Ajker Patrika

ব্যাংকিংয়ের নামে কারসাজি, ফাঁসছে ফার্স্ট সিকিউরিটি

জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা 
আপডেট : ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৫: ০৩
ব্যাংকিংয়ের নামে কারসাজি, ফাঁসছে ফার্স্ট সিকিউরিটি

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক (এফএসআইবিএল) ভয়াবহ আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর মূলে রয়েছে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ এবং গ্রাহকদের অর্থ পরিশোধে ব্যর্থতা। গত ৩১ মার্চ ব্যাংকটির ইনভেস্টমেন্ট মনিটরিং অ্যান্ড রিকভারি বিভাগের একটি প্রতিবেদন থেকে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৬টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকটির মোট ৫১ হাজার ২৫ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে, যার মধ্যে বিতর্কিত এস আলম গ্রুপ একাই বেনামি ও নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

প্রতিবেদন অনুসারে, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৫৮ হাজার ১৮২ কোটি টাকাই খেলাপি। শতকরা হিসেবে এটি মোট ঋণের ৯৫ শতাংশ, যা দেশের ব্যাংকিং খাতের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। অন্যদিকে, ব্যাংকটির আমানত সংগ্রহের পরিমাণ ৪৩ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। মার্চ, ২০২৫ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটিতে প্রায় ১৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি রয়েছে।

ব্যাংকের একাধিক শাখা ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী অর্থ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। গ্রাহক ভেদে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার বেশি পরিশোধ করা হচ্ছে না, যা গ্রাহকদের মধ্যে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। আমানতকারীদের টাকা উত্তোলনের চাপ সামলাতে ব্যাংকটি রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। গ্রাহকেরা টাকা জমা না দিয়ে বরং বাজপাখির মতো টাকা উত্তোলনের জন্য ছুটে আসছেন।

ব্যাংকারদের মতে, নামসর্বস্ব কাগুজে প্রতিষ্ঠান, ভুয়া দলিল, জামানতকৃত সম্পত্তির অতিমূল্যায়নসহ নানাবিধ অনিয়মের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। বিশাল পরিমাণ ঋণখেলাপি, মূলধন ঘাটতি ও লোকসানের ভারে ব্যাংকটি কুঁজো হয়ে পড়েছে। আর্থিক খাতের মাফিয়া হিসেবে পরিচিত এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রিত এই ব্যাংকটিতে দীর্ঘ দিন ধরে এই লুটপাট চলেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ব্যাংকটির ফরেনসিক প্রতিবেদনেও ভুয়া দলিল দিয়ে কাগুজে কোম্পানির নামে বিনিয়োগ গ্রহণের বিষয়টি উঠে এসেছে।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান এই পরিস্থিতিকে ‘ব্যাংক খাতের সর্বনাশ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এর জন্য একটি সংঘবদ্ধ চক্রকে তিনি দায়ী করেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, তৎকালীন সরকার এই অনিয়মে বাধা দেয়নি, বরং সরকার প্রধানের নাম ব্যবহার করে ব্যাংক খালি করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, এস আলমের লোকজন এখনো নানা অপতৎপরতা চালাচ্ছে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে বকেয়া শোধ করছে না। চেয়ারম্যান আশা প্রকাশ করেছেন, সামনে ব্যাংকটির পরিবর্তন আসবে এবং এ জন্য সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ উদ্যোগ প্রয়োজন। তিনি বকেয়া আদায়ে প্রয়োজনে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার কথাও জানিয়েছেন।

সূত্র জানায়, হাসিনা সরকারের আমলে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকসহ বেশ কিছু ব্যাংকে প্রকৃত তথ্য গোপন করে লুটপাট চালানো হতো। ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই তথ্যগুলো প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। এতে আতঙ্কিত হয়ে গ্রাহকেরা একযোগে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন শুরু করলে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে তীব্র তারল্য সংকট দেখা দেয়।

খেলাপির তালিকায় দেশের অনেক বড় বড় গ্রুপ ও কোম্পানির নাম উঠে এসেছে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের গুলশান শাখার বড় বিনিয়োগ গ্রহীতা দেশবন্ধু গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন ১ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। দেশবন্ধু গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেড, দেশবন্ধু ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড, দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলস, সাউথইস্ট সোয়েটার্স লিমিটেড ও এম আর ট্রেডিং। দীর্ঘদিন বিনিয়োগ করা অর্থ ফেরত না দেওয়ায় এসব ঋণ খেলাপি হিসেবে গণ্য হয়েছে।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের আরেক বড় খেলাপি সিকদার গ্রুপ। এই গ্রুপের অনাদায়ি বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮১০ কোটি টাকা। সিকদার গ্রুপের সাবেক চেয়ারম্যান, মৃত জয়নুল হক সিকদারের পুত্র রন হক সিকদার, রিক হক সিকদার ও দীপু হক সিকদারের মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে এ ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন অর্থ ফেরত না দেওয়ায় এগুলোও খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে।

ব্যাংকের অন্য গুরুত্বপূর্ণ খেলাপি গ্রাহকদের মধ্যে রয়েছে এমআরসি বিজনেস হাউস, যার খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮৭৫ কোটি টাকা। গ্লোব ট্রেডার্সের বকেয়া দাঁড়িয়েছে ৮০২ কোটি টাকায়। তাসনিম ফ্লাওয়ার মিলসের ঋণ ৭২৫ কোটি টাকা এবং মো. নুরুন্নবীর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৫৪ কোটি টাকা।

জুবিলি রোড শাখার অন্যান্য খেলাপি গ্রাহক হিসেবে রয়েছে সাফরান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল (৬৩৪ কোটি টাকা), ইমেজ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল (৫৯৮ কোটি টাকা) ও ইকো ট্রেড কর্নার (৫৭৮ কোটি টাকা)।

আগ্রাবাদ শাখার খেলাপিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এস এ অয়েল রিফাইনারি, যার ঋণ ৬৩২ কোটি টাকা। লিজেন্ডারি ইন্টারন্যাশনালও প্রায় ৬৩৩ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে রয়েছে। রংধনু বিল্ডার্স প্রাইভেট লিমিটেডের বকেয়া ৫৮৭ কোটি টাকা, যা বসুন্ধরা শাখায় রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান জানিয়েছেন, এই ব্যাংকটির বিষয়ে গভর্নর বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছেন। গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যাংকটিকে একীভূত করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে রাতারাতি সবকিছু সম্ভব নয়। বকেয়া আদায়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে এবং কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত