Ajker Patrika

‘আমি তাদের পাপেট নই’—এই কণ্ঠ যেন হারিয়ে না যায়

‘আমি তাদের পাপেট নই’—এই কণ্ঠ যেন হারিয়ে না যায়

২৪ জুলাই ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এক তরুণী জানালেন, তিনি তাঁর বাবা-মায়ের সঙ্গে আপস করেছেন। তিনি আর মামলা চালাতে চান না। আদালত মামলাটি খারিজ করে দিলেন। প্রথম শুনলে এটি খুব সাধারণ ঘটনা মনে হতে পারে। পরিবারে তো সমস্যা হতেই পারে; ঝগড়া-বিবাদ, মান-অভিমান শেষে আপস-মীমাংসা তো হতেই পারে।

কিন্তু এই ঘটনার গভীরে গেলে বোঝা যায়, এটি নিছক পারিবারিক বিবাদের একটি সাধারণ উদাহরণ নয়; এক তরুণীর আত্মরক্ষার লড়াই। এটি পরিবারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নিয়ন্ত্রণ, শাসন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক ব্যক্তিগত প্রতিবাদ। এক পুরোনো সমাজে নতুন কণ্ঠস্বরের উদ্ভাস।

ঘটনাটির শুরু ২২ জুন ২০২৫। রাজধানীর একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ১৯ বছর বয়সী ছাত্রী মেহরীন আহমেদ ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এম এ আজহারুল ইসলামের আদালতে মামলা করেন। মামলার আসামি তাঁরই বাবা নাসির আহমেদ এবং মা জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি অভিযোগ করেন, তাঁর মা-বাবা নিয়মিতভাবে তাঁর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালাচ্ছেন। ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছেন। তাঁর কথামতো খেতে দেন না, ঘুমাতে দেন না। মানসিক হাসপাতালে জোর করে ভর্তি করান, যেখানে তাঁকে চিকিৎসা না দিয়ে আরও হেনস্তা করা হয়।

আদালতে মেহরীন বলেন, ‘আমি খেতে পারি না, ঘুমাতে পারি না। আমাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে আমাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করা হয়েছে। আমি আমার সুরক্ষা চাই। আমি জাস্টিস চাই।’ তিনি স্পষ্ট কণ্ঠে বলেন, ‘আমি তাদের পাপেট নই।’

আদালতে আরও বলেন, পরিবারে তিনি কথা বললেই অপমান করা হয়, গালিগালাজ করা হয়, হেয় করা হয়। তাঁর প্রাপ্ত অধিকার ও সম্পদের সুযোগ থেকেও তাঁকে বঞ্চিত করা হয়। এমনকি নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র ব্যবহারেও বাধা দেওয়া হয়। সবচেয়ে ভয়াবহ অভিযোগ হলো, ২৫ মে সন্ধ্যায় তাঁকে শারীরিকভাবে আঘাত করা হয়। তাঁর শরীরে জখম হয়।

এ ঘটনা দেশের সংবাদমাধ্যমে আসে। আলোচনা তৈরি হয়। অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেন, একজন সন্তান কী করে মা-বাবার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন? আবার কেউ কেউ বলেন, কেন নয়? একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হিসেবে যদি সে নির্যাতনের শিকার হয়, তাহলে তার প্রতিবাদ করা উচিত।

তবে সেই আলোচনার মাঝেই আসে হঠাৎ মোড় ঘোরা সংবাদ। ২৪ জুলাই আদালতে মেহরীন জানান, তাঁর বাবা-মায়ের সঙ্গে আপস হয়েছে। তিনি আর মামলা চালাতে চান না। আদালত মামলাটি খারিজ করেন।

এই আপস কি প্রকৃত সমঝোতা? নাকি সামাজিক চাপ, আত্মীয়দের দৃষ্টি কিংবা একা হয়ে যাওয়ার ভয়ের ফল? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো আমরা পাব না। কিন্তু এই ঘটনা আমাদের সমাজব্যবস্থার, পারিবারিক সম্পর্কের এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার জায়গা নিয়ে বড় কিছু প্রশ্ন তোলে; যার উত্তর দেওয়া না গেলে সমাজ আরও অনেক বেশি অসুস্থ হয়ে উঠবে।

পারিবারিক সম্পর্ক বনাম ব্যক্তিস্বাধীনতা: সংঘাতের শুরু কোথায়

বাংলাদেশের পরিবারব্যবস্থা এখনো অনেকটাই অভিভাবককেন্দ্রিক। মা-বাবা সন্তানকে ভালোবাসেন, কিন্তু সেই ভালোবাসার রূপ অনেক সময় হয় কর্তৃত্বপরায়ণমূলক। সন্তান বড় হয়ে গেলেও অভিভাবক মনে করেন, তাঁদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। সন্তান কী পড়বে, কোথায় যাবে, কাকে বন্ধু হিসেবে বেছে নেবে, কী খাবে, কোথায় যাবে না—এসব নিয়েই থাকে কঠোর বিধিনিষেধ; বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে এ নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি।

তরুণেরা যখন নিজেদের মতো করে ভাবতে শুরু করে, নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে চায়, তখনই সংঘাতের সূত্রপাত হয়। মেহরীনের ঘটনাও সেই বিবাদেরই চূড়ান্ত রূপ।

এখানে আমরা প্রশ্ন তুলতে পারি, ১৯ বছর বয়সের এক তরুণী কি নিজের জীবনের কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না? আইন অনুযায়ী, তিনি প্রাপ্তবয়স্ক। তাঁর নিজস্ব মতপ্রকাশ, স্বাধীন চলাফেরা এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সংরক্ষণের অধিকার রয়েছে।

অভিভাবকেরা হয়তো বলেন, আমরা সন্তানের মঙ্গল কামনা করি। কিন্তু সেই মঙ্গল চাপিয়ে দিলে, সন্তানকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে দিলে, তা কি আর মঙ্গল থাকে? মেহরীনের মামলা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—পারিবারিক সম্পর্কের ভেতরেও থাকতে পারে নিয়ন্ত্রণ, নিপীড়ন আর অসম্মান।

নিপীড়নকে শাসন ভাবার প্রবণতা

আমাদের সমাজে এখনো একটি বড় সমস্যা হলো, শাসন আর নিপীড়নের পার্থক্য না করা; বিশেষ করে মা-বাবা মনে করেন, সন্তানকে শাসন করাই ভালোবাসার প্রকাশ। কখনো কখনো সেই শাসন গালাগাল, মানসিক অবজ্ঞা, এমনকি শারীরিক আঘাতেও রূপ নেয়।

এই শাসনকে সমাজও গ্রহণ করে। কেউ বলে না, এটা ভুল; বরং সন্তান প্রতিবাদ করলে বলে, ‘বড়দের বিরুদ্ধে মুখ খুলো না।’ ফলে সন্তানের অভিযোগ বা কষ্ট কেউ শোনে না। তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় ‘অভদ্র’ বা ‘অযোগ্য’ তকমা।

মেহরীন যখন আদালতে গিয়ে বলেন, ‘আমি তাদের পাপেট নই’, তখন সেই বাক্য শুধু তাঁর নয়, হয়ে ওঠে অনেকের মনের কথা। কারণ, বহু তরুণ-তরুণী আজও পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, মুখ খুলতে পারছে না। যদি কেউ মুখ খোলে, তখন তাকে ঘরের শত্রু, জাতির কলঙ্ক হিসেবে দেখা হয়।

আপস, চাপ, নাকি মিথ্যে আশ্বাস

মামলার শেষ পর্যায়ে এসে যখন জানা যায়, মেহরীন আপস করেছেন, তখন মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। কেউ স্বস্তি পায়—বলে, ‘ভালো হয়েছে, পরিবারটি রক্ষা পেল।’ আবার কেউ ভাবে, এটা কি সত্যি আপস? নাকি চাপ?

সন্তান যখন মা-বাবার বিরুদ্ধে মামলা করে, তখন সে একা হয়ে পড়ে। আত্মীয়রা মুখ ফিরিয়ে নেয়, বন্ধুদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। অনেক সময় আর্থিকভাবে সে নির্ভরশীল থাকে পরিবারে। সমাজও তার পাশে দাঁড়ায় না। এমন পরিস্থিতিতে আপসই যেন একমাত্র উপায় হয়।

তাই এই আপসের পেছনে হয়তো রয়েছে বোঝাপড়া, আবার হতে পারে ভয়, হতাশা বা নিরুপায় আত্মসমর্পণ। আমরা হয়তো সবটা জানতে পারব না। তবে এটুকু স্পষ্ট, এই আপস পুরো বিষয়টি সমাধান করে দেয়নি; বরং নতুন করে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে।

বাংলাদেশের আইনি প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশে ‘পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০’ নামের একটি আইন রয়েছে, যা পারিবারিক পরিসরে ঘটে যাওয়া শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক বা যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা দেয়। এই আইনের আওতায় স্ত্রী, সন্তান, ভাইবোন, পিতামাতা—সবাই অভিযোগ করতে পারেন।

আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যে কেউ, অন্য সদস্যের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ করতে পারবেন এবং আদালত নির্যাতনকারীকে সতর্ক, নিয়ন্ত্রণ বা ভিন্ন বাসস্থানে থাকার নির্দেশ দিতে পারেন।

এ ছাড়া দণ্ডবিধির ৩২৩, ৩৫৪, ৫০৬ ধারাও প্রযোজ্য হতে পারে, যদি শারীরিক আঘাত বা ভয়ভীতি দেখানো হয়। তবে সমস্যা হচ্ছে, এসব আইন অনেকে জানে না, জানলেও প্রয়োগে ভয় পায়। আর সবচেয়ে বড় বাধা হলো—পারিবারিক সম্মান রক্ষার ভয়।

সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও মিডিয়ার ভূমিকা

মেহরীনের মামলাটি গণমাধ্যমে আসায় আলোচনার ঝড় ওঠে। সোশ্যাল মিডিয়ায় দুই পক্ষেই কথা ওঠে—একদল বলেন, ‘এই মেয়েটি ভুল করেছে’; আরেক দল বলেন, ‘এটা সাহসের পরিচয়।’

দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের সমাজে এখনো সন্তানকে মানুষ হিসেবে নয়, মালিকানার বস্তু হিসেবে দেখা হয়; বিশেষ করে মেয়েরা নিজের মতো করে কিছু বললে, তাকে বলা হয় ‘উগ্র’, ‘বেপরোয়া’ বা ‘অত্যন্ত আধুনিক।’ অথচ তারা চায়, কেবল সম্মানজনক, নির্যাতনমুক্ত জীবন।

মিডিয়ার একটি ইতিবাচক ভূমিকা ছিল, তারা বিষয়টি সামনে এনেছিল। তবে অনেক ক্ষেত্রে সংবাদ উপস্থাপনায় ছিল রসাল উপাদান খোঁজার প্রবণতা, যা সংবেদনশীলতা ও গোপনীয়তা লঙ্ঘনের আশঙ্কা তৈরি করে।

এখনই সময় পরিবার ও সমাজের আত্মসমালোচনার

মেহরীনের ঘটনা যে ঝড় তুলেছিল, তা কি হঠাৎ থেমে যাওয়ার মতো? একজন সন্তান যদি পরিবারেই নিরাপদ না থাকে, তাহলে সে কোথায় যাবে? কীভাবে সে নিজের মর্যাদা রক্ষা করবে?—এই প্রশ্নের তো উত্তর আমাদের খুঁজতেই হবে।

সমাজ এখনো তৈরি হয়নি সন্তানের কথা শোনার জন্য। কিন্তু তৈরি হওয়া দরকার। পরিবার মানে কেবল ‘আমি যা বলছি সেটাই করো’ নয়; পরিবার হওয়া উচিত বোঝাপড়ার জায়গা, যেখানে ভুল হলে দুপক্ষই শোনে, বোঝে, ঠিক করে।

সন্তানেরা মানুষ, তাদের ভাবনা, চাওয়া, কষ্ট—সবকিছুরই দাম আছে। সেই দাম দেওয়া না হলে আরও অনেক মেহরীন তৈরি হবে—কেউ মুখ খুলবে, কেউ মুখ বন্ধ করে থাকবে, কেউ আবার একসময় হারিয়ে যাবে।

আইন থাকতে হবে, প্রয়োগও হতে হবে। পরিবারে শিশু, কিশোর, তরুণ বা নারীর প্রতি সহিংসতা, মানসিক নিপীড়ন বা নিয়ন্ত্রণ কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যাবে না।

তবে আইনের বাইরেও প্রয়োজন শিক্ষা—পারিবারিক শিক্ষা। সন্তানের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া, কথায় কথায় অপমান না করা, মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া—এসব নিয়েই আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে।

সব শেষে বলতেই হয়, একজন মেহরীন যখন বলে, ‘আমি তাদের পাপেট নই’, তখন সেই কণ্ঠ যেন হারিয়ে না যায় সমাজের চাপে, ভয় আর অভিশাপে। আমাদের কাজ সেই কণ্ঠের পাশে দাঁড়ানো, তাকে রক্ষা করা, তাকে সম্মান করা। তবেই সমাজ হবে মানবিক, পরিবার হবে আশ্রয়স্থল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

রুয়া নির্বাচন: বিএনপিপন্থীদের বর্জন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জামায়াতপন্থী ২৭ জন নির্বাচিত

সৌদি আরবের কেনা ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলকে দেওয়ার অনুরোধ যুক্তরাষ্ট্রের, প্রত্যাখ্যান করে কিসের ইঙ্গিত দিল রিয়াদ

‘পাপ কাহিনী’র হাত ধরে দেশের ওটিটিতে ফিরল অশ্লীলতা

আওয়ামী লীগ নেতাকে ধরতে গিয়ে ছেলের বঁটির আঘাতে এসআই আহত, আটক ২

সাবেক এমপি শাম্মী আহমেদের বাসায় সমন্বয়ক পরিচয়ে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি, আটক ৫

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত