Ajker Patrika

একটি বর্ধিত সভার পোস্টমর্টেম

মহিউদ্দিন খান মোহন 
প্রায় সাত বছর পর অনুষ্ঠিত বর্ধিত সভায় লন্ডনে চিকিৎসাধীন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ভার্চুয়ালি বক্তব্য রেখেছেন। ছবি: সংগৃহীত
প্রায় সাত বছর পর অনুষ্ঠিত বর্ধিত সভায় লন্ডনে চিকিৎসাধীন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ভার্চুয়ালি বক্তব্য রেখেছেন। ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি ঘটা করে অনুষ্ঠিত হলো বিএনপির বর্ধিত সভা। সভাটির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, প্রায় সাত বছর পরে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বক্তব্য রেখেছেন। লন্ডনে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়া প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি সভাটিতে সংযুক্ত হয়ে বক্তব্য রেখেছেন। চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী কাউকে আক্রমণ না করে অত্যন্ত ভদ্রোচিত ভাষায় কথা বলেছেন তিনি। নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বানের পাশাপাশি দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে নিজের সম্পৃক্ত থাকার ইচ্ছার কথাও জানিয়েছেন তিনি। লন্ডন থেকে যুক্ত হয়ে সভায় সভাপতিত্ব করেছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দীর্ঘদিন পর অনুষ্ঠিত দলটির জাতীয় নির্বাহী কমিটির এই বর্ধিত সভা সংগত কারণেই নেতা-কর্মীদের মধ্যে যেমন উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল, তেমনি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলেও ঔৎসুক্যের অন্ত ছিল না। বিশেষত সভা থেকে নেতা-কর্মীরা কী বার্তা পাবেন, তা নিয়ে সবারই কৌতূহল ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত নতুন কোনো বার্তা নেতা-কর্মীরা পাননি। নিজেদের ঐক্যবদ্ধ রাখা এবং আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনা পেয়েছেন নেতা-কর্মীরা; যা এর আগেও প্রায় প্রতিটি সভায় তিনি বলেছেন।

যেভাবে যে পরিসরে বিএনপির এই বর্ধিত সভাটি হয়েছে, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অভিনবই বলা যায়। জাতীয় কাউন্সিল সম্মেলনের আদলে অনুষ্ঠিত হয়েছে বর্ধিত সভাটি। চার হাজারের অধিক প্রতিনিধির অংশগ্রহণে একটি দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির বর্ধিত সভা নজিরবিহীন ঘটনা। এদিক দিয়ে বিএনপি একটি রেকর্ড করল। এ সভাকে সফল করতে ব্যবস্থাপনা কমিটি, বাস্তবায়ন কমিটি, অভ্যর্থনা উপকমিটি, আপ্যায়ন উপকমিটি, শৃঙ্খলা উপকমিটি ইত্যাদি বিভিন্ন কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। যতদূর জানি বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জাতীয় নির্বাহী কমিটির বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা স্থায়ী কমিটির সদস্য, নির্বাহী কমিটির সদস্য, জেলা কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক এবং অঙ্গসংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে। এর বাইরে দলের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরাও বিশেষভাবে আমন্ত্রিত হতে পারেন।

কিন্তু গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও দলটির নেতা-কর্মীদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, চিরাচরিত নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে এ ক্ষেত্রে। গঠনতান্ত্রিক রীতি উপেক্ষা করে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল উপজেলা বিএনপির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদেরও। এমনকি কোনো ক্রাইটেরিয়ায়ই পড়েন না, এমন অনেকে আমন্ত্রণ পেয়েছেন। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড হলো, বর্ধিত সভায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে একটি বিশেষ ক্রাইটেরিয়া সৃষ্টি করা হয়েছিল ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রাথমিক মনোনয়নপ্রাপ্ত’ বলে। এই ক্রাইটেরিয়ায় প্রতিটি সংসদীয় আসনে প্রাথমিক মনোনয়নপ্রাপ্ত অন্তত তিনজন করে বর্ধিত সভায় আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। প্রশ্ন হলো, গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত নির্বাচনে ‘প্রাথমিক মনোনয়নপ্রাপ্তদের’ বর্ধিত সভায় যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিএনপি কি ওই নির্বাচনকে প্রকারান্তরে স্বীকৃতি দিল না? অবশ্য মুখে ‘রাতের ভোটের নির্বাচন’, ‘অবৈধ সংসদ’ বললেও তাদের সাতজন এমপি চার বছর পর্যন্ত সংসদ সদস্য হিসেবে বহাল থেকে রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ-সুবিধাই ভোগ করেছেন। এমনকি ভাগে পাওয়া একমাত্র নারী সংসদ সদস্য রাজউক থেকে একটি প্লট বরাদ্দ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে তৎকালীন স্পিকারের কাছে আবেদনও করেছিলেন। পরে তীব্র সমালোচনার মুখে তিনি সে আবেদন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। সে সময় অনেকেই ওই এমপিদের ‘অবৈধ সংসদের বৈধ এমপি’ বলে কটাক্ষ করতেন। বর্ধিত সভায় অঙ্গসংগঠনগুলোর এমন অনেক নেতা-কর্মীকে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছিল, দলটির গঠনতন্ত্র অনুসারে যাঁদের ধারেকাছেও ঘেঁষার কথা নয়। অভিযোগ রয়েছে, এদেরকে বিভিন্ন উপকমিটির সদস্য হিসেবে কার্ড বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আবার এমন অনেক নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, যাঁদের বর্ধিত সভার আবরণে অনুষ্ঠিত ওই কর্মী সভার আমন্ত্রণ পাওয়া উচিত ছিল। দলটির দুঃসময়ের কান্ডারিখ্যাত প্রয়াত একজন শীর্ষনেতার পুত্র আফসোস করে বললেন, ‘বর্ধিত সভায় আমন্ত্রণ পাব কী? দলেই তো ঠাঁই মিলছে না!’ তিনি জানালেন, দলের যাঁরা নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মী তাঁরা এখন বঞ্চিত, অবহেলিত। তাঁদের জেলায় এখন চলছে ‘এক নেত্রীর শাসন’। তাঁর হুকুমেই সব চলে। কারও বলার বা করার কিছু নেই। নেতা-কর্মীরা নাকি আড়ালে-আবডালে ওই নেত্রীকে সে জেলার ‘শেখ হাসিনা’ বলে অভিহিত করে থাকেন।

এদিকে ‘কামাল জামান’ নামে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ জনৈক ব্যক্তিকে একটি উপকমিটির সদস্য হিসেবে বর্ধিত সভায় প্রবেশ কার্ড দেওয়ার অভিযোগ করেছেন বিএনপির এক কর্মী। তিনি তাঁর ফেসবুক পেজে কার্ডের ছবি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ওই ব্যক্তির ছবি পোস্ট করে জানতে চেয়েছেন, এই ব্যক্তি কী করে দলের গুরুত্বপূর্ণ সভায় ঢুকতে পারল? অপরদিকে মো. সারোয়ার হোসেন রুবেল নামে এক ব্যক্তি ‘জিয়া প্রজন্ম দল’ নামে এক ভুয়া সংগঠনের মহাসচিব হিসেবে নিজের নামে ডেলিগেট কার্ড বানিয়ে সভায় যোগ দিয়েছিলেন। পরে এ বিষয়ে বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ওই ব্যক্তির সঙ্গে মূল দল কিংবা কোনো অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনের সম্পর্ক নেই বলে জানানো হয়েছে। একটি বড় আয়োজনে কিছু ভুলত্রুটি থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তবে দলের সঙ্গে সম্পর্কহীন এবং সাবেক স্বৈরশাসক-দলটির নেতাদের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি কী করে একটি উপকমিটির সদস্য হলেন—এ প্রশ্ন বিএনপির কর্মীদের। তাঁদের কয়েকজন ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ১৭ বছর আমরা জীবন বাজি রেখে যাঁদের বিরুদ্ধে লড়াই করলাম, এখন তাঁদেরই দোসররা আমাদের পেছনে ফেলে সামনের সারিতে চলে যাচ্ছেন। তাঁরা আমাকে অনুরোধ করলেন এসব তথ্য তুলে ধরতে, যাতে দলের হাইকমান্ড অনুপ্রবেশকারীদের সম্পর্কে সতর্ক হতে পারে। তাঁদের বলেছি, তথ্য হয়তো তুলে ধরতে পারব, তবে তোমাদের হাইকমান্ড তা ধর্তব্য বলে গণ্য করবে কি না, সে গ্যারান্টি দিতে পারব না।

রাজনৈতিক সচেতন মহল বলছে, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির উল্লিখিত বর্ধিত সভাটি আক্ষরিক অর্থে বর্ধিত সভা ছিল না। কার্যত তা ছিল জাতীয় কাউন্সিল সম্মেলনের মহড়া। যেহেতু আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে দলটির কাউন্সিল সম্মেলনের সম্ভাবনা নেই, তাই নেতা-কর্মীদের কেন্দ্রীয়ভাবে একত্র করে পরবর্তী নির্দেশনা দেওয়ার জন্য এই সভাটিকে উপলক্ষ করা হয়েছিল। সে হিসেবে সভাটিকে ‘কেন্দ্রীয় কর্মী সম্মেলন’ হিসেবে অভিহিত করা যেত। এটা স্বীকার্য যে বিএনপি এখন যে সাংগঠনিক অবস্থায় রয়েছে, তাতে জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠানের কথা ভাবা প্রায় অসম্ভব। অধিকাংশ জেলায় নির্বাচিত কমিটি নেই। কোথাও আবার পূর্বতন কমিটি ভেঙে দিয়ে গঠন করা হয়েছে আহ্বায়ক কমিটি। জেলার অধীন উপজেলা কমিটিগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। দ্বন্দ্ব-কোন্দলের অবসান হয়নি কোথাও। ইতিমধ্যে দু-চারটি জেলায় নির্বাচনের মাধ্যমে ‘সুপার ফাইভ’ বা ‘সুপার সেভেন’ কমিটি গঠিত হয়েছে। তবে তাতে কোন্দলের অবসান হয়নি। পূর্ণাঙ্গ কমিটি কবে হবে, কেউ জানে না। পূর্বতন কমিটি ভেঙে দিয়ে গঠন করা আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে অসন্তোষ। মুন্সিগঞ্জ জেলা বিএনপির কমিটি ভেঙে দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে সপ্তাহ দুয়েক আগে। আহ্বায়ক করা হয়েছে ২০২০ সালে বিএনপির সব পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগী নেতা সাবেক প্রতিমন্ত্রী মিজানুর রহমান সিনহাকে। এ নিয়ে স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীর একাংশের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে অসন্তোষ।

বিএনপি এখন ব্যস্ত রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে দ্রুত নির্বাচন আদায়ের চেষ্টায়। কিন্তু অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন করে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে দলকে ঐক্যবদ্ধ না করে নির্বাচনে অবতীর্ণ হওয়া নতুন সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছে রাজনীতি-অভিজ্ঞ মহল। এহেন পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত বর্ধিত সভা বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি বর্ধন ও ভেঙে পড়া ঐক্যকে পুনরুদ্ধারে কতটুকু ইতিবাচক ভূমিকা রাখে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত