মযহারুল ইসলাম চৌধুরী
ঢাকার আদি-স্থানীয় মানুষের মুখের ভাষা নির্ভেজাল বাংলা কখনো ছিল না। ছিল পৃথক দুটি স্থানীয় ভাষা, সোব্বাসি ও ঢাকাইয়া কুট্টি। সোব্বাসি ভাষা হিন্দি ও উর্দুর মিশ্রণে হলেও হিন্দি, উর্দু নয়। হিন্দি ও উর্দুর মিশ্রিত রূপ। স্থানীয়দের এই ভাষার প্রসার ঘটেছিল ঢাকার নবাবদের সংস্পর্শে। নবাববাড়িতে, নবাব দরবারে, বাগানে, আস্তাবলে, বাবুর্চিখানায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্থানীয়রা কাজকর্মে, জীবিকায় নিয়োজিত ছিল। নবাববাড়ির সদস্যদের সঙ্গে কথোপকথনের মধ্য দিয়ে সোব্বাসি কথ্য ভাষার সৃষ্টি। নবাব পরিবারের ভাষা বাংলা ছিল না। ছিল চোস্ত উর্দু ঘরানার। নিজেদের স্থানীয় ভাষা এবং নবাবদের বলা ভাষার মিশ্রণে স্থানীয়দের মধ্যে কথ্য সোব্বাসি ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ। এই ভাষার ছিল না বর্ণমালা, ছিল না সাহিত্যও। অপর অংশের স্থানীয়দের মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার আদলে মুখের ভাষা ছিল বাংলা ভাষারই কথ্য কিংবা বিকৃত রূপ। যেটি ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষা নামে খ্যাত। কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঢাকাইয়া ভাষায় সর্বাধিক চলচ্চিত্রে, নাটকে, কৌতুক নকশায় অনর্গল সংলাপ বলেছেন। এবং গর্ব করে বলতেন ‘আমি বাঙাল, আমি ঢাকার ভানু।’
মজার বিষয় হচ্ছে, এ দুই ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে একধরনের আভিজাত্য ও অনাভিজাত্যের আদলে পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্বও ছিল। নবাববাড়ির সোব্বাসিভাষী কর্মচারীরা নিজেদের অভিজাত জ্ঞান করত। অপরাংশের ঢাকাইয়া কুট্টিরা ক্ষুদ্র কুটিরশিল্পের কারিগরসহ বিভিন্ন ছোটখাটো পেশায় যুক্ত থাকায় সোব্বাসিভাষীরা নিজেদের তুলনায় তাদের অনগ্রসর বিবেচনা করত। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবেও অগ্রসর ছিল সোব্বাসিভাষীরা। যেহেতু ঢাকার সেরা ধনী নবাব পরিবারের সঙ্গে তাদের নিত্য যোগাযোগ ও সান্নিধ্যলাভ সম্ভব হতো জীবিকাজনিত কারণে, তাই নবাবদের উন্নত সংস্কৃতির প্রভাবও পড়েছিল তাদের ওপর, তবে সেটা বাঙালিয়ানার নয়। অল্পবিস্তর শিক্ষালাভও ঘটেছিল তাদের, যার কারণে এ দুই ভাষাভাষীর মানুষের মধ্যে যেমন ছিল দ্বন্দ্ব, তেমনি বৈষম্যও। সোব্বাসিভাষীরা ঢাকাইয়াভাষীদের কুট্টি এবং ঢাকাইয়াভাষীরা সোব্বাসিভাষীদের ‘হামোকা তোমোকা’ বলে উপহাস করত। সোব্বাসিভাষীরা যেমন বলত, ‘মেরে আম্মিনে সেরবেনের পাকইস’, অর্থাৎ আমার মা ফিরনি রেঁধেছে; ‘আপ কাঁইয়ে’, অর্থাৎ আপনি বলুন ইত্যাদি। এ ধরনের ভাষাই সোব্বাসি ভাষা নামে বিস্তার ও পরিচিতি লাভ করেছিল। দুই ভাষাভাষীর মধ্যে খুনসুটি-বৈরিতা যেমন ছিল, তেমনি সামাজিক ক্ষেত্রেও পারতপক্ষে কেউ কারও সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হতো না ওই ভাষা-সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণেই।
ধর্মীয় উৎসব-পার্বণের পাশাপাশি স্থানীয়দের নিজস্ব সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে উঠেছিল। সেগুলো ছিল যেমন স্বাতন্ত্র্য, তেমনি স্বকীয়তায়। চৈত্রসংক্রান্তিতে মেলা হতো। স্থানীয়দের ভাষায় ‘চৈত্র পূজার মেলা’। হিন্দু-মুসলিমনির্বিশেষে সবাই দর্শক-ক্রেতা হিসেবে মেলায় যোগ দিত। ঘুড়ি ওড়ানো নিত্যদিনই দেখা যেত, তবে সাকরাইন বাড়ির ছাদে, বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলজুড়ে, খোলা মাঠে ঘুড়ি ওড়ানো উৎসবের আদলে পালিত হতো। বর্ষা মৌসুমে টইটম্বুর বুড়িগঙ্গা নদীতে সাঁতার প্রতিযোগিতা, নৌকাবাইচের আয়োজন ছিল অপরিহার্য। স্থানীয়দের উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাঁতারু, দীর্ঘ লম্বা আকৃতির বাইচের নৌকা এসে ভিড় করত। রোজার শেষ দিকে স্থানীয় যুবকেরা গানের দল গঠন করে ভোররাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান করে চাঁদা তুলত। স্থানীয় ভাষায় গানের দলকে বলা হতো ‘কাসিদা’। কালের গর্ভে সেগুলো এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
স্থানীয়রা গানের ভক্ত ছিল। তবে বাংলা গানের নয়। হিন্দি, উর্দু গানই তাদের পছন্দের তালিকায় ছিল। স্থানীয়দের কাছে জনপ্রিয় ছিল বোম্বের হিন্দি ও লাহোরের উর্দু গান। বাসাবাড়িতে সিলোন বেতারের জনপ্রিয় পুরোনো হিন্দি গানগুলো বাজত। সড়কের পাশে খাবার হোটেলে রেকর্ড প্লেয়ারে বিরামহীন বাজত জনপ্রিয় হিন্দি ও উর্দু গান। বিয়েসহ সব সামাজিক অনুষ্ঠানে মাইক বাজানো ছিল অপরিহার্য। ওই সব মাইকে দিন-রাত হিন্দি ও উর্দু গানের পাশাপাশি বাংলা গানও অবিরাম বাজত। সংগীতের প্রতি তারা অনুরাগী ছিল তো বটেই, তখনকার সাংস্কৃতিক সব মাধ্যমের দর্শক-শ্রোতা হিসেবে তাদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। তাদের সেরা বিনোদনের উপকরণ ছিল প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছবি দেখা। একসময় বোম্বে নির্মিত হিন্দি ছবির একচেটিয়া দর্শক ছিল তারা। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় ভারতের হিন্দি, বাংলা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি সব ধরনের পত্র-পত্রিকা প্রকাশনা, প্রদর্শন ও আগমন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দেন আইউব খান। এতে আমাদের সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়, যার ধারাবাহিকতা নানা প্রতিবন্ধকতায় আজও বিদ্যমান। প্রযুক্তি অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধকতার দেয়াল ভেঙে দিয়েছে। বোম্বের হিন্দি ছবির জায়গাটি দখলের চেষ্টা করেছিল লাহোরে নির্মিত উর্দু ছবি। তবে বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের দাপটে উর্দু ছবি আমাদের ভূখণ্ডে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করতে ব্যর্থ হয়। বাংলা চলচ্চিত্রের প্রভাবে এখানে উর্দু ছবি দাঁড়াতে পারেনি। স্থানীয়রা উর্দু, বাংলা দুই ভাষার ছবি দেখতেই প্রেক্ষাগৃহে ছুটত। স্থানীয়রা সব ধরনের সাংস্কৃতিক উপভোগে নিজেদের যুক্ত রাখত। সাংস্কৃতিক অনুরাগী হিসেবে, দর্শক-শ্রোতা হিসেবে তাদের উপস্থিতি বরাবরই ছিল।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের গুলিতে ছাত্র হত্যার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয়দের মধ্যেও তীব্র ক্ষোভ-বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছাত্রদের আন্দোলনের সীমানা পেরিয়ে দেশজুড়ে ক্ষোভের সঞ্চার করে। সারা পূর্ব বাংলার মানুষের মতো স্থানীয়দেরও বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ছাত্র হত্যার আগপর্যন্ত ভাষা আন্দোলন দেশবাসীর ওপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। কিন্তু বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ডের পর ভাষা আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। স্থানীয়দের মধ্যেও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সবেগে বিস্তার লাভ করে। এবং তারা অকাতরে শামিল হয়ে যায়।
প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে অর্থ ও নির্মাণসামগ্রী পাওয়া ছিল কষ্টকরই। কিন্তু পুরান ঢাকার হোসেনি দালান অঞ্চলের স্থানীয় ঠিকাদার-ব্যবসায়ী পেয়ারু সর্দার এগিয়ে এসে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে তাঁর গোডাউন থেকে ইট, বালু, সুরকি, রড, সিমেন্ট ইত্যাদি স্বতঃস্ফূর্ত সরবরাহ করে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে সহযোগিতা করেছিলেন। স্থানীয়রা নিজেদের সোব্বাসি ও ঢাকাইয়া আঞ্চলিক ভাষাকে অতিক্রম করে মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে এবং ভাষা ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। ওই সময় তাদের মধ্যে আর বৈরিতার ছিটেফোঁটাও ছিল না। তবে তারা পরস্পর নিজেদের স্থানীয় ভাষা কিন্তু ত্যাগ করেনি। আজও তার অস্তিত্ব পুরান ঢাকায় বহাল তবিয়তে রয়েছে।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
ঢাকার আদি-স্থানীয় মানুষের মুখের ভাষা নির্ভেজাল বাংলা কখনো ছিল না। ছিল পৃথক দুটি স্থানীয় ভাষা, সোব্বাসি ও ঢাকাইয়া কুট্টি। সোব্বাসি ভাষা হিন্দি ও উর্দুর মিশ্রণে হলেও হিন্দি, উর্দু নয়। হিন্দি ও উর্দুর মিশ্রিত রূপ। স্থানীয়দের এই ভাষার প্রসার ঘটেছিল ঢাকার নবাবদের সংস্পর্শে। নবাববাড়িতে, নবাব দরবারে, বাগানে, আস্তাবলে, বাবুর্চিখানায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্থানীয়রা কাজকর্মে, জীবিকায় নিয়োজিত ছিল। নবাববাড়ির সদস্যদের সঙ্গে কথোপকথনের মধ্য দিয়ে সোব্বাসি কথ্য ভাষার সৃষ্টি। নবাব পরিবারের ভাষা বাংলা ছিল না। ছিল চোস্ত উর্দু ঘরানার। নিজেদের স্থানীয় ভাষা এবং নবাবদের বলা ভাষার মিশ্রণে স্থানীয়দের মধ্যে কথ্য সোব্বাসি ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ। এই ভাষার ছিল না বর্ণমালা, ছিল না সাহিত্যও। অপর অংশের স্থানীয়দের মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার আদলে মুখের ভাষা ছিল বাংলা ভাষারই কথ্য কিংবা বিকৃত রূপ। যেটি ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষা নামে খ্যাত। কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঢাকাইয়া ভাষায় সর্বাধিক চলচ্চিত্রে, নাটকে, কৌতুক নকশায় অনর্গল সংলাপ বলেছেন। এবং গর্ব করে বলতেন ‘আমি বাঙাল, আমি ঢাকার ভানু।’
মজার বিষয় হচ্ছে, এ দুই ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে একধরনের আভিজাত্য ও অনাভিজাত্যের আদলে পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্বও ছিল। নবাববাড়ির সোব্বাসিভাষী কর্মচারীরা নিজেদের অভিজাত জ্ঞান করত। অপরাংশের ঢাকাইয়া কুট্টিরা ক্ষুদ্র কুটিরশিল্পের কারিগরসহ বিভিন্ন ছোটখাটো পেশায় যুক্ত থাকায় সোব্বাসিভাষীরা নিজেদের তুলনায় তাদের অনগ্রসর বিবেচনা করত। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবেও অগ্রসর ছিল সোব্বাসিভাষীরা। যেহেতু ঢাকার সেরা ধনী নবাব পরিবারের সঙ্গে তাদের নিত্য যোগাযোগ ও সান্নিধ্যলাভ সম্ভব হতো জীবিকাজনিত কারণে, তাই নবাবদের উন্নত সংস্কৃতির প্রভাবও পড়েছিল তাদের ওপর, তবে সেটা বাঙালিয়ানার নয়। অল্পবিস্তর শিক্ষালাভও ঘটেছিল তাদের, যার কারণে এ দুই ভাষাভাষীর মানুষের মধ্যে যেমন ছিল দ্বন্দ্ব, তেমনি বৈষম্যও। সোব্বাসিভাষীরা ঢাকাইয়াভাষীদের কুট্টি এবং ঢাকাইয়াভাষীরা সোব্বাসিভাষীদের ‘হামোকা তোমোকা’ বলে উপহাস করত। সোব্বাসিভাষীরা যেমন বলত, ‘মেরে আম্মিনে সেরবেনের পাকইস’, অর্থাৎ আমার মা ফিরনি রেঁধেছে; ‘আপ কাঁইয়ে’, অর্থাৎ আপনি বলুন ইত্যাদি। এ ধরনের ভাষাই সোব্বাসি ভাষা নামে বিস্তার ও পরিচিতি লাভ করেছিল। দুই ভাষাভাষীর মধ্যে খুনসুটি-বৈরিতা যেমন ছিল, তেমনি সামাজিক ক্ষেত্রেও পারতপক্ষে কেউ কারও সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হতো না ওই ভাষা-সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণেই।
ধর্মীয় উৎসব-পার্বণের পাশাপাশি স্থানীয়দের নিজস্ব সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে উঠেছিল। সেগুলো ছিল যেমন স্বাতন্ত্র্য, তেমনি স্বকীয়তায়। চৈত্রসংক্রান্তিতে মেলা হতো। স্থানীয়দের ভাষায় ‘চৈত্র পূজার মেলা’। হিন্দু-মুসলিমনির্বিশেষে সবাই দর্শক-ক্রেতা হিসেবে মেলায় যোগ দিত। ঘুড়ি ওড়ানো নিত্যদিনই দেখা যেত, তবে সাকরাইন বাড়ির ছাদে, বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলজুড়ে, খোলা মাঠে ঘুড়ি ওড়ানো উৎসবের আদলে পালিত হতো। বর্ষা মৌসুমে টইটম্বুর বুড়িগঙ্গা নদীতে সাঁতার প্রতিযোগিতা, নৌকাবাইচের আয়োজন ছিল অপরিহার্য। স্থানীয়দের উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাঁতারু, দীর্ঘ লম্বা আকৃতির বাইচের নৌকা এসে ভিড় করত। রোজার শেষ দিকে স্থানীয় যুবকেরা গানের দল গঠন করে ভোররাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান করে চাঁদা তুলত। স্থানীয় ভাষায় গানের দলকে বলা হতো ‘কাসিদা’। কালের গর্ভে সেগুলো এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
স্থানীয়রা গানের ভক্ত ছিল। তবে বাংলা গানের নয়। হিন্দি, উর্দু গানই তাদের পছন্দের তালিকায় ছিল। স্থানীয়দের কাছে জনপ্রিয় ছিল বোম্বের হিন্দি ও লাহোরের উর্দু গান। বাসাবাড়িতে সিলোন বেতারের জনপ্রিয় পুরোনো হিন্দি গানগুলো বাজত। সড়কের পাশে খাবার হোটেলে রেকর্ড প্লেয়ারে বিরামহীন বাজত জনপ্রিয় হিন্দি ও উর্দু গান। বিয়েসহ সব সামাজিক অনুষ্ঠানে মাইক বাজানো ছিল অপরিহার্য। ওই সব মাইকে দিন-রাত হিন্দি ও উর্দু গানের পাশাপাশি বাংলা গানও অবিরাম বাজত। সংগীতের প্রতি তারা অনুরাগী ছিল তো বটেই, তখনকার সাংস্কৃতিক সব মাধ্যমের দর্শক-শ্রোতা হিসেবে তাদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। তাদের সেরা বিনোদনের উপকরণ ছিল প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছবি দেখা। একসময় বোম্বে নির্মিত হিন্দি ছবির একচেটিয়া দর্শক ছিল তারা। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় ভারতের হিন্দি, বাংলা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি সব ধরনের পত্র-পত্রিকা প্রকাশনা, প্রদর্শন ও আগমন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দেন আইউব খান। এতে আমাদের সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়, যার ধারাবাহিকতা নানা প্রতিবন্ধকতায় আজও বিদ্যমান। প্রযুক্তি অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধকতার দেয়াল ভেঙে দিয়েছে। বোম্বের হিন্দি ছবির জায়গাটি দখলের চেষ্টা করেছিল লাহোরে নির্মিত উর্দু ছবি। তবে বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের দাপটে উর্দু ছবি আমাদের ভূখণ্ডে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করতে ব্যর্থ হয়। বাংলা চলচ্চিত্রের প্রভাবে এখানে উর্দু ছবি দাঁড়াতে পারেনি। স্থানীয়রা উর্দু, বাংলা দুই ভাষার ছবি দেখতেই প্রেক্ষাগৃহে ছুটত। স্থানীয়রা সব ধরনের সাংস্কৃতিক উপভোগে নিজেদের যুক্ত রাখত। সাংস্কৃতিক অনুরাগী হিসেবে, দর্শক-শ্রোতা হিসেবে তাদের উপস্থিতি বরাবরই ছিল।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের গুলিতে ছাত্র হত্যার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয়দের মধ্যেও তীব্র ক্ষোভ-বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছাত্রদের আন্দোলনের সীমানা পেরিয়ে দেশজুড়ে ক্ষোভের সঞ্চার করে। সারা পূর্ব বাংলার মানুষের মতো স্থানীয়দেরও বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ছাত্র হত্যার আগপর্যন্ত ভাষা আন্দোলন দেশবাসীর ওপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। কিন্তু বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ডের পর ভাষা আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। স্থানীয়দের মধ্যেও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সবেগে বিস্তার লাভ করে। এবং তারা অকাতরে শামিল হয়ে যায়।
প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে অর্থ ও নির্মাণসামগ্রী পাওয়া ছিল কষ্টকরই। কিন্তু পুরান ঢাকার হোসেনি দালান অঞ্চলের স্থানীয় ঠিকাদার-ব্যবসায়ী পেয়ারু সর্দার এগিয়ে এসে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে তাঁর গোডাউন থেকে ইট, বালু, সুরকি, রড, সিমেন্ট ইত্যাদি স্বতঃস্ফূর্ত সরবরাহ করে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে সহযোগিতা করেছিলেন। স্থানীয়রা নিজেদের সোব্বাসি ও ঢাকাইয়া আঞ্চলিক ভাষাকে অতিক্রম করে মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে এবং ভাষা ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। ওই সময় তাদের মধ্যে আর বৈরিতার ছিটেফোঁটাও ছিল না। তবে তারা পরস্পর নিজেদের স্থানীয় ভাষা কিন্তু ত্যাগ করেনি। আজও তার অস্তিত্ব পুরান ঢাকায় বহাল তবিয়তে রয়েছে।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
দেশের সংবিধান, পুলিশ, স্থানীয় সরকার, নির্বাচন, বিচারব্যবস্থাসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কারের নানা আলাপ হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু এই সময়ে অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়ে খুব বেশি কিছু করা হয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারেরই গঠন করা শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
৩ ঘণ্টা আগেঈশ্বরকে এখনো বুঝে উঠতে পারিনি আমরা। এ কারণে মানবদেহ থাকলেও মনুষ্যত্ব, মানবিকতা নেই কিংবা মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি। ঈশ্বরকে বোঝার জন্য আমরা দায়বদ্ধ নই, যদিও আমাদের দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গটি এখানে আসার কথা ছিল না। শব্দটি প্রযোজ্য নয় এখানে। কিন্তু জন্ম, মৃত্যু ও ধর্মকে পুঁজি করে এক অদৃশ্য নাগপাশে বাঁধা পড়ে
৩ ঘণ্টা আগেঅন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ও কার্যপরিধি নিয়ে রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজে আলোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়েছে। এক অংশ মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকার শুধু নির্বাচন পরিচালনার জন্য যথেষ্ট নয়; বিচার বিভাগে সংস্কার, হাসিনা সরকারের হত্যা-নির্যাতন, গুম-খুন ও দুর্নীতির বিচার, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষকরণসহ নানা
৩ ঘণ্টা আগেঢাকা শহরে পরিবহনের অব্যবস্থাপনার কারণে নগরবাসী কাহিল অনেক আগে থেকেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যানজটের অসহনীয় যন্ত্রণা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বর্তমান সরকারের কিছু উদ্যোগ গ্রহণের কারণে মানুষ আশার আলো দেখতে পেলেও সময়ের সঙ্গে সেই আশাও নিরাশায় পরিণত হয়েছে। মূলত পরিবহনমালিক ও নেতাদের অসহযোগিতার কারণে
৩ ঘণ্টা আগে