Ajker Patrika

অন্তর্বর্তী সরকারের সালতামামি

বৈষম্য নিরসনে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই

অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যে রাজনৈতিক দলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, সেই এনসিপির একশ্রেণির নেতা-কর্মী চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, মব কালচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। এতে সরকার ও এনসিপি বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইমেজ দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। তাদের ঐক্যও নষ্ট হয়ে গেছে। এই অবস্থা আরও কিছুদিন চলতে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

ড. এম এম আকাশ
বৈষম্য নিরসনে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। গত বছর জুলাই-আগস্টে দেশে গড়ে ওঠা ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে। তখন সাধারণ মানুষের মনে একধরনের ইতিবাচক প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল। তারা আশা করেছিল, অতীতের ব্যর্থতা সংশোধন করে দেশ নতুনভাবে যাত্রা শুরু করবে। কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নয়ন অর্জিত হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে, যার ফল ভোগ করতে পারবে দেশের প্রত্যেক নাগরিক।

ছাত্র-জনতার এই আন্দোলন ছিল বিস্ময়কর। অতীতের যেকোনো সরকারবিরোধী আন্দোলনের চেয়ে গত বছরের আন্দোলন ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এই আন্দোলনে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের সমর্থন থাকলেও মাঠে সক্রিয় ছিলেন শিক্ষার্থীরা, যাদের দৃশ্যত কোনো রাজনৈতিক পরিচিতি ও অভিলাষ ছিল না। সাধারণ মানুষ মনে করেছিল, আন্দোলনের মাধ্যমে যে নতুন সরকারের সূচনা হয়েছে, তা দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন করবে। অনেকেই এটাকে সাধারণ কোনো গণ-অভ্যুত্থান না বলে ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’, এমনকি ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলে আখ্যায়িত করেন।

অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ও অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই এই প্রত্যাশা সংশোধন করেছেন। তাঁরা এখন বুঝতে পেরেছেন ১৯৬৯ ও ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের তুলনায় ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান ছিল কম বিস্তৃত, কম গভীর এবং নেতৃত্বও ছিল মতাদর্শগতভাবে বিভক্ত এবং স্বতঃস্ফূর্ত। এখন সাধারণ অভিমত হচ্ছে, জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ছিল ‘মেটিকুলাসলি ডিজাইন্ড গণ-অভ্যুত্থান’। কারা এই ডিজাইন করেছিলেন, তা-ও এখন প্রকাশ পাচ্ছে। এই আন্দোলনের নেতিবাচক লক্ষ্যটি ছিল, ‘এক দফা এক দাবি, হাসিনা তুই কবে যাবি’। কিন্তু হাসিনা চলে যাওয়ার পর তাদের ঐক্য আর থাকল না! ফলে সরকারকে যাঁরা ক্ষমতায় বসিয়েছেন, তাঁরাই সরকারকে নানা পরস্পরবিরোধী চাপ দিচ্ছেন। এই বাস্তব সীমাবদ্ধতার পটভূমিতে আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের বিগত এক বছরের সাফল্য-ব্যর্থতা দুইভাবে মূল্যায়ন করতে পারি।

এর মধ্যে একটি পদ্ধতি হচ্ছে জনমনে সৃষ্ট উচ্চাশা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের গৃহীত কর্মপরিকল্পনার মূল্যায়ন। কেউ কেউ মনে করেন, একটি অনির্বাচিত সরকারের জন্য এক বছর মেয়াদকালও খুব স্বল্প সময় নয়। এর মধ্যেই সরকারের অনেক কিছু করার ছিল, যা তারা করতে পারেনি। সমালোচকদের অভিমত হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার গণপ্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করেন, বিগত এক বছরে দেশের রাজনীতি, শাসনকাঠামো বা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কি বড় কোনো পরিবর্তন হয়েছে? শাসকদের শ্রেণি চরিত্রের কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে? শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মূল উপজীব্য ছিল বৈষম্য নিরসন করা, সে ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়েছে কি? সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকট কি দূর হয়েছে, এমনকি গণতন্ত্র কি প্রকৃতই আরও এগিয়েছে?

আমার উত্তর, এসব ক্ষেত্রে তেমন কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়নি। শ্রেণিশোষণ, সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন অত্যন্ত কঠিন কাজ। এটা মূলত রাজনৈতিক কাজ। জনগণকে সচেতন, সংগঠিত ও উদ্বুদ্ধ করে সেটা করতে হবে। এ জন্য নতুন রাজনৈতিক গণ-ক্ষমতাকাঠামো তৈরি করতে হতো। কিন্তু বিগত এক বছরে সে ধরনের কোনো উদ্যোগ আমরা প্রত্যক্ষ করিনি। জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার মতো কোনো রাজনৈতিক সরকার এটি নয়।

সরকারের মধ্যে এনসিপিকে এ রকম একটি শক্তিতে পরিণত করতে যাঁরা চেয়েছিলেন, তাঁরা পদত্যাগ করে মাঠের রাজনীতিতে নেমেছেন। কেউ যদি প্রত্যাশা করে থাকেন যে, অন্তর্বর্তী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এ ধরনের পরিবর্তন সাধন করবেন, তাহলে সেটা ভুল হবে। কারণ, এটা অতিপ্রত্যাশা, কাজেই তা পূরণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আর যাঁরা একে বিপ্লবে পরিণত করতে চেয়েছিলেন, তাঁরাও ব্যর্থ হয়েছেন। যেদিন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি মেনে নিয়ে সাংবিধানিক পদ্ধতির অধীনেই অন্তর্বর্তী সরকার তৈরি হয়েছে, সেদিনই বোঝা গেছে এটি কোনো বিপ্লবী সরকার নয়।

সীমিত প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সীমিত প্রত্যাশাগুলো ছিল—আন্দোলন করতে গিয়ে যাঁরা নিহত হলেন, আন্দোলন দমনকালে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যেসব সদস্য নিহত হলেন, তাঁদের সবার পূর্ণাঙ্গ এবং গ্রহণযোগ্য একটি তালিকা প্রণয়ন করা। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের কারণ এবং কে হত্যাকারী, তা নির্ণীত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমরা সেই তালিকা ও বিবরণ এখনো পাইনি এবং ভবিষ্যতে তালিকা পেলেও বিবরণ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এটা ছিল মানুষের ন্যূনতম একটি প্রত্যাশা। এই প্রত্যাশা পূরণ হওয়া উচিত ছিল। অন্যথায় ভবিষ্যতে সব ধরনের আন্দোলনে নিহত ও আহতদের নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। আমি একে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের একটি বড় ব্যর্থতা বলেই মনে করি।

দ্বিতীয় প্রত্যাশা ছিল, অতীতে অর্থনৈতিক এবং শাসনক্ষমতা পরিচালনাকালে যাঁরা অপরাধী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছেন, বিশেষত সরকার কর্তৃক গঠিত শ্বেতপত্রে যাঁদের ব্যাপারে ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করা হয়েছে, তাঁদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট শাস্তিমূলক দৃষ্টান্ত স্থাপন। যদিও শ্বেতপত্রে অপরাধীদের নাম উল্লেখ করা হয়নি, কিন্তু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইঙ্গিত সেখানে যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। এদের ব্যাপারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে না। যাঁরা বিগত সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে অর্থ লোপাট করেছেন বা অন্যান্য আর্থিক ও সামাজিক অপরাধ করেছেন, তাঁদের তালিকা কেন প্রকাশিত হলো না? অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচন করা প্রয়োজন ছিল। একই সঙ্গে দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎকৃত অর্থ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ, আমি বলতে চাইছি, সাড়ে ১৫ বছর সময়ে যাঁরা আর্থিক, রাজনৈতিক ও বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যাঁরা সরাসরি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়দের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন ছিল। হয়তো বলা হবে, অপরাধীদের অনেকেই এখন জেলে বন্দী আছেন। কিন্তু জেলে বন্দী থাকলেও তাঁদের বিচারকাজ চলছে মন্থর গতিতে। হয়তো ভবিষ্যতে একসময় তাঁরা খালাস পেয়ে যাবেন। আবারও নতুন করে অপরাধকর্ম শুরু করবেন। বিভিন্ন সেক্টরে যাঁরা বড় বড় অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হবেন, তাঁদের জন্য প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিগত সরকারের আমলে যাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে মারাত্মক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের সবাইকে কি গ্রেপ্তার করা হয়েছে? অর্থাৎ, সব অভিযুক্তের বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করে নিরপরাধীদের খালাস এবং অপরাধীদের শাস্তির নিশ্চয়তা বিধান এখনো সম্ভব হয়নি। সম্ভবত পক্ষপাতহীন, চাপহীন স্বচ্ছ বিচারের ক্ষমতা বর্তমান সরকার এবং প্রশাসনের নেই।

আরেকটি প্রত্যাশা ছিল, পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার করা যাবে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার সমতুল্য ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। পাচারকৃত এই অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে, তা-ও আমরা জানতে পারছি না। আর্থিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অপরাধীদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হলো তো নাই-ই, উপরন্তু কার অপরাধ কতটা, তা-ও জানা গেল না। ফলে বিচারের মাধ্যমে তাঁদের অন্তত কিছু শাস্তিদানের বিষয়টিও অনিশ্চিত রয়ে গেল।

হত্যার অভিযোগ এবং অর্থনৈতিক অপরাধের অভিযোগ এক জিনিস নয়। সেখানেও তালগোল পাকিয়ে ফেলা হয়েছে। কে অসৎ ব্যবসায়ী, কে অসৎ আমলা, কে অসৎ রাজনীতিবিদ, কে দুর্নীতি করেছে, কে সহায়তা করেছে, কে লাভবান হয়েছে—এগুলো তদন্ত করে প্রতিষ্ঠা না করে হরেদরে অভিযোগ করে অসংখ্য দুর্বল মামলা করা এই সরকারের আরেকটি ব্যর্থতা। এ জন্য ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে তারা যে বিচার চাইবে বা করবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর করলেও তারা পক্ষপাতমূলক বিচার করতে পারে। এ ধরনের অসম্পূর্ণ ঝুলন্ত বিচার মানুষ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে প্রত্যাশা করেনি। ফলে তারা হতাশ হয়েছে।

তাই সাধারণ মানুষ চাইছে অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এমন রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করুক, যারা এই অসমাপ্ত কাজগুলো দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। না হলে জনগণকে আরেকটি অপেক্ষাকৃত সচেতন গণ-অভ্যুত্থান গড়ে তুলতে হবে।

অর্থনৈতিক সাফল্য বা ব্যর্থতাসমূহ

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য দুটি চ্যালেঞ্জ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি স্বল্পতম সময়ের মধ্যে কমিয়ে এনে সাধারণ মানুষের জন্য স্বস্তি নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়টি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়ানো। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের স্থবিরতা কাটানো এবং প্রবৃদ্ধি যতটুকু পারা যায়, তা ধরে রাখাও ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।

সর্বশেষ খবর হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। তবে প্রত্যাশিত মাত্রায় নয়। আর সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও খাদ্যপণ্য, বিশেষ করে চালের দাম এখনো সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি যেভাবে কমেছে, তাতে ধনী লোকদের জন্য কিছুটা সুবিধা হলেও দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য অসুবিধা বেড়েছে। কাজেই মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমার কারণে সাধারণ মানুষের তেমন কোনো উপকার হয়নি। একই সঙ্গে যাঁরা কর্মরত আছেন, তাঁদের মজুরি বৃদ্ধির সঙ্গে মূল্যস্ফীতির সমন্বয় ঘটেনি। মূল্যস্ফীতি যেভাবে বেড়েছে, শ্রমিক-কর্মচারীর মজুরি/বেতন সেভাবে বাড়েনি। ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। যাঁরা স্বনিয়োজিত পেশায় নিযুক্ত ছিলেন, অর্থনীতিতে মন্দাবস্থার কারণে তাঁদের বিক্রি ও আয় কমেছে। অর্থাৎ, সামষ্টিক দারিদ্র্য বেড়েছে, বেকারত্বের হার বেড়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধিও অর্ধেকে নেমে এসেছে। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা বজায় রাখার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হয়েছে।

বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার অনেকটা বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা বলেছিলেন, আমরা আইএমএফের নির্দেশনার ভিত্তিতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করব না। যদি মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিনিময় হার অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস-বৃদ্ধি শুরু হয়, তাহলে আমরা বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করব। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার অনেকটা বাজারভিত্তিক করার পর প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ১২২-১২৩ টাকায় স্থির হয়েছিল। মাঝে ১২৫ টাকায় ওঠার পর আবারও মার্কিন ডলারের বিনিময় হার কমেছে। আগে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ১১০ টাকায় স্থির করে রেখেছিল। তার অর্থ হচ্ছে, মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আমাদের আমদানি ব্যয় বেড়েছে, যা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে।

অন্যদিকে এখন বাজারে জোগান বৃদ্ধিজনিত কারণে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে মার্কিন ডলার কিনে তার দাম আবার ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। আগে অস্বাভাবিক বৃদ্ধির বিরুদ্ধে, হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে বললেও এখন আইএমএফ কিন্তু কিছু বলছে না। তাই আমার প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন ডলারের ভিত্তিমূল্য কীভাবে নির্ধারণ করবে? প্রতি মার্কিন ডলারের দাম কত টাকার নিচে নামলে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে মার্কিন ডলার কিনে নেবে এবং কত টাকার ওপরে উঠলে রিজার্ভ থেকে মার্কিন ডলার বাজারে ছাড়বে, তা কীভাবে ঠিক করা হবে? এগুলো এখনো স্পষ্ট করে বলা হয়নি।

সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্কারোপ করেছে। কোনো কোনো দেশ এই শুল্কহার আলোচনার মাধ্যমে যৌক্তিকভাবে কমিয়ে আনতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো সাফল্য প্রদর্শন করতে পারেনি। যেমন—ভিয়েতনামের রপ্তানি পণ্যের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রাথমিক পর্যায়ে ৪৬ শতাংশ বাড়তি শুল্কারোপ করলে দেশটি আলোচনার মাধ্যমে বাড়তি শুল্কহারের পরিমাণ ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। ভবিষ্যতে ভিয়েতনামকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান ১৫ শতাংশসহ মোট ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। আর বাংলাদেশের ওপর আরোপিত বাড়তি শুল্কহারও কমিয়ে ২০ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান ১৫ শতাংশসহ মোট ৩৫ শতাংশ শুল্ক প্রদান করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে ভিয়েতনাম হচ্ছে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকসামগ্রী রপ্তানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। বাংলাদেশ বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় শীর্ষস্থানে রয়েছে। ভিয়েতনাম তৃতীয় স্থানে রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে ভিয়েতনামের তৈরি পোশাক রপ্তানি গ্যাপ খুবই সামান্য।

রাজনীতিতে পক্ষপাতিত্ব

অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যে রাজনৈতিক দলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, সেই এনসিপির একশ্রেণির নেতা-কর্মী চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, মব কালচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। এতে সরকার ও এনসিপি বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইমেজ দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। তাদের ঐক্যও নষ্ট হয়ে গেছে। এই অবস্থা আরও কিছুদিন চলতে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাতন্ত্র্য ও নিরপেক্ষতা দৃঢ়ভাবে রক্ষা করা উচিত। এ দেশে কিংস পার্টি স্ট্র্যাটেজি অতীতে গণতন্ত্র আনতে পারেনি। জিয়া ও এরশাদ আমলে তা প্রমাণিত হয়েছে।

তাই আশু করণীয় হবে নিজের নিরপেক্ষ অবস্থান ও ন্যূনতম সংস্কার নিশ্চিত করে স্বল্প সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। জনগণের তখন সুযোগ থাকবে পুরোনো স্বৈরাচারকে ফেরত না এনে আরও গণতান্ত্রিক কোনো সরকারকে বেছে নেওয়ার। সেই পথ ও সুযোগ আপাতত ঠিকমতো করে দিতে পারলে সরকারকে ফুল মার্ক দিতে হয়তো জনগণের কোনো আপত্তি থাকবে না।

লেখক: অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

অনুলিখন: এম এ খালেক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘোষণা কিশোরগঞ্জের আইনজীবীর, ফেসবুকে ঝড়

‘বিএনপি করি, শেখ হাসিনার আদর্শে বিশ্বাসী’: সেই ইউপি সদস্য গ্রেপ্তার

অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি-পদোন্নতির ক্ষমতা পাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্ট

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর রাশিয়ার তেল কেনা স্থগিত করল চীন

পলাতক আসামিরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না, আরপিও সংশোধন অনুমোদন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

মৃতের শরীরে লবণ

সম্পাদকীয়
মৃতের শরীরে লবণ

গাজীপুরের টঙ্গীতে এক ছিনতাইকারীকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল এলাকাবাসী। দুজন মিলে মোবাইল ছিনতাই করতে গিয়েছিল, তাদের একজন পালিয়ে গিয়েছিল, অন্যজনকে ধরে রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা।

টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়। যদি প্রতিদিন ২০টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে তা প্রতিরোধ করা হয় না কেন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত লোকবল কি নেই? ছিনতাইয়ের স্পটগুলো কি চিহ্নিত করা হয়েছে? এই দায় কার ওপর বর্তায়? যদি ছিনতাই রোধ করার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হতো এবং ছিনতাইকারীদের উপযুক্ত শাস্তি হতো, তাহলে এ পথ কেউ মাড়াত না। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে সংশ্লিষ্টরা। আর তাই এখনো প্রতিদিন গড়ে ২০টা করে ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে।

ছিনতাই করার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নয়। কিন্তু উত্তেজিত জনতা সেই সাজাই দিয়েছে ছিনতাইকারীকে। জনতা ছিনতাইকারীকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেনি, বিচার চায়নি, বরং হাত-পা রশি দিয়ে বেঁধে বেদম প্রহার করেছে। এতটাই মেরেছে যে ঘটনাস্থলেই সে নিহত হয়েছে। নিহত হওয়ার পর মৃতদেহে লবণ ছিটিয়ে উল্লাস করেছে জনতা!

আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এই দৃষ্টান্ত মোটেই সুখকর কিছু নয়। যারা হত্যা করে, তারাই হত্যাকারী। এই হত্যার দায় কি এই উল্লসিত জনতা দেবে? প্রশ্ন জাগে, মানুষ কেন এতটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠল? কেন একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে? আইনের পথটি কি তাদের জানা নেই?

জানা আছে নিশ্চয়। কিন্তু দিনের পর দিন ছিনতাইকারীদের শাস্তি হচ্ছে না দেখে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। পুলিশ কিংবা নিরাপত্তারক্ষীরা যদি সতর্ক হয়ে ছিনতাইকারীদের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে পারত, ছিনতাইকারীরা যদি তাদের অপরাধের সাজা পেত, তাহলে হয়তো মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিত না। কিন্তু এখন এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যদি কেউ কাউকে ছিনতাইকারী বলে পেটাতে শুরু করে, তাহলে সমবেত জনতার প্রত্যেকেই খায়েশ মিটিয়ে পেটাতে থাকবে। কারও সাতে-পাঁচে নেই—এমন একজন নিরীহ মানুষও এই মবের হাতে প্রাণ হারাতে পারে।

ধরা যাক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হয়ে ছিনতাইকারীদের ধরতে শুরু করল, তাতে কি জনতার এই উন্মত্ততা কমে যাবে? মনে হয় না। হিংস্রতা নিবারণের জন্য পারিবারিক শিক্ষা, সচেতনতা ইত্যাদির প্রয়োজন পড়ে। সৎ গুণাবলি তৈরি করতে হলে তো সেটার চর্চা দরকার। সেই চর্চাই তো কমে গেছে। একজন মানুষের মনে যদি হিংসা, ঘৃণা, ক্ষোভ জমা হতে থাকে, কমে যেতে থাকে ভালোবাসা, মানবতা—তাহলে সে মৃত মানুষের লাশ নিয়ে উল্লাসই করবে! এ এক ভয়াবহ বাস্তবতা!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘোষণা কিশোরগঞ্জের আইনজীবীর, ফেসবুকে ঝড়

‘বিএনপি করি, শেখ হাসিনার আদর্শে বিশ্বাসী’: সেই ইউপি সদস্য গ্রেপ্তার

অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি-পদোন্নতির ক্ষমতা পাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্ট

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর রাশিয়ার তেল কেনা স্থগিত করল চীন

পলাতক আসামিরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না, আরপিও সংশোধন অনুমোদন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

এ যুগের ভূখণ্ড দখলের লড়াই

রাজিউল হাসান
পুতিনের আবারও পরাক্রমশালী হয়ে ওঠার স্বপ্ন বরাবরই প্রতিবেশীদের জন্য বড় শঙ্কা তৈরি করছে। ছবি: সংগৃহীত
পুতিনের আবারও পরাক্রমশালী হয়ে ওঠার স্বপ্ন বরাবরই প্রতিবেশীদের জন্য বড় শঙ্কা তৈরি করছে। ছবি: সংগৃহীত

মধ্যযুগে রাজা-বাদশাহ-সম্রাটরা গায়ের জোরে দুর্বল রাজ্যগুলোকে দখলে নিতেন। রাজ্য দখলের সেসব লড়াইয়ে বেঘোরে প্রাণ হারাত হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। সে যুগ গত হয়েছে বহু আগে। আধুনিক যুগে রাজ্য গলাধঃকরণ দুঃস্বপ্নেও কেউ কল্পনা করতে চাইবে না। কিন্তু সেই বিষয়টিই ইউক্রেনের জন্য বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। ২০১৪ সালের যুদ্ধে দেশটির ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে নেয় রাশিয়া। প্রথমে সামরিক শক্তির জোরে উপদ্বীপটি দখল করা হয়েছে, তারপর গণভোট দিয়ে সেই দখলকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

এবার ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চল মোটামুটি দখলে চলে গেছে রাশিয়ার কাছে। এখন যুদ্ধ থামাতে এই অঞ্চলকে রাশিয়ার কাছে সমর্পণের শর্ত হাজির করা হয়েছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির কাছে। ক্রিমিয়া দখলের সময় রাশিয়ার পাশে কেউ ছিল না। বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রও কড়া অবস্থান নিয়েছিল মস্কোর বিরুদ্ধে। তারপরও ঠেকানো যায়নি। এবার অবস্থা ভিন্ন। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এখন ইউক্রেনের বিষয়ে খানিকটা বৈরী মনোভাবাপন্ন। তাঁর তরফ থেকেই দনবাস সমর্পণের প্রস্তাব গেছে ইউক্রেনের কাছে। ফলে এবারও যে রাশিয়া দনবাস দখল করে নেবে, সে ব্যাপারে আপাতত কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু জেলেনস্কির জন্য এই যুদ্ধ যেমন বড় চাপ, একইভাবে দনবাস সমর্পণ হবে তাঁর জন্য রাজনৈতিক আত্মহত্যা।

রাশিয়া-ইউক্রেনের বর্তমান অবস্থার কারণ অনুসন্ধান করতে হলে কিছুটা পেছন ফিরে তাকাতে হবে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর ইউক্রেনের স্বাধীন দেশ হিসেবে পথচলা শুরু হয়। কিন্তু ‘পৃথিবীর রুটির ঝুড়ি’খ্যাত দেশটির বড় দুর্ভাগ্য, তারা এক পরাশক্তির প্রতিবেশী। প্রতিবেশী শক্তিশালী ও ভালো হলে কিছু সুবিধা অবশ্যই পাওয়া যায়। কিন্তু প্রতিবেশী যদি বৈরী হয়, তাহলে যেকোনো দেশের জন্যই একসময় তা বড় ধরনের হুমকি হয়ে ওঠে।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো আবার পরাক্রমশালী হয়ে ওঠার স্বপ্ন বরাবরই প্রতিবেশীদের জন্য বড় শঙ্কা তৈরি করছে। তার ওপর ইউক্রেনের সাম্প্রতিক ইতিহাস ঘাঁটলে পরিষ্কার হয়ে যায়, দেশটির বেশির ভাগ রাজনীতিকেরই মনোযোগ রাশিয়ার মতো পরাক্রমশালী প্রতিবেশীকে নিজের পক্ষে রাখা নয়, যেকোনো মূল্যে তাকে ঠেকানো। বিশেষ করে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি দেশের প্রতিরক্ষার কথা বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোয় যোগ দিতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। তাঁর এই প্রত্যাশা আরও চড়িয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কিন্তু রাশিয়া তো তার দোরগোড়ায় ন্যাটোর ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন মানবে না। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। জেলেনস্কির তৎপরতার ছুতোয় ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ফের ইউক্রেনে তথাকথিত রুশ অভিযান শুরু হয়, যা এখনো চলছে।

বিবিসি, সিএনএনসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য বলছে, গত প্রায় চার বছরে রাশিয়া ইউক্রেনের এক-পঞ্চমাংশ এলাকা দখল করে নিয়েছে। দনবাস অঞ্চলের সিংহভাগ এখন রুশ নিয়ন্ত্রণে। ইউক্রেনের লুহানস্ক, দোনেৎস্ক এবং কৃষ্ণসাগর-তীরবর্তী মারিউপোল বন্দর নিয়ে এই অঞ্চল গঠিত। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দনবাস ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার হাতে গেলে ক্রিমিয়ার সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ সৃষ্টি হবে। এ কারণেই রাশিয়ার জন্য এলাকাটি গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু জেলেনস্কি এই অঞ্চল সমর্পণ করতে নারাজ। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার প্রতি কিছুটা হলেও নমনীয়। যুদ্ধ থামাতে তিনি রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ নানা হুমকি দিয়েছেন, রুশ তেল না কিনতে ইউরোপীয় মিত্র এবং ভারত ও চীনকে বারবার সতর্ক করে যাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু এখন পর্যন্ত মস্কোর বিরুদ্ধে বড় কোনো পদক্ষেপ তিনি নেননি। বরং তিনি রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা দেশগুলোর ওপর চাপিয়েছেন বাড়তি শুল্ক। তাঁর উদ্দেশ্য রুশ তেলের বিপণন কমিয়ে দেশটির আর্থিক শক্তি কমিয়ে আনা। তবে কূটনৈতিকভাবে তিনি এখনো পুতিনের প্রতি নমনীয়। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র পেতে জেলেনস্কি হোয়াইট হাউসে গিয়েছিলেন। সেই ক্ষেপণাস্ত্র তো তিনি পানইনি, বরং এবারও ‘অপমানিত’ হয়ে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। ট্রাম্প এ সময় তাঁকে উল্টো যুদ্ধ থামাতে দনবাস সমর্পণ করতে বলেছেন। এর আগেও ট্রাম্প এমন কথা বলেছেন জেলেনস্কিকে। গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে হোয়াইট হাউসে একবার অপমানিত হতে হয়েছে তাঁকে। সেবার প্রকাশ্যে অপমান করলেও এবার তেমনটা ঘটেনি। তবে সূত্রের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদপত্র ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এবারও জেলেনস্কিকে ‘ধমক’ দিয়েছেন ট্রাম্প।

জেলেনস্কির এবারের হোয়াইট হাউস সফরের এক দিন আগেই পুতিনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন ট্রাম্প। সেই আলোচনার পর ফের সরাসরি সাক্ষাতের ঘোষণা আসে তাঁদের তরফ থেকে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এ সাক্ষাৎ হতে পারে বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। তবে এবার আর যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে নয়, ট্রাম্প-পুতিন দেখা হবে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে। কিন্তু এটিও জেলেনস্কির জন্য বড় দুঃসংবাদ। কারণ, হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট ভিক্টর অরবান পুতিনের বড় সমর্থক। কাজেই এই আলোচনায়ও যে ইউক্রেনের জন্য কোনো সুসংবাদ বয়ে আনবে না, তা আগেভাগেই অনুমান করা যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও জেলেনস্কি ওই বৈঠকে থাকতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, তাঁকে যদি আমন্ত্রণ জানানো হয়, তাহলে তিনি বৈঠকে থাকতে চান।

তবে যুদ্ধ থামাতে ট্রাম্পের প্রচেষ্টা, জেলেনস্কির কূটনৈতিক তৎপরতার ফলাফল যদি দনবাস সমর্পণ হয়, তাহলে তা হবে ইউক্রেন ও তার জনগণের জন্য বড় ক্ষতি। পাশাপাশি সারা বিশ্বের জন্যও অশনিসংকেত হবে সেটি। ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের পর এরই মধ্যে প্রাণ বাঁচাতে লাখো ইউক্রেনীয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছে। ফলে জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশের ওপর চাপ বেড়েছে। তার ওপর ইউক্রেনকে লাগাতার নানাভাবে সহায়তা দিতে গিয়ে ইউরোপের দেশগুলোকে পড়তে হয়েছে আর্থিক চাপে। এমন ক্ষতি স্বীকার করা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনকে যদি গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল সমর্পণ করতে হয়, তাহলে গোটা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য তা হবে বড় এক পরাজয়।

এদিকে রাশিয়ার এভাবে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের ভূখণ্ড দখল করে নেওয়া যদি বৈধতা পেয়ে যায়, তখন বাকি বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোও ‘নিপীড়ক’ হয়ে উঠতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। এমনিতেই শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রতিবেশী দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে নানা ঝক্কি সামলাতে হয়। তার ওপর ভূখণ্ড দখলের উদাহরণ সৃষ্টি হলে হুমকিতে পড়বে দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর জাতীয় নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা। ফলে বিশ্বজুড়ে বাড়বে অবিশ্বাস, তৈরি হবে অস্থিরতা। তার সরাসরি প্রভাব পড়বে অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের ওপর। বেড়ে যাবে সংঘাত, যুদ্ধবিগ্রহ। কিন্তু আধুনিক যুগে এমনটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘোষণা কিশোরগঞ্জের আইনজীবীর, ফেসবুকে ঝড়

‘বিএনপি করি, শেখ হাসিনার আদর্শে বিশ্বাসী’: সেই ইউপি সদস্য গ্রেপ্তার

অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি-পদোন্নতির ক্ষমতা পাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্ট

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর রাশিয়ার তেল কেনা স্থগিত করল চীন

পলাতক আসামিরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না, আরপিও সংশোধন অনুমোদন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘বিরল খনিজ’ আগামীর বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের নয়া হাতিয়ার

আব্দুর রহমান 
আজকে ভূ-রাজনীতির খেলার বস্তু হয়ে উঠছে বিরল মৃত্তিকা খনিজ পদার্থগুলো। ছবি: সংগৃহীত
আজকে ভূ-রাজনীতির খেলার বস্তু হয়ে উঠছে বিরল মৃত্তিকা খনিজ পদার্থগুলো। ছবি: সংগৃহীত

‘ওয়েপনাইজেশন অব এভরিথিং’ মানে ‘সবকিছুর অস্ত্রীকরণ’ করা—কথাটি এখন আর কল্পনা নয়, বৈশ্বিক রাজনীতির নির্মম বাস্তবতা। শক্তির ভারসাম্য এখন কেবল পারমাণবিক বোমা বা তেল ও গ্যাসক্ষেত্রের ওপর নির্ভর করে না। আজকে ভূ-রাজনীতির খেলার বস্তু হয়ে উঠছে বিরল মৃত্তিকা খনিজ পদার্থগুলো। যেগুলোর নাম অধিকাংশ মানুষই শোনেনি, যা বিশ্বের প্রযুক্তি, সামরিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে অবস্থান করছে।

রেয়ার আর্থ মিনারেলস বা বিরল মৃত্তিকা খনিজ পদার্থগুলো বলতে সাধারণত নিওডিমিয়াম, ডিসপ্রোসিয়াম, ল্যান্থানাম, সেরিয়াম, টার্বিয়ামের মতো ১৭টি ধাতব পদার্থকে বোঝায়। এগুলো রকেট, যুদ্ধবিমান, স্মার্টফোন, ইলেকট্রিক গাড়ির মোটর, উইন্ড টারবাইন, সোলার প্যানেল, স্যাটেলাইট যোগাযোগব্যবস্থা, এমনকি মিসাইল গাইডেন্স সিস্টেমসহ নানা যন্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। একুশ শতকের শিল্প ও সামরিক শক্তির ভিত্তি হিসেবে এই খনিজগুলো পুরোপুরি নির্ভরশীল।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিরল খনিজকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত আগ্রহ তীব্র হয়েছে। তিনি চীনকে প্রতিরোধের নতুন সূত্র হিসেবে এই খনিজের জোগান ও নিয়ন্ত্রণের ওপর মনোযোগ দিচ্ছেন। এরই মধ্যে চীনের মিত্র পাকিস্তান ও খনিজসমৃদ্ধ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ওয়াশিংটন সম্পর্ক জোরদার করেছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতরা মিয়ানমারের বিরল খনিজসমৃদ্ধ এলাকা ঘুরে দেখছেন, বিনিয়োগ ও সরবরাহ চুক্তির সম্ভাবনা খুঁজছেন। এমনকি দেশটির জান্তা সরকার যুক্তরাষ্ট্রের আনুকূল্য লাভের জন্য এই বিরল খনিজকে কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সম্ভাবনা দেখছে। চীনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন তৎপরতা নিছক অর্থনৈতিক নয়, বরং এটি এক নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা বলে ধারণা করা যাচ্ছে।

চীনও থেমে নেই। দেশটি অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিল ভবিষ্যতের যুদ্ধের রণক্ষেত্র হবে ভূগর্ভ। ১৯৯২ সালে তৎকালীন নেতা দেং জিয়াওপিং বলেছিলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের তেল আছে, আর চীনের আছে বিরল খনিজ।’ সেই কথার অর্থ আজ পরিষ্কার হচ্ছে। চীন এখন বিশ্বের মোট উৎপাদিত বিরল খনিজের ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে, আর পরিশোধনের ৯০ শতাংশ সম্পূর্ণ তাদের হাতে। এর মানে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ বা জাপান কোথাও খনিজ আবিষ্কার করলেও সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করতে প্রায়ই চীনের ওপর নির্ভর করতে হয়। কারণ, খনিজকে বাজারযোগ্য অবস্থায় আনতে যে প্রযুক্তি, শ্রম ও পরিবেশগত অবকাঠামো দরকার, তা চীনের বাইরে তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। বৈদ্যুতিক গাড়ি থেকে যুদ্ধবিমান, রকেট থেকে ব্যাটারি, প্রতিটি উচ্চপ্রযুক্তির যন্ত্রে এই খনিজ অপরিহার্য। তাই চীন চাইলে বৈশ্বিক শিল্পপ্রবাহের শিরা বন্ধ করে দিতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বকে প্রযুক্তিগতভাবে অচল করে দিতে পারে।

চীন প্রথমে খনিজকে অস্ত্রে পরিণত করতে না চাইলেও ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ চীনকে সেই পথে ঠেলে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনের রপ্তানিতে শতভাগের বেশি শুল্ক বসানোর পর বেইজিংও পাল্টা পদক্ষেপ নেয়। মার্কিন প্রযুক্তি রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি হলে চীন ঘোষণা করে, চীনা বা বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান যদি চীনের বিরল খনিজ বা প্রযুক্তি ব্যবহার করে সামরিক উদ্দেশ্যে কিছু তৈরি করতে চায়, তবে বেইজিংয়ের অনুমতি লাগবে। আর এই ঘোষণার পেছনে আছে ক্ষমতার প্রশ্ন। চীন জানে, বিশ্ব এখন তাদের খনিজের ওপর নির্ভরশীল।

যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এখন নাজুক। তাদের সামরিক প্রযুক্তি, যেমন এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান, রাডারব্যবস্থা কিংবা মিসাইল গাইডেন্স সিস্টেম বা ক্ষেপণাস্ত্র নির্দেশক প্রযুক্তি—সবই বিরল খনিজের ওপর নির্ভরশীল। একেকটি এফ-৩৫ বিমান তৈরিতে লাগে প্রায় ৪০০ কেজি বিরল মৃত্তিকা খনিজ, যার অধিকাংশই আসে চীন থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সফটওয়্যার কোম্পানি গোভিনির গবেষণায় দেখা গেছে, অন্তত ১,৯০৮টি অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত প্রায় ৮০ হাজার উপাদান সরাসরি চীনা খনিজের ওপর নির্ভরশীল। এই পরিসংখ্যান যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাশিল্পের ভঙ্গুর বাস্তবতাকে প্রকাশ করে।

ইউরোপও একই সংকটে আছে। জার্মানির গাড়িশিল্প, ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন—সবই চীনের সরবরাহের কাছে বাঁধা। অথচ বিকল্প জোগান গড়ে তোলার মতো প্রযুক্তি, অর্থ বা সময় তাদের নেই। যুক্তরাষ্ট্র এখন মরিয়া হয়ে আফ্রিকার দেশগুলো যেমন অ্যাঙ্গোলা, কঙ্গো, তানজানিয়া ও মোজাম্বিকে নতুন খনিজ উৎস খুঁজছে। এমনকি লাতিন আমেরিকাতেও তাদের নজর আছে। সেখানে পশ্চিমা জোটের অর্থায়নে গড়ে তোলা হচ্ছে সড়ক, রেল ও বন্দর, যাতে ভবিষ্যতে চীনের বিকল্প সরবরাহ পথ তৈরি করা যায়।

বিরল খনিজকে কেন্দ্র করে চীনের কৌশলগত বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টার বিপরীতে ট্রাম্প প্রশাসনও পাল্টা খেলায় নেমেছে। গ্রিনল্যান্ডের বরফাচ্ছন্ন ভূমি থেকে শুরু করে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত খনিজ অঞ্চল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র নজর দিচ্ছে নতুন খনিজ খাত দখলে। অস্ট্রেলিয়ায় বিনিয়োগ চুক্তি, পাকিস্তানের পাহাড়ি অঞ্চলে অনুসন্ধান, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কূটনৈতিক দর-কষাকষি—সবই একই ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অংশ।

এরই অংশ হিসেবে ‘ডিফেন্স প্রোডাকশন অ্যাক্ট’-এর আওতায় ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র রেয়ার আর্থ খাতে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ ঘোষণা করেছে। দেশটি অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভিয়েতনাম ও আফ্রিকার বেশ কিছু রাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে নতুন খনি প্রকল্প সন্ধানে নেমেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও ‘ক্রিটিক্যাল র ম্যাটেরিয়ালস অ্যাক্ট’ পাস করে চীনের বিকল্প সরবরাহশৃঙ্খল তৈরির চেষ্টা করছে।

এই নতুন স্নায়ুযুদ্ধের অস্ত্র পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র নয়, বরং মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা সামারিয়াম, গ্যাডোলিনিয়াম, ডিসপোরিয়াম আর ইট্রিয়ামের মতো ধাতু। ভবিষ্যতের প্রযুক্তি ও সামরিক শক্তি পুরোপুরি দাঁড়িয়ে থাকবে এই ধাতুগুলোর ওপর। চীন এখন বুঝে গেছে, যুদ্ধ না করেও আধিপত্য কায়েম করা সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রও তা বুঝে গেছে, কিন্তু তাদের হাতে সময় কম।

পৃথিবী যখন জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় ‘সবুজ জ্বালানির’ দিকে ঝুঁকছে, তখন এই খনিজগুলোর চাহিদা বহুগুণ বেড়ে গেছে। একেকটি বৈদ্যুতিক গাড়িতে প্রায় ১০ কেজি রেয়ার আর্থ মিনারেলস লাগে, একটি উইন্ড টারবাইনে প্রয়োজন ৬০০ কেজিরও বেশি। ফলে ‘সবুজবিপ্লব’ যত দ্রুত এগোচ্ছে, ততই রেয়ার আর্থের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে।

এই নির্ভরতা নতুন উপনিবেশবাদের রূপ নিচ্ছে। আফ্রিকার কঙ্গো, জাম্বিয়া, নামিবিয়া, লাতিন আমেরিকার চিলি ও বলিভিয়া—সবখানে এখন খনিজের নামে বিদেশি বিনিয়োগের হিড়িক। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইউরোপ—সবাই একে অপরকে টপকে খনি, রপ্তানি অধিকার ও অবকাঠামো নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করছে। স্থানীয় জনগণ পাচ্ছে দূষণ, স্থানচ্যুতি আর ঋণচক্রের শৃঙ্খল।

ভবিষ্যতের যুদ্ধ মিসাইল দিয়ে নয়, সরবরাহ চেইনের দখল দিয়ে হবে। যে রাষ্ট্রের হাতে থাকবে রেয়ার আর্থ মিনারেলসের প্রবাহ, সেই দেশই নির্ধারণ করবে কারা প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাবে, কারা জ্বালানি উৎপাদন করবে, এমনকি কারা যুদ্ধ করবে।

চীন এখন এই সরবরাহ-শৃঙ্খলের প্রভু। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরোধে মরিয়া। ইউরোপের দেশগুলো নিজেদের অবস্থান খুঁজছে—কেউ চীনের সঙ্গে সমঝোতায়, কেউ আমেরিকার সঙ্গে জোটে। কিন্তু আসল প্রশ্ন হলো—এ প্রতিযোগিতা শেষ পর্যন্ত মানবতার উপকারে আসবে, নাকি নতুন এক খনিজ সাম্রাজ্যের জন্ম দেবে? তবে সবুজ শক্তির নামে যে প্রতিযোগিতা চলছে, তা যদি পরিবেশবিধ্বংস, দারিদ্র্য আর বৈষম্যই বাড়ায়, তবে এই রেয়ার আর্থ আসলে আধুনিক সভ্যতার নতুন শৃঙ্খল হয়ে দাঁড়াবে। ইতিহাস ইঙ্গিত দেয়, এই প্রতিযোগিতা দ্রুত শেষ হবে না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘোষণা কিশোরগঞ্জের আইনজীবীর, ফেসবুকে ঝড়

‘বিএনপি করি, শেখ হাসিনার আদর্শে বিশ্বাসী’: সেই ইউপি সদস্য গ্রেপ্তার

অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি-পদোন্নতির ক্ষমতা পাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্ট

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর রাশিয়ার তেল কেনা স্থগিত করল চীন

পলাতক আসামিরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না, আরপিও সংশোধন অনুমোদন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নতুন অস্থিরতা

পাক-আফগান সংঘাত

এস এম হাসানুজ্জামান
কান্দাহার প্রদেশের স্পিন বোল্ডাকে আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তের কাছে একটি ট্যাংকের ওপরে বসে আছেন একজন আফগান তালেবান যোদ্ধা। ছবি: রয়টার্সের সৌজন্যে
কান্দাহার প্রদেশের স্পিন বোল্ডাকে আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তের কাছে একটি ট্যাংকের ওপরে বসে আছেন একজন আফগান তালেবান যোদ্ধা। ছবি: রয়টার্সের সৌজন্যে

দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি প্রাচীনকাল থেকে বহুপক্ষীয়, জটিল এবং কয়েকটি দেশের আধিপত্যবাদী স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। বিশেষ করে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্ত এলাকা, যা প্রাচীনকাল থেকে সামরিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত। সাম্প্রতিক সংঘাতের মাধ্যমে তা আবারও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সীমান্তের এই অস্থিরতা কেবল দুই দেশের মধ্যে সামরিক উত্তেজনায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতি, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, মানবিক পরিস্থিতি এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।

২০২৫ সালের ৯ অক্টোবর কাবুলের আবদুল হাক্ক স্কয়ারে দুটি বিস্ফোরণ ঘটে, যা পুরো শহরকে আতঙ্কের ছায়ায় আচ্ছন্ন করে। এই বিস্ফোরণকে পাকিস্তান সরকার তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) প্রধান নূর ওয়ালি মেহসুদকে লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে বলে দাবি করা হয়। যদিও মেহসুদ নিজে একটি অডিও বার্তায় বেঁচে থাকার ঘোষণা দেন। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ১১ অক্টোবর রাতে আফগান বাহিনী পাকিস্তানি সীমান্তচৌকিগুলোতে পাল্টা হামলা চালায়। এই আক্রমণে পাকিস্তান তার ২৩ সেনা সদস্যকে হারায়। তবে পাল্টা হামলায় তারা দাবি করে, ২০০ তালেবান এবং তাদের সহযোগী সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে। আফগান বাহিনী ঘোষণা করে, তারা সীমান্তে ২৫টি পাকিস্তানি চৌকি দখল করেছে। এর পরপরই তোরখাম, চামান এবং অন্যান্য প্রধান সীমান্তচৌকিগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাণিজ্য, পরিবহন এবং সাধারণ জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাপনে মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলে।

সীমান্ত সংঘাতের পেছনে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক জটিলতা রয়েছে। পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে, আফগান সরকার তাদের ভূখণ্ডে টিটিপি সদস্যদের নিরাপদ আশ্রয় দিচ্ছে। আফগান প্রশাসন এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও পাকিস্তানের অভ্যন্তরে টিটিপির হামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতি দুই দেশের সম্পর্ককে ক্রমেই উত্তেজনাপূর্ণ করে তুলেছে। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর, আফগান ভূখণ্ডে টিটিপির কার্যক্রম বৃদ্ধি পায়। ইসলামাবাদ এই কার্যক্রমকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে। আফগানিস্তানের তালেবানরা রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে, যা সীমান্ত অস্থিরতাকে আরও তীব্র করছে।

সীমান্ত সংঘাতের সামরিক দিকও অত্যন্ত জটিল। এ ক্ষেত্রে সংঘাত প্রায়ই গেরিলা যুদ্ধের কৌশলে পরিচালিত হয়। তালেবান বাহিনী হঠাৎ এবং অপ্রত্যাশিত আক্রমণ, দ্রুতগতি, স্থানীয় সমর্থন এবং ট্যাকটিক্যাল অপ্রচলিত কৌশল ব্যবহার করে পাকিস্তানি সীমান্তপ্রহরীদের তুলনায় অধিক কার্যকরভাবে। পাকিস্তানি বাহিনী তুলনামূলকভাবে বড়, আধুনিক ও স্থায়ী। তাদের কাছে প্রচলিত যুদ্ধের প্রযুক্তি রয়েছে—যেমন ট্যাংক, বিমান, পর্যবেক্ষণব্যবস্থা এবং আধুনিক অস্ত্র। তবু গেরিলা কৌশলের কারণে সীমান্তচৌকিগুলো হারাতে পারে। তালেবান বাহিনী স্বল্পসংখ্যক হলেও দ্রুতগতি ও চমকপ্রদ কৌশল ব্যবহার করে কার্যকর আক্রমণ চালায়।

টিটিপি, তালেবান এবং ইসলামিক স্টেট ইন খোরাসান প্রভিন্সের কর্মকাণ্ড সীমান্ত সংঘাতকে আরও জটিল করেছে। টিটিপি পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালায়, যার মধ্যে আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং অন্যান্য সহিংস কর্মকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত। আফগান ভূখণ্ডে তারা নিরাপদ আশ্রয় পায়। আফগানিস্তান তালেবান বাহিনীর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়, কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক প্রতিরোধের কারণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

এখনকার দুই দেশের মধ্যে সংঘাতে সীমান্তচৌকিগুলো বন্ধ থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য এবং পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে। সীমান্তবর্তী সাধারণ জনগণ মানবিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবার সীমিত প্রাপ্যতা, আফগান শরণার্থীদের নিরাপদ আশ্রয় না পাওয়া এবং অর্থনৈতিক দুর্ভোগ মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। সীমান্ত অস্থিরতার কারণে স্থানীয় অর্থনীতি বিপর্যস্ত। তাই আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে মানবিক সহায়তার জন্য এই সংকট প্রশমিত করা প্রয়োজন।

এই সংঘাতে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিরও গুরুত্ব আছে। সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পাকিস্তান সন্দেহের চোখে দেখছে। ভারতের কূটনৈতিক নীতির প্রভাব এবং পাকিস্তানের নিরাপত্তা চিন্তা—সবকিছু মিলিত হয়ে সংকটকে আরও জটিল করেছে। সৌদি আরব, কাতার, ইরান, চীন এবং রাশিয়া উভয় পক্ষকে সংযম বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে। আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের সফরে শান্তিপূর্ণ সমাধানের ওপর জোর দিয়েছেন। পাকিস্তানও সীমান্তে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমিত করতে পারে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সীমান্তে উত্তেজনা অব্যাহত থাকলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও খারাপ হতে পারে। তবে উভয় পক্ষই বড় ধরনের সংঘাতে জড়াতে চায় না, কারণ তারা ইতিমধ্যেই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত সমস্যায় জর্জরিত। পাকিস্তান টিটিপির হামলা মোকাবিলায় লড়ছে এবং আফগানিস্তানও তাদের ভূখণ্ডে তালেবান বাহিনীর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যস্থতা ছাড়া এই সংকট সমাধান সম্ভব নয়।

পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত সংঘাত কেবল সামরিক উত্তেজনার বিষয় নয়। এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং মানবিক নিরাপত্তার জন্য বহুমাত্রিক সংকট। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং উভয় দেশের আন্তরিকতা ছাড়া এই সংকট সমাধান সম্ভব নয়। দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে, উভয় দেশকে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের দিকে মনোযোগী হতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘোষণা কিশোরগঞ্জের আইনজীবীর, ফেসবুকে ঝড়

‘বিএনপি করি, শেখ হাসিনার আদর্শে বিশ্বাসী’: সেই ইউপি সদস্য গ্রেপ্তার

অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি-পদোন্নতির ক্ষমতা পাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্ট

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর রাশিয়ার তেল কেনা স্থগিত করল চীন

পলাতক আসামিরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না, আরপিও সংশোধন অনুমোদন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত