Ajker Patrika

জনগণই ক্ষমতার উৎস—এ কি পরিহাস

গণ-অভ্যুত্থানের পর কেউ কেউ আওয়ামী লীগকে অগ্রাহ্য করতে চেয়ে পুরো মুক্তিযুদ্ধকেই মামুলি একটি ইতিহাসের অংশ বলে ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একটি জাতি তো তার ইতিহাস বহন করে, রক্তে সেটা থেকে যায়। কেউ একজন নতুন একটা তত্ত্ব নিয়ে হাজির হলেই জনগণ তাতে সায় দেবে, এমন মনে করার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ নেই।

জাহীদ রেজা নূর  
জনগণই ক্ষমতার উৎস—এ কি পরিহাস

এবারের মার্চ মাসটাকে কীভাবে দেখা হবে? কে কীভাবে দেখবে? উন্মাতাল এই শহরের ফুঁসে ওঠা দেখে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ৩ মার্চের ইত্তেফাকের শিরোনাম করেছিলেন ‘বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন’। এর নিচেই ছিল ‘আমি শেখ মুজিব বলছি’। সেই সময়ের নায়ক শেখ মুজিবুর রহমান।

সে সময়টি পাড়ি দিয়েছে আমাদের ইতিহাস, তাকে কোনো ধরনের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে অবমূল্যায়ন করা যাবে না। ইতিহাসের নানা দিক থাকে, নানা ভাবনায় জারিত হয় মানুষ, কিন্তু বাঙালির ইতিহাসে ১৯৭১ সালের অর্জন ও অঙ্গীকার সবকিছুর ওপরে স্থান নিয়েছে। এই ইতিহাস ভুলিয়ে দিয়ে নব নব তরিকা হাজির করলে ইতিহাসই তা প্রত্যাখ্যান করবে।

স্বাধীন বাংলাদেশ তার অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারেনি। একটি ন্যায়বিচার-সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ে ওঠেনি, বরং নিজের সংস্কৃতি নিয়ে আবারও দ্বিধায় পড়েছে তারা। যে যৌবনের উজ্জীবন হয়েছিল বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনে, তার ধারাবাহিকতাকে এখন অগ্রাহ্য করছে কেউ কেউ। তারা ভুলে যাচ্ছে, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিরা যে বৈষম্যের সৃষ্টি করে রেখেছিল, তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। গুটিকয়েক সরকারি দালাল ছাড়া সবাই সেদিন পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল ঘৃণাভরে।

সেই ইতিহাস কি জানে আজকের প্রজন্ম? তখন প্রত্যেকেই হৃদয়ে বয়ে বেড়াত একটি স্বপ্ন, স্বাধীনতা যার নাম। আমাদের স্বাধীনতার মাসে লেখাটি লিখতে গিয়ে বেশ কিছু প্রশ্নের উদয় হচ্ছে মনে। তারই কিছু কথা বলব আজ।

২. সম্প্রতি উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলাম। নানা রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে দেশের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে মনে হলো, ঢাকা মহানগরীতে যত ধরনের বিভাজন ও সহিংসতা বিদ্যমান এই মুহূর্তে, গ্রামের মানুষ সেগুলো বহন করতে রাজি নয়। একটি সুন্দর নিরাপদ রাষ্ট্রে তারা বসবাস করতে চায়। তবে তাদের সেই নিরবচ্ছিন্ন শান্তির তৃষ্ণা নিবারণ হয় না সব সময়।

উত্তরবঙ্গের একেবারে শেষ মাথায় একটি ছোট শহরে অনেক মমতা দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল একটি পাঠাগার। কেন, কী কারণে ৫ আগস্টের পর সেই পাঠাগার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং বইগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তার কোনো ব্যাখ্যা স্থানীয় কেউ দিতে পারে না। একটি পাঠাগার কার চক্ষুশূল হতে পারে, তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে।

কিছুক্ষণ আগেই বলেছি, এই ভূখণ্ডে হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা। এ কথাও বলেছি, এই স্বাধীনতা লাভের ব্যাপারে নানা ধরনের বয়ান দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেসব বয়ান যাঁরা দাঁড় করাতে চাইছেন, তাঁরা ইতিহাসের কাছে না গিয়ে ধরি মাছ না ছুঁই পানি ধরনের একটা মানসিকতা বহন করে চলেছেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই ভাষার প্রশ্নে বাঙালি প্রথম যে ধাক্কাটা খেয়েছিল, তাতেই নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা ও অঙ্গীকারবোধে জারিত হয়েছিল এই ভূখণ্ডের মানুষ। সেই চেতনা নিয়েই পাকিস্তানি জান্তাদের বৈষম্যের দীর্ঘ পথকে চ্যালেঞ্জ করেই এগিয়ে গেছে এ দেশের জনগণ। এই মানুষেরা যে আত্মপরিচয় গড়ে তুলেছে, তাতে ধর্ম-বর্ণে কোনো ভেদাভেদ থাকার কথা নয়। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, সেই আত্মপরিচয় গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা যেমন এসেছে, তেমনি যাঁরা সেই অঙ্গীকার করেছিলেন, তাঁরা তা বেমালুম ভুলে গিয়ে কেবল সুবিধাবাদী কিংবা সুবিধাভোগী একটি শ্রেণিতে পরিণত হয়েছেন। তার চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, কোনো ধরনের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এসে যখন এই খেটে খাওয়া মানুষকে স্বপ্ন দেখায়, তখন কিছুদিন অতিক্রান্ত হলেই বোঝা যায় একইভাবে প্রতারিত হতে হবে। ব্যাপারটিকে দুঃসহ স্বপ্ন বললে ভুল হয় না।

আমি উত্তরবঙ্গের কয়েকটি শহরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। তারা প্রথমে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করে বুঝে নিতে চেয়েছেন যে আমি কোন মানসিকতার মানুষ। আরও সহজ করে বললে বলতে হয়, তারা জানতে চায় আমি কোনো রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব করছি কি না। যে রকম ভাঙচুর, লুটপাট ইত্যাদি হয়েছে, তাতে মানুষকে বিশ্বাস করা যে কঠিন হয়ে পড়েছে, সে কথা স্পষ্ট বোঝা গেল। মব ভায়োলেন্স যেভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে, তাতে মনে হচ্ছে শুভবুদ্ধি দিয়ে এর নাগাল পাওয়া কঠিন এখনো। পুলিশ বাস করছে ভয়ের রাজত্বে, হঠাৎ একদল লোক এসে চিৎকার-চেঁচামেচি করলেই তার দাবি পূরণ করে দেওয়া হবে—এ রকম একটা মানসিকতা গড়ে উঠছে। ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, স্বপ্নের কোনো সফল পরিণতি আসবে কি না, তা নিয়ে সবাই সন্দিহান, অন্তত যাদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি।

তেঁতুলিয়ায় পৌঁছানোর পর স্মৃতি রোমন্থন করে বললাম, যখন বছর ১৫ আগে ডাকবাংলোয় থাকার সময় একটা ফ্যান নিয়ে বাজারের পাশ দিয়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম আমরা। পথটি পাড়ি দেওয়ার সময় বারবার দেখতে হয়েছে গরুর পাল ভারত সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে বাংলায়। এটা যে চোরাকারবারি, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু এটাও বোঝা যাচ্ছিল যে সীমান্তের দুই দিকের মানুষেরই এতে লাভালাভ বণ্টনের পরিকল্পনা রয়েছে।

এবার যখন সে কথা বলছিলাম, তখন আমাদের গাড়ির চালক সতর্ক করে দিয়ে বললেন, রাতের বেলায় ভুলেও ভ্যানে করে ঘুরবেন না। কে কখন কোন দিক থেকে এসে চাপাতি কিংবা ছুরি ধরবে, সে-কথা আগে থেকে বলা যায় না। সুতরাং সাবধান থাকবেন।

তার পরও বাজার বসছে, হাট বসছে, মাঠে খেলছে শিশু-তরুণেরা, মেলা হচ্ছে এবং এই সবকিছু নিয়ে ও না নিয়েই জীবন একরকম বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যে অঙ্গীকারের কথা একটু আগে বলেছি, সেই অঙ্গীকারের ব্যাপারে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। রাজনৈতিক মাঠটি কে কীভাবে দখল করবে, তা নিয়েই বর্তমান রাজনীতির ভূগোল এগোচ্ছে।

৩. যাত্রাপথে যে স্কুল কিংবা কলেজ সামনে পড়েছে, দুরু দুরু বক্ষে তাকিয়ে দেখেছি সেখানে শহীদ মিনারটি অক্ষত আছে কি না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আশ্বস্ত হয়েছি। আমাদের ইতিহাসের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে কেউ যদি কোনো সময় মনে করেন, বায়ান্ন সালে ভাষা আন্দোলন করা উচিত হয়নি কিংবা একাত্তর সালে মুসলমান-মুসলমান ভাইদের মধ্যে অকারণে যুদ্ধ বেধে গিয়েছিল এবং সেই ইতিহাস যদি জাতিকে গেলানোর চেষ্টা করা হয়, তাহলে কোন ধরনের রাজনীতির সূচনা হবে, সে-কথা এই মুহূর্তে ভাবা যাচ্ছে না। তবে সেটা যে একটি অশ্বডিম্ব হবে, সে কথা বলাই বাহুল্য।

আশার দিক হলো, গণ-অভ্যুত্থানের পর কেউ কেউ আওয়ামী লীগকে অগ্রাহ্য করতে চেয়ে পুরো মুক্তিযুদ্ধকেই মামুলি একটি ইতিহাসের অংশ বলে ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একটি জাতি তো তার ইতিহাস বহন করে, রক্তে সেটা থেকে যায়। কেউ একজন নতুন একটা তত্ত্ব নিয়ে হাজির হলেই জনগণ তাতে সায় দেবে, এমন মনে করার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ নেই। মানুষের কাছে যেতে হবে তার প্রত্যাশিত রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে।

ভাষাসংগ্রামী মোহাম্মদ সুলতানের নামে একটি পাঠাগার উদ্বোধন হলো তাঁর জন্মভূমি বোদায়। সেখানে বিশিষ্টজনেরা কথা বললেন এবং সেই পাঠাগার ধীরে ধীরে আলোর পথ দেখাবে বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেন। বক্তৃতামালার মাঝে ছোট্ট একটি মেয়ে একুশের একটি ছড়া আবৃত্তি করল। সেই আবৃত্তিতে চর্চার স্পর্শ ছিল। তাতে মনে হয়েছে, একুশের চেতনা তো শিকড়ের ব্যাপার। কিন্তু যেকোনো কিছুর মতোই তার পরিচর্যা প্রয়োজন। নিজের লাভালাভের খেয়ালে উন্মত্ত হয়ে উঠলে সেই পরিচর্যা করার সুযোগ থাকে না। তাই মনগুলো হয়ে থাকে অকর্ষিত। সেই সুযোগটা নেয় বিভিন্ন রকম অন্ধের দল। তারা অকর্ষিত মনে পশ্চাৎপদতার বীজ বোনে। মর্ম না বুঝে মুখস্থ বিদ্যাকে হৃদয়ে ঢোকানোর চেষ্টা করে। তাতে যে প্রজন্মের সৃষ্টি হয়, সেই প্রজন্ম যৌক্তিকতার ধার ধারে না এবং তাদের মধ্যে মননচর্চা থাকে না। আমরা যেন জেনে-বুঝে সেই অন্ধতাকে ফিরিয়ে আনার শপথ নিয়েছি।

৪. বাংলাবান্ধায় জিরো পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেল উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠার মতো এক ঘটনা। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার বিকেলের আলোয় পতাকা নামানোর সময় বিজিবি ও বিএসএফ সীমান্তের দুই দিক থেকে এসে এমন কিছু মহড়া করে, যা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।

এ সময় সেই পতাকা নামানো প্রদর্শনী শেষে বাংলাদেশের মানুষ ভারতের জিরো পয়েন্টে গিয়ে তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে পারে। ভারতীয়রাও বাংলাদেশের জিরো পয়েন্টের ভেতরে ঢুকে কথাবার্তা বলতে পারে, ছবি তুলতে পারে। এই দৃশ্য দেখার জন্য বাংলাদেশ-ভারত উভয় সীমান্তেই গ্যালারি তৈরি করে রাখা হয়েছে। সেখানে বসে এই দৃশ্য দেখা যায় এবং প্রদর্শনী শেষ হলে সবার সঙ্গে মিলেমিশে ছবি তোলা যায়।

এই প্রদর্শনী দেখব বলে আধা ঘণ্টা আগেই আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টে। পঞ্চগড় থেকে এক প্রৌঢ় দম্পতি বসে ছিলেন আমাদের পাশেই। সবাই যখন বিজিবি ও বিএসএফের সঙ্গে ছবি তুলছে, আনন্দ করছে, তখন দেখা গেল এক অনন্য দৃশ্য। সীমান্তের ওপারে থুত্থুড়ে দুই বুড়ো-বুড়ি হাজির হয়েছেন ছোট্ট এক নাতি ও নাতির মাকে নিয়ে। আর পঞ্চগড় থেকে আসা ওই দম্পতি সীমান্তের কাছে এসে জড়িয়ে ধরছেন ভারতে থাকা মা-বাবাকে, কাঁদছেন। বহুদিন পর এখানে এসে মিলন হলো তাঁদের। এই ঘটনার কি কোনো ব্যাখ্যা হয়?

ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক উত্তপ্ত থাকার মূল কারণ রাজনৈতিক। নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন করে প্রতিবেশীসুলভ মনোভাব ফিরিয়ে আনতে না পারলে সমূহ বিপদ। নইলে ধর্মব্যবসায়ীরা আমাদের আত্মপরিচয় ভুলিয়ে দেবে। আমাদের কূটনীতির মূল কথা যে ‘কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুতা’, সেটা বোঝার জন্য খুব বেশি মেধাবী হতে হয় না। কিন্তু আমরা নিজেরা নিজেদের সম্মান করি না বলে একে অন্যের সঙ্গে হানাহানি করি। ভারতে যেমন এ ধরনের উগ্রপন্থা রয়েছে এবং রয়েছে দাদাগিরি করার খাসলত, তেমনি আমাদের দেশেও রয়েছে উগ্র ধর্মান্ধতা।

মিলনেই মুক্তি—এ কথা বোঝার মতো পরিস্থিতি কি এখন বিরাজ করছে? কিংবা কিছুদিন আগেও কি বিরাজ করেছিল? দেশের জনগণকে এ রকম শাস্তি দেওয়ার অধিকার এসব ক্ষমতাধর লোককে কে দিয়েছে? এরাই কিন্তু মুখে বলে—জনগণই ক্ষমতার উৎস। এত বড় পরিহাস পৃথিবী কমই দেখেছে।

লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত