Ajker Patrika

মোদিকে কি আরও পাঁচ বছর দেখতে হবে

উপসম্পাদকীয়
মোদিকে কি আরও পাঁচ বছর দেখতে হবে

অবশেষে ফলাফল প্রকাশ পেতেই সবাই অবাক হয়ে গেল। কেউই বিজেপির জয়ের গভীরতা ও ব্যাপ্তি অথবা কংগ্রেসের পরাজয়ের বিষয়টি আগাম বুঝতে পারেনি। রাজস্থানের ব্যাপারে সব সময়ই একটা প্রশ্ন ঝুলে থাকে। এই রাজ্যের মানুষ সাধারণত ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দেন। এটা বিশ্বাস করার কোনো কারণ ছিল না যে মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট ও সাবেক উপমুখ্যমন্ত্রী শচিন পাইলটকে জোর করে এক সুরে গান করতে বাধ্য করলেই সেই প্রবণতা উল্টে যাবে। তবুও নির্বাচন কাভার করা লোকেরা বলেছিলেন যে রাজস্থানে কংগ্রেস ভালো অবস্থানে রয়েছে।

ধরেই নেওয়া হয়েছিল, মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস নিশ্চিতভাবে জিতছে। সর্বোপরি দলটি ২০১৮ সালের নির্বাচনে জিতলেও, দল ভাঙানোর কারণে ক্ষমতা হারিয়েছিল। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ক্লান্ত ও বৃদ্ধ মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানের সঙ্গে লেপ্টে থাকা ইনকাম্বেন্সির ঘটনা। সব মিলিয়ে বলা হয়েছিল, ভোটাররা কংগ্রেসকে আবার বেছে নেবেন। আর ছত্তিশগড় নিয়ে তো আলোচনাই হয়নি। কংগ্রেস বলেছিল, তারা নিশ্চিত জিতবে এবং কম লোকই এই দাবির সঙ্গে তীব্রভাবে দ্বিমত করেছিলেন।

যা-ই হোক, ফলাফল যখন আসতে থাকে, তখন এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে ভোটারদের মনোভাব খুব কম লোকই অনুমান করতে পেরেছিলেন। সত্যিই ভোটের সময় একটা রাজ্য ঘুরে আপনি বুঝতেই পারলেন না যে বিজেপি ভূমিধস বিজয় পেতে চলেছে। যে সাংবাদিকেরা নির্বাচন কাভার করেছেন, তাঁরাই যে শুধু বুঝতে পারেননি, বিষয়টা এমন না। এমনকি বুথফেরত ভোটারদের মতামতের ওপর চালানো জরিপ বা এক্সিট পোলের সঙ্গে জড়িতরাও (ব্যতিক্রম দু-একটি বাদে) বুঝতে পারেননি। আরও খারাপ, মধ্যপ্রদেশ কংগ্রেস তার নিজস্ব প্রচারে বিশ্বাসী ছিল। শেষ অবধি তারা নিশ্চিত ছিল যে তারা জিততে চলেছে। 

কংগ্রেস হেরে যাওয়ায় বলছে, সনাতন ধর্ম নিয়ে তাদের তামিলনাড়ুর মিত্র ডিএমকের নেতা যখন লাগামহীন আক্রমণ শুরু করেছিলেন, তখন তারা (কংগ্রেস) যথেষ্ট জোরালোভাবে প্রতিবাদ করেনি। কিন্তু প্রত্যেকেই এ কথা বলেছেন, কংগ্রেসের নরম হিন্দুত্ব লাইন নেওয়ায় হেরেছে। যাঁরা রাহুল গান্ধীর প্রতাপের অভিযোগ করেছিলেন এবং কংগ্রেসকে পরামর্শ দিয়েছিলেন রাজ্যের অভিজ্ঞ নেতাদের কাছে প্রচারাভিযান ছেড়ে দিতে, তাঁরাই এখন বলছেন, অশোক গেহলট এবং মধ্যপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী দিগ্বিজয় সিং ও কমলনাথ, ‘কংগ্রেসের মুখ’ হিসেবে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা খুবই বৃদ্ধ এবং বিতর্কিত।

যুবশক্তি কোথায় ছিল? তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য কেউ ছিল না। সে কারণে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে বিজেপির বিজয় শুধু একটি জিনিসই বুঝিয়ে দিয়েছে যে ভারতের হিন্দিভাষী অঞ্চলের মানুষের কাছে এখনো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভোটের আবেদন ঈর্ষণীয়। এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা, যা সব ঘটনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিছু কারণে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা সম্ভবত চামচামতো (সম্ভ্রান্ত) শোনাবে বলে ভয় পান, তাই তাঁরা বলতে অনিচ্ছুক। আগেও যখন বিজেপি উত্তর প্রদেশে অভূতপূর্ব জয়লাভ করেছিল, তখনো এটিকে মোদির বিজয় বলে মেনে নিতে অনেকের অনীহা ছিল। এর বদলে তাঁরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের প্রশংসা করেছিলেন। তাঁকে নির্বাচনের নায়ক বানিয়েছিলেন। কিন্তু সত্য হলো যে বিজেপির বিজয়ের জন্য দেওয়া সব কারণ—জাতি গণনা, কল্যাণ প্রকল্প, হিন্দুত্ব ইত্যাদি বিষয় তোলা যায়। কিন্তু ভোটারদের কাছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

মোদির নেতৃত্বই বিজেপিকে কার্যত হিন্দি বলয়ে অপরাজেয় করে তুলেছে। বিজেপিকে রাজস্থানে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে কাউকে তুলে ধরতে হয়নি। এমনকি মধ্যপ্রদেশেও, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে এর সমীকরণের কারণে নির্বাচনের পরেও শিবরাজ সিং চৌহান যে অবিসংবাদিত নেতা হতে চলেছেন, তা কোনোভাবেই স্পষ্ট ছিল না। ভোটাররা আসলে পাত্তা দেননি। তাঁরা মোদিকে ভোট দিয়েছেন। মোদি এমন একজন নেতা, যাঁর আবেদন এখন বিজেপির চেয়ে অনেক বেশি। মোদির অধীনে সব নির্বাচনেই তিনি সব আকর্ষণের কেন্দ্রে। হিন্দিভাষী অঞ্চলে এটি কাজ করে। এটা ঠিক যে একই যুক্তি ভারতের বাকি অংশে কাজ করে না। পশ্চিমবঙ্গকে মোদি ব্যক্তিগত প্রেস্টিজ ইস্যু করার পরেও তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) ভূমিধস জয় পায়। কর্নাটকে তিনি অক্লান্তভাবে রাজ্যজুড়ে প্রচার চালিয়েছেন, শুধু কংগ্রেসকে হারানোর জন্য। পাঞ্জাবে মোদির সব প্রচার মাঠে মারা গেছে। কিন্তু হিন্দিভাষী অঞ্চলের ভোটাররা মোদিকে ভালোবাসেন এবং যতক্ষণ বিজেপি তাঁর নামে ভোট চাইবে, তাঁরা মোদির অনুকূলে উৎসাহের সঙ্গে সাড়া দেবেন। 

এই নির্বাচনের একটা প্রভাব ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে আছে। যদি মোদির কারিশমা উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও গুজরাটে কাজ করে তাহলে বিজেপি নির্বাচনে জিতবে। বিহার একটু ধূসর এলাকা। এরপরও সম্ভবত মোদি-জাদু সেখানে কাজ করবে। কিন্তু বিহার ছাড়াও বিজেপির জেতার জন্য হিন্দি-বেল্টে যথেষ্ট আসন থাকবে।

এর মানে হলো, আমাদের মোদিকে আরও পাঁচ বছর দেখতে হবে। কয়েক সপ্তাহ আগে লিখেছিলাম, ‘মোদিকে আর একজন সাধারণ রাজনীতিবিদ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে না। লোকেরা তাঁকে প্রকৃতির একটা শক্তি (ফোর্স অব নেচার) হিসেবে দেখে।’
একইভাবে স্পষ্ট যে বিরোধী দলগুলো কীভাবে মোদির বিরোধিতা করতে হবে তা বুঝতে পারেনি। ব্যক্তিগত আক্রমণ (যেমন কুখ্যাত ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ অভিযান) উল্টে বুমেরাং হয়েছে। আমিও লিখেছিলাম: ‘তাঁর ব্যর্থতার দায় অন্যদের। তাঁর সব সাফল্য একান্তই তাঁর নিজস্ব। এক রহস্যময় উপায়ে, তিনি মনে হয় রোজকার রাজনীতির ঝগড়াঝাঁটির ওপরে উঠে গেছেন।’

পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে মোদিকে কীভাবে পরাজিত করতে হবে, বিরোধীরা তা নির্ধারণ করে উঠতে পারবে কি না, আমার সন্দেহ আছে। সুতরাং, আমাদের যে প্রশ্নটি করা উচিত না তা হলো, ‘মোদি কি জিতবেন?’ এটি হওয়া উচিত, ‘তিনি জিতলে এবার কী করবেন?’
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ ভারত একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। মোদির অধীনে অর্থনীতি ঠিকই চলবে—আমরা গত দশকে তা দেখেছি এবং উন্নয়ন চলবে। কিন্তু প্রকৃত উদ্বেগ আমাদের গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে। তিনি কি তাদের যথেষ্ট সম্মান করবেন? ভারতের বহুত্ববাদী চরিত্র সম্পর্কে তিনি কী বলবেন? তিনি কীভাবে তা সংরক্ষণ এবং বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবেন?

তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সময় (শেষ হওয়ার সময় তাঁর বয়স হবে ৭৯ বছর) তিনি কি নির্বাচন জিততে এবং তাঁর বিরোধীদের শাস্তি দেওয়ার ওপর কম মনোযোগ দেবেন? তিনি কি এক শক্তিশালী কিন্তু গণতান্ত্রিক নেতার ঐতিহ্য নিশ্চিত করতে কাজ করবেন? নাকি আমাদের আরও একই রকম দেখতে হবে?

মোদি কখনো এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেন না। তাঁর কাছে কেউ এসব প্রশ্ন করার সাহস করে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই বিধানসভা নির্বাচনের ফল ভুলে যাবে, কিন্তু এটা সাফল্য না ব্যর্থতা, তা ইতিহাস বিচার করবে। 

(ভারতীয় অনলাইন পোর্টাল দ্য প্রিন্ট-এ প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)

বীর সাংভি, সাবেক সম্পাদক, হিন্দুস্তান টাইমস

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ডিএনসিসির পদ ছাড়লেন এস্তোনিয়ার নাগরিক আমিনুল ইসলাম

ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল নিয়ে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা, চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশ

এনআইডির নাম ও জন্মতারিখ সংশোধনের দায়িত্বে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা

পদত্যাগ করব না, আলোচনা করে সমাধান করব: কুয়েট উপাচার্য

কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর অতর্কিত গুলি, নিহত ২৬

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত