেতনা নিয়েই পাকিস্তানি জান্তাদের বৈষম্যের দীর্ঘ পথকে চ্যালেঞ্জ করেই এগিয়ে গেছে এ দেশের জনগণ। এই মানুষেরা যে আত্মপরিচয় গড়ে তুলেছে, তাতে ধর্ম-বর্ণে কোনো ভেদাভেদ থাকার কথা নয়। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, সেই আত্মপরিচয় গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা যেমন এসেছে, তেমনি যাঁরা সেই অঙ্গীকার করেছিলেন, তাঁরা তা বেমালুম ভুলে গিয়ে কেবল সুবিধাবাদী কিংবা সুবিধাভোগী একটি শ্রেণিতে পরিণত হয়েছেন। তার চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, কোনো ধরনের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এসে যখন এই খেটে খাওয়া মানুষকে স্বপ্ন দেখায়, তখন কিছুদিন অতিক্রান্ত হলেই বোঝা যায় একইভাবে প্রতারিত হতে হবে। ব্যাপারটিকে দুঃসহ স্বপ্ন বললে ভুল হয় না।
আমি উত্তরবঙ্গের কয়েকটি শহরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। তারা প্রথমে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করে বুঝে নিতে চেয়েছেন যে আমি কোন মানসিকতার মানুষ। আরও সহজ করে বললে বলতে হয়, তারা জানতে চায় আমি কোনো রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব করছি কি না। যে রকম ভাঙচুর, লুটপাট ইত্যাদি হয়েছে, তাতে মানুষকে বিশ্বাস করা যে কঠিন হয়ে পড়েছে, সে কথা স্পষ্ট বোঝা গেল। মব ভায়োলেন্স যেভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে, তাতে মনে হচ্ছে শুভবুদ্ধি দিয়ে এর নাগাল পাওয়া কঠিন এখনো। পুলিশ বাস করছে ভয়ের রাজত্বে, হঠাৎ একদল লোক এসে চিৎকার-চেঁচামেচি করলেই তার দাবি পূরণ করে দেওয়া হবে—এ রকম একটা মানসিকতা গড়ে উঠছে। ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, স্বপ্নের কোনো সফল পরিণতি আসবে কি না, তা নিয়ে সবাই সন্দিহান, অন্তত যাদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি।
তেঁতুলিয়ায় পৌঁছানোর পর স্মৃতি রোমন্থন করে বললাম, যখন বছর ১৫ আগে ডাকবাংলোয় থাকার সময় একটা ফ্যান নিয়ে বাজারের পাশ দিয়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম আমরা। পথটি পাড়ি দেওয়ার সময় বারবার দেখতে হয়েছে গরুর পাল ভারত সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে বাংলায়। এটা যে চোরাকারবারি, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু এটাও বোঝা যাচ্ছিল যে সীমান্তের দুই দিকের মানুষেরই এতে লাভালাভ বণ্টনের পরিকল্পনা রয়েছে।
এবার যখন সে কথা বলছিলাম, তখন আমাদের গাড়ির চালক সতর্ক করে দিয়ে বললেন, রাতের বেলায় ভুলেও ভ্যানে করে ঘুরবেন না। কে কখন কোন দিক থেকে এসে চাপাতি কিংবা ছুরি ধরবে, সে-কথা আগে থেকে বলা যায় না। সুতরাং সাবধান থাকবেন।
তার পরও বাজার বসছে, হাট বসছে, মাঠে খেলছে শিশু-তরুণেরা, মেলা হচ্ছে এবং এই সবকিছু নিয়ে ও না নিয়েই জীবন একরকম বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যে অঙ্গীকারের কথা একটু আগে বলেছি, সেই অঙ্গীকারের ব্যাপারে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। রাজনৈতিক মাঠটি কে কীভাবে দখল করবে, তা নিয়েই বর্তমান রাজনীতির ভূগোল এগোচ্ছে।
৩. যাত্রাপথে যে স্কুল কিংবা কলেজ সামনে পড়েছে, দুরু দুরু বক্ষে তাকিয়ে দেখেছি সেখানে শহীদ মিনারটি অক্ষত আছে কি না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আশ্বস্ত হয়েছি। আমাদের ইতিহাসের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে কেউ যদি কোনো সময় মনে করেন, বায়ান্ন সালে ভাষা আন্দোলন করা উচিত হয়নি কিংবা একাত্তর সালে মুসলমান-মুসলমান ভাইদের মধ্যে অকারণে যুদ্ধ বেধে গিয়েছিল এবং সেই ইতিহাস যদি জাতিকে গেলানোর চেষ্টা করা হয়, তাহলে কোন ধরনের রাজনীতির সূচনা হবে, সে-কথা এই মুহূর্তে ভাবা যাচ্ছে না। তবে সেটা যে একটি অশ্বডিম্ব হবে, সে কথা বলাই বাহুল্য।
আশার দিক হলো, গণ-অভ্যুত্থানের পর কেউ কেউ আওয়ামী লীগকে অগ্রাহ্য করতে চেয়ে পুরো মুক্তিযুদ্ধকেই মামুলি একটি ইতিহাসের অংশ বলে ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একটি জাতি তো তার ইতিহাস বহন করে, রক্তে সেটা থেকে যায়। কেউ একজন নতুন একটা তত্ত্ব নিয়ে হাজির হলেই জনগণ তাতে সায় দেবে, এমন মনে করার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ নেই। মানুষের কাছে যেতে হবে তার প্রত্যাশিত রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে।
ভাষাসংগ্রামী মোহাম্মদ সুলতানের নামে একটি পাঠাগার উদ্বোধন হলো তাঁর জন্মভূমি বোদায়। সেখানে বিশিষ্টজনেরা কথা বললেন এবং সেই পাঠাগার ধীরে ধীরে আলোর পথ দেখাবে বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেন। বক্তৃতামালার মাঝে ছোট্ট একটি মেয়ে একুশের একটি ছড়া আবৃত্তি করল। সেই আবৃত্তিতে চর্চার স্পর্শ ছিল। তাতে মনে হয়েছে, একুশের চেতনা তো শিকড়ের ব্যাপার। কিন্তু যেকোনো কিছুর মতোই তার পরিচর্যা প্রয়োজন। নিজের লাভালাভের খেয়ালে উন্মত্ত হয়ে উঠলে সেই পরিচর্যা করার সুযোগ থাকে না। তাই মনগুলো হয়ে থাকে অকর্ষিত। সেই সুযোগটা নেয় বিভিন্ন রকম অন্ধের দল। তারা অকর্ষিত মনে পশ্চাৎপদতার বীজ বোনে। মর্ম না বুঝে মুখস্থ বিদ্যাকে হৃদয়ে ঢোকানোর চেষ্টা করে। তাতে যে প্রজন্মের সৃষ্টি হয়, সেই প্রজন্ম যৌক্তিকতার ধার ধারে না এবং তাদের মধ্যে মননচর্চা থাকে না। আমরা যেন জেনে-বুঝে সেই অন্ধতাকে ফিরিয়ে আনার শপথ নিয়েছি।
৪. বাংলাবান্ধায় জিরো পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেল উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠার মতো এক ঘটনা। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার বিকেলের আলোয় পতাকা নামানোর সময় বিজিবি ও বিএসএফ সীমান্তের দুই দিক থেকে এসে এমন কিছু মহড়া করে, যা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।
এ সময় সেই পতাকা নামানো প্রদর্শনী শেষে বাংলাদেশের মানুষ ভারতের জিরো পয়েন্টে গিয়ে তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে পারে। ভারতীয়রাও বাংলাদেশের জিরো পয়েন্টের ভেতরে ঢুকে কথাবার্তা বলতে পারে, ছবি তুলতে পারে। এই দৃশ্য দেখার জন্য বাংলাদেশ-ভারত উভয় সীমান্তেই গ্যালারি তৈরি করে রাখা হয়েছে। সেখানে বসে এই দৃশ্য দেখা যায় এবং প্রদর্শনী শেষ হলে সবার সঙ্গে মিলেমিশে ছবি তোলা যায়।
এই প্রদর্শনী দেখব বলে আধা ঘণ্টা আগেই আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টে। পঞ্চগড় থেকে এক প্রৌঢ় দম্পতি বসে ছিলেন আমাদের পাশেই। সবাই যখন বিজিবি ও বিএসএফের সঙ্গে ছবি তুলছে, আনন্দ করছে, তখন দেখা গেল এক অনন্য দৃশ্য। সীমান্তের ওপারে থুত্থুড়ে দুই বুড়ো-বুড়ি হাজির হয়েছেন ছোট্ট এক নাতি ও নাতির মাকে নিয়ে। আর পঞ্চগড় থেকে আসা ওই দম্পতি সীমান্তের কাছে এসে জড়িয়ে ধরছেন ভারতে থাকা মা-বাবাকে, কাঁদছেন। বহুদিন পর এখানে এসে মিলন হলো তাঁদের। এই ঘটনার কি কোনো ব্যাখ্যা হয়?
ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক উত্তপ্ত থাকার মূল কারণ রাজনৈতিক। নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন করে প্রতিবেশীসুলভ মনোভাব ফিরিয়ে আনতে না পারলে সমূহ বিপদ। নইলে ধর্মব্যবসায়ীরা আমাদের আত্মপরিচয় ভুলিয়ে দেবে। আমাদের কূটনীতির মূল কথা যে ‘কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুতা’, সেটা বোঝার জন্য খুব বেশি মেধাবী হতে হয় না। কিন্তু আমরা নিজেরা নিজেদের সম্মান করি না বলে একে অন্যের সঙ্গে হানাহানি করি। ভারতে যেমন এ ধরনের উগ্রপন্থা রয়েছে এবং রয়েছে দাদাগিরি করার খাসলত, তেমনি আমাদের দেশেও রয়েছে উগ্র ধর্মান্ধতা।
মিলনেই মুক্তি—এ কথা বোঝার মতো পরিস্থিতি কি এখন বিরাজ করছে? কিংবা কিছুদিন আগেও কি বিরাজ করেছিল? দেশের জনগণকে এ রকম শাস্তি দেওয়ার অধিকার এসব ক্ষমতাধর লোককে কে দিয়েছে? এরাই কিন্তু মুখে বলে—জনগণই ক্ষমতার উৎস। এত বড় পরিহাস পৃথিবী কমই দেখেছে।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
গণ-অভ্যুত্থানের পর কেউ কেউ আওয়ামী লীগকে অগ্রাহ্য করতে চেয়ে পুরো মুক্তিযুদ্ধকেই মামুলি একটি ইতিহাসের অংশ বলে ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একটি জাতি তো তার ইতিহাস বহন করে, রক্তে সেটা থেকে যায়। কেউ একজন নতুন একটা তত্ত্ব নিয়ে হাজির হলেই জনগণ তাতে সায় দেবে, এমন মনে করার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ নেই।
জাহীদ রেজা নূর

এবারের মার্চ মাসটাকে কীভাবে দেখা হবে? কে কীভাবে দেখবে? উন্মাতাল এই শহরের ফুঁসে ওঠা দেখে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ৩ মার্চের ইত্তেফাকের শিরোনাম করেছিলেন ‘বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন’। এর নিচেই ছিল ‘আমি শেখ মুজিব বলছি’। সেই সময়ের নায়ক শেখ মুজিবুর রহমান।
সে সময়টি পাড়ি দিয়েছে আমাদের ইতিহাস, তাকে কোনো ধরনের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে অবমূল্যায়ন করা যাবে না। ইতিহাসের নানা দিক থাকে, নানা ভাবনায় জারিত হয় মানুষ, কিন্তু বাঙালির ইতিহাসে ১৯৭১ সালের অর্জন ও অঙ্গীকার সবকিছুর ওপরে স্থান নিয়েছে। এই ইতিহাস ভুলিয়ে দিয়ে নব নব তরিকা হাজির করলে ইতিহাসই তা প্রত্যাখ্যান করবে।
স্বাধীন বাংলাদেশ তার অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারেনি। একটি ন্যায়বিচার-সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ে ওঠেনি, বরং নিজের সংস্কৃতি নিয়ে আবারও দ্বিধায় পড়েছে তারা। যে যৌবনের উজ্জীবন হয়েছিল বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনে, তার ধারাবাহিকতাকে এখন অগ্রাহ্য করছে কেউ কেউ। তারা ভুলে যাচ্ছে, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিরা যে বৈষম্যের সৃষ্টি করে রেখেছিল, তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। গুটিকয়েক সরকারি দালাল ছাড়া সবাই সেদিন পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল ঘৃণাভরে।
সেই ইতিহাস কি জানে আজকের প্রজন্ম? তখন প্রত্যেকেই হৃদয়ে বয়ে বেড়াত একটি স্বপ্ন, স্বাধীনতা যার নাম। আমাদের স্বাধীনতার মাসে লেখাটি লিখতে গিয়ে বেশ কিছু প্রশ্নের উদয় হচ্ছে মনে। তারই কিছু কথা বলব আজ।
২. সম্প্রতি উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলাম। নানা রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে দেশের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে মনে হলো, ঢাকা মহানগরীতে যত ধরনের বিভাজন ও সহিংসতা বিদ্যমান এই মুহূর্তে, গ্রামের মানুষ সেগুলো বহন করতে রাজি নয়। একটি সুন্দর নিরাপদ রাষ্ট্রে তারা বসবাস করতে চায়। তবে তাদের সেই নিরবচ্ছিন্ন শান্তির তৃষ্ণা নিবারণ হয় না সব সময়।
উত্তরবঙ্গের একেবারে শেষ মাথায় একটি ছোট শহরে অনেক মমতা দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল একটি পাঠাগার। কেন, কী কারণে ৫ আগস্টের পর সেই পাঠাগার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং বইগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তার কোনো ব্যাখ্যা স্থানীয় কেউ দিতে পারে না। একটি পাঠাগার কার চক্ষুশূল হতে পারে, তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে।
কিছুক্ষণ আগেই বলেছি, এই ভূখণ্ডে হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা। এ কথাও বলেছি, এই স্বাধীনতা লাভের ব্যাপারে নানা ধরনের বয়ান দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেসব বয়ান যাঁরা দাঁড় করাতে চাইছেন, তাঁরা ইতিহাসের কাছে না গিয়ে ধরি মাছ না ছুঁই পানি ধরনের একটা মানসিকতা বহন করে চলেছেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই ভাষার প্রশ্নে বাঙালি প্রথম যে ধাক্কাটা খেয়েছিল, তাতেই নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা ও অঙ্গীকারবোধে জারিত হয়েছিল এই ভূখণ্ডের মানুষ। সেই চেতনা নিয়েই পাকিস্তানি জান্তাদের বৈষম্যের দীর্ঘ পথকে চ্যালেঞ্জ করেই এগিয়ে গেছে এ দেশের জনগণ। এই মানুষেরা যে আত্মপরিচয় গড়ে তুলেছে, তাতে ধর্ম-বর্ণে কোনো ভেদাভেদ থাকার কথা নয়। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, সেই আত্মপরিচয় গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা যেমন এসেছে, তেমনি যাঁরা সেই অঙ্গীকার করেছিলেন, তাঁরা তা বেমালুম ভুলে গিয়ে কেবল সুবিধাবাদী কিংবা সুবিধাভোগী একটি শ্রেণিতে পরিণত হয়েছেন। তার চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, কোনো ধরনের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এসে যখন এই খেটে খাওয়া মানুষকে স্বপ্ন দেখায়, তখন কিছুদিন অতিক্রান্ত হলেই বোঝা যায় একইভাবে প্রতারিত হতে হবে। ব্যাপারটিকে দুঃসহ স্বপ্ন বললে ভুল হয় না।
আমি উত্তরবঙ্গের কয়েকটি শহরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। তারা প্রথমে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করে বুঝে নিতে চেয়েছেন যে আমি কোন মানসিকতার মানুষ। আরও সহজ করে বললে বলতে হয়, তারা জানতে চায় আমি কোনো রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব করছি কি না। যে রকম ভাঙচুর, লুটপাট ইত্যাদি হয়েছে, তাতে মানুষকে বিশ্বাস করা যে কঠিন হয়ে পড়েছে, সে কথা স্পষ্ট বোঝা গেল। মব ভায়োলেন্স যেভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে, তাতে মনে হচ্ছে শুভবুদ্ধি দিয়ে এর নাগাল পাওয়া কঠিন এখনো। পুলিশ বাস করছে ভয়ের রাজত্বে, হঠাৎ একদল লোক এসে চিৎকার-চেঁচামেচি করলেই তার দাবি পূরণ করে দেওয়া হবে—এ রকম একটা মানসিকতা গড়ে উঠছে। ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, স্বপ্নের কোনো সফল পরিণতি আসবে কি না, তা নিয়ে সবাই সন্দিহান, অন্তত যাদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি।
তেঁতুলিয়ায় পৌঁছানোর পর স্মৃতি রোমন্থন করে বললাম, যখন বছর ১৫ আগে ডাকবাংলোয় থাকার সময় একটা ফ্যান নিয়ে বাজারের পাশ দিয়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম আমরা। পথটি পাড়ি দেওয়ার সময় বারবার দেখতে হয়েছে গরুর পাল ভারত সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে বাংলায়। এটা যে চোরাকারবারি, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু এটাও বোঝা যাচ্ছিল যে সীমান্তের দুই দিকের মানুষেরই এতে লাভালাভ বণ্টনের পরিকল্পনা রয়েছে।
এবার যখন সে কথা বলছিলাম, তখন আমাদের গাড়ির চালক সতর্ক করে দিয়ে বললেন, রাতের বেলায় ভুলেও ভ্যানে করে ঘুরবেন না। কে কখন কোন দিক থেকে এসে চাপাতি কিংবা ছুরি ধরবে, সে-কথা আগে থেকে বলা যায় না। সুতরাং সাবধান থাকবেন।
তার পরও বাজার বসছে, হাট বসছে, মাঠে খেলছে শিশু-তরুণেরা, মেলা হচ্ছে এবং এই সবকিছু নিয়ে ও না নিয়েই জীবন একরকম বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যে অঙ্গীকারের কথা একটু আগে বলেছি, সেই অঙ্গীকারের ব্যাপারে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। রাজনৈতিক মাঠটি কে কীভাবে দখল করবে, তা নিয়েই বর্তমান রাজনীতির ভূগোল এগোচ্ছে।
৩. যাত্রাপথে যে স্কুল কিংবা কলেজ সামনে পড়েছে, দুরু দুরু বক্ষে তাকিয়ে দেখেছি সেখানে শহীদ মিনারটি অক্ষত আছে কি না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আশ্বস্ত হয়েছি। আমাদের ইতিহাসের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে কেউ যদি কোনো সময় মনে করেন, বায়ান্ন সালে ভাষা আন্দোলন করা উচিত হয়নি কিংবা একাত্তর সালে মুসলমান-মুসলমান ভাইদের মধ্যে অকারণে যুদ্ধ বেধে গিয়েছিল এবং সেই ইতিহাস যদি জাতিকে গেলানোর চেষ্টা করা হয়, তাহলে কোন ধরনের রাজনীতির সূচনা হবে, সে-কথা এই মুহূর্তে ভাবা যাচ্ছে না। তবে সেটা যে একটি অশ্বডিম্ব হবে, সে কথা বলাই বাহুল্য।
আশার দিক হলো, গণ-অভ্যুত্থানের পর কেউ কেউ আওয়ামী লীগকে অগ্রাহ্য করতে চেয়ে পুরো মুক্তিযুদ্ধকেই মামুলি একটি ইতিহাসের অংশ বলে ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একটি জাতি তো তার ইতিহাস বহন করে, রক্তে সেটা থেকে যায়। কেউ একজন নতুন একটা তত্ত্ব নিয়ে হাজির হলেই জনগণ তাতে সায় দেবে, এমন মনে করার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ নেই। মানুষের কাছে যেতে হবে তার প্রত্যাশিত রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে।
ভাষাসংগ্রামী মোহাম্মদ সুলতানের নামে একটি পাঠাগার উদ্বোধন হলো তাঁর জন্মভূমি বোদায়। সেখানে বিশিষ্টজনেরা কথা বললেন এবং সেই পাঠাগার ধীরে ধীরে আলোর পথ দেখাবে বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেন। বক্তৃতামালার মাঝে ছোট্ট একটি মেয়ে একুশের একটি ছড়া আবৃত্তি করল। সেই আবৃত্তিতে চর্চার স্পর্শ ছিল। তাতে মনে হয়েছে, একুশের চেতনা তো শিকড়ের ব্যাপার। কিন্তু যেকোনো কিছুর মতোই তার পরিচর্যা প্রয়োজন। নিজের লাভালাভের খেয়ালে উন্মত্ত হয়ে উঠলে সেই পরিচর্যা করার সুযোগ থাকে না। তাই মনগুলো হয়ে থাকে অকর্ষিত। সেই সুযোগটা নেয় বিভিন্ন রকম অন্ধের দল। তারা অকর্ষিত মনে পশ্চাৎপদতার বীজ বোনে। মর্ম না বুঝে মুখস্থ বিদ্যাকে হৃদয়ে ঢোকানোর চেষ্টা করে। তাতে যে প্রজন্মের সৃষ্টি হয়, সেই প্রজন্ম যৌক্তিকতার ধার ধারে না এবং তাদের মধ্যে মননচর্চা থাকে না। আমরা যেন জেনে-বুঝে সেই অন্ধতাকে ফিরিয়ে আনার শপথ নিয়েছি।
৪. বাংলাবান্ধায় জিরো পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেল উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠার মতো এক ঘটনা। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার বিকেলের আলোয় পতাকা নামানোর সময় বিজিবি ও বিএসএফ সীমান্তের দুই দিক থেকে এসে এমন কিছু মহড়া করে, যা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।
এ সময় সেই পতাকা নামানো প্রদর্শনী শেষে বাংলাদেশের মানুষ ভারতের জিরো পয়েন্টে গিয়ে তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে পারে। ভারতীয়রাও বাংলাদেশের জিরো পয়েন্টের ভেতরে ঢুকে কথাবার্তা বলতে পারে, ছবি তুলতে পারে। এই দৃশ্য দেখার জন্য বাংলাদেশ-ভারত উভয় সীমান্তেই গ্যালারি তৈরি করে রাখা হয়েছে। সেখানে বসে এই দৃশ্য দেখা যায় এবং প্রদর্শনী শেষ হলে সবার সঙ্গে মিলেমিশে ছবি তোলা যায়।
এই প্রদর্শনী দেখব বলে আধা ঘণ্টা আগেই আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টে। পঞ্চগড় থেকে এক প্রৌঢ় দম্পতি বসে ছিলেন আমাদের পাশেই। সবাই যখন বিজিবি ও বিএসএফের সঙ্গে ছবি তুলছে, আনন্দ করছে, তখন দেখা গেল এক অনন্য দৃশ্য। সীমান্তের ওপারে থুত্থুড়ে দুই বুড়ো-বুড়ি হাজির হয়েছেন ছোট্ট এক নাতি ও নাতির মাকে নিয়ে। আর পঞ্চগড় থেকে আসা ওই দম্পতি সীমান্তের কাছে এসে জড়িয়ে ধরছেন ভারতে থাকা মা-বাবাকে, কাঁদছেন। বহুদিন পর এখানে এসে মিলন হলো তাঁদের। এই ঘটনার কি কোনো ব্যাখ্যা হয়?
ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক উত্তপ্ত থাকার মূল কারণ রাজনৈতিক। নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন করে প্রতিবেশীসুলভ মনোভাব ফিরিয়ে আনতে না পারলে সমূহ বিপদ। নইলে ধর্মব্যবসায়ীরা আমাদের আত্মপরিচয় ভুলিয়ে দেবে। আমাদের কূটনীতির মূল কথা যে ‘কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুতা’, সেটা বোঝার জন্য খুব বেশি মেধাবী হতে হয় না। কিন্তু আমরা নিজেরা নিজেদের সম্মান করি না বলে একে অন্যের সঙ্গে হানাহানি করি। ভারতে যেমন এ ধরনের উগ্রপন্থা রয়েছে এবং রয়েছে দাদাগিরি করার খাসলত, তেমনি আমাদের দেশেও রয়েছে উগ্র ধর্মান্ধতা।
মিলনেই মুক্তি—এ কথা বোঝার মতো পরিস্থিতি কি এখন বিরাজ করছে? কিংবা কিছুদিন আগেও কি বিরাজ করেছিল? দেশের জনগণকে এ রকম শাস্তি দেওয়ার অধিকার এসব ক্ষমতাধর লোককে কে দিয়েছে? এরাই কিন্তু মুখে বলে—জনগণই ক্ষমতার উৎস। এত বড় পরিহাস পৃথিবী কমই দেখেছে।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

এবারের মার্চ মাসটাকে কীভাবে দেখা হবে? কে কীভাবে দেখবে? উন্মাতাল এই শহরের ফুঁসে ওঠা দেখে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ৩ মার্চের ইত্তেফাকের শিরোনাম করেছিলেন ‘বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন’। এর নিচেই ছিল ‘আমি শেখ মুজিব বলছি’। সেই সময়ের নায়ক শেখ মুজিবুর রহমান।
সে সময়টি পাড়ি দিয়েছে আমাদের ইতিহাস, তাকে কোনো ধরনের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে অবমূল্যায়ন করা যাবে না। ইতিহাসের নানা দিক থাকে, নানা ভাবনায় জারিত হয় মানুষ, কিন্তু বাঙালির ইতিহাসে ১৯৭১ সালের অর্জন ও অঙ্গীকার সবকিছুর ওপরে স্থান নিয়েছে। এই ইতিহাস ভুলিয়ে দিয়ে নব নব তরিকা হাজির করলে ইতিহাসই তা প্রত্যাখ্যান করবে।
স্বাধীন বাংলাদেশ তার অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারেনি। একটি ন্যায়বিচার-সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ে ওঠেনি, বরং নিজের সংস্কৃতি নিয়ে আবারও দ্বিধায় পড়েছে তারা। যে যৌবনের উজ্জীবন হয়েছিল বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনে, তার ধারাবাহিকতাকে এখন অগ্রাহ্য করছে কেউ কেউ। তারা ভুলে যাচ্ছে, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিরা যে বৈষম্যের সৃষ্টি করে রেখেছিল, তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। গুটিকয়েক সরকারি দালাল ছাড়া সবাই সেদিন পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল ঘৃণাভরে।
সেই ইতিহাস কি জানে আজকের প্রজন্ম? তখন প্রত্যেকেই হৃদয়ে বয়ে বেড়াত একটি স্বপ্ন, স্বাধীনতা যার নাম। আমাদের স্বাধীনতার মাসে লেখাটি লিখতে গিয়ে বেশ কিছু প্রশ্নের উদয় হচ্ছে মনে। তারই কিছু কথা বলব আজ।
২. সম্প্রতি উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলাম। নানা রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে দেশের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে মনে হলো, ঢাকা মহানগরীতে যত ধরনের বিভাজন ও সহিংসতা বিদ্যমান এই মুহূর্তে, গ্রামের মানুষ সেগুলো বহন করতে রাজি নয়। একটি সুন্দর নিরাপদ রাষ্ট্রে তারা বসবাস করতে চায়। তবে তাদের সেই নিরবচ্ছিন্ন শান্তির তৃষ্ণা নিবারণ হয় না সব সময়।
উত্তরবঙ্গের একেবারে শেষ মাথায় একটি ছোট শহরে অনেক মমতা দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল একটি পাঠাগার। কেন, কী কারণে ৫ আগস্টের পর সেই পাঠাগার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং বইগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তার কোনো ব্যাখ্যা স্থানীয় কেউ দিতে পারে না। একটি পাঠাগার কার চক্ষুশূল হতে পারে, তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে।
কিছুক্ষণ আগেই বলেছি, এই ভূখণ্ডে হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা। এ কথাও বলেছি, এই স্বাধীনতা লাভের ব্যাপারে নানা ধরনের বয়ান দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেসব বয়ান যাঁরা দাঁড় করাতে চাইছেন, তাঁরা ইতিহাসের কাছে না গিয়ে ধরি মাছ না ছুঁই পানি ধরনের একটা মানসিকতা বহন করে চলেছেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই ভাষার প্রশ্নে বাঙালি প্রথম যে ধাক্কাটা খেয়েছিল, তাতেই নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা ও অঙ্গীকারবোধে জারিত হয়েছিল এই ভূখণ্ডের মানুষ। সেই চেতনা নিয়েই পাকিস্তানি জান্তাদের বৈষম্যের দীর্ঘ পথকে চ্যালেঞ্জ করেই এগিয়ে গেছে এ দেশের জনগণ। এই মানুষেরা যে আত্মপরিচয় গড়ে তুলেছে, তাতে ধর্ম-বর্ণে কোনো ভেদাভেদ থাকার কথা নয়। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, সেই আত্মপরিচয় গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা যেমন এসেছে, তেমনি যাঁরা সেই অঙ্গীকার করেছিলেন, তাঁরা তা বেমালুম ভুলে গিয়ে কেবল সুবিধাবাদী কিংবা সুবিধাভোগী একটি শ্রেণিতে পরিণত হয়েছেন। তার চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, কোনো ধরনের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এসে যখন এই খেটে খাওয়া মানুষকে স্বপ্ন দেখায়, তখন কিছুদিন অতিক্রান্ত হলেই বোঝা যায় একইভাবে প্রতারিত হতে হবে। ব্যাপারটিকে দুঃসহ স্বপ্ন বললে ভুল হয় না।
আমি উত্তরবঙ্গের কয়েকটি শহরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। তারা প্রথমে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করে বুঝে নিতে চেয়েছেন যে আমি কোন মানসিকতার মানুষ। আরও সহজ করে বললে বলতে হয়, তারা জানতে চায় আমি কোনো রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব করছি কি না। যে রকম ভাঙচুর, লুটপাট ইত্যাদি হয়েছে, তাতে মানুষকে বিশ্বাস করা যে কঠিন হয়ে পড়েছে, সে কথা স্পষ্ট বোঝা গেল। মব ভায়োলেন্স যেভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে, তাতে মনে হচ্ছে শুভবুদ্ধি দিয়ে এর নাগাল পাওয়া কঠিন এখনো। পুলিশ বাস করছে ভয়ের রাজত্বে, হঠাৎ একদল লোক এসে চিৎকার-চেঁচামেচি করলেই তার দাবি পূরণ করে দেওয়া হবে—এ রকম একটা মানসিকতা গড়ে উঠছে। ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, স্বপ্নের কোনো সফল পরিণতি আসবে কি না, তা নিয়ে সবাই সন্দিহান, অন্তত যাদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি।
তেঁতুলিয়ায় পৌঁছানোর পর স্মৃতি রোমন্থন করে বললাম, যখন বছর ১৫ আগে ডাকবাংলোয় থাকার সময় একটা ফ্যান নিয়ে বাজারের পাশ দিয়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম আমরা। পথটি পাড়ি দেওয়ার সময় বারবার দেখতে হয়েছে গরুর পাল ভারত সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে বাংলায়। এটা যে চোরাকারবারি, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু এটাও বোঝা যাচ্ছিল যে সীমান্তের দুই দিকের মানুষেরই এতে লাভালাভ বণ্টনের পরিকল্পনা রয়েছে।
এবার যখন সে কথা বলছিলাম, তখন আমাদের গাড়ির চালক সতর্ক করে দিয়ে বললেন, রাতের বেলায় ভুলেও ভ্যানে করে ঘুরবেন না। কে কখন কোন দিক থেকে এসে চাপাতি কিংবা ছুরি ধরবে, সে-কথা আগে থেকে বলা যায় না। সুতরাং সাবধান থাকবেন।
তার পরও বাজার বসছে, হাট বসছে, মাঠে খেলছে শিশু-তরুণেরা, মেলা হচ্ছে এবং এই সবকিছু নিয়ে ও না নিয়েই জীবন একরকম বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যে অঙ্গীকারের কথা একটু আগে বলেছি, সেই অঙ্গীকারের ব্যাপারে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। রাজনৈতিক মাঠটি কে কীভাবে দখল করবে, তা নিয়েই বর্তমান রাজনীতির ভূগোল এগোচ্ছে।
৩. যাত্রাপথে যে স্কুল কিংবা কলেজ সামনে পড়েছে, দুরু দুরু বক্ষে তাকিয়ে দেখেছি সেখানে শহীদ মিনারটি অক্ষত আছে কি না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আশ্বস্ত হয়েছি। আমাদের ইতিহাসের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে কেউ যদি কোনো সময় মনে করেন, বায়ান্ন সালে ভাষা আন্দোলন করা উচিত হয়নি কিংবা একাত্তর সালে মুসলমান-মুসলমান ভাইদের মধ্যে অকারণে যুদ্ধ বেধে গিয়েছিল এবং সেই ইতিহাস যদি জাতিকে গেলানোর চেষ্টা করা হয়, তাহলে কোন ধরনের রাজনীতির সূচনা হবে, সে-কথা এই মুহূর্তে ভাবা যাচ্ছে না। তবে সেটা যে একটি অশ্বডিম্ব হবে, সে কথা বলাই বাহুল্য।
আশার দিক হলো, গণ-অভ্যুত্থানের পর কেউ কেউ আওয়ামী লীগকে অগ্রাহ্য করতে চেয়ে পুরো মুক্তিযুদ্ধকেই মামুলি একটি ইতিহাসের অংশ বলে ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একটি জাতি তো তার ইতিহাস বহন করে, রক্তে সেটা থেকে যায়। কেউ একজন নতুন একটা তত্ত্ব নিয়ে হাজির হলেই জনগণ তাতে সায় দেবে, এমন মনে করার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ নেই। মানুষের কাছে যেতে হবে তার প্রত্যাশিত রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে।
ভাষাসংগ্রামী মোহাম্মদ সুলতানের নামে একটি পাঠাগার উদ্বোধন হলো তাঁর জন্মভূমি বোদায়। সেখানে বিশিষ্টজনেরা কথা বললেন এবং সেই পাঠাগার ধীরে ধীরে আলোর পথ দেখাবে বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেন। বক্তৃতামালার মাঝে ছোট্ট একটি মেয়ে একুশের একটি ছড়া আবৃত্তি করল। সেই আবৃত্তিতে চর্চার স্পর্শ ছিল। তাতে মনে হয়েছে, একুশের চেতনা তো শিকড়ের ব্যাপার। কিন্তু যেকোনো কিছুর মতোই তার পরিচর্যা প্রয়োজন। নিজের লাভালাভের খেয়ালে উন্মত্ত হয়ে উঠলে সেই পরিচর্যা করার সুযোগ থাকে না। তাই মনগুলো হয়ে থাকে অকর্ষিত। সেই সুযোগটা নেয় বিভিন্ন রকম অন্ধের দল। তারা অকর্ষিত মনে পশ্চাৎপদতার বীজ বোনে। মর্ম না বুঝে মুখস্থ বিদ্যাকে হৃদয়ে ঢোকানোর চেষ্টা করে। তাতে যে প্রজন্মের সৃষ্টি হয়, সেই প্রজন্ম যৌক্তিকতার ধার ধারে না এবং তাদের মধ্যে মননচর্চা থাকে না। আমরা যেন জেনে-বুঝে সেই অন্ধতাকে ফিরিয়ে আনার শপথ নিয়েছি।
৪. বাংলাবান্ধায় জিরো পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেল উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠার মতো এক ঘটনা। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার বিকেলের আলোয় পতাকা নামানোর সময় বিজিবি ও বিএসএফ সীমান্তের দুই দিক থেকে এসে এমন কিছু মহড়া করে, যা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।
এ সময় সেই পতাকা নামানো প্রদর্শনী শেষে বাংলাদেশের মানুষ ভারতের জিরো পয়েন্টে গিয়ে তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে পারে। ভারতীয়রাও বাংলাদেশের জিরো পয়েন্টের ভেতরে ঢুকে কথাবার্তা বলতে পারে, ছবি তুলতে পারে। এই দৃশ্য দেখার জন্য বাংলাদেশ-ভারত উভয় সীমান্তেই গ্যালারি তৈরি করে রাখা হয়েছে। সেখানে বসে এই দৃশ্য দেখা যায় এবং প্রদর্শনী শেষ হলে সবার সঙ্গে মিলেমিশে ছবি তোলা যায়।
এই প্রদর্শনী দেখব বলে আধা ঘণ্টা আগেই আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টে। পঞ্চগড় থেকে এক প্রৌঢ় দম্পতি বসে ছিলেন আমাদের পাশেই। সবাই যখন বিজিবি ও বিএসএফের সঙ্গে ছবি তুলছে, আনন্দ করছে, তখন দেখা গেল এক অনন্য দৃশ্য। সীমান্তের ওপারে থুত্থুড়ে দুই বুড়ো-বুড়ি হাজির হয়েছেন ছোট্ট এক নাতি ও নাতির মাকে নিয়ে। আর পঞ্চগড় থেকে আসা ওই দম্পতি সীমান্তের কাছে এসে জড়িয়ে ধরছেন ভারতে থাকা মা-বাবাকে, কাঁদছেন। বহুদিন পর এখানে এসে মিলন হলো তাঁদের। এই ঘটনার কি কোনো ব্যাখ্যা হয়?
ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক উত্তপ্ত থাকার মূল কারণ রাজনৈতিক। নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন করে প্রতিবেশীসুলভ মনোভাব ফিরিয়ে আনতে না পারলে সমূহ বিপদ। নইলে ধর্মব্যবসায়ীরা আমাদের আত্মপরিচয় ভুলিয়ে দেবে। আমাদের কূটনীতির মূল কথা যে ‘কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুতা’, সেটা বোঝার জন্য খুব বেশি মেধাবী হতে হয় না। কিন্তু আমরা নিজেরা নিজেদের সম্মান করি না বলে একে অন্যের সঙ্গে হানাহানি করি। ভারতে যেমন এ ধরনের উগ্রপন্থা রয়েছে এবং রয়েছে দাদাগিরি করার খাসলত, তেমনি আমাদের দেশেও রয়েছে উগ্র ধর্মান্ধতা।
মিলনেই মুক্তি—এ কথা বোঝার মতো পরিস্থিতি কি এখন বিরাজ করছে? কিংবা কিছুদিন আগেও কি বিরাজ করেছিল? দেশের জনগণকে এ রকম শাস্তি দেওয়ার অধিকার এসব ক্ষমতাধর লোককে কে দিয়েছে? এরাই কিন্তু মুখে বলে—জনগণই ক্ষমতার উৎস। এত বড় পরিহাস পৃথিবী কমই দেখেছে।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

গত এক শতাব্দীতে বাঙালির জন্য রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কম কিছু ঘটেনি। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটছে ১৯৪৭ সালে, বঙ্গভঙ্গের সময়। দেশভাগের চেষ্টা আগেও একবার হয়েছিল, ১৯০৫ সালে; তখন তা কার্যকর হয়নি। ৪২ বছর পরে আবার চেষ্টা হলো, এবার তা সফল হলো। সাতচল্লিশে ভঙ্গ হলো বঙ্গ।
৮ ঘণ্টা আগে
স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন ও সম্ভাবনার এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। পদ্মা সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রোরেল—অবকাঠামোগত উন্নয়নের এ দৃশ্যপট আজ অনেকের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার। তবু উন্নয়নের এই ঝলমলে রূপের আড়ালে লুকিয়ে আছে কিছু অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি, কিছু অপূর্ণ আশার গল্প।
৮ ঘণ্টা আগে
একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে যেন এক অদ্ভুত বৈপরীত্যের মুখোমুখি আমরা দাঁড়িয়ে আছি। একদিকে প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি, আকাশচুম্বী অট্টালিকা, শপিং মলের উজ্জ্বল আলো আর বিলাসবহুল জীবনের হাতছানি; অন্যদিকে এক গভীর অন্ধকার, যা নিঃশব্দে গ্রাস করছে আমাদের মানবিক সত্তাকে। এই অন্ধকারের নাম ‘ভোগবাদ’। এটি শুধু সামাজিক
৮ ঘণ্টা আগে
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে চোর সন্দেহে তিনজনকে পিটিয়ে মেরেছে এলাকার উত্তেজিত জনতা। গত শনিবার কাটাবাড়ি ইউনিয়নের নাসিরাবাদ গ্রামে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। এলাকাবাসী বলছেন, তিনটি গরু চুরি করে এরা পিকআপে তুলে নিয়েছিল।
৮ ঘণ্টা আগেসিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

গত এক শতাব্দীতে বাঙালির জন্য রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কম কিছু ঘটেনি। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটছে ১৯৪৭ সালে, বঙ্গভঙ্গের সময়। দেশভাগের চেষ্টা আগেও একবার হয়েছিল, ১৯০৫ সালে; তখন তা কার্যকর হয়নি। ৪২ বছর পরে আবার চেষ্টা হলো, এবার তা সফল হলো। সাতচল্লিশে ভঙ্গ হলো বঙ্গ।
সেটা যেন শুধু মাটির বিভাজন নয়, মানুষেরও বিভাজন হলো প্রথম। এই বিভাজন একদা অখণ্ড বঙ্গদেশের একাংশকে যুক্ত করে দিল ভারতের সঙ্গে। সেখানকার বাঙালির রাজনৈতিক পরিচয় দাঁড়াল ভারতীয় বলে; আরেক অংশকে শামিল করে দিল পাকিস্তানের সঙ্গে, সেখানকার বাঙালির পরিচয় দাঁড়াল পাকিস্তানি বলে। এপারের মানুষ ওপারে গেছে, ওপারের মানুষ এসেছে এপারে, মানুষের রক্তে রঙিন হয়েছে বিভক্ত মাটি ও নদী। দুই রাষ্ট্র—ভারত ও পাকিস্তান। দেশ দুটি মিত্র হলো না পরস্পরের এবং সেই বৈরিতা ছড়িয়ে পড়ল দুই পাশের বাঙালির মনেও। ভারতের অংশ হয়ে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি যতটা না অসন্তুষ্ট হয়েছে, পাকিস্তানে বিলীন হওয়ার আশঙ্কায় পূর্ববঙ্গের বাঙালি অসন্তুষ্ট হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে সে আরও এক বিভাজন ঘটিয়েছে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ত্যাগ-আত্মত্যাগে, রক্তের বিনিময়ে।
স্বাধীন বাংলাদেশের ভৌগোলিক কাঠামো আসলে সাতচল্লিশেই তৈরি হয়ে গেছে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাকে ইদানীং বেশি করে ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদী এবং আধা মৌলবাদীরা তথাকথিত লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়ন বলতে পছন্দ করে। কথাটা মিথ্যা, আদতেই।
কেননা, লাহোর প্রস্তাব ছিল অস্পষ্ট, হয়তো তাকে ইচ্ছা করেই অস্পষ্ট করে রাখা হয়েছিল। তাতে পাকিস্তানের কিংবা ভারত বিভাজনের কথা স্পষ্ট করে উল্লেখ পর্যন্ত করা হয়নি এবং দুই অঞ্চলে দুটি ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্রের কথা বলা হলেও পরে দিল্লি সম্মেলনে প্রস্তাবটি সংশোধন করে একটা রাষ্ট্রের পক্ষেই বক্তব্য দাঁড় করানো হয়েছিল। কিন্তু একাত্তরে একটা পাকিস্তান ভেঙে দুটি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ঘটেনি। বাংলাদেশ একটা স্বাধীন, ধর্মনিরপেক্ষ ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা নিয়ে রক্তের মধ্য দিয়ে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং সেটা করেছে দ্বিজাতিতত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে।
আমরা বলি এবং মিথ্যা বলি না যে বঙ্গবিভাগের পেছনে ইংরেজদের কারসাজি ছিল। যেমন সেটা ১৯০৫ সালে, তেমনি ১৯৪৭ সালেও বোঝা গেছে। সে সময়ের ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারি তাঁর নোটে লিখেছিলেন, ‘ঐক্যবদ্ধ বঙ্গ একটা শক্তি, বিভক্ত বঙ্গ নানা দিকে টানবে এবং সেটাই হবে ওই পরিকল্পনার (বঙ্গবিভাগের) একটা বড় গুণ।’ এ ছিল ইংরেজের অভিপ্রায়, কিন্তু বঙ্গদেশের নিজের মধ্যেও নিশ্চয় সেই উপাদানগুলো বিদ্যমান ছিল, যাদের অস্তিত্ব ওই আশাবাদকে সমর্থন করেছে। নানা দিকে টানাপোড়েন ছিল। আর তার কারণ অন্য কিছু নয়—মধ্যবিত্ত শ্রেণি। মধ্যবিত্ত সর্বত্রই একটা অগোছালো ব্যাপার। তার একেক অংশে একেক প্রবণতা, তার একদিকের সঙ্গে অপর দিকের বিরোধ; পরাধীন বাংলায় পরাধীনতার কারণেই পরস্পর বিরোধিতাটা ছিল বরং বেশি। এই মধ্যবিত্ত মোটেই স্বাধীন ছিল না। তার ভিত প্রোথিত ছিল চাকরিতে, পেশায় এবং কিছুটা ভূমিরাজস্বে। শিল্প ও বাণিজ্যের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই ছিল না। দুর্বল মেরুদণ্ডের এই শ্রেণির একাংশ তাই আত্মসমর্পণ করেছিল। আত্মসমর্পণকারীরা আবার দুই ভাগে বিভক্ত, এক ভাগ সাহেবমুখী; অপর ভাগ ইয়ং বেঙ্গল। অর্থাৎ একই সঙ্গে সাহেবমুখী ও সামন্তবাদবিরোধী। আর যে অংশটি ছিল সর্বাধিক প্রভাবশালী, সেটা ছিল অধীনতার বিষয়ে সচেতন এবং তাদেরকে জাতীয়তাবাদীও বলতে হবে। কিন্তু এরা মূলত সংস্কারপন্থী এবং চূড়ান্ত বিচারে, নিজেদের শ্রেণিগত স্বার্থের জন্য আপসপন্থী ছিল। এর সূত্রপাতে আছেন রামমোহন এবং মাঝখানে বঙ্কিমচন্দ্র।
বঙ্কিমচন্দ্রের নাম বিশেষভাবে করতে হয়, কেননা তিনি ছিলেন মধ্যবিত্তের এই ধারার সবচেয়ে উজ্জ্বল ও প্রভাবশালী মুখপাত্র। বঙ্কিম ছিলেন অত্যন্ত আধুনিক এবং পরাধীনতার গ্লানিতে অত্যধিক পীড়িত। কিন্তু শ্রেণিগত কারণেই তিনিও আটকা পড়ে গেলেন একটা গণ্ডিতে। তিনি বলেছেন, ‘আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি’। তাঁর এই বক্তব্য ছিল বড় স্পষ্ট। এই অনুমোদন ছিল না বলেই বঙ্কিমচন্দ্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের হৃদয়হীনতার কথা জেনেও তার পুরোপুরি উচ্ছেদ চাননি। ইংরেজ অসন্তুষ্ট হবে ভেবে, স্বাধীনতার জন্য প্রবল আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও প্রকাশ্যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লিখতে পারেননি। ইংরেজের বদলে তিনি যবনকে দাঁড় করালেন এবং সেই মৃত অশ্বকে যখন প্রহার শুরু করলেন, তখন সেই প্রহারের ভেতরে ইংরেজের প্রতি অক্ষম অসন্তোষ ছিল ঠিকই, কিন্তু তা প্রকাশ পেল না। বিকাশে আগ্রহী মুসলমান বাঙালি মনে করল এ আর এমন কিছু নয়, তার প্রতি ঘৃণা বটে।
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বাংলায় সাম্প্রদায়িকতা কৃষকদের মধ্যে ছিল না, তা ছিল মধ্যবিত্তেরই ব্যাধি। তবে পরাধীন বঙ্গে জাতীয়তাবাদীরা আন্তরিক ছিলেন। কিন্তু জাতীয় ছিলেন না, তাঁরা সাম্প্রদায়িক হয়ে পড়েছিলেন। তাদের কাছে জাতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক অংশের জন্য হিন্দু জাতি, আরেক অংশের জন্য মুসলিম জাতি। তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। তবে সেটা ছিল জনগণের সঙ্গে নয়। তা ছিল দুটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে—যাদের একটা উঠেছে, আরেকটা উঠতে চাইছে।
একটা দ্বন্দ্ব ছিল ইংরেজের সঙ্গে বাঙালির; আরেকটা দ্বন্দ্ব গড়ে উঠেছিল বাঙালি হিন্দুর সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের। প্রথম দ্বন্দ্বটা তার তীব্রতা অক্ষুণ্ন রাখতে পারেনি দ্বিতীয় দ্বন্দ্বের কারণে। আর হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব ছিল বলেই দেশভাগ হলো। না হলে বাইরে থেকে চতুর ইংরেজ যতই কলকাঠি নাডুক না কেন, ঘটনাটি ঘটত না। ১৯০৫-এ কাজ হয়নি, তখন অগ্রসর হিন্দু মধ্যবিত্ত এটা চায়নি। তারা অখণ্ড বঙ্গ সংস্কৃতির ব্যবচ্ছেদের আশঙ্কা করেছে। সে আশঙ্কা মোটেই অন্যায় ছিল না। কিন্তু অন্তরে ছিল আরও এক গভীর শঙ্কা, সে হচ্ছে খণ্ডিত বঙ্গে পেশাগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও জমির মালিকানা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার শঙ্কা। ১৯৪৭ সালে সেই শ্রেণিই আবার বঙ্গভঙ্গে বিশ্বাসী হয়ে পড়ল, মূলত সেই অর্থনৈতিক শঙ্কাতেই। এবারের ভয়টা ছিল অবিভক্ত বঙ্গে মুসলিম সংখ্যাধিক্যের। অপর দিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের যে অংশ উঠতে চাচ্ছিল, তারা ১৯০৫ সালেও বঙ্গভঙ্গ চেয়েছে, যেভাবে চেয়েছে সাতচল্লিশেও। সেটা ছিল নিজেদের শ্রেণিস্বার্থে।
ভারতের অন্তর্ভুক্ত বাঙালি তার সংস্কৃতির ওপর হিন্দির চাপ কম পোহায়নি। ওই চাপ, বলা বাহুল্য, ক্রমাগত বেড়েছে। কংগ্রেসের শাসন পশ্চিমবঙ্গের জন্য দুঃশাসনই ছিল। হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপির শাসনামল তো দুঃশাসনের সীমা-পরিসীমা অতিক্রম করে হিন্দু রাষ্ট্রের পথে এগোতে চাচ্ছে।
লক্ষ করার বিষয়, অবিভক্ত বঙ্গে নেতৃত্ব ছিল মধ্যবিত্তের হাতেই। কিন্তু বাঙালি মধ্যবিত্ত বাংলার রাজনীতিকে ভারতবর্ষের রাজনীতি থেকে আলাদা রাখতে পারেনি। একদিক দিয়ে প্রবেশ করেছেন গান্ধী, আরেক দিক দিয়ে জিন্নাহ। বাংলার রাজনীতি অংশ হয়ে গেছে সর্বভারতীয় রাজনীতির এবং তার চাবিকাঠি বাংলার এ কে ফজলুল হক কিংবা সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে থাকেনি, থেকেছে অবাঙালিদের হাতেই। এর কারণও শ্রেণিগত। বাঙালি মধ্যবিত্ত অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ছিল, অবাঙালি মধ্যবিত্তের তুলনায়। শ্রেণি অবস্থান এসব ঘটনার সুন্দর ব্যাখ্যা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

গত এক শতাব্দীতে বাঙালির জন্য রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কম কিছু ঘটেনি। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটছে ১৯৪৭ সালে, বঙ্গভঙ্গের সময়। দেশভাগের চেষ্টা আগেও একবার হয়েছিল, ১৯০৫ সালে; তখন তা কার্যকর হয়নি। ৪২ বছর পরে আবার চেষ্টা হলো, এবার তা সফল হলো। সাতচল্লিশে ভঙ্গ হলো বঙ্গ।
সেটা যেন শুধু মাটির বিভাজন নয়, মানুষেরও বিভাজন হলো প্রথম। এই বিভাজন একদা অখণ্ড বঙ্গদেশের একাংশকে যুক্ত করে দিল ভারতের সঙ্গে। সেখানকার বাঙালির রাজনৈতিক পরিচয় দাঁড়াল ভারতীয় বলে; আরেক অংশকে শামিল করে দিল পাকিস্তানের সঙ্গে, সেখানকার বাঙালির পরিচয় দাঁড়াল পাকিস্তানি বলে। এপারের মানুষ ওপারে গেছে, ওপারের মানুষ এসেছে এপারে, মানুষের রক্তে রঙিন হয়েছে বিভক্ত মাটি ও নদী। দুই রাষ্ট্র—ভারত ও পাকিস্তান। দেশ দুটি মিত্র হলো না পরস্পরের এবং সেই বৈরিতা ছড়িয়ে পড়ল দুই পাশের বাঙালির মনেও। ভারতের অংশ হয়ে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি যতটা না অসন্তুষ্ট হয়েছে, পাকিস্তানে বিলীন হওয়ার আশঙ্কায় পূর্ববঙ্গের বাঙালি অসন্তুষ্ট হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে সে আরও এক বিভাজন ঘটিয়েছে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ত্যাগ-আত্মত্যাগে, রক্তের বিনিময়ে।
স্বাধীন বাংলাদেশের ভৌগোলিক কাঠামো আসলে সাতচল্লিশেই তৈরি হয়ে গেছে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাকে ইদানীং বেশি করে ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদী এবং আধা মৌলবাদীরা তথাকথিত লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়ন বলতে পছন্দ করে। কথাটা মিথ্যা, আদতেই।
কেননা, লাহোর প্রস্তাব ছিল অস্পষ্ট, হয়তো তাকে ইচ্ছা করেই অস্পষ্ট করে রাখা হয়েছিল। তাতে পাকিস্তানের কিংবা ভারত বিভাজনের কথা স্পষ্ট করে উল্লেখ পর্যন্ত করা হয়নি এবং দুই অঞ্চলে দুটি ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্রের কথা বলা হলেও পরে দিল্লি সম্মেলনে প্রস্তাবটি সংশোধন করে একটা রাষ্ট্রের পক্ষেই বক্তব্য দাঁড় করানো হয়েছিল। কিন্তু একাত্তরে একটা পাকিস্তান ভেঙে দুটি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ঘটেনি। বাংলাদেশ একটা স্বাধীন, ধর্মনিরপেক্ষ ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা নিয়ে রক্তের মধ্য দিয়ে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং সেটা করেছে দ্বিজাতিতত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে।
আমরা বলি এবং মিথ্যা বলি না যে বঙ্গবিভাগের পেছনে ইংরেজদের কারসাজি ছিল। যেমন সেটা ১৯০৫ সালে, তেমনি ১৯৪৭ সালেও বোঝা গেছে। সে সময়ের ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারি তাঁর নোটে লিখেছিলেন, ‘ঐক্যবদ্ধ বঙ্গ একটা শক্তি, বিভক্ত বঙ্গ নানা দিকে টানবে এবং সেটাই হবে ওই পরিকল্পনার (বঙ্গবিভাগের) একটা বড় গুণ।’ এ ছিল ইংরেজের অভিপ্রায়, কিন্তু বঙ্গদেশের নিজের মধ্যেও নিশ্চয় সেই উপাদানগুলো বিদ্যমান ছিল, যাদের অস্তিত্ব ওই আশাবাদকে সমর্থন করেছে। নানা দিকে টানাপোড়েন ছিল। আর তার কারণ অন্য কিছু নয়—মধ্যবিত্ত শ্রেণি। মধ্যবিত্ত সর্বত্রই একটা অগোছালো ব্যাপার। তার একেক অংশে একেক প্রবণতা, তার একদিকের সঙ্গে অপর দিকের বিরোধ; পরাধীন বাংলায় পরাধীনতার কারণেই পরস্পর বিরোধিতাটা ছিল বরং বেশি। এই মধ্যবিত্ত মোটেই স্বাধীন ছিল না। তার ভিত প্রোথিত ছিল চাকরিতে, পেশায় এবং কিছুটা ভূমিরাজস্বে। শিল্প ও বাণিজ্যের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই ছিল না। দুর্বল মেরুদণ্ডের এই শ্রেণির একাংশ তাই আত্মসমর্পণ করেছিল। আত্মসমর্পণকারীরা আবার দুই ভাগে বিভক্ত, এক ভাগ সাহেবমুখী; অপর ভাগ ইয়ং বেঙ্গল। অর্থাৎ একই সঙ্গে সাহেবমুখী ও সামন্তবাদবিরোধী। আর যে অংশটি ছিল সর্বাধিক প্রভাবশালী, সেটা ছিল অধীনতার বিষয়ে সচেতন এবং তাদেরকে জাতীয়তাবাদীও বলতে হবে। কিন্তু এরা মূলত সংস্কারপন্থী এবং চূড়ান্ত বিচারে, নিজেদের শ্রেণিগত স্বার্থের জন্য আপসপন্থী ছিল। এর সূত্রপাতে আছেন রামমোহন এবং মাঝখানে বঙ্কিমচন্দ্র।
বঙ্কিমচন্দ্রের নাম বিশেষভাবে করতে হয়, কেননা তিনি ছিলেন মধ্যবিত্তের এই ধারার সবচেয়ে উজ্জ্বল ও প্রভাবশালী মুখপাত্র। বঙ্কিম ছিলেন অত্যন্ত আধুনিক এবং পরাধীনতার গ্লানিতে অত্যধিক পীড়িত। কিন্তু শ্রেণিগত কারণেই তিনিও আটকা পড়ে গেলেন একটা গণ্ডিতে। তিনি বলেছেন, ‘আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি’। তাঁর এই বক্তব্য ছিল বড় স্পষ্ট। এই অনুমোদন ছিল না বলেই বঙ্কিমচন্দ্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের হৃদয়হীনতার কথা জেনেও তার পুরোপুরি উচ্ছেদ চাননি। ইংরেজ অসন্তুষ্ট হবে ভেবে, স্বাধীনতার জন্য প্রবল আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও প্রকাশ্যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লিখতে পারেননি। ইংরেজের বদলে তিনি যবনকে দাঁড় করালেন এবং সেই মৃত অশ্বকে যখন প্রহার শুরু করলেন, তখন সেই প্রহারের ভেতরে ইংরেজের প্রতি অক্ষম অসন্তোষ ছিল ঠিকই, কিন্তু তা প্রকাশ পেল না। বিকাশে আগ্রহী মুসলমান বাঙালি মনে করল এ আর এমন কিছু নয়, তার প্রতি ঘৃণা বটে।
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বাংলায় সাম্প্রদায়িকতা কৃষকদের মধ্যে ছিল না, তা ছিল মধ্যবিত্তেরই ব্যাধি। তবে পরাধীন বঙ্গে জাতীয়তাবাদীরা আন্তরিক ছিলেন। কিন্তু জাতীয় ছিলেন না, তাঁরা সাম্প্রদায়িক হয়ে পড়েছিলেন। তাদের কাছে জাতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক অংশের জন্য হিন্দু জাতি, আরেক অংশের জন্য মুসলিম জাতি। তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। তবে সেটা ছিল জনগণের সঙ্গে নয়। তা ছিল দুটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে—যাদের একটা উঠেছে, আরেকটা উঠতে চাইছে।
একটা দ্বন্দ্ব ছিল ইংরেজের সঙ্গে বাঙালির; আরেকটা দ্বন্দ্ব গড়ে উঠেছিল বাঙালি হিন্দুর সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের। প্রথম দ্বন্দ্বটা তার তীব্রতা অক্ষুণ্ন রাখতে পারেনি দ্বিতীয় দ্বন্দ্বের কারণে। আর হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব ছিল বলেই দেশভাগ হলো। না হলে বাইরে থেকে চতুর ইংরেজ যতই কলকাঠি নাডুক না কেন, ঘটনাটি ঘটত না। ১৯০৫-এ কাজ হয়নি, তখন অগ্রসর হিন্দু মধ্যবিত্ত এটা চায়নি। তারা অখণ্ড বঙ্গ সংস্কৃতির ব্যবচ্ছেদের আশঙ্কা করেছে। সে আশঙ্কা মোটেই অন্যায় ছিল না। কিন্তু অন্তরে ছিল আরও এক গভীর শঙ্কা, সে হচ্ছে খণ্ডিত বঙ্গে পেশাগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও জমির মালিকানা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার শঙ্কা। ১৯৪৭ সালে সেই শ্রেণিই আবার বঙ্গভঙ্গে বিশ্বাসী হয়ে পড়ল, মূলত সেই অর্থনৈতিক শঙ্কাতেই। এবারের ভয়টা ছিল অবিভক্ত বঙ্গে মুসলিম সংখ্যাধিক্যের। অপর দিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের যে অংশ উঠতে চাচ্ছিল, তারা ১৯০৫ সালেও বঙ্গভঙ্গ চেয়েছে, যেভাবে চেয়েছে সাতচল্লিশেও। সেটা ছিল নিজেদের শ্রেণিস্বার্থে।
ভারতের অন্তর্ভুক্ত বাঙালি তার সংস্কৃতির ওপর হিন্দির চাপ কম পোহায়নি। ওই চাপ, বলা বাহুল্য, ক্রমাগত বেড়েছে। কংগ্রেসের শাসন পশ্চিমবঙ্গের জন্য দুঃশাসনই ছিল। হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপির শাসনামল তো দুঃশাসনের সীমা-পরিসীমা অতিক্রম করে হিন্দু রাষ্ট্রের পথে এগোতে চাচ্ছে।
লক্ষ করার বিষয়, অবিভক্ত বঙ্গে নেতৃত্ব ছিল মধ্যবিত্তের হাতেই। কিন্তু বাঙালি মধ্যবিত্ত বাংলার রাজনীতিকে ভারতবর্ষের রাজনীতি থেকে আলাদা রাখতে পারেনি। একদিক দিয়ে প্রবেশ করেছেন গান্ধী, আরেক দিক দিয়ে জিন্নাহ। বাংলার রাজনীতি অংশ হয়ে গেছে সর্বভারতীয় রাজনীতির এবং তার চাবিকাঠি বাংলার এ কে ফজলুল হক কিংবা সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে থাকেনি, থেকেছে অবাঙালিদের হাতেই। এর কারণও শ্রেণিগত। বাঙালি মধ্যবিত্ত অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ছিল, অবাঙালি মধ্যবিত্তের তুলনায়। শ্রেণি অবস্থান এসব ঘটনার সুন্দর ব্যাখ্যা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

এবারের মার্চ মাসটাকে কীভাবে দেখা হবে? কে কীভাবে দেখবে? উন্মাতাল এই শহরের ফুঁসে ওঠা দেখে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ৩ মার্চের ইত্তেফাকের শিরোনাম করেছিলেন ‘বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন’।
০৩ মার্চ ২০২৫
স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন ও সম্ভাবনার এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। পদ্মা সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রোরেল—অবকাঠামোগত উন্নয়নের এ দৃশ্যপট আজ অনেকের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার। তবু উন্নয়নের এই ঝলমলে রূপের আড়ালে লুকিয়ে আছে কিছু অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি, কিছু অপূর্ণ আশার গল্প।
৮ ঘণ্টা আগে
একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে যেন এক অদ্ভুত বৈপরীত্যের মুখোমুখি আমরা দাঁড়িয়ে আছি। একদিকে প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি, আকাশচুম্বী অট্টালিকা, শপিং মলের উজ্জ্বল আলো আর বিলাসবহুল জীবনের হাতছানি; অন্যদিকে এক গভীর অন্ধকার, যা নিঃশব্দে গ্রাস করছে আমাদের মানবিক সত্তাকে। এই অন্ধকারের নাম ‘ভোগবাদ’। এটি শুধু সামাজিক
৮ ঘণ্টা আগে
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে চোর সন্দেহে তিনজনকে পিটিয়ে মেরেছে এলাকার উত্তেজিত জনতা। গত শনিবার কাটাবাড়ি ইউনিয়নের নাসিরাবাদ গ্রামে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। এলাকাবাসী বলছেন, তিনটি গরু চুরি করে এরা পিকআপে তুলে নিয়েছিল।
৮ ঘণ্টা আগেমাসুদ-উর রহমান

স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন ও সম্ভাবনার এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। পদ্মা সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রোরেল—অবকাঠামোগত উন্নয়নের এ দৃশ্যপট আজ অনেকের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার। তবু উন্নয়নের এই ঝলমলে রূপের আড়ালে লুকিয়ে আছে কিছু অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি, কিছু অপূর্ণ আশার গল্প। নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে গঠিত হওয়া অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর জনগণের প্রত্যাশা ছিল—এই সরকার শুধু উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে না, বরং দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত থেকে যাওয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে।
কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পরেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো অগ্রসর হওয়া গেছে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে ধীরগতিতে, অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। যেমন ধরা যাক, আমাদের সবচেয়ে গর্বের অর্জন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছিলাম স্বাধীনতা উপভোগের স্বাদ। কিন্তু জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ নিয়ে বিগত সরকারের সময়ে নানা অপকর্ম করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার নামের পাশে মিথ্যা সনদ জুড়ে দেওয়া শুধু প্রতারণা নয়, এটি একধরনের অপরাধ—ইতিহাস ও জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা।
এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ বাতিল ও শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে’।
এটি এমন এক ঘোষণা ছিল, যা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনাকে পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি বলা যায়। কিন্তু সময় গড়িয়েছে, বছর পেরিয়েছে, অথচ বাস্তব অগ্রগতি দেখা যায়নি। আজও বহু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রীয় সুবিধা নিচ্ছেন, বিপরীতে অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিই পাননি। একটি জাতির আত্মপরিচয়ের ভিত্তি যদি মিথ্যার ওপর দাঁড়ায়, তাহলে সেই ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করতে পারলে রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিটি যেমন মজবুত হতো, তেমনি রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় হতো না।
২০২৫ সালের ৪ এপ্রিল দেশের প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকগুলোর খবর ছিল—‘প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের কথা নিশ্চিত করেছে মিয়ানমার।’ সেই সময় অনেকে মনে করেছিলেন, অবশেষে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সফল হচ্ছে। কিন্তু বছরের শেষে দেখা গেল, একজন রোহিঙ্গাকেও ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি; বরং আরও অনেকে সীমান্ত পেরিয়ে এসেছে।
কক্সবাজার ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরগুলোতে এখন ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে, যাদের কারণে স্থানীয় অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা ও নিরাপত্তা—সবই চাপে রয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে মিয়ানমারের প্রতি চাপ অব্যাহত থাকলেও বাংলাদেশের পক্ষে একক প্রচেষ্টায় এই জটিল সমস্যার সমাধান করা কঠিন। তবু জনগণের প্রত্যাশা ছিল—সরকার অন্তত প্রত্যাবাসনের দৃশ্যমান সূচনা করবে। কিন্তু তা হয়নি।
প্রতিনিয়ত আমরা দেখছি, নদী দূষিত হচ্ছে, বনভূমি হারিয়ে যাচ্ছে, গ্রাম ও শহর প্লাস্টিকে ভরে যাচ্ছে। পরিবেশের এই সংকট রোধে ২০২৪ সালের ১ নভেম্বর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয়, ‘কাঁচাবাজারেও আজ থেকে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ’। সেই ঘোষণায় বলা হয়েছিল, আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবায়নে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। এখন বহাল তবিয়তে প্রতিটি বাজারে, এমনকি পাড়ার ছোট দোকানেও পলিথিন ব্যাগ আগের মতোই ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ তরুণদের হাতে। অথচ কর্মসংস্থানের অভাব আজ তরুণদের সবচেয়ে বড় হতাশার কারণ। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে একটি দৈনিকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘২৬ লাখ শিক্ষিত বেকারের দেশে ২৬ লাখ ভারতীয় কী করে চাকরি করে’। প্রতিবেদকের ভাষ্যমতে, ‘একটা স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রকে আরেকটি রাষ্ট্র কি এভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে? বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের “দুরভিসন্ধির” পরিকল্পনাগুলোর একটি এটি। এমন কোনো সেক্টর নেই, যেখানে ভারতীয়দের সুকৌশলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়নি। অথচ দেশে শিক্ষিত বেকার ২৬ লাখ ৪০ হাজার!’ এমন প্রতিবেদন কেবল পরিসংখ্যান নয়, এটি এক তীব্র প্রশ্ন—দেশে যদি এত বেকার তরুণ থাকে, তবে বিদেশিরা কেন চাকরি পাবে? এমন বাস্তবতায় প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস তখন ঘোষণা দিয়েছিলেন, দেশে এমন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে, যাতে বিদেশি কর্মীদের আর সুযোগ না থাকে। এক বছর পার হয়ে গেলেও ২৬ লাখ ভারতীয়কে চাকরিচ্যুত করার কোনো খবর এখনো গণমাধ্যমে দেখা যায়নি।
এরপর একটি স্বাধীন দেশের জন্য সার্বভৌমত্বের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পরপরই গণমাধ্যমে বলা হয়েছিল, ‘হাসিনা সরকারের আমলে করা সকল গোপন চুক্তি বাতিল করা হবে।’ কিন্তু এ বছরের ২১ অক্টোবর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ঘোষণা দেন, ‘ভারতের সঙ্গে ১০ চুক্তি বাতিলের দাবি সত্য নয়’। এরপর ২৬ অক্টোবরের আরেকটি সংবাদ থেকে জানা গেল, ‘দ্বিগুণ মূল্যে কমলাপুর মেট্রোরেলের কাজ পেয়েছে ভারতীয় কোম্পানি’। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সব সময় গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেই সম্পর্ক যেন কখনোই সমমর্যাদার বাইরে না যায়। দেশের স্বার্থ ও অর্থনৈতিক ন্যায্যতা রক্ষা করার জন্য বিষয়গুলো স্বচ্ছ ও জবাবদিহি অপরিহার্য।
তারপর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ চিকিৎসার জন্য প্রতিবছর বিপুল অর্থ ব্যয় করে বিদেশে, বিশেষত ভারতে যায়। এই পরিস্থিতি বদলানোর আশায় সরকার ঘোষণা দিয়েছিল, চীন বাংলাদেশে চারটি বৃহৎ বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ করবে। চলতি বছরের ১৩ এপ্রিল একটি দৈনিকের শিরোনাম ছিল, ‘বড় হাসপাতাল করতে চায় চীন’। এই হাসপাতালগুলোর একটি নামও ঠিক করা হয়েছিল ‘চায়না-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ জেনারেল হাসপাতাল’। প্রতিশ্রুতি ছিল, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও উত্তরবঙ্গে হাসপাতাল নির্মিত হবে, যাতে জনগণ উন্নত চিকিৎসা পায় এবং আর বিদেশে যেতে না হয়। কিন্তু আজও সেই হাসপাতালের জমি নির্ধারণের কাজই শুরু হয়নি, হাসপাতাল তো দূরের কথা!
এই তালিকা এখানেই শেষ নয়। এমন আরও অনেক প্রতিশ্রুতি আছে, যেগুলো বাস্তবায়িত হলে দেশের চেহারা বদলে যেত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অনেক কিছুই পরিকল্পনার স্তর পেরোতে পারছে না। অথচ এসব কাজের জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন নেই—প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা, দৃঢ়তা
আর দায়িত্ববোধ।
তবু হতাশ হইনি। কারণ, পরিবর্তনের প্রক্রিয়া এক দিনে ঘটে না, সময় লাগে। হয়তো সরকার এখনো প্রস্তুতি নিচ্ছে, হয়তো নীতিগত বাধা কাটানোর চেষ্টা করছে। তাই বিশ্বাস রাখতে চাই, একদিন এই ‘হতে পারত’গুলো সত্যি হবে, বাস্তবে রূপ নেবে সেই সব প্রতিশ্রুতি।
আমরা যারা এই দেশের নাগরিক, আমাদেরও দায়িত্ব শুধু সমালোচনা নয়, সচেতন থাকা, দাবি জানানো এবং প্রয়োজনে ইতিবাচক চাপ সৃষ্টি করা। কারণ, সরকার, রাষ্ট্র, জাতি—সবই আমাদের সম্মিলিত সত্তা।

স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন ও সম্ভাবনার এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। পদ্মা সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রোরেল—অবকাঠামোগত উন্নয়নের এ দৃশ্যপট আজ অনেকের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার। তবু উন্নয়নের এই ঝলমলে রূপের আড়ালে লুকিয়ে আছে কিছু অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি, কিছু অপূর্ণ আশার গল্প। নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে গঠিত হওয়া অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর জনগণের প্রত্যাশা ছিল—এই সরকার শুধু উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে না, বরং দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত থেকে যাওয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে।
কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পরেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো অগ্রসর হওয়া গেছে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে ধীরগতিতে, অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। যেমন ধরা যাক, আমাদের সবচেয়ে গর্বের অর্জন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছিলাম স্বাধীনতা উপভোগের স্বাদ। কিন্তু জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ নিয়ে বিগত সরকারের সময়ে নানা অপকর্ম করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার নামের পাশে মিথ্যা সনদ জুড়ে দেওয়া শুধু প্রতারণা নয়, এটি একধরনের অপরাধ—ইতিহাস ও জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা।
এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ বাতিল ও শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে’।
এটি এমন এক ঘোষণা ছিল, যা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনাকে পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি বলা যায়। কিন্তু সময় গড়িয়েছে, বছর পেরিয়েছে, অথচ বাস্তব অগ্রগতি দেখা যায়নি। আজও বহু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রীয় সুবিধা নিচ্ছেন, বিপরীতে অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিই পাননি। একটি জাতির আত্মপরিচয়ের ভিত্তি যদি মিথ্যার ওপর দাঁড়ায়, তাহলে সেই ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করতে পারলে রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিটি যেমন মজবুত হতো, তেমনি রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় হতো না।
২০২৫ সালের ৪ এপ্রিল দেশের প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকগুলোর খবর ছিল—‘প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের কথা নিশ্চিত করেছে মিয়ানমার।’ সেই সময় অনেকে মনে করেছিলেন, অবশেষে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সফল হচ্ছে। কিন্তু বছরের শেষে দেখা গেল, একজন রোহিঙ্গাকেও ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি; বরং আরও অনেকে সীমান্ত পেরিয়ে এসেছে।
কক্সবাজার ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরগুলোতে এখন ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে, যাদের কারণে স্থানীয় অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা ও নিরাপত্তা—সবই চাপে রয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে মিয়ানমারের প্রতি চাপ অব্যাহত থাকলেও বাংলাদেশের পক্ষে একক প্রচেষ্টায় এই জটিল সমস্যার সমাধান করা কঠিন। তবু জনগণের প্রত্যাশা ছিল—সরকার অন্তত প্রত্যাবাসনের দৃশ্যমান সূচনা করবে। কিন্তু তা হয়নি।
প্রতিনিয়ত আমরা দেখছি, নদী দূষিত হচ্ছে, বনভূমি হারিয়ে যাচ্ছে, গ্রাম ও শহর প্লাস্টিকে ভরে যাচ্ছে। পরিবেশের এই সংকট রোধে ২০২৪ সালের ১ নভেম্বর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয়, ‘কাঁচাবাজারেও আজ থেকে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ’। সেই ঘোষণায় বলা হয়েছিল, আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবায়নে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। এখন বহাল তবিয়তে প্রতিটি বাজারে, এমনকি পাড়ার ছোট দোকানেও পলিথিন ব্যাগ আগের মতোই ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ তরুণদের হাতে। অথচ কর্মসংস্থানের অভাব আজ তরুণদের সবচেয়ে বড় হতাশার কারণ। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে একটি দৈনিকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘২৬ লাখ শিক্ষিত বেকারের দেশে ২৬ লাখ ভারতীয় কী করে চাকরি করে’। প্রতিবেদকের ভাষ্যমতে, ‘একটা স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রকে আরেকটি রাষ্ট্র কি এভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে? বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের “দুরভিসন্ধির” পরিকল্পনাগুলোর একটি এটি। এমন কোনো সেক্টর নেই, যেখানে ভারতীয়দের সুকৌশলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়নি। অথচ দেশে শিক্ষিত বেকার ২৬ লাখ ৪০ হাজার!’ এমন প্রতিবেদন কেবল পরিসংখ্যান নয়, এটি এক তীব্র প্রশ্ন—দেশে যদি এত বেকার তরুণ থাকে, তবে বিদেশিরা কেন চাকরি পাবে? এমন বাস্তবতায় প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস তখন ঘোষণা দিয়েছিলেন, দেশে এমন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে, যাতে বিদেশি কর্মীদের আর সুযোগ না থাকে। এক বছর পার হয়ে গেলেও ২৬ লাখ ভারতীয়কে চাকরিচ্যুত করার কোনো খবর এখনো গণমাধ্যমে দেখা যায়নি।
এরপর একটি স্বাধীন দেশের জন্য সার্বভৌমত্বের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পরপরই গণমাধ্যমে বলা হয়েছিল, ‘হাসিনা সরকারের আমলে করা সকল গোপন চুক্তি বাতিল করা হবে।’ কিন্তু এ বছরের ২১ অক্টোবর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ঘোষণা দেন, ‘ভারতের সঙ্গে ১০ চুক্তি বাতিলের দাবি সত্য নয়’। এরপর ২৬ অক্টোবরের আরেকটি সংবাদ থেকে জানা গেল, ‘দ্বিগুণ মূল্যে কমলাপুর মেট্রোরেলের কাজ পেয়েছে ভারতীয় কোম্পানি’। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সব সময় গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেই সম্পর্ক যেন কখনোই সমমর্যাদার বাইরে না যায়। দেশের স্বার্থ ও অর্থনৈতিক ন্যায্যতা রক্ষা করার জন্য বিষয়গুলো স্বচ্ছ ও জবাবদিহি অপরিহার্য।
তারপর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ চিকিৎসার জন্য প্রতিবছর বিপুল অর্থ ব্যয় করে বিদেশে, বিশেষত ভারতে যায়। এই পরিস্থিতি বদলানোর আশায় সরকার ঘোষণা দিয়েছিল, চীন বাংলাদেশে চারটি বৃহৎ বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ করবে। চলতি বছরের ১৩ এপ্রিল একটি দৈনিকের শিরোনাম ছিল, ‘বড় হাসপাতাল করতে চায় চীন’। এই হাসপাতালগুলোর একটি নামও ঠিক করা হয়েছিল ‘চায়না-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ জেনারেল হাসপাতাল’। প্রতিশ্রুতি ছিল, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও উত্তরবঙ্গে হাসপাতাল নির্মিত হবে, যাতে জনগণ উন্নত চিকিৎসা পায় এবং আর বিদেশে যেতে না হয়। কিন্তু আজও সেই হাসপাতালের জমি নির্ধারণের কাজই শুরু হয়নি, হাসপাতাল তো দূরের কথা!
এই তালিকা এখানেই শেষ নয়। এমন আরও অনেক প্রতিশ্রুতি আছে, যেগুলো বাস্তবায়িত হলে দেশের চেহারা বদলে যেত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অনেক কিছুই পরিকল্পনার স্তর পেরোতে পারছে না। অথচ এসব কাজের জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন নেই—প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা, দৃঢ়তা
আর দায়িত্ববোধ।
তবু হতাশ হইনি। কারণ, পরিবর্তনের প্রক্রিয়া এক দিনে ঘটে না, সময় লাগে। হয়তো সরকার এখনো প্রস্তুতি নিচ্ছে, হয়তো নীতিগত বাধা কাটানোর চেষ্টা করছে। তাই বিশ্বাস রাখতে চাই, একদিন এই ‘হতে পারত’গুলো সত্যি হবে, বাস্তবে রূপ নেবে সেই সব প্রতিশ্রুতি।
আমরা যারা এই দেশের নাগরিক, আমাদেরও দায়িত্ব শুধু সমালোচনা নয়, সচেতন থাকা, দাবি জানানো এবং প্রয়োজনে ইতিবাচক চাপ সৃষ্টি করা। কারণ, সরকার, রাষ্ট্র, জাতি—সবই আমাদের সম্মিলিত সত্তা।

এবারের মার্চ মাসটাকে কীভাবে দেখা হবে? কে কীভাবে দেখবে? উন্মাতাল এই শহরের ফুঁসে ওঠা দেখে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ৩ মার্চের ইত্তেফাকের শিরোনাম করেছিলেন ‘বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন’।
০৩ মার্চ ২০২৫
গত এক শতাব্দীতে বাঙালির জন্য রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কম কিছু ঘটেনি। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটছে ১৯৪৭ সালে, বঙ্গভঙ্গের সময়। দেশভাগের চেষ্টা আগেও একবার হয়েছিল, ১৯০৫ সালে; তখন তা কার্যকর হয়নি। ৪২ বছর পরে আবার চেষ্টা হলো, এবার তা সফল হলো। সাতচল্লিশে ভঙ্গ হলো বঙ্গ।
৮ ঘণ্টা আগে
একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে যেন এক অদ্ভুত বৈপরীত্যের মুখোমুখি আমরা দাঁড়িয়ে আছি। একদিকে প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি, আকাশচুম্বী অট্টালিকা, শপিং মলের উজ্জ্বল আলো আর বিলাসবহুল জীবনের হাতছানি; অন্যদিকে এক গভীর অন্ধকার, যা নিঃশব্দে গ্রাস করছে আমাদের মানবিক সত্তাকে। এই অন্ধকারের নাম ‘ভোগবাদ’। এটি শুধু সামাজিক
৮ ঘণ্টা আগে
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে চোর সন্দেহে তিনজনকে পিটিয়ে মেরেছে এলাকার উত্তেজিত জনতা। গত শনিবার কাটাবাড়ি ইউনিয়নের নাসিরাবাদ গ্রামে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। এলাকাবাসী বলছেন, তিনটি গরু চুরি করে এরা পিকআপে তুলে নিয়েছিল।
৮ ঘণ্টা আগেহেনা শিকদার

একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে যেন এক অদ্ভুত বৈপরীত্যের মুখোমুখি আমরা দাঁড়িয়ে আছি। একদিকে প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি, আকাশচুম্বী অট্টালিকা, শপিং মলের উজ্জ্বল আলো আর বিলাসবহুল জীবনের হাতছানি; অন্যদিকে এক গভীর অন্ধকার, যা নিঃশব্দে গ্রাস করছে আমাদের মানবিক সত্তাকে। এই অন্ধকারের নাম ‘ভোগবাদ’। এটি শুধু সামাজিক ধারণা নয়, একটি সর্বগ্রাসী জীবনদর্শনে পরিণত হয়েছে, যার করাল গ্রাসে আমাদের শত শত বছরের সঞ্চিত মূল্যবোধগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।
‘ভোগবাদ’ আমাদের শেখায়, তোমার পরিচয় তোমার অধিকারে, তোমার ব্যক্তিত্ব তোমার পরিধেয় ব্র্যান্ডে, আর তোমার জীবনের সার্থকতা তোমার ব্যাংক ব্যালেন্সে। এই দর্শন অনুযায়ী, জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় আরও বেশি ভোগ করা, আরও বেশি সঞ্চয় করা নয় এবং আরও বেশি ক্রয় করা। আমাদের এই অন্তহীন ‘আরও চাই’ সংস্কৃতি এমন এক মরীচিকার পেছনে ধাবিত করছে, যেখানে তৃষ্ণা মেটে না, কেবল বাড়ে। আর এই উন্মত্ত দৌড়ে আমরা যা কিছু পেছনে ফেলে আসছি, তা হলো আমাদের মনুষ্যত্বের অলংকার—আমাদের মূল্যবোধ।
মূল্যবোধের এই মৃত্যুর প্রথম ও প্রধান লক্ষণ হলো মানবিক সম্পর্কের অবমূল্যায়ন। যে সমাজে একজন মানুষের মূল্যায়ন তার চরিত্র, প্রজ্ঞা বা সহানুভূতির পরিবর্তে তার ব্যবহৃত গাড়ি, দামি মোবাইল ফোন অথবা বাড়ির আকার দিয়ে নির্ধারিত হয়, সে সমাজে সম্পর্কের উষ্ণতা আশা করা বৃথা। সম্পর্কগুলো ক্রমেই যেন ‘লেনদেনভিত্তিক’ হয়ে উঠছে। ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, আত্মীয়তার মতো পবিত্র বন্ধনগুলোও আজ লাভ-ক্ষতির নিক্তিতে মাপা হয়। ‘আমার এতে কী লাভ?’—এ প্রশ্নই যখন সবকিছুর আগে চলে আসে, তখন নিঃস্বার্থপরতা, ত্যাগ বা মমত্ববোধের মতো শব্দগুলো অভিধান থেকে নির্বাসিত হতে বাধ্য।
ভোগবাদী সমাজ আত্মকেন্দ্রিকতাকে উসকে দেয়। ‘আমি’ এবং ‘আমার’—এই দুটি শব্দ আমাদের চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে। এই আত্মকেন্দ্রিকতার ফলে ‘আমরা’ বা ‘সমাজ’ ধারণাটি ফিকে হয়ে যায়। অন্যের প্রতি সহানুভূতি কিংবা সহমর্মিতা প্রদর্শনের অবকাশ কোথায়, যখন আমরা প্রত্যেকেই নিজের সুখের নীড় নির্মাণে ব্যস্ত? এই সমাজ আমাদের শিখিয়ে দেয়, পাশের বাড়ির মানুষটি অনাহারে থাকলেও তোমার কিছু যায় আসে না, যদি তোমার ফ্রিজ ভর্তি থাকে। এই যে সামষ্টিক চেতনার মৃত্যু, এটাই মূল্যবোধের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়।
নৈতিকতা ও সততার ধারণাটিও এই ভোগবাদী দর্শনের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত। যখন সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি হয় অর্থ ও প্রতিপত্তি, তখন সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথটি বৈধ না অবৈধ, তা বিবেচ্য বিষয় থাকে না। ‘দ্য ইন্ড জাস্টিফাইস দ্য মিনস’ অর্থাৎ, উদ্দেশ্য সফল হলেই উপায় যেকোনো কিছু হতে পারে। ফলে দুর্নীতি, প্রবঞ্চনা, মিথ্যাচার সামাজিক ব্যাধি থেকে একধরনের ‘স্মার্টনেস’ বা ‘দক্ষতা’ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। যে তরুণসমাজ সততাকে ‘বোকামি’ এবং অসদুপায় অবলম্বনকে ‘চালাকি’ বলে মনে করে, তাদের হাতে ভবিষ্যতের মূল্যবোধ কতটা সুরক্ষিত, তা সহজেই অনুমেয়।
ভোগবাদ আমাদের একটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক সংকটেও নিমজ্জিত করছে। বিজ্ঞাপনের মায়াজাল আর সোশ্যাল মিডিয়ার লোকদেখানো জীবনের চাকচিক্য আমাদের মধ্যে একধরনের স্থায়ী অতৃপ্তি তৈরি করছে। নিজের যা আছে, তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার পরিবর্তে অন্যের যা আছে, তা না পাওয়ার হতাশায় আমরা নিমজ্জিত হচ্ছি। এই অন্তহীন তুলনা আর প্রতিযোগিতার ফলে বাড়ছে বিষণ্ণতা, একাকিত্ব ও মানসিক অস্থিরতা। আমরা ভুলে যাচ্ছি, জীবনের প্রকৃত সুখ বস্তুগত প্রাপ্তিতে নয়, বরং আত্মিক প্রশান্তি, জ্ঞানার্জন এবং অর্থপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে নিহিত।
পরিবেশগত বিপর্যয়ের পেছনেও এই ভোগবাদী সংস্কৃতির দায় অপরিসীম। আরও নতুন পণ্য, আরও নতুন ফ্যাশনের চাহিদা মেটাতে গিয়ে আমরা প্রকৃতির ওপর যে অপরিসীম অত্যাচার চালাচ্ছি, তার ফল আমরা এরই মধ্যে পেতে শুরু করেছি। যে মূল্যবোধ আমাদের শেখাত প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান করতে, সেই মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে আমরা এক আত্মঘাতী খেলায় মেতেছি।
তাহলে প্রশ্ন হলো, এই অবক্ষয়ের শেষ কোথায়? আমরা কি শুধুই পণ্যের দাস হয়ে থাকব? এর উত্তর আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। ভোগবাদ হলো জীবনের প্রয়োজন মেটানোর উপকরণমাত্র, তাকে জীবনের লক্ষ্যে পরিণত করা এক বিরাট প্রমাদ। আমাদের সন্তানদের শেখাতে হবে, জীবনের সার্থকতা দামি পোশাকে নয়, পরিচ্ছন্ন চরিত্রে; বিলাসবহুল বাড়িতে নয়, ভালোবাসাপূর্ণ পরিবারে; এবং অফুরন্ত সম্পদে নয়, অন্যের জন্য কিছু করতে পারার তৃপ্তিতে।
আমাদের উচিত বস্তুগত সমৃদ্ধি এবং আত্মিক বা মানবিক মূল্যবোধের মধ্যে একটি ভারসাম্য খোঁজা। অন্যথায়, আমরা এমন এক ‘সোনার খাঁচা’ তৈরি করব, যেখানে সব থাকবে, শুধু থাকবে না সেই পাখি—যার নাম ‘মানবতা’। কিন্তু এই ভোগবাদের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছে পুঁজির দাসত্বের কারণে। কোনোভাবেই এটাকে এড়ানোর সুযোগ নেই। মূল্যবোধের এই মৃত্যু রোধ করতে না পারলে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এক বিত্তশালী কিন্তু দেউলিয়া সমাজে বাস করবে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে যেন এক অদ্ভুত বৈপরীত্যের মুখোমুখি আমরা দাঁড়িয়ে আছি। একদিকে প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি, আকাশচুম্বী অট্টালিকা, শপিং মলের উজ্জ্বল আলো আর বিলাসবহুল জীবনের হাতছানি; অন্যদিকে এক গভীর অন্ধকার, যা নিঃশব্দে গ্রাস করছে আমাদের মানবিক সত্তাকে। এই অন্ধকারের নাম ‘ভোগবাদ’। এটি শুধু সামাজিক ধারণা নয়, একটি সর্বগ্রাসী জীবনদর্শনে পরিণত হয়েছে, যার করাল গ্রাসে আমাদের শত শত বছরের সঞ্চিত মূল্যবোধগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।
‘ভোগবাদ’ আমাদের শেখায়, তোমার পরিচয় তোমার অধিকারে, তোমার ব্যক্তিত্ব তোমার পরিধেয় ব্র্যান্ডে, আর তোমার জীবনের সার্থকতা তোমার ব্যাংক ব্যালেন্সে। এই দর্শন অনুযায়ী, জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় আরও বেশি ভোগ করা, আরও বেশি সঞ্চয় করা নয় এবং আরও বেশি ক্রয় করা। আমাদের এই অন্তহীন ‘আরও চাই’ সংস্কৃতি এমন এক মরীচিকার পেছনে ধাবিত করছে, যেখানে তৃষ্ণা মেটে না, কেবল বাড়ে। আর এই উন্মত্ত দৌড়ে আমরা যা কিছু পেছনে ফেলে আসছি, তা হলো আমাদের মনুষ্যত্বের অলংকার—আমাদের মূল্যবোধ।
মূল্যবোধের এই মৃত্যুর প্রথম ও প্রধান লক্ষণ হলো মানবিক সম্পর্কের অবমূল্যায়ন। যে সমাজে একজন মানুষের মূল্যায়ন তার চরিত্র, প্রজ্ঞা বা সহানুভূতির পরিবর্তে তার ব্যবহৃত গাড়ি, দামি মোবাইল ফোন অথবা বাড়ির আকার দিয়ে নির্ধারিত হয়, সে সমাজে সম্পর্কের উষ্ণতা আশা করা বৃথা। সম্পর্কগুলো ক্রমেই যেন ‘লেনদেনভিত্তিক’ হয়ে উঠছে। ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, আত্মীয়তার মতো পবিত্র বন্ধনগুলোও আজ লাভ-ক্ষতির নিক্তিতে মাপা হয়। ‘আমার এতে কী লাভ?’—এ প্রশ্নই যখন সবকিছুর আগে চলে আসে, তখন নিঃস্বার্থপরতা, ত্যাগ বা মমত্ববোধের মতো শব্দগুলো অভিধান থেকে নির্বাসিত হতে বাধ্য।
ভোগবাদী সমাজ আত্মকেন্দ্রিকতাকে উসকে দেয়। ‘আমি’ এবং ‘আমার’—এই দুটি শব্দ আমাদের চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে। এই আত্মকেন্দ্রিকতার ফলে ‘আমরা’ বা ‘সমাজ’ ধারণাটি ফিকে হয়ে যায়। অন্যের প্রতি সহানুভূতি কিংবা সহমর্মিতা প্রদর্শনের অবকাশ কোথায়, যখন আমরা প্রত্যেকেই নিজের সুখের নীড় নির্মাণে ব্যস্ত? এই সমাজ আমাদের শিখিয়ে দেয়, পাশের বাড়ির মানুষটি অনাহারে থাকলেও তোমার কিছু যায় আসে না, যদি তোমার ফ্রিজ ভর্তি থাকে। এই যে সামষ্টিক চেতনার মৃত্যু, এটাই মূল্যবোধের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়।
নৈতিকতা ও সততার ধারণাটিও এই ভোগবাদী দর্শনের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত। যখন সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি হয় অর্থ ও প্রতিপত্তি, তখন সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথটি বৈধ না অবৈধ, তা বিবেচ্য বিষয় থাকে না। ‘দ্য ইন্ড জাস্টিফাইস দ্য মিনস’ অর্থাৎ, উদ্দেশ্য সফল হলেই উপায় যেকোনো কিছু হতে পারে। ফলে দুর্নীতি, প্রবঞ্চনা, মিথ্যাচার সামাজিক ব্যাধি থেকে একধরনের ‘স্মার্টনেস’ বা ‘দক্ষতা’ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। যে তরুণসমাজ সততাকে ‘বোকামি’ এবং অসদুপায় অবলম্বনকে ‘চালাকি’ বলে মনে করে, তাদের হাতে ভবিষ্যতের মূল্যবোধ কতটা সুরক্ষিত, তা সহজেই অনুমেয়।
ভোগবাদ আমাদের একটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক সংকটেও নিমজ্জিত করছে। বিজ্ঞাপনের মায়াজাল আর সোশ্যাল মিডিয়ার লোকদেখানো জীবনের চাকচিক্য আমাদের মধ্যে একধরনের স্থায়ী অতৃপ্তি তৈরি করছে। নিজের যা আছে, তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার পরিবর্তে অন্যের যা আছে, তা না পাওয়ার হতাশায় আমরা নিমজ্জিত হচ্ছি। এই অন্তহীন তুলনা আর প্রতিযোগিতার ফলে বাড়ছে বিষণ্ণতা, একাকিত্ব ও মানসিক অস্থিরতা। আমরা ভুলে যাচ্ছি, জীবনের প্রকৃত সুখ বস্তুগত প্রাপ্তিতে নয়, বরং আত্মিক প্রশান্তি, জ্ঞানার্জন এবং অর্থপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে নিহিত।
পরিবেশগত বিপর্যয়ের পেছনেও এই ভোগবাদী সংস্কৃতির দায় অপরিসীম। আরও নতুন পণ্য, আরও নতুন ফ্যাশনের চাহিদা মেটাতে গিয়ে আমরা প্রকৃতির ওপর যে অপরিসীম অত্যাচার চালাচ্ছি, তার ফল আমরা এরই মধ্যে পেতে শুরু করেছি। যে মূল্যবোধ আমাদের শেখাত প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান করতে, সেই মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে আমরা এক আত্মঘাতী খেলায় মেতেছি।
তাহলে প্রশ্ন হলো, এই অবক্ষয়ের শেষ কোথায়? আমরা কি শুধুই পণ্যের দাস হয়ে থাকব? এর উত্তর আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। ভোগবাদ হলো জীবনের প্রয়োজন মেটানোর উপকরণমাত্র, তাকে জীবনের লক্ষ্যে পরিণত করা এক বিরাট প্রমাদ। আমাদের সন্তানদের শেখাতে হবে, জীবনের সার্থকতা দামি পোশাকে নয়, পরিচ্ছন্ন চরিত্রে; বিলাসবহুল বাড়িতে নয়, ভালোবাসাপূর্ণ পরিবারে; এবং অফুরন্ত সম্পদে নয়, অন্যের জন্য কিছু করতে পারার তৃপ্তিতে।
আমাদের উচিত বস্তুগত সমৃদ্ধি এবং আত্মিক বা মানবিক মূল্যবোধের মধ্যে একটি ভারসাম্য খোঁজা। অন্যথায়, আমরা এমন এক ‘সোনার খাঁচা’ তৈরি করব, যেখানে সব থাকবে, শুধু থাকবে না সেই পাখি—যার নাম ‘মানবতা’। কিন্তু এই ভোগবাদের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছে পুঁজির দাসত্বের কারণে। কোনোভাবেই এটাকে এড়ানোর সুযোগ নেই। মূল্যবোধের এই মৃত্যু রোধ করতে না পারলে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এক বিত্তশালী কিন্তু দেউলিয়া সমাজে বাস করবে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

এবারের মার্চ মাসটাকে কীভাবে দেখা হবে? কে কীভাবে দেখবে? উন্মাতাল এই শহরের ফুঁসে ওঠা দেখে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ৩ মার্চের ইত্তেফাকের শিরোনাম করেছিলেন ‘বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন’।
০৩ মার্চ ২০২৫
গত এক শতাব্দীতে বাঙালির জন্য রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কম কিছু ঘটেনি। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটছে ১৯৪৭ সালে, বঙ্গভঙ্গের সময়। দেশভাগের চেষ্টা আগেও একবার হয়েছিল, ১৯০৫ সালে; তখন তা কার্যকর হয়নি। ৪২ বছর পরে আবার চেষ্টা হলো, এবার তা সফল হলো। সাতচল্লিশে ভঙ্গ হলো বঙ্গ।
৮ ঘণ্টা আগে
স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন ও সম্ভাবনার এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। পদ্মা সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রোরেল—অবকাঠামোগত উন্নয়নের এ দৃশ্যপট আজ অনেকের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার। তবু উন্নয়নের এই ঝলমলে রূপের আড়ালে লুকিয়ে আছে কিছু অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি, কিছু অপূর্ণ আশার গল্প।
৮ ঘণ্টা আগে
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে চোর সন্দেহে তিনজনকে পিটিয়ে মেরেছে এলাকার উত্তেজিত জনতা। গত শনিবার কাটাবাড়ি ইউনিয়নের নাসিরাবাদ গ্রামে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। এলাকাবাসী বলছেন, তিনটি গরু চুরি করে এরা পিকআপে তুলে নিয়েছিল।
৮ ঘণ্টা আগেসম্পাদকীয়

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে চোর সন্দেহে তিনজনকে পিটিয়ে মেরেছে এলাকার উত্তেজিত জনতা। গত শনিবার কাটাবাড়ি ইউনিয়নের নাসিরাবাদ গ্রামে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।
এলাকাবাসী বলছেন, তিনটি গরু চুরি করে এরা পিকআপে তুলে নিয়েছিল। জানাজানি হলে বাড়ির লোকজন এবং পাড়াপড়শিরা একত্র হয়ে পিকআপটিকে ধাওয়া করে।
একপর্যায়ে পিকআপ থেকে তিন চোর পুকুরে ঝাঁপ দেয়। এরপর তারা ধরা পড়ে এবং মার খায়। উত্তেজিত লোকজন তাদের এমন মার দেয় যে তিনজনেরই মৃত্যু হয়।
যে তিনজনকে হত্যা করা হলো, তারা যদি সত্যিই গরু চুরি করতে এসে থাকে, তাহলে শাস্তি তাদের অবশ্যই প্রাপ্য। প্রচলিত আইনে তাদের শাস্তি হওয়ার কথা। যে কেউ জানেন, এ রকম ক্ষেত্রে অপরাধীকে ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সোপর্দ করতে হয়। কিন্তু বাস্তবে কী দেখা গেল। যে যেভাবে পেরেছে, সেভাবেই তাদের শরীরে আঘাত করেছে। আঘাত এতটাই গুরুতর ছিল যে তাৎক্ষণিকভাবে দুজনের মৃত্যু হয়, এবং একজন মৃত্যুবরণ করে হাসপাতালে নেওয়ার পর।
লক্ষ করলে দেখা যায়, মানুষ দিন দিন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। তারা আইন নিজের হাতেই তুলে নিচ্ছে। কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটবে? কেন মানুষ পুলিশ কিংবা আদালতের কাজকে নিজের কাজ হিসেবে মনে করবে?
একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে যে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে ফেললেই আর কোনো দিক বিবেচনা না করে তাকে আঘাত করা শুরু হয়ে যায়। কোনো একজন কাউকে অপরাধী হিসেবে ঘোষণা করে দেওয়ার অপেক্ষা শুধু, এরপর দলেবলে পেটানোর সুখ খুঁজে ফেরা!
আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, এ ধরনের ঘটনা অবশ্যই অন্যায়। আমরা গত শতাব্দীর সিনেমাগুলোয় দেখেছি, মেলোড্রামার শেষ দৃশ্যে পুলিশ সংলাপ আওড়াচ্ছে, ‘আইন নিজের হাতে কোনোভাবেই তুলে নেবেন না।’ এই সংলাপ নিয়ে বহু হাসাহাসি করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সমাজে যেসব কারণ মানুষকে নিষ্ঠুর, নির্মম, অভদ্র, অসহিষ্ণু, অমানবিক করে তুলছে, সেগুলো আমাদের চিহ্নিত করা দরকার সবার আগে। ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া’ থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। আমরা এ রকম এক অমানবিক পরিস্থিতি কেন তৈরি করলাম, তার সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণও জরুরি।
মানুষ কতটা অমানুষ হয়ে উঠেছে, ভিন্ন দুটি উদাহরণের মাধ্যমে তা দেখার চেষ্টা করব। ২০২৪ সালের ২৭ মার্চের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে একটি ছাগল কলা খেয়ে ফেলেছে। তাই ছাগলটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল এক কলাবিক্রেতা।
মৃত ছাগল-মাতার আশপাশে ঘুরছিল তখন দুই অবোধ ছাগলছানা। দ্বিতীয়টিও ছাগল হত্যার ঘটনা। বগুড়ার শেরপুরে গাছের পাতা খাওয়ার কারণে রামদা দিয়ে কুপিয়ে একটি ছাগলকে মেরে ফেললেন এক যুবক। ২০২৫ সালের ১৪ আগস্টের ঘটনা এটি। ঘটেছিল চকধলী গ্রামে।
এবার তিনটি অপরাধে যে ধরনের শাস্তি পেল অপরাধীরা, তা বিবেচনা করে দেখুন। আর ভাবুন, কোন পথে আমরা চলেছি!

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে চোর সন্দেহে তিনজনকে পিটিয়ে মেরেছে এলাকার উত্তেজিত জনতা। গত শনিবার কাটাবাড়ি ইউনিয়নের নাসিরাবাদ গ্রামে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।
এলাকাবাসী বলছেন, তিনটি গরু চুরি করে এরা পিকআপে তুলে নিয়েছিল। জানাজানি হলে বাড়ির লোকজন এবং পাড়াপড়শিরা একত্র হয়ে পিকআপটিকে ধাওয়া করে।
একপর্যায়ে পিকআপ থেকে তিন চোর পুকুরে ঝাঁপ দেয়। এরপর তারা ধরা পড়ে এবং মার খায়। উত্তেজিত লোকজন তাদের এমন মার দেয় যে তিনজনেরই মৃত্যু হয়।
যে তিনজনকে হত্যা করা হলো, তারা যদি সত্যিই গরু চুরি করতে এসে থাকে, তাহলে শাস্তি তাদের অবশ্যই প্রাপ্য। প্রচলিত আইনে তাদের শাস্তি হওয়ার কথা। যে কেউ জানেন, এ রকম ক্ষেত্রে অপরাধীকে ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সোপর্দ করতে হয়। কিন্তু বাস্তবে কী দেখা গেল। যে যেভাবে পেরেছে, সেভাবেই তাদের শরীরে আঘাত করেছে। আঘাত এতটাই গুরুতর ছিল যে তাৎক্ষণিকভাবে দুজনের মৃত্যু হয়, এবং একজন মৃত্যুবরণ করে হাসপাতালে নেওয়ার পর।
লক্ষ করলে দেখা যায়, মানুষ দিন দিন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। তারা আইন নিজের হাতেই তুলে নিচ্ছে। কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটবে? কেন মানুষ পুলিশ কিংবা আদালতের কাজকে নিজের কাজ হিসেবে মনে করবে?
একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে যে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে ফেললেই আর কোনো দিক বিবেচনা না করে তাকে আঘাত করা শুরু হয়ে যায়। কোনো একজন কাউকে অপরাধী হিসেবে ঘোষণা করে দেওয়ার অপেক্ষা শুধু, এরপর দলেবলে পেটানোর সুখ খুঁজে ফেরা!
আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, এ ধরনের ঘটনা অবশ্যই অন্যায়। আমরা গত শতাব্দীর সিনেমাগুলোয় দেখেছি, মেলোড্রামার শেষ দৃশ্যে পুলিশ সংলাপ আওড়াচ্ছে, ‘আইন নিজের হাতে কোনোভাবেই তুলে নেবেন না।’ এই সংলাপ নিয়ে বহু হাসাহাসি করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সমাজে যেসব কারণ মানুষকে নিষ্ঠুর, নির্মম, অভদ্র, অসহিষ্ণু, অমানবিক করে তুলছে, সেগুলো আমাদের চিহ্নিত করা দরকার সবার আগে। ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া’ থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। আমরা এ রকম এক অমানবিক পরিস্থিতি কেন তৈরি করলাম, তার সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণও জরুরি।
মানুষ কতটা অমানুষ হয়ে উঠেছে, ভিন্ন দুটি উদাহরণের মাধ্যমে তা দেখার চেষ্টা করব। ২০২৪ সালের ২৭ মার্চের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে একটি ছাগল কলা খেয়ে ফেলেছে। তাই ছাগলটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল এক কলাবিক্রেতা।
মৃত ছাগল-মাতার আশপাশে ঘুরছিল তখন দুই অবোধ ছাগলছানা। দ্বিতীয়টিও ছাগল হত্যার ঘটনা। বগুড়ার শেরপুরে গাছের পাতা খাওয়ার কারণে রামদা দিয়ে কুপিয়ে একটি ছাগলকে মেরে ফেললেন এক যুবক। ২০২৫ সালের ১৪ আগস্টের ঘটনা এটি। ঘটেছিল চকধলী গ্রামে।
এবার তিনটি অপরাধে যে ধরনের শাস্তি পেল অপরাধীরা, তা বিবেচনা করে দেখুন। আর ভাবুন, কোন পথে আমরা চলেছি!

এবারের মার্চ মাসটাকে কীভাবে দেখা হবে? কে কীভাবে দেখবে? উন্মাতাল এই শহরের ফুঁসে ওঠা দেখে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ৩ মার্চের ইত্তেফাকের শিরোনাম করেছিলেন ‘বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন’।
০৩ মার্চ ২০২৫
গত এক শতাব্দীতে বাঙালির জন্য রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কম কিছু ঘটেনি। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটছে ১৯৪৭ সালে, বঙ্গভঙ্গের সময়। দেশভাগের চেষ্টা আগেও একবার হয়েছিল, ১৯০৫ সালে; তখন তা কার্যকর হয়নি। ৪২ বছর পরে আবার চেষ্টা হলো, এবার তা সফল হলো। সাতচল্লিশে ভঙ্গ হলো বঙ্গ।
৮ ঘণ্টা আগে
স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন ও সম্ভাবনার এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। পদ্মা সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রোরেল—অবকাঠামোগত উন্নয়নের এ দৃশ্যপট আজ অনেকের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার। তবু উন্নয়নের এই ঝলমলে রূপের আড়ালে লুকিয়ে আছে কিছু অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি, কিছু অপূর্ণ আশার গল্প।
৮ ঘণ্টা আগে
একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে যেন এক অদ্ভুত বৈপরীত্যের মুখোমুখি আমরা দাঁড়িয়ে আছি। একদিকে প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি, আকাশচুম্বী অট্টালিকা, শপিং মলের উজ্জ্বল আলো আর বিলাসবহুল জীবনের হাতছানি; অন্যদিকে এক গভীর অন্ধকার, যা নিঃশব্দে গ্রাস করছে আমাদের মানবিক সত্তাকে। এই অন্ধকারের নাম ‘ভোগবাদ’। এটি শুধু সামাজিক
৮ ঘণ্টা আগে