এই এক বছরে মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বড় প্রত্যাশাটি থেকে অস্পষ্টতার চাদর যেন সরছেই না। সেটা হচ্ছে—নির্বাচন, মানুষের ভোট দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা। নির্বাচন কবে হবে কেউ জানে না। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি আরও ছয় মাস আগে থেকেই নির্বাচনের একটা রোডম্যাপের দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু কোনোই কাজ হয়নি। গত ঈদের আগে আগে জাতির উদ্দেশে ভাষণে ড. ইউনূস অবশ্য জানিয়েছিলেন এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হতে পারে।
মাসুদ কামাল
সেই দৃশ্যটা আমি এখনো ভুলতে পারি না।
আজকাল সামাজিক মাধ্যমে নানা ধরনের ছোট ছোট ভিডিও থাকে। কিছু থাকে নিছক হাসির, কিছু থাকে সামাজিক বক্তব্যনির্ভর। ছেলে-বুড়ো অনেককেই দেখি সেইসব রিলস বা শর্টসে বুঁদ হয়ে থাকতে। আমি নিজেও যখন ক্লান্ত থাকি, অল্প সময়ের জন্য মনটাকে একটু হালকা করতে চাই, এসব দেখি। কিন্তু যত কিছুই দেখি না কেন, ওই যে দৃশ্যটা, দ্রুত পায়ে শেখ হাসিনা আর তাঁর বোন হেঁটে গাড়িতে উঠছেন, পাশেই একটা সামরিক হেলিকপ্টার চালু অবস্থায় মাটিতে দাঁড়িয়ে, কিন্তু দুই বোন গিয়ে কালো জিপটাতেই উঠলেন—জাস্ট ভুলতে পারি না। বিভিন্ন মিডিয়াতে এই ঘটনার যতগুলো ভিডিও দেখেছি, সব একই রকম। একটা গাছের আড়াল থেকে কেউ একজন শক্তিশালী ক্যামেরা দিয়ে ভিডিওটি করেছেন। কে তিনি? এখন পর্যন্ত সেই ব্যক্তির পরিচয়টা আমি কোথাও পাইনি। তিনি সম্ভবত ওই সরকারের ভেতরেরই কেউ হবেন। না হলে প্রটেক্টেড ওই এলাকায় ঢুকবেন কী করে? তবে আমার এটাও মনে হয়, তিনি সে সময় বেশ ভয়ে ছিলেন। তাই গাছের পাতার আড়াল থেকেই ভিডিওটা করেছেন।
ব্যক্তিটি যে-ই হোন না কেন, যেভাবেই দৃশ্যটা ধারণ করুন না কেন, একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তিনি মানুষের মনে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছে—অতি ক্ষমতাবান ব্যক্তি, যাঁর মুখের সামান্য একটা অভিব্যক্তি হাজারো মানুষের বাঁচা-মরার কারণ হতে পারে, তাঁর মধ্যেও মৃত্যুভয় রয়েছে। তিনিও অপরাজেয় নন। ক্ষুব্ধ ও ঐক্যবদ্ধ সাধারণ মানুষ তাঁকে পরাজিত করতে পারে। জনগণ খেপে গেলে স্বৈরাচারী শাসক, তাঁর অনুগত শান্ত্রী-সামন্ত, মারাত্মক মারণাস্ত্র—সবকিছুই শুকনো পাতার মতো উড়ে যায়।
কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করে, আগস্ট ২০২৪-এর আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিটি কী? আমি বলব—জনগণের মনের ওই সাহসী প্রত্যয়টিই আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। সাধারণ মানুষ এখন বিশ্বাস করে, কোনো স্বৈরশাসকই অপরাজেয় নয়। মানুষ রুখে দাঁড়ালে লেজ গুটিয়ে তাঁরা নেংটি ইঁদুরের মতো পালিয়ে যান।
প্রাপ্তি কি কেবল এতটুকুই? আর কিছু নেই? আছে, আরও কিছু আছে। তবে সেসব প্রত্যাশার তুলনায় খুবই কম। একটু ডিটেইলে বলি।
হাসিনা ও তাঁর পারিষদবর্গ পালিয়ে যাওয়ার পর মানুষ খুব করে আশা করেছিল—এবার বুঝি একটা ভালো কিছু হবে। অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ, প্রশাসন—সব জায়গাতেই ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশের বাস্তবতায় সেসব যে এত দ্রুত হওয়া সম্ভব নয়, এটা মানুষ বুঝতে চায়নি। তারা ভেবেছে, হাসিনাকে যদি তাড়ানো সম্ভব হয়, তাহলে এসব সুশাসন কেন সম্ভব হবে না?
প্রত্যাশিত সুশাসনের পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব না হলেও তার প্রক্রিয়াটা কি শুরু করা যাবে না? সুশাসনের পথে দু-একটা পদক্ষেপ কি আমরা দিতে পারব না? এসব প্রশ্নেরও যে খুব আশাব্যঞ্জক জবাব পাওয়া যাচ্ছে, তেমনটি বলা যাবে না।
আসলে ঝামেলাটা কোথায়? আমার বিবেচনায় ঝামেলার শুরুটা হয়েছিল একেবারে শুরুতেই। জনগণের বিপুল সেই প্রত্যাশার বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ভুল মানুষের হাতে। স্বৈরশাসক বিতাড়নে জনগণ যে বিপুল ক্ষোভ ও সাহসের প্রকাশ ঘটিয়েছিল, তার উৎসটা আসলে কোথায় ছিল? সাধারণ মানুষের মনোজগতে। পুঞ্জীভূত ক্ষোভের উত্তাপে তাদের মনে দীর্ঘদিন ধরে ঘুমিয়ে থাকা চেতনা জেগে উঠেছিল। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ড. ইউনূস সেই চেতনাকে স্পর্শ করার ক্ষমতাই রাখেন না। এই দেশের সাধারণ মানুষকে তিনি চেনেন না। তিনি অন্য জগতের বাসিন্দা। তিনি গ্রামীণ ব্যাংক করেছেন, কিন্তু গ্রামের মানুষের মনটাই বোঝেন না। গ্রামের মানুষের কষ্ট বলতে তিনি সুদ করে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নেওয়াকে মনে করেন। তিনি গ্রামের মানুষের জন্য তুলনামূলক সহজ শর্তের ঋণ ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। এর বাইরে যে গরিব মানুষের আরও কিছু চাহিদা থাকতে পারে, এটা উপলব্ধির চেষ্টা তিনি করেননি। নিজে ভুক্তভোগী হওয়ার কারণে শেখ হাসিনার প্রতি তাঁর রাগ ছিল—এটা সত্য। কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্ষোভ আর তাঁর ক্ষোভ এক নয়। তাঁর ক্ষোভ ছিল—হাসিনা তাঁর বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা করেছে, সেগুলোর কারণে তাঁকে কষ্ট পেতে হচ্ছে, তাঁর সময় নষ্ট হচ্ছে, তিনি তাঁর স্বাভাবিক কাজগুলো করতে পারছেন না। তাই দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রথমেই তিনি নিজের কষ্টগুলোর নিরাময় করে নিয়েছেন। কিন্তু জনগণের মধ্যেকার যে ভোট, ভাত, নিরাপত্তা, সুশাসন ইত্যাদির প্রত্যাশা, সেগুলো বাস্তবায়নে তিনি তেমন কোনো তাড়া অনুভব করেননি।
আমাদের জন্য বেদনার আরেকটা জায়গা হলো—তিনি নিজে যেমন সাধারণ মানুষের দুঃখ, বেদনা, চাহিদা থেকে দূরবর্তী জায়গায় অবস্থান করেন, তিনি যাঁদের নিয়ে কেবিনেট গঠন করেছেন, তাঁদের অধিকাংশই তাঁর কাছাকাছি চরিত্রের। মোদ্দা কথা, এলিট শ্রেণির কতিপয় বয়স্ক ব্যক্তিকে নিয়ে এসে পুরো কেবিনেটকেই একটা প্রবীণ ক্লাবে পরিণত করেছেন। এদের সততা নিয়ে কোনো প্রশ্ন যদি না-ও করি, যোগ্যতা নিয়ে কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাবে। আমি একেবারে শুরু থেকেই এই লোকগুলোর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম। পরে দেখা গেল সাংবাদিক নূরুল কবীরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস নিজেও বিষয়টা স্বীকার করলেন। এই স্বীকারোক্তির মাধ্যমে তিনি নিজে হয়তো মহৎ সাজার চেষ্টা করলেন, কিন্তু উপলব্ধি করতে পারলেন না তাঁর কথায় দেশের মানুষ কতটা উদ্বেগের মধ্যে পড়ে গেছে! মানুষ আতঙ্ক বোধ করছে—দেশ পরিচালনার দায়িত্ব কতিপয় আনাড়ি লোকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
কারা করেছেন এই কাজটা? প্রথমত, গণ-অভ্যুত্থানের কৃতিত্বের দাবিদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র। বিষয়টা ইউনূস সাহেবও স্বীকার করেছেন, বলেছেন, ছাত্ররাই নাকি তাঁর প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই তিনি প্রথমে দুজন এবং পরে আরও একজন ছাত্রকে তাঁর কেবিনেটে জায়গা করে দিয়েছেন। আমার মনে হয় এটা ছিল ড. ইউনূস সরকারের একটা বড় ভুল। অথবা কে জানে, আমরা যেটাকে ভুল বলে বিবেচনা করছি, ইনটেনশনালি তিনি সেটাই করতে চেয়েছেন!
ছাত্রদের উপদেষ্টা পরিষদে নেওয়ার কারণে পুরো ছাত্রসমাজের মধ্যে আন্দোলন চলাকালে যে ঐক্যটা ছিল, সেটা নষ্ট হয়ে গেছে। প্রথমত, অনেক ছাত্রের মধ্যেই প্রশ্ন জেগেছে—কোন পদ্ধতিতে এই তিনজনকে নির্বাচন করা হলো? তাঁরাই কি সবচেয়ে যোগ্য? তাঁরা যদি হতে পারেন, তাহলে আমি নই কেন? তাঁরা কি আমার চেয়েও যোগ্য? পুরো আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রও নিহত হয়নি, তাহলে কোন বিবেচনায় তিনজন উপদেষ্টা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই নিতে হবে? প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্য কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন বিবেচনায় নেওয়া হলো না?
এসব প্রশ্নের কোনোই জবাব নেই। এই ঘটনায় ছাত্রদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হলো দুই ধরনের। কেউ কেউ হতাশ হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লেন। আবার কেউ কেউ স্থানীয় পর্যায়ে ‘সমন্বয়ক’, ‘জুলাই যোদ্ধা’ বা ‘ছাত্র’ পরিচয়ে টু-পাইস কামানোতে মন দিলেন। অনেকে আবার ঝাঁপিয়ে পড়লেন তদবির-বাণিজ্যে। এসব ঘটনার প্রতিফলন দেখা যেতে থাকল ওইসব ছাত্রদের চেহারা-ছবি, আচার-আচরণ বা কথাবার্তাতেও।
ছাত্রদের আরও বড় একটা ক্ষতি ড. ইউনূস করলেন তাঁদেরকে একটা রাজনৈতিক দল গঠনে প্ররোচিত করে। ড. ইউনূসের কথাবার্তায় এবং ছাত্রনেতাদের আচার-আচরণে সাধারণ মানুষের বুঝতে কষ্ট হলো না, এটা আসলে একটা কিংস পার্টি ছাড়া আর কিছু নয়। ফলে কিংস পার্টি হিসেবে তারা যত বেশি প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধা পেতে থাকল, তার আনুপাতিক হারে কমতে থাকল তাদের প্রতি মানুষের সমর্থন। এই প্রবণতার সর্বশেষ নমুনা আমরা দেখতে পেলাম ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এনসিপির ইশতেহার ঘোষণার সমাবেশে। এর ৫০০ গজ দূরে শাহবাগে একই সময়ে বিএনপির ছাত্রসংগঠনের সভা হচ্ছিল। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে তুলনাটা এমনিতেই এসে গেছে। বিষয়টা এনসিপির জন্য আর যাই হোক, সম্মানজনক ছিল না।
ছাত্রদের প্রতি সাধারণ মানুষের নেতিবাচক মনোভাব দারুণভাবে বেড়ে যায় গুলশানে এক সাবেক এমপির বাসায় চাঁদাবাজির ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর। তখন একের পর এক এ ধরনের আরও খবর আসতে থাকে সারা দেশ থেকেই।
মাঝে মাঝে আমার সন্দেহ হয়—ড. ইউনূস কি ইচ্ছা করেই ছাত্র ও তরুণসমাজকে মানুষের কাছে বিতর্কিত করে তুলেছেন? এই ছেলেমেয়েরা বুঝতে না পেরে সেই ফাঁদে পা দিয়েছেন? প্রশ্ন করতে পারেন—ড. ইউনূসের এতে লাভটা কী? একটা কথা ভাবুন—ড. ইউনূসকে যত দিন ধরে চেনেন, বলুন তো তিনি আসলে কার লোক? তিনি আসলে পশ্চিমা বিশ্বের লোক। তাদের পারপাসই সার্ভ করেছেন তিনি এত বছর। আর এই পশ্চিমা বিশ্ব সবচেয়ে ভয় পায় তরুণসমাজের আপরাইজিংকে। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রীদের যে নির্মমভাবে কিছুদিন আগে সেখানকার সরকার দমন করেছে, সেটাও কিন্তু ঠিক ওই কারণেই। এখনো তার রেশ চলছে। এখন আমাদের এখানে ছাত্র-তরুণসমাজের প্রতি সাধারণ জনগণ যদি একবার বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠতে পারে, সেটার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে। ভবিষ্যতে তাঁদের ওপর সাধারণ মানুষ আর আগের মতো আস্থা রাখবে না। অনেকে হয়তো বলবেন আমি অতিমাত্রায় সন্দেহপ্রবণ হয়ে গেছি। হতে পারে, কিন্তু বিষয়গুলোকে আমি সেভাবেই চিন্তা করি। সন্দেহ করাটাকে আমি একজন সাংবাদিকের স্বাভাবিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বলেই বিবেচনা করি।
তাহলে কি ভালো কিছু নেই? ভালো কিছুই কি হয়নি এই এক বছরে? আমি তা বলছি না। বেশ কিছু সেক্টরে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেছে। বিশেষ করে ব্যাংকিং সেক্টরে অবাধ লুটপাট, বিদেশে লাগাতার অর্থ পাচার—এসব ক্ষেত্রে দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে। আর্থিক খাতে মানুষের আস্থা ফিরে এসেছে। তবে দুর্নীতি শুরুর দিকে একটু থমকে থাকলেও এখন আবার ধীরে ধীরে গতি ফিরে পাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো হয়নি। ভালো করার চেষ্টা সরকারের আছে বলেও মনে হয় না। ফলে উল্টো মব কালচার যেন একটা প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা পেয়েছে। যাকে ইচ্ছা তাকে একটা ট্যাগ লাগিয়ে হেনস্তা করা হচ্ছে, কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। পুলিশ দেখেও না দেখার ভান করছে। কারণ, দেখতে বা ফেরাতে গেলেই বিপদ। পটিয়ার ওসির মতো কে আর শখ করে ক্লোজড হতে চান!
তবে আমার বিবেচনায় সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থায়। ১১টি সংস্কার কমিশন করা হয়েছে, কিন্তু এখানে শিক্ষাবিষয়ক কোনো কমিশন নেই। কেন নেই—তার কোনো জবাবও নেই। প্রতিবছর বছরের একেবারে প্রথম দিন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একটা বই উৎসব হয়। অনেক বছর ধরেই এটা হয়ে আসছে। কিন্তু এবার সেটা হয়নি। সরকার ঘোষণা দিয়েই বন্ধ রেখেছে। না রেখে আসলে উপায়ও ছিল না, কারণ তারা বেশির ভাগ বই ছাপতেই পারেনি। আবার উচ্চতর শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা গেছে ভিন্ন ধরনের সংকট। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে সমন্বয়ক বা বৈষম্যবিরোধী পদবি অর্জনের আগ্রহ বেড়ে গেছে। ভালো রেজাল্ট করার চেয়ে তাঁরা সমন্বয়ক হওয়াকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন।
এই এক বছরে মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বড় প্রত্যাশাটি থেকে অস্পষ্টতার চাদর যেন সরছেই না। সেটা হচ্ছে—নির্বাচন, মানুষের ভোট দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা। নির্বাচন কবে হবে, তা কেউ জানে না। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি আরও ছয় মাস আগে থেকেই নির্বাচনের একটা রোডম্যাপের দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু কোনোই কাজ হয়নি। গত ঈদের আগে আগে জাতির উদ্দেশে ভাষণে ড. ইউনূস অবশ্য জানিয়েছিলেন এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হতে পারে। ঠিক পরের সপ্তাহেই লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণায় বলা হলো সংস্কার ইত্যাদি সব ঠিকঠাকমতো হলে রোজার এক সপ্তাহ আগেও নির্বাচন হতে পারে। সে হিসাবে আগামী ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে? না, এটাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। এই যে অনিশ্চয়তা, এটাকেই সবচেয়ে বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করছে অনেকে। তারা প্রকারান্তরে ড. ইউনূসের ‘নিয়ত’ নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করছে।
সংস্কার কার্যক্রম অবশ্য একটা শেপ পেতে শুরু করেছে। কিন্তু সেখানেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মতবিরোধ রয়ে গেছে। কয়েকটা ইস্যুতে জামায়াত ও এনসিপি তো রীতিমতো কঠোর অবস্থানে রয়েছে। বলছে—সংস্কার ও বিচার সম্পন্ন না হলে তারা নির্বাচনেই যাবে না। দুই বা ততোধিক দল নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিলে, শেষ পর্যন্ত এটাকে কেন্দ্র করে নির্বাচনকে আরও পিছিয়ে দেওয়ার একটা অজুহাত পেয়ে যেতে পারেন ড. ইউনূস। এ রকম কিছু হলে দেশে একটা গৃহযুদ্ধও লেগে যেতে পারে। এই মুহূর্তে রাজনীতি করতে না পারলে আওয়ামী লীগও সেই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা পালিয়ে দেশের বাইরে থাকলেও দলটির অগণিত কর্মী-সমর্থক এখনো এই মাটিতেই আছেন। সরকারের কোন দুর্বলতাকে তাঁরা কখন কীভাবে গ্রহণ করবেন—সেটাও হয়তো সময়েই টের পাওয়া যাবে।
এতকিছুর পরও, লেখার শুরুতে যে ভিডিও ক্লিপটার কথা বলেছিলাম, সেটা কিন্তু আমি প্রায়ই দেখি। মনের ভেতর সেই সাহসটা আবারও স্পর্শ করতে পারি। মনে হয় আসলেই আমরা সাহসী জাতি।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
সেই দৃশ্যটা আমি এখনো ভুলতে পারি না।
আজকাল সামাজিক মাধ্যমে নানা ধরনের ছোট ছোট ভিডিও থাকে। কিছু থাকে নিছক হাসির, কিছু থাকে সামাজিক বক্তব্যনির্ভর। ছেলে-বুড়ো অনেককেই দেখি সেইসব রিলস বা শর্টসে বুঁদ হয়ে থাকতে। আমি নিজেও যখন ক্লান্ত থাকি, অল্প সময়ের জন্য মনটাকে একটু হালকা করতে চাই, এসব দেখি। কিন্তু যত কিছুই দেখি না কেন, ওই যে দৃশ্যটা, দ্রুত পায়ে শেখ হাসিনা আর তাঁর বোন হেঁটে গাড়িতে উঠছেন, পাশেই একটা সামরিক হেলিকপ্টার চালু অবস্থায় মাটিতে দাঁড়িয়ে, কিন্তু দুই বোন গিয়ে কালো জিপটাতেই উঠলেন—জাস্ট ভুলতে পারি না। বিভিন্ন মিডিয়াতে এই ঘটনার যতগুলো ভিডিও দেখেছি, সব একই রকম। একটা গাছের আড়াল থেকে কেউ একজন শক্তিশালী ক্যামেরা দিয়ে ভিডিওটি করেছেন। কে তিনি? এখন পর্যন্ত সেই ব্যক্তির পরিচয়টা আমি কোথাও পাইনি। তিনি সম্ভবত ওই সরকারের ভেতরেরই কেউ হবেন। না হলে প্রটেক্টেড ওই এলাকায় ঢুকবেন কী করে? তবে আমার এটাও মনে হয়, তিনি সে সময় বেশ ভয়ে ছিলেন। তাই গাছের পাতার আড়াল থেকেই ভিডিওটা করেছেন।
ব্যক্তিটি যে-ই হোন না কেন, যেভাবেই দৃশ্যটা ধারণ করুন না কেন, একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তিনি মানুষের মনে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছে—অতি ক্ষমতাবান ব্যক্তি, যাঁর মুখের সামান্য একটা অভিব্যক্তি হাজারো মানুষের বাঁচা-মরার কারণ হতে পারে, তাঁর মধ্যেও মৃত্যুভয় রয়েছে। তিনিও অপরাজেয় নন। ক্ষুব্ধ ও ঐক্যবদ্ধ সাধারণ মানুষ তাঁকে পরাজিত করতে পারে। জনগণ খেপে গেলে স্বৈরাচারী শাসক, তাঁর অনুগত শান্ত্রী-সামন্ত, মারাত্মক মারণাস্ত্র—সবকিছুই শুকনো পাতার মতো উড়ে যায়।
কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করে, আগস্ট ২০২৪-এর আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিটি কী? আমি বলব—জনগণের মনের ওই সাহসী প্রত্যয়টিই আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। সাধারণ মানুষ এখন বিশ্বাস করে, কোনো স্বৈরশাসকই অপরাজেয় নয়। মানুষ রুখে দাঁড়ালে লেজ গুটিয়ে তাঁরা নেংটি ইঁদুরের মতো পালিয়ে যান।
প্রাপ্তি কি কেবল এতটুকুই? আর কিছু নেই? আছে, আরও কিছু আছে। তবে সেসব প্রত্যাশার তুলনায় খুবই কম। একটু ডিটেইলে বলি।
হাসিনা ও তাঁর পারিষদবর্গ পালিয়ে যাওয়ার পর মানুষ খুব করে আশা করেছিল—এবার বুঝি একটা ভালো কিছু হবে। অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ, প্রশাসন—সব জায়গাতেই ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশের বাস্তবতায় সেসব যে এত দ্রুত হওয়া সম্ভব নয়, এটা মানুষ বুঝতে চায়নি। তারা ভেবেছে, হাসিনাকে যদি তাড়ানো সম্ভব হয়, তাহলে এসব সুশাসন কেন সম্ভব হবে না?
প্রত্যাশিত সুশাসনের পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব না হলেও তার প্রক্রিয়াটা কি শুরু করা যাবে না? সুশাসনের পথে দু-একটা পদক্ষেপ কি আমরা দিতে পারব না? এসব প্রশ্নেরও যে খুব আশাব্যঞ্জক জবাব পাওয়া যাচ্ছে, তেমনটি বলা যাবে না।
আসলে ঝামেলাটা কোথায়? আমার বিবেচনায় ঝামেলার শুরুটা হয়েছিল একেবারে শুরুতেই। জনগণের বিপুল সেই প্রত্যাশার বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ভুল মানুষের হাতে। স্বৈরশাসক বিতাড়নে জনগণ যে বিপুল ক্ষোভ ও সাহসের প্রকাশ ঘটিয়েছিল, তার উৎসটা আসলে কোথায় ছিল? সাধারণ মানুষের মনোজগতে। পুঞ্জীভূত ক্ষোভের উত্তাপে তাদের মনে দীর্ঘদিন ধরে ঘুমিয়ে থাকা চেতনা জেগে উঠেছিল। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ড. ইউনূস সেই চেতনাকে স্পর্শ করার ক্ষমতাই রাখেন না। এই দেশের সাধারণ মানুষকে তিনি চেনেন না। তিনি অন্য জগতের বাসিন্দা। তিনি গ্রামীণ ব্যাংক করেছেন, কিন্তু গ্রামের মানুষের মনটাই বোঝেন না। গ্রামের মানুষের কষ্ট বলতে তিনি সুদ করে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নেওয়াকে মনে করেন। তিনি গ্রামের মানুষের জন্য তুলনামূলক সহজ শর্তের ঋণ ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। এর বাইরে যে গরিব মানুষের আরও কিছু চাহিদা থাকতে পারে, এটা উপলব্ধির চেষ্টা তিনি করেননি। নিজে ভুক্তভোগী হওয়ার কারণে শেখ হাসিনার প্রতি তাঁর রাগ ছিল—এটা সত্য। কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্ষোভ আর তাঁর ক্ষোভ এক নয়। তাঁর ক্ষোভ ছিল—হাসিনা তাঁর বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা করেছে, সেগুলোর কারণে তাঁকে কষ্ট পেতে হচ্ছে, তাঁর সময় নষ্ট হচ্ছে, তিনি তাঁর স্বাভাবিক কাজগুলো করতে পারছেন না। তাই দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রথমেই তিনি নিজের কষ্টগুলোর নিরাময় করে নিয়েছেন। কিন্তু জনগণের মধ্যেকার যে ভোট, ভাত, নিরাপত্তা, সুশাসন ইত্যাদির প্রত্যাশা, সেগুলো বাস্তবায়নে তিনি তেমন কোনো তাড়া অনুভব করেননি।
আমাদের জন্য বেদনার আরেকটা জায়গা হলো—তিনি নিজে যেমন সাধারণ মানুষের দুঃখ, বেদনা, চাহিদা থেকে দূরবর্তী জায়গায় অবস্থান করেন, তিনি যাঁদের নিয়ে কেবিনেট গঠন করেছেন, তাঁদের অধিকাংশই তাঁর কাছাকাছি চরিত্রের। মোদ্দা কথা, এলিট শ্রেণির কতিপয় বয়স্ক ব্যক্তিকে নিয়ে এসে পুরো কেবিনেটকেই একটা প্রবীণ ক্লাবে পরিণত করেছেন। এদের সততা নিয়ে কোনো প্রশ্ন যদি না-ও করি, যোগ্যতা নিয়ে কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাবে। আমি একেবারে শুরু থেকেই এই লোকগুলোর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম। পরে দেখা গেল সাংবাদিক নূরুল কবীরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস নিজেও বিষয়টা স্বীকার করলেন। এই স্বীকারোক্তির মাধ্যমে তিনি নিজে হয়তো মহৎ সাজার চেষ্টা করলেন, কিন্তু উপলব্ধি করতে পারলেন না তাঁর কথায় দেশের মানুষ কতটা উদ্বেগের মধ্যে পড়ে গেছে! মানুষ আতঙ্ক বোধ করছে—দেশ পরিচালনার দায়িত্ব কতিপয় আনাড়ি লোকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
কারা করেছেন এই কাজটা? প্রথমত, গণ-অভ্যুত্থানের কৃতিত্বের দাবিদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র। বিষয়টা ইউনূস সাহেবও স্বীকার করেছেন, বলেছেন, ছাত্ররাই নাকি তাঁর প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই তিনি প্রথমে দুজন এবং পরে আরও একজন ছাত্রকে তাঁর কেবিনেটে জায়গা করে দিয়েছেন। আমার মনে হয় এটা ছিল ড. ইউনূস সরকারের একটা বড় ভুল। অথবা কে জানে, আমরা যেটাকে ভুল বলে বিবেচনা করছি, ইনটেনশনালি তিনি সেটাই করতে চেয়েছেন!
ছাত্রদের উপদেষ্টা পরিষদে নেওয়ার কারণে পুরো ছাত্রসমাজের মধ্যে আন্দোলন চলাকালে যে ঐক্যটা ছিল, সেটা নষ্ট হয়ে গেছে। প্রথমত, অনেক ছাত্রের মধ্যেই প্রশ্ন জেগেছে—কোন পদ্ধতিতে এই তিনজনকে নির্বাচন করা হলো? তাঁরাই কি সবচেয়ে যোগ্য? তাঁরা যদি হতে পারেন, তাহলে আমি নই কেন? তাঁরা কি আমার চেয়েও যোগ্য? পুরো আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রও নিহত হয়নি, তাহলে কোন বিবেচনায় তিনজন উপদেষ্টা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই নিতে হবে? প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্য কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন বিবেচনায় নেওয়া হলো না?
এসব প্রশ্নের কোনোই জবাব নেই। এই ঘটনায় ছাত্রদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হলো দুই ধরনের। কেউ কেউ হতাশ হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লেন। আবার কেউ কেউ স্থানীয় পর্যায়ে ‘সমন্বয়ক’, ‘জুলাই যোদ্ধা’ বা ‘ছাত্র’ পরিচয়ে টু-পাইস কামানোতে মন দিলেন। অনেকে আবার ঝাঁপিয়ে পড়লেন তদবির-বাণিজ্যে। এসব ঘটনার প্রতিফলন দেখা যেতে থাকল ওইসব ছাত্রদের চেহারা-ছবি, আচার-আচরণ বা কথাবার্তাতেও।
ছাত্রদের আরও বড় একটা ক্ষতি ড. ইউনূস করলেন তাঁদেরকে একটা রাজনৈতিক দল গঠনে প্ররোচিত করে। ড. ইউনূসের কথাবার্তায় এবং ছাত্রনেতাদের আচার-আচরণে সাধারণ মানুষের বুঝতে কষ্ট হলো না, এটা আসলে একটা কিংস পার্টি ছাড়া আর কিছু নয়। ফলে কিংস পার্টি হিসেবে তারা যত বেশি প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধা পেতে থাকল, তার আনুপাতিক হারে কমতে থাকল তাদের প্রতি মানুষের সমর্থন। এই প্রবণতার সর্বশেষ নমুনা আমরা দেখতে পেলাম ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এনসিপির ইশতেহার ঘোষণার সমাবেশে। এর ৫০০ গজ দূরে শাহবাগে একই সময়ে বিএনপির ছাত্রসংগঠনের সভা হচ্ছিল। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে তুলনাটা এমনিতেই এসে গেছে। বিষয়টা এনসিপির জন্য আর যাই হোক, সম্মানজনক ছিল না।
ছাত্রদের প্রতি সাধারণ মানুষের নেতিবাচক মনোভাব দারুণভাবে বেড়ে যায় গুলশানে এক সাবেক এমপির বাসায় চাঁদাবাজির ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর। তখন একের পর এক এ ধরনের আরও খবর আসতে থাকে সারা দেশ থেকেই।
মাঝে মাঝে আমার সন্দেহ হয়—ড. ইউনূস কি ইচ্ছা করেই ছাত্র ও তরুণসমাজকে মানুষের কাছে বিতর্কিত করে তুলেছেন? এই ছেলেমেয়েরা বুঝতে না পেরে সেই ফাঁদে পা দিয়েছেন? প্রশ্ন করতে পারেন—ড. ইউনূসের এতে লাভটা কী? একটা কথা ভাবুন—ড. ইউনূসকে যত দিন ধরে চেনেন, বলুন তো তিনি আসলে কার লোক? তিনি আসলে পশ্চিমা বিশ্বের লোক। তাদের পারপাসই সার্ভ করেছেন তিনি এত বছর। আর এই পশ্চিমা বিশ্ব সবচেয়ে ভয় পায় তরুণসমাজের আপরাইজিংকে। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রীদের যে নির্মমভাবে কিছুদিন আগে সেখানকার সরকার দমন করেছে, সেটাও কিন্তু ঠিক ওই কারণেই। এখনো তার রেশ চলছে। এখন আমাদের এখানে ছাত্র-তরুণসমাজের প্রতি সাধারণ জনগণ যদি একবার বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠতে পারে, সেটার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে। ভবিষ্যতে তাঁদের ওপর সাধারণ মানুষ আর আগের মতো আস্থা রাখবে না। অনেকে হয়তো বলবেন আমি অতিমাত্রায় সন্দেহপ্রবণ হয়ে গেছি। হতে পারে, কিন্তু বিষয়গুলোকে আমি সেভাবেই চিন্তা করি। সন্দেহ করাটাকে আমি একজন সাংবাদিকের স্বাভাবিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বলেই বিবেচনা করি।
তাহলে কি ভালো কিছু নেই? ভালো কিছুই কি হয়নি এই এক বছরে? আমি তা বলছি না। বেশ কিছু সেক্টরে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেছে। বিশেষ করে ব্যাংকিং সেক্টরে অবাধ লুটপাট, বিদেশে লাগাতার অর্থ পাচার—এসব ক্ষেত্রে দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে। আর্থিক খাতে মানুষের আস্থা ফিরে এসেছে। তবে দুর্নীতি শুরুর দিকে একটু থমকে থাকলেও এখন আবার ধীরে ধীরে গতি ফিরে পাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো হয়নি। ভালো করার চেষ্টা সরকারের আছে বলেও মনে হয় না। ফলে উল্টো মব কালচার যেন একটা প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা পেয়েছে। যাকে ইচ্ছা তাকে একটা ট্যাগ লাগিয়ে হেনস্তা করা হচ্ছে, কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। পুলিশ দেখেও না দেখার ভান করছে। কারণ, দেখতে বা ফেরাতে গেলেই বিপদ। পটিয়ার ওসির মতো কে আর শখ করে ক্লোজড হতে চান!
তবে আমার বিবেচনায় সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থায়। ১১টি সংস্কার কমিশন করা হয়েছে, কিন্তু এখানে শিক্ষাবিষয়ক কোনো কমিশন নেই। কেন নেই—তার কোনো জবাবও নেই। প্রতিবছর বছরের একেবারে প্রথম দিন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একটা বই উৎসব হয়। অনেক বছর ধরেই এটা হয়ে আসছে। কিন্তু এবার সেটা হয়নি। সরকার ঘোষণা দিয়েই বন্ধ রেখেছে। না রেখে আসলে উপায়ও ছিল না, কারণ তারা বেশির ভাগ বই ছাপতেই পারেনি। আবার উচ্চতর শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা গেছে ভিন্ন ধরনের সংকট। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে সমন্বয়ক বা বৈষম্যবিরোধী পদবি অর্জনের আগ্রহ বেড়ে গেছে। ভালো রেজাল্ট করার চেয়ে তাঁরা সমন্বয়ক হওয়াকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন।
এই এক বছরে মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বড় প্রত্যাশাটি থেকে অস্পষ্টতার চাদর যেন সরছেই না। সেটা হচ্ছে—নির্বাচন, মানুষের ভোট দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা। নির্বাচন কবে হবে, তা কেউ জানে না। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি আরও ছয় মাস আগে থেকেই নির্বাচনের একটা রোডম্যাপের দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু কোনোই কাজ হয়নি। গত ঈদের আগে আগে জাতির উদ্দেশে ভাষণে ড. ইউনূস অবশ্য জানিয়েছিলেন এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হতে পারে। ঠিক পরের সপ্তাহেই লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণায় বলা হলো সংস্কার ইত্যাদি সব ঠিকঠাকমতো হলে রোজার এক সপ্তাহ আগেও নির্বাচন হতে পারে। সে হিসাবে আগামী ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে? না, এটাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। এই যে অনিশ্চয়তা, এটাকেই সবচেয়ে বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করছে অনেকে। তারা প্রকারান্তরে ড. ইউনূসের ‘নিয়ত’ নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করছে।
সংস্কার কার্যক্রম অবশ্য একটা শেপ পেতে শুরু করেছে। কিন্তু সেখানেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মতবিরোধ রয়ে গেছে। কয়েকটা ইস্যুতে জামায়াত ও এনসিপি তো রীতিমতো কঠোর অবস্থানে রয়েছে। বলছে—সংস্কার ও বিচার সম্পন্ন না হলে তারা নির্বাচনেই যাবে না। দুই বা ততোধিক দল নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিলে, শেষ পর্যন্ত এটাকে কেন্দ্র করে নির্বাচনকে আরও পিছিয়ে দেওয়ার একটা অজুহাত পেয়ে যেতে পারেন ড. ইউনূস। এ রকম কিছু হলে দেশে একটা গৃহযুদ্ধও লেগে যেতে পারে। এই মুহূর্তে রাজনীতি করতে না পারলে আওয়ামী লীগও সেই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা পালিয়ে দেশের বাইরে থাকলেও দলটির অগণিত কর্মী-সমর্থক এখনো এই মাটিতেই আছেন। সরকারের কোন দুর্বলতাকে তাঁরা কখন কীভাবে গ্রহণ করবেন—সেটাও হয়তো সময়েই টের পাওয়া যাবে।
এতকিছুর পরও, লেখার শুরুতে যে ভিডিও ক্লিপটার কথা বলেছিলাম, সেটা কিন্তু আমি প্রায়ই দেখি। মনের ভেতর সেই সাহসটা আবারও স্পর্শ করতে পারি। মনে হয় আসলেই আমরা সাহসী জাতি।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে রবার্ট গাব্রিয়েল মুগাবে ছিলেন একসময়ের মহানায়ক। তবে স্বাধীনতার পর ক্ষমতার মোহ ও স্বৈরতান্ত্রিক আচরণে তিনি নিজ জাতির মানুষের কাছে ঘৃণিত এক শাসকে পরিণত হন। পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে।
২ ঘণ্টা আগেএক বছর আগে ৫ আগস্ট বাংলাদেশে অবিশ্বাস্য, অথচ বাস্তব এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল, যা নিশ্চয়ই ইতিহাস হয়ে থাকবে। কোনো বড় রাজনৈতিক দল বা সংগঠিত কোনো রাজনৈতিক শক্তির ডাকে নয়, মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্র-তরুণদের কোটা নিয়ে ক্ষোভের পরিণতিতে শুরু হওয়া আন্দোলনে একটি দীর্ঘকালীন...
২ ঘণ্টা আগেঅন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। গত বছর জুলাই-আগস্টে দেশে গড়ে ওঠা ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে। তখন সাধারণ মানুষের মনে একধরনের ইতিবাচক প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল।
১ দিন আগেবর্ষাকাল এলেই যেন ঢাকায় জলাবদ্ধতা ভর করে বসে। জলাবদ্ধতা যখন এই শহরের ঘাড়ে চেপে বসে, তখন এই নগরের মানুষকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আজ এই শহরের এত সমস্যার মুখোমুখি হতে হতো না যদি তারা অপরিকল্পিত নগরায়ণের দিকে না ঝুঁকত, যদি নদী কিংবা খালের স্থান দখল না করে কোনো স্থাপনা করার পরিকল্পনা করত।
১ দিন আগে