Ajker Patrika

সংকটকালে সারথিকে স্মরণ

ইদানীং তাজউদ্দীনকে শেখ মুজিবের বিকল্প হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন কেউ কেউ। তাঁদের সে চাওয়ার মধ্যে যতটা না আন্তরিকতার ছাপ পাওয়া যায়, তার চেয়ে ঢের বেশি লক্ষণীয় সূক্ষ্ম রাজনীতি। তাজউদ্দীনের মুক্তিযুদ্ধকালীন নেতৃত্বের ভূমিকাটিকে আড়াল করে রাখার মাধ্যমে জাতি হিসেবে আমরা নিজেদেরকেই খাটো করছি।

আজাদুর রহমান চন্দন
আপডেট : ২৮ জুলাই ২০২৫, ০৮: ০৮
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ভূ-রাজনৈতিক কারণেই আমাদের এই ছোট্ট ভূখণ্ডটির ওপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শ্যেনদৃষ্টি অনেক আগে থেকে। কিন্তু ইদানীং যেন তারা আমাদের দেশটিকে গিলে খেতে মরিয়া। মিয়ানমারের আরাকান আর্মির স্বার্থে করিডর আর চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ইজারা দিতে বাধ্য করার আলোচনার রেশ কাটতে না কাটতেই সামনে এল এক গোপন শুল্ক-বাণিজ্য চুক্তির কথা। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে ধরনের ‘নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট’ বা এনডিএ সই করেছে, তা দেশের ইতিহাসে প্রথম। অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি এক গোলটেবিল আলোচনায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কোনো পার্টনার (অন্য দেশ) কোনো দিন এনডিএ ডকুমেন্ট দেয়নি।’ এনডিএ হলো এমন একধরনের আইনি চুক্তি, যা দুটি পক্ষের মধ্যে গোপনীয় তথ্য আদান-প্রদানকালে ব্যবহার করা হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে একটি পক্ষ অন্য পক্ষের সঙ্গে কিছু নির্দিষ্ট তথ্য শেয়ার করে, কিন্তু সেই তথ্য অন্য কারও সঙ্গে শেয়ার করা বা প্রকাশ না করার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়। দেবপ্রিয় বলেন, ‘এর বদলে নন-পেপার ইস্যু করা যেত—যার অর্থ হলো এটা আমার অবস্থান, কিন্তু আমি নিজে সই করব না। নন-পেপার হলে রেসপনসিবিলিটি তৈরি হতো, কিন্তু এখন বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়ে গেছে। এখন যদি বাংলাদেশ কোনো লবিস্ট নিয়োগ করে, তার কাছেও এ তথ্য প্রকাশ করা যাবে না।’

প্রথমে জানা গিয়েছিল যে বাংলাদেশি সব ধরনের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, তিন মাস ধরে আলোচনার পর বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ৭ জুলাই নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এ ঘোষণা দেন তিনি। এর আগে ৩ এপ্রিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছিলেন ট্রাম্প। সে সময় বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। এর আগে থেকেই দেশটিতে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর গড়ে ১৫ শতাংশ করে শুল্ক ছিল। নতুন শুল্কহার ৯ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও সেটি পিছিয়ে ১ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়। চূড়ান্ত শুল্কের পরিমাণ উল্লেখ করে বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশের নেতাদের উদ্দেশে চিঠি পাঠান ট্রাম্প। এসব চিঠি ট্রুথ সোশ্যালে প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে লেখা চিঠিতে ট্রাম্প বলেছেন, ‘২০২৫ সালের ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো সব বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক বসবে। এটি খাতভিত্তিক শুল্কের সঙ্গে আলাদাভাবে যোগ হবে। উচ্চ শুল্ক এড়াতে যদি কোনো পণ্য ঘুরপথে যুক্তরাষ্ট্রে আনা হয়, তাহলে সেই পণ্যের ওপরও উচ্চ শুল্কই আরোপ করা হবে।’

এই শুল্ক আরোপ নিছক কোনো সাধারণ বাণিজ্যের ব্যাপার নয়, এটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি ভূ-রাজনৈতিক হাতিয়ার। যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক কৌশল হলো—বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশকে চাপে ফেলে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেশটির ক্রমবর্ধমান রপ্তানি প্রবৃদ্ধিকে হুমকির মুখে ফেলা। বাংলাদেশকে পাঠানো মার্কিন বাণিজ্য দপ্তর ইউএসটিআরের গোপনীয় চিঠিতে সে ধরনের সব শর্তই উল্লেখ আছে। ইউএস-বাংলাদেশ অন রেসিপ্রোকাল ট্রেড (বাংলাদেশ স্পেসিফিক কমিটমেন্টস) শিরোনামের চিঠিটি পাঠানো হয় গত ২১ মে। এ নিয়ে সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়েরের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চুক্তির বিভিন্ন শর্তসংবলিত ২১ পাতার চিঠিটি মোটাদাগে ছয় ভাগে বিভক্ত। অর্থাৎ ছয় ধরনের শতাধিক শর্তসংক্রান্ত আলোচনা রয়েছে চুক্তিতে। এগুলো হলো করসংক্রান্ত শর্ত, অশুল্ক বাধাসংক্রান্ত শর্ত, ডিজিটাল বাণিজ্য ও প্রযুক্তিসংক্রান্ত শর্ত, রুলস অব অরিজিন-সংক্রান্ত শর্ত, অর্থনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত শর্ত এবং বাণিজ্যিক শর্ত। অর্থনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত শর্ত এবং বাণিজ্যিক শর্তগুলো পর্যালোচনা করলে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ও চাপের বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা যায়। এসব শর্তের মাধ্যমে বাংলাদেশে মার্কিন পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি যেমন নিশ্চিত করা হয়েছে, তেমনি চীনা আমদানি কমাতেও এতে স্পষ্ট নির্দেশনা আছে।

মার্কিন স্বার্থ রক্ষাকারী ওই গোপন চুক্তিসংক্রান্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিল বাংলা আউটলুক। সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন মহলের চাপে বাংলা আউটলুক পরে প্রতিবেদনটি সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। জনপ্রত্যাশা ছিল, বিগত সরকারগুলো বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যেসব অসম চুক্তি করেছে, অন্তর্বর্তী সরকার সেগুলো বাতিল করবে। কিন্তু কোনো অসম চুক্তি বাতিল করা তো দূরের কথা, উল্টো এনডিএর মতো গোপনীয় চুক্তি করছে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার। সাম্রাজ্যবাদী নগ্ন হস্তক্ষেপের প্রেক্ষাপটে ভীষণভাবে মনে পড়ে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য সারথি তাজউদ্দীন আহমদের কথা।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর ১৯৭২ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারার সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। প্রাথমিক আলোচনার পর বিস্তারিত আলোচনার জন্য ম্যাকনামারা, তাজউদ্দীন আহমদ এবং সিরাজুদ্দিন যখন বসলেন; তখন ম্যাকনামারা জানতে চাইলেন বাংলাদেশের জন্য কোথায় কী ধরনের সাহায্য দরকার। তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, ‘আমাদের যা দরকার তা আপনি দিতে পারবেন কি না আমার সন্দেহ আছে।’ ম্যাকনামারা বললেন, ‘মিস্টার মিনিস্টার, আপনি বলুন, আমরা চেষ্টা করব দিতে।’ তখন তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, ‘মিস্টার ম্যাকনামারা, আমার গরু এবং দড়ি দরকার। যুদ্ধের সময় গরু সব হারিয়ে গেছে। এখানে-ওখানে চলে গেছে, মরে গেছে। পাকিস্তান যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, চাষিরা এদিক-সেদিক পালিয়ে গেছে, তখন গরু হারিয়ে গেছে। এখন যুদ্ধ শেষ, চাষি ফিরেছে কিন্তু গরু নাই, তাই চাষ করবে কীভাবে? কাজেই আমাদের অগ্রাধিকার চাহিদা হলো গরু।’ ম্যাকনামারার চোখমুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, ‘আর আমাদের সমস্ত দড়ি তো পাকিস্তানিরা নষ্ট করে ফেলেছে, এখন গরু পেলে গরু বাঁধতে দড়ি প্রয়োজন। গরু এবং দড়ি প্রয়োজন খুব তাড়াতাড়ি, না হলে সামনে জমিতে চাষ হবে না।’ অস্বস্তিকর সেই মিটিং শেষে যখন তাজউদ্দীন আহমদকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি কেন এ রকম করলেন। উনি বললেন, ‘কেন, গরু ছাড়া কি চাষ হয়?’ মহা চটেছিলেন। বললেন, ‘এই লোকটি তো আমেরিকার ডিফেন্স সেক্রেটারি ছিলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছে আমেরিকা। আমাদেরকে স্যাবোটাজ করেছে। শেষ পর্যন্ত সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছে আমাদেরকে ধ্বংস করে দিতে। আর তাঁর কাছে সাহায্য চাবো আমি?’ এমনই আত্মসম্মান ও দেশাত্মবোধ ছিল তাজউদ্দীন আহমদের। (সূত্র-তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা, শারমিন আহমদ)

তাজউদ্দীন আহমদের জন্মশতবার্ষিকী ছিল ২৩ জুলাই। জাতীয়ভাবে দিনটি উদ্‌যাপনের দাবি রাখলেও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অনেকটা নীরবেই কেটে গেল দিনটি। অবশ্য ২০ জুলাই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মিলনায়তনে একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল সাহিত্যকাগজ ‘কালের ধ্বনি’। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাজউদ্দীন মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাতেই নেতৃত্ব দিয়েছেন সুনিপুণ পরিকল্পনা, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা ও সাংগঠনিক দক্ষতার সঙ্গে। ৯ মাসের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়লাভের পেছনে তাঁর সেই নেতৃত্বের ভূমিকা ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে থাকবে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যেও তাঁর ছিল অসাধারণ সব কর্মপরিকল্পনা। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই তাঁকে চরম অবমূল্যায়নের শিকার হয়ে চলে যেতে হয় আড়ালে।

ইদানীং তাজউদ্দীনকে শেখ মুজিবের বিকল্প হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন কেউ কেউ। তাঁদের সে চাওয়ার মধ্যে যতটা না আন্তরিকতার ছাপ পাওয়া যায়, তার চেয়ে ঢের বেশি লক্ষণীয় সূক্ষ্ম রাজনীতি। তাজউদ্দীনের মুক্তিযুদ্ধকালীন নেতৃত্বের ভূমিকাটিকে আড়াল করে রাখার মাধ্যমে জাতি হিসেবে আমরা নিজেদেরকেই খাটো করছি। আবার তাজউদ্দীন নিজেই যাঁকে ‘লিডার’ মানতেন মনেপ্রাণে, তাঁর বিকল্প হিসেবে তাঁকে তুলে ধরার চেষ্টাও তাজউদ্দীনের প্রতি কম অবিচার নয়। বাস্তবে তাজউদ্দীন নিজে থেকে কখনো নেতা হতে চাননি। শেখ মুজিবকে নেতা মেনেই তিনি একাত্তরে যুদ্ধ পরিচালনা এবং পরে দেশ গড়ার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করতে চেয়েছেন। তাঁর মনে ক্ষোভ-অভিমান অবশ্যই ছিল, আর তা যৌক্তিকও। তাই বলে নিজেকে কখনো মুজিবের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে চাননি। দেশ যখন আজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চতুর্মুখী চাপের মুখে, তখন তাজউদ্দীনের মতো জাতীয় নেতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা যায় অনায়াসে।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ব্যাংকিংয়ের নামে কারসাজি, ফাঁসছে ফার্স্ট সিকিউরিটি

‘আমার নিরপরাধ ছেলেডারে ডাইক্যা নিয়া ওসি স্যার জেলে ডুকাইয়া দিল’

রাঙামাটির হোটেল থেকে নারীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার, ম্যানেজার আটক

চাঁদাবাজদের কথিত তালিকা নিয়ে রাজশাহীতে তোলপাড়, বিএনপি-জামায়াত নেতাদের নাম

দুর্নীতির তদন্ত ঝুলে আছে, মেঘনা পেট্রোলিয়ামের এমডি অবসরে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত