মহিউদ্দিন খান মোহন
এ কথা আজ আমরা ভুলতে বসেছি যে আমাদের একটি মর্যাদাসম্পন্ন দিবসের নাম ‘মহান শহীদ দিবস’; যার জন্ম ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। কেন, কীভাবে এ দিবসটির জন্ম, তা অনেকেরই জানা। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা অবশ্য অতটা জ্ঞাত নয়। ফেব্রুয়ারি মাসটিকে তারা ধরে নিয়েছে বইমেলার উৎসবের মাস হিসেবে। অথচ দিবসটি যে আমাদের জাতীয়তাবোধ তথা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার অঙ্কুরোদগম ঘটিয়েছিল, তা অনেকেরই জানা নেই। উপরন্তু মাসটির মধ্যভাগে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ নামের একটি দিবসের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে এর ভাবগাম্ভীর্যকে ক্ষুণ্ন করা হয়েছে অনেকাংশে। এমনকি আমরা ভুলতে বসেছি, স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ১৯৮৩ সালের ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি। আমাদের এই ভুলে যাওয়ার চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য জাতীয় ইতিহাসের এক ট্র্যাজিক ব্যাপার। এর কারণে অনেক ঐতিহাসিক সত্য এখন কারও কারও কাছে নিছক গালগল্প মনে হয়। অথচ ওইসব ঘটনার ধারাবাহিকতায় এসেছে আমাদের স্বাধীনতা, ফিরে এসেছে গণতন্ত্র।
তারপর সে আন্দোলন নানা ধাপ পেরিয়ে ১৯৫২ সালে এসে চূড়ান্ত রূপলাভ করে। ২৭ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন জিন্নাহর উক্তির প্রতিধ্বনি করে বলেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। তাঁর এ মন্তব্য ঝিমিয়ে পড়া ভাষা আন্দোলনকে জাগিয়ে তোলে। ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরি হলে আওয়ামী মুসলিম লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় নেতাদের সভায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য তাঁকে সভাপতি করে ২৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। কাজী গোলাম মাহবুবকে সংগ্রাম পরিষদের সম্পাদক করা হয়। এই সভাতেই ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ আহূত ৪ ফেব্রুয়ারির ঢাকা নগরীতে ছাত্র ধর্মঘট, সভা ও মিছিলের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়। এ ছাড়া পূর্ববঙ্গীয় আইন পরিষদের অধিবেশনের দিন ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী হরতাল, সভা ও বিক্ষোভ মিছিলের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ইতিমধ্যে ২১ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকায় মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করে।
সরকার নানাভাবে চেষ্টা করেও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচি স্থগিত বা পরিবর্তন করাতে না পেরে ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে এক মাসের জন্য ঢাকা শহরে সব ধরনের সভা-সমাবেশ-মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে (১৪৪ ধারা)। এ ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার পর ঢাকার ৯৪ নবাবপুর রোডে আওয়ামী মুসলিম লীগের কার্যালয়ে নেতারা জরুরি সভায় মিলিত হন। সভায় সভাপতিত্ব করেন সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা আবুল হাশিম। সভায় পরদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল বিতর্ক হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষের প্রস্তাব গৃহীত হয়ে যায়। অপরদিকে সরকারের ১৪৪ ধারা ঘোষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক হল, ঢাকা মেডিকেল কলেজে ছাত্রসভায় পরদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অন্যদিকে অলি আহাদের নেতৃত্বে যুবলীগ কর্মীরাও ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ও যুবলীগ নেতারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ) প্রাঙ্গণে সমবেত হন। এ সময় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে কি না, তা নিয়ে নেতাদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি দেখা দেয়। একদল যেকোনো মূল্যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে, অন্যরা তার বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নেয়। এরপর দুপুর ১২টার দিকে গাজীউল হকের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রসভা শুরু হয়। সভায় দু-একজন ছাড়া প্রায় সব বক্তাই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত দেন। সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল মতিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে জোরালো বক্তব্য দেন। এরপর সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৬ জন, ৮ জন করে গ্রুপে ভাগ হয়ে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় বের হতে থাকেন এবং গেটের বাইরে অপেক্ষমাণ পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করতে থাকে। পুলিশের এই আচরণে ক্ষিপ্ত ছাত্ররা একযোগে বিশ্ববিদ্যালয় গেট অতিক্রম করে রাজপথে নেমে এলে পুলিশ লাঠিপেটা এবং কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। জবাবে ছাত্ররাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করেন। মুহূর্তে এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ছাত্ররা মিছিলসহ পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। গণপরিষদ ভবনে (বর্তমান জগন্নাথ হল) আইন পরিষদের অধিবেশন চলছিল। মিছিলটি এর কাছাকাছি পৌঁছালে ঢাকার জেলা প্রশাসক পুলিশকে গুলি করার নির্দেশ দেন। এলোপাতাড়ি গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র আবুল বরকত গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। তাঁকে অন্যরা ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যান, সেখানে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এদিন পুলিশের গুলিতে আরও নিহত হন জব্বার ও রফিক।
ছাত্র মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনা বিদ্যুৎবেগে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। ঢাকা শহর পরিণত হয় মিছিলের শহরে। সবার কণ্ঠে একই স্লোগান—‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নূরুল আমিনের কল্লা চাই’, ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’।
ওদিকে ছাত্র মিছিলে গুলির সংবাদে আইন পরিষদের চলমান অধিবেশনে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সদস্য মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ অধিবেশন মুলতবি রেখে ছাত্র মিছিলে গুলির ঘটনার ওপর আলোচনার প্রস্তাব করেন। তাঁকে সমর্থন করেন খয়রাত হোসেন ও আনোয়ারা খাতুন। কিন্তু স্পিকার সে প্রস্তাব গ্রহণ না করায় এবং মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন ছাত্রহত্যার পক্ষে সাফাই গাওয়ার প্রতিবাদে আইন পরিষদ সদস্য মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, দৈনিক আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন, বেগম আনোয়ারা খাতুন ও কংগ্রেস দলীয় সদস্যরা ওয়াক আউট করেন। মাওলানা তর্কবাগীশ ও আবুল কালাম শামসুদ্দিন গণপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। ঢাকার পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করায় সরকার ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কারফিউ জারি করে এবং সেনাবাহিনী তলব করে।
২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ চলে। এদিন শফিউর রহমানসহ কয়েকজন শহীদ হন। ছাত্রনেতাদের বৈঠকে ২১ ফেব্রুয়ারি যেখানে প্রথম গুলি চালানো হয়েছিল, সেখানে একটি শহীদ মিনার স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি। রাতে সে মোতাবেক শহীদ মিনারটি নির্মিত হয়। এই নির্মাণকাজে ইট, বালু, রড, সিমেন্ট সরবরাহ করেন ঢাকার তৎকালীন নেতৃস্থানীয় ঠিকাদার পিয়ারু সরদার। ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে শহীদ মিনারটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। কিন্তু ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতেই পুলিশ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় শহীদ মিনারটি। পরবর্তীকালে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ওই বছরই আতাউর রহমান খান মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রখ্যাত স্থপতি হামিদুর রাহমানের নকশায় বর্তমান শহীদ মিনার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। আতাউর রহমান খান সরকারের আমলে সে নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। পরে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের আমলে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লে. জে. আযম খান শহীদ মিনারটি নির্মাণের ব্যবস্থা করেন। ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ বরকতের মা সেটা উদ্বোধন করেন।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের গর্ভে জন্ম নেওয়া মহান শহীদ দিবস সৃষ্টির ইতিহাস এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিশদ বর্ণনা সম্ভব নয়। আজ নানাবিধ কারণে মহান শহীদ দিবসের সে মহিমা অনেকটাই ম্লান। এ দিনটি আজ শুধুই আনুষ্ঠানিকতা ও উৎসবের দিবসে পরিণত হয়েছে। মহান শহীদ দিবসের মাহাত্ম্য ভুলে যাওয়া হবে আত্মঘাতী।
এ কথা আজ আমরা ভুলতে বসেছি যে আমাদের একটি মর্যাদাসম্পন্ন দিবসের নাম ‘মহান শহীদ দিবস’; যার জন্ম ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। কেন, কীভাবে এ দিবসটির জন্ম, তা অনেকেরই জানা। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা অবশ্য অতটা জ্ঞাত নয়। ফেব্রুয়ারি মাসটিকে তারা ধরে নিয়েছে বইমেলার উৎসবের মাস হিসেবে। অথচ দিবসটি যে আমাদের জাতীয়তাবোধ তথা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার অঙ্কুরোদগম ঘটিয়েছিল, তা অনেকেরই জানা নেই। উপরন্তু মাসটির মধ্যভাগে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ নামের একটি দিবসের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে এর ভাবগাম্ভীর্যকে ক্ষুণ্ন করা হয়েছে অনেকাংশে। এমনকি আমরা ভুলতে বসেছি, স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ১৯৮৩ সালের ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি। আমাদের এই ভুলে যাওয়ার চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য জাতীয় ইতিহাসের এক ট্র্যাজিক ব্যাপার। এর কারণে অনেক ঐতিহাসিক সত্য এখন কারও কারও কাছে নিছক গালগল্প মনে হয়। অথচ ওইসব ঘটনার ধারাবাহিকতায় এসেছে আমাদের স্বাধীনতা, ফিরে এসেছে গণতন্ত্র।
তারপর সে আন্দোলন নানা ধাপ পেরিয়ে ১৯৫২ সালে এসে চূড়ান্ত রূপলাভ করে। ২৭ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন জিন্নাহর উক্তির প্রতিধ্বনি করে বলেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। তাঁর এ মন্তব্য ঝিমিয়ে পড়া ভাষা আন্দোলনকে জাগিয়ে তোলে। ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরি হলে আওয়ামী মুসলিম লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় নেতাদের সভায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য তাঁকে সভাপতি করে ২৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। কাজী গোলাম মাহবুবকে সংগ্রাম পরিষদের সম্পাদক করা হয়। এই সভাতেই ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ আহূত ৪ ফেব্রুয়ারির ঢাকা নগরীতে ছাত্র ধর্মঘট, সভা ও মিছিলের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়। এ ছাড়া পূর্ববঙ্গীয় আইন পরিষদের অধিবেশনের দিন ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী হরতাল, সভা ও বিক্ষোভ মিছিলের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ইতিমধ্যে ২১ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকায় মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করে।
সরকার নানাভাবে চেষ্টা করেও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচি স্থগিত বা পরিবর্তন করাতে না পেরে ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে এক মাসের জন্য ঢাকা শহরে সব ধরনের সভা-সমাবেশ-মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে (১৪৪ ধারা)। এ ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার পর ঢাকার ৯৪ নবাবপুর রোডে আওয়ামী মুসলিম লীগের কার্যালয়ে নেতারা জরুরি সভায় মিলিত হন। সভায় সভাপতিত্ব করেন সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা আবুল হাশিম। সভায় পরদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল বিতর্ক হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষের প্রস্তাব গৃহীত হয়ে যায়। অপরদিকে সরকারের ১৪৪ ধারা ঘোষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক হল, ঢাকা মেডিকেল কলেজে ছাত্রসভায় পরদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অন্যদিকে অলি আহাদের নেতৃত্বে যুবলীগ কর্মীরাও ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ও যুবলীগ নেতারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ) প্রাঙ্গণে সমবেত হন। এ সময় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে কি না, তা নিয়ে নেতাদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি দেখা দেয়। একদল যেকোনো মূল্যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে, অন্যরা তার বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নেয়। এরপর দুপুর ১২টার দিকে গাজীউল হকের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রসভা শুরু হয়। সভায় দু-একজন ছাড়া প্রায় সব বক্তাই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত দেন। সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল মতিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে জোরালো বক্তব্য দেন। এরপর সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৬ জন, ৮ জন করে গ্রুপে ভাগ হয়ে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় বের হতে থাকেন এবং গেটের বাইরে অপেক্ষমাণ পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করতে থাকে। পুলিশের এই আচরণে ক্ষিপ্ত ছাত্ররা একযোগে বিশ্ববিদ্যালয় গেট অতিক্রম করে রাজপথে নেমে এলে পুলিশ লাঠিপেটা এবং কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। জবাবে ছাত্ররাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করেন। মুহূর্তে এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ছাত্ররা মিছিলসহ পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। গণপরিষদ ভবনে (বর্তমান জগন্নাথ হল) আইন পরিষদের অধিবেশন চলছিল। মিছিলটি এর কাছাকাছি পৌঁছালে ঢাকার জেলা প্রশাসক পুলিশকে গুলি করার নির্দেশ দেন। এলোপাতাড়ি গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র আবুল বরকত গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। তাঁকে অন্যরা ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যান, সেখানে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এদিন পুলিশের গুলিতে আরও নিহত হন জব্বার ও রফিক।
ছাত্র মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনা বিদ্যুৎবেগে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। ঢাকা শহর পরিণত হয় মিছিলের শহরে। সবার কণ্ঠে একই স্লোগান—‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নূরুল আমিনের কল্লা চাই’, ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’।
ওদিকে ছাত্র মিছিলে গুলির সংবাদে আইন পরিষদের চলমান অধিবেশনে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সদস্য মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ অধিবেশন মুলতবি রেখে ছাত্র মিছিলে গুলির ঘটনার ওপর আলোচনার প্রস্তাব করেন। তাঁকে সমর্থন করেন খয়রাত হোসেন ও আনোয়ারা খাতুন। কিন্তু স্পিকার সে প্রস্তাব গ্রহণ না করায় এবং মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন ছাত্রহত্যার পক্ষে সাফাই গাওয়ার প্রতিবাদে আইন পরিষদ সদস্য মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, দৈনিক আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন, বেগম আনোয়ারা খাতুন ও কংগ্রেস দলীয় সদস্যরা ওয়াক আউট করেন। মাওলানা তর্কবাগীশ ও আবুল কালাম শামসুদ্দিন গণপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। ঢাকার পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করায় সরকার ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কারফিউ জারি করে এবং সেনাবাহিনী তলব করে।
২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ চলে। এদিন শফিউর রহমানসহ কয়েকজন শহীদ হন। ছাত্রনেতাদের বৈঠকে ২১ ফেব্রুয়ারি যেখানে প্রথম গুলি চালানো হয়েছিল, সেখানে একটি শহীদ মিনার স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি। রাতে সে মোতাবেক শহীদ মিনারটি নির্মিত হয়। এই নির্মাণকাজে ইট, বালু, রড, সিমেন্ট সরবরাহ করেন ঢাকার তৎকালীন নেতৃস্থানীয় ঠিকাদার পিয়ারু সরদার। ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে শহীদ মিনারটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। কিন্তু ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতেই পুলিশ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় শহীদ মিনারটি। পরবর্তীকালে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ওই বছরই আতাউর রহমান খান মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রখ্যাত স্থপতি হামিদুর রাহমানের নকশায় বর্তমান শহীদ মিনার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। আতাউর রহমান খান সরকারের আমলে সে নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। পরে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের আমলে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লে. জে. আযম খান শহীদ মিনারটি নির্মাণের ব্যবস্থা করেন। ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ বরকতের মা সেটা উদ্বোধন করেন।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের গর্ভে জন্ম নেওয়া মহান শহীদ দিবস সৃষ্টির ইতিহাস এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিশদ বর্ণনা সম্ভব নয়। আজ নানাবিধ কারণে মহান শহীদ দিবসের সে মহিমা অনেকটাই ম্লান। এ দিনটি আজ শুধুই আনুষ্ঠানিকতা ও উৎসবের দিবসে পরিণত হয়েছে। মহান শহীদ দিবসের মাহাত্ম্য ভুলে যাওয়া হবে আত্মঘাতী।
এমনিতেই ফেব্রুয়ারি এলে রাজপথগুলো আগুনরাঙা হয়ে ওঠে। বাতাসে গনগনে ফুলকি ছড়াতে শুরু করে। ফেব্রুয়ারি এ দেশের প্রতিটি মানুষকে মনে করিয়ে দেয় ১৯৫২ সালে তার রচিত পথের কথা।
৭ ঘণ্টা আগে২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতা হলেও স্বৈরশাসক হাসিনা কিংবা আন্দোলনকারীরা তা আন্দাজ করতে পারেননি। জনগণ তাতে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিয়েছিল স্বৈরশাসক হাসিনাকে...
৭ ঘণ্টা আগেতথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ বা পিআইবিতে তারুণ্যের উৎসবে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পেশিশক্তিনির্ভর ছাত্ররাজনীতির অবসান হওয়া প্রয়োজন। ছাত্রদের দেশের কল্যাণে ইতিবাচক রাজনীতি করতে...
৭ ঘণ্টা আগেএকুশ মানে মাথা নত না করা—শিক্ষাবিদ আবুল ফজলের বলা এই বাক্যটি এতটা প্রাসঙ্গিক হয়ে আর কবে দেখা দিয়েছে? নানা লোকের নানা মতবাদে দেশের ভাবনার ভারসাম্য যখন বিপদের সম্মুখীন, তখন একুশ আমাদের কোন অনুপ্রেরণা দেয়, সেটা নির্ধারণ করার দায়িত্বও এ সময়কার মানুষদের ওপর বর্তায়।
১ দিন আগে