Ajker Patrika

ইশ্‌, স্কুলটা যদি সেদিন বন্ধ থাকত

আপডেট : ২৭ জুলাই ২০২৫, ০৭: ৪৭
যেকোনো দুর্ঘটনাস্থলে উৎসুক জনতার ভিড় অনাকাঙ্ক্ষিত। ছবি: আজকের পত্রিকা
যেকোনো দুর্ঘটনাস্থলে উৎসুক জনতার ভিড় অনাকাঙ্ক্ষিত। ছবি: আজকের পত্রিকা

নেত্রকোনা পুলিশ লাইনস স্কুলে দুই দিন ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল অনিবন্ধিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নেত্রকোনায় পদযাত্রা করবে বলে। তাদের কর্মসূচিতে আসা নিরাপত্তা প্রদানকারী পুলিশ এই স্কুলে অবস্থান করবে—এমনটা উল্লেখ করে স্কুল কর্তৃপক্ষ একটি বন্ধের নোটিশ দেয় স্কুলের ফেসবুক পেজে। নেটিজেনদের কঠোর সমালোচনার পর স্কুল কর্তৃপক্ষ নিজেদের দেওয়া ঘোষণাটিকে ‘ফেক’ বা ‘ভুয়া’ দাবি করে আরও একটি পোস্ট দেয় স্কুল খোলা থাকার কথা বলে। এটি নিঃসন্দেহে স্কুল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, অসততা তো বটেই। আর এ কথা না বললেই নয় যে, একটি অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের জন্য অন্য এলাকা থেকে পুলিশ এনে পাহারা দেওয়া কোনো শুভ ফল দিতে পারে না। এটা অন্যায় নয়তো কী?

হঠাৎ মনে হলো—ইশ্‌, যদি এ রকম কোনো কারণে, ‘ভুল’ করেও সেদিন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এমন একটি বন্ধের নোটিশ দিত! আজ তাহলে ছোট্ট ছোট্ট প্রাণগুলো পুড়ে নিস্তেজ হতো না, তাদের অভিভাবক-শিক্ষকেরা দগ্ধ হতেন না, সারা দেশের মানুষকেও মনে চাপা কষ্টের আঘাতে চোখ ভেজাতে হতো না। তবে এর মানে এই নয় যে অন্য কেউ তাদের জায়গায় দগ্ধ হতো! শুধু মনে হচ্ছে—স্কুলটা যদি বন্ধ থাকত। কারও মৃত্যু কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না, এ রকম ভয়াবহ দুর্ঘটনায় তো নয়ই।

শুরু করেছিলাম রাজনীতির মাঠ থেকে। তবে রাজনৈতিক আলাপ এখানে আপাতত অপ্রয়োজনীয়। এদিকটা এক পাশ করে রাখা যায়। ২১ জুলাই রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান আছড়ে পড়ে যে দুর্ঘটনা হলো, তাতে আহত-নিহত ব্যক্তিদের পরিবার-আত্মীয় তো বটেই, এ দেশের প্রতিটি নাগরিক যে ট্রমায় পড়েছে, তা থেকে উতরানো সহজ নয়। মা-বাবার উদ্বেগের কথা ছাড়ুন, অভিভাবক না হয়েও পরিবারের অন্যান্য সদস্য খুব কষ্ট পায় যখন সেই পরিবারের কোনো শিশু একটু ব্যথা পায়—সেটা গরম দুধ খেতে মুখ পুড়ে যাক কিংবা গরম পানি পড়ে হাত পুড়ে যাক। সেখানে মাইলস্টোনের কত কত শিশু দাউ দাউ করা আগুনে জ্বলেছে—এই ভয়ংকর দৃশ্য কল্পনায় ভেসে উঠলে অসুস্থ হয়ে পড়াটা অস্বাভাবিক নয়।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমাদের সহকর্মীরা এই দুর্ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে হয়তো গলা ধরিয়ে ফেলেছেন, লিখতে গিয়ে হয়তো কম্পিউটারের কি-বোর্ড ভিজিয়ে ফেলেছেন। এ রকম সময়ে সাংবাদিকতাটা এত সহজ হয় না। তবু মনকে শক্ত রেখে নিজের পেশার সঙ্গে ন্যায়সংগত আচরণ করতে হয়। এরই মধ্যে নিহতের ‘সঠিক’ সংখ্যা না জানানোর অভিযোগ করেছেন অনেকে—সরকারের পাশাপাশি দোষ দিয়েছেন সাংবাদিকদের। কাউকে কাউকে কথার যুক্তিতে হারিয়ে দিয়েছেন সাংবাদিকেরা।

আমাদের পুরো দেশ নাড়িয়ে দিয়েছে এক দিনের একটি বিমান দুর্ঘটনা। অন্যদিকে দূরদেশ ফিলিস্তিনে বিমান থেকে বোমা ফেলার দৃশ্য নিয়মিত ঘটনা। নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ বা শিশু—হাজার হাজার প্রাণ যেন প্রতিদিন পাখি হয়ে উড়ে যাচ্ছে স্বর্গের দিকে। বিশ্ববাসীকে ফিলিস্তিনের ঘটনা নাড়িয়ে দিলেও নড়াতে পারে না যারা যুদ্ধের কলকাঠি নাড়ে, তাদের। আমরা বাংলাদেশিরাও ফিলিস্তিনের ভয়াবহতা মানতে পারি না, মানতে পারি না যেকোনো যুদ্ধের বিভীষিকা, নিজের দেশেরটা কী করে মেনে নেব? আমাদের আগের প্রজন্ম যেমন পাকিস্তানি সেনাদের নারকীয় আচরণ ভুলতে পারেনি, আমরা যেমন বছরের পর বছর অপশাসনের কথা ভুলতে পারি না, তেমনি ভয়াবহ দুর্ঘটনায় হৃদয়বিদারক মৃত্যুও ভুলতে পারব না। রানা প্লাজা ধসের কথা আমরা যেমন মনে রেখেছি, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কথাও ভুলিনি। মনে আছে বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের কথা। ভুলে যাব না মিটফোর্ডের সামনে হত্যাকাণ্ডের পৈশাচিক ভিডিওচিত্র।

২.

খুব অবাক লাগে, যখন দেখি এ দেশে দুই ধরনের মানুষ রয়েছে। প্রথম ধরনের মানুষগুলো স্বার্থান্বেষী, তাদের সংখ্যাই যেন বেশি। এই যেমন, মাইলস্টোনে দুর্ঘটনার পর পর যারা ‘ব্যবসা’ শুরু করেছিল, তাদের কথা বলছি। কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ভিউ’ ব্যবসার জন্য আহতদের ভিডিও করতে ব্যস্ত, আবার একশ্রণির উৎসুক জনতা ঘটনাস্থলে ভিড় করে উদ্ধারকাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করছিল। সবচেয়ে বেশি মন খারাপ করা অভিযোগ—দুই লিটার পানির দাম ৬০০ টাকা কিংবা স্বল্প দূরত্বের রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া কয়েক গুণ বেশি। যারা এ রকম পরিস্থিতিতে এ ধরনের ‘ব্যবসা’ করে, তারা এই দলভুক্ত। তাদের মধ্যে মানবিকতা বা বিবেকবোধের ছিটেফোঁটা যে নেই, তা স্পষ্ট।

দ্বিতীয় ধরনের মানুষেরা ঠিক এর উল্টো। এমন মানুষের সংখ্যা খুব খুব খুবই কম। তবে মন ভালো হয়ে যায় যখন দেখি কেউ বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। গণমাধ্যমকর্মী অপূর্ণ রুবেলের কথাই ধরুন। মাইলস্টোনের দুর্ঘটনায় আহতদের পরিবারের সদস্যদের জন্য বিনা মূল্যে ‘বাইক সার্ভিস’ দিয়েছেন। হাসপাতাল থেকে ফার্মেসি কিংবা বাড়ি—তিনি বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হয়ে পৌঁছে দিয়েছেন তাঁর মোটরসাইকেলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি এখন ‘ভাইরাল’। ভালো লেগেছে সাবেক গণমাধ্যমকর্মী ও রন্ধনশিল্পী ফাতেমা আবেদীনের উদ্যোগ। তাঁর রেস্তোরাঁ থেকে বিনা মূল্যে রোগী ও আত্মীয়দের খাবার পৌঁছে গেছে যথাস্থানে। মানবিকতা ধুঁকছে, কিন্তু বেঁচে তো আছে—এই ধরনের মানুষগুলোর জন্যই। এই মানবিকতাকে আইসিইউতে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা করে ছাড়পত্র দেওয়া হোক—এটুকুই অনুরোধ করা যেতে পারে প্রথম ধরনের মানুষগুলোর কাছে।

সাধারণত দুর্ঘটনা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে, অথচ আমাদের হয়েছে উল্টো। আমরা শুধু এই দুজন ব্যতিক্রম মানুষকে যদি উৎসুক জনতার বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিই, তাহলেই চিত্রটা বোঝা যায়। কিন্তু এমনটা হওয়া কি স্বাভাবিক প্রবণতা? কোথাও দুর্ঘটনা দেখলে দর্শকের মতো ভিড় করা মোটেও কাম্য নয়। তেমনি অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাপার, দুর্যোগের সময় সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে জরুরি জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেওয়া। এই প্রবণতা থেকে বের হয়ে না আসতে পারলে সহমর্মিতা, সহানুভূতি, মানবিকতা—সবই হারিয়ে যাবে কোনো কৃষ্ণগহ্বরে।

৩.

সংখ্যায় কম হলেও ভালো ও মানবিক উদ্যোগগুলো দেখতে দেখতে আমরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসব। সময় লাগবে না খুব একটা। কিন্তু ভুলে যাব না। ভুলে যাওয়া উচিত নয়। কারণ, আমরা একটা নিরাপদ বাসযোগ্য দেশ চাই। যে দেশে আমাদের সন্তানেরা কোনো মুরগির খামারের মতো খাঁচায় ঢুকে পড়াশোনা করবে না, রাস্তার কোনো যান এসে তাদের ধাক্কা দেবে না, কোনো ভবন থেকে পা পিছলে পড়ে যাবে না, পড়ার চাপে আর অন্য কারও কটু কথায় আত্মহননের পথ বেছে নেবে না, এমনকি কোনো যুদ্ধবিমান এসে তাদের স্কুলে আছড়ে পড়বে না। তাই প্রশ্নগুলো উঠতে থাকুক—উড্ডয়নের আগে কি বিমান পরীক্ষা করা হয় না? যুদ্ধবিমানে কি কোনো ব্ল্যাক বক্স থাকে না? প্রশিক্ষণ শেষে একজন পাইলটকে কেন পরীক্ষার জন্য একটি বিমান লোকালয়ের ওপর দিয়ে চালাতে হবে? অথবা, কেন বিমানঘাঁটি বা বিমানবন্দরের আশপাশে কোনো অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হবে? রাষ্ট্রীয় অপ্রয়োজনীয় সফর বা ভাস্কর্য নির্মাণের মতো যত্রতত্র কোটি কোটি টাকা খরচ না করে এই টাকা কি দেশবাসীর নিরাপত্তার কাজে ব্যয় করা যায় না? শিক্ষার মানোন্নয়ন কাজে ব্যয় করা যায় না?

উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত এ ধরনের প্রশ্ন উঠতে থাকুক। নয়তো কোনো মায়ের কানে আমৃত্যু বাজতে থাকবে—‘আজ স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছে না মা’ কিংবা ‘মা, আমি স্কুলে গেলাম, টাটা’।

এখনো মনে হচ্ছে—ইশ্‌, স্কুলটা যদি সেদিন বন্ধ থাকত! তাহলে বেঁচে যেত শিশুরা, কোনো ভিডিও শিকারির খপ্পরে পড়ত না আহত ব্যক্তিরা, ঘটনাস্থলে জমত না ভিড়, ভাড়া বাড়াত না যানবাহনের চালকেরা, বেশি দামে পানি বিক্রি করত না দোকানিরা। স্কুলটা খোলা থাকায় প্রমাণিত হয়ে গেল কতটা নির্বোধ হলে এ ধরনের অবিবেচক কাণ্ড ঘটাতে পারে কেউ কেউ।

লেখক:– সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

রুয়া নির্বাচন: বিএনপিপন্থীদের বর্জন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জামায়াতপন্থী ২৭ জন নির্বাচিত

‘পাপ কাহিনী’র হাত ধরে দেশের ওটিটিতে ফিরল অশ্লীলতা

সৌদি আরবের কেনা ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলকে দেওয়ার অনুরোধ যুক্তরাষ্ট্রের, প্রত্যাখ্যান করে কিসের ইঙ্গিত দিল রিয়াদ

সাবেক এমপি শাম্মী আহমেদের বাসায় সমন্বয়ক পরিচয়ে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি, আটক ৫

আগের তিন ভোটের নির্বাচনী কর্মকর্তারা দায়িত্ব পাবেন না

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত