Ajker Patrika

শিল্পনীতির গলদ

আবু তাহের খান 
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

নয়া কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা জোরদারকরণ, বিনিয়োগে খুদে উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি প্রভৃতি দিক বিবেচনায় বাজেটে ও রাষ্ট্রের অন্যান্য নীতিমালায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে (এসএমই) বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনের কথা বহুদিন ধরেই বলা হচ্ছে। এবং বলতে বলতে সেটি ইতিমধ্যে এতটাই জনপ্রিয় কথোপকথনে পরিণত হয়েছে যে কেউ কেউ তা বুঝে বললেও অনেকেই আবার তা না বুঝেও বলেন। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের ঘোষিত বাজেটকে সামনে রেখে এ-সংক্রান্ত আলোচনা আরও জোরদার হয়ে উঠেছে। কিন্তু এসব আলোচনায় যাঁরা অংশ নিচ্ছেন, অর্থাৎ যাঁরা এ নিয়ে কথা বলছেন—তাঁদের সবাই কি জানেন রাষ্ট্রের সর্বশেষ শিল্পনীতি ২০২২ অনুযায়ী ক্ষুদ্রশিল্প আসলে কত ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প আসলে কোন দুই বিনিয়োগসীমার মধ্যবর্তী? উল্লিখিত শিল্পনীতি অনুযায়ী, ১৫ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগসীমার শিল্প হচ্ছে ক্ষুদ্রশিল্প এবং ১৫ কোটি টাকা থেকে ৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগসীমার শিল্প হচ্ছে মাঝারি শিল্প।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের বিদ্যমান আর্থসামাজিক কাঠামোয় ১৫ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগসীমার শিল্পকে ক্ষুদ্র শিল্প ও ৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগসীমার শিল্পকে মাঝারি শিল্প বলাটা কতখানি যৌক্তিক? এরূপ বিনিয়োগসীমার আওতাধীন শিল্প তো আসলে অনেকাংশে বৃহৎ শিল্প এবং এগুলোর মধ্যকার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আবার বৃহতের মধ্যেও বৃহত্তর। আর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, অর্থনৈতিক খাতের পেশাজীবী কিংবা এসএমই খাতের প্রকৃত উদ্যোক্তারাও আসলে এসএমই বলতে এত বড় বিনিয়োগকে বুঝতে বা বোঝাতে চান না। তাহলে শিল্পনীতিতে এ ধরনের অবাস্তব সংজ্ঞার অনুপ্রবেশ ঘটল কীভাবে, যা আবার ১৯৯১ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত আছে? এবং অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের এ রকম অবাস্তব সংজ্ঞার আওতাতেই এ দেশের শিল্প খাতের উদ্যোক্তা, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও অন্য অংশীজনেরা ৩৫ বছর ধরে তাঁদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। আর সেসব কার্যক্রমের আওতায় দেশের বৃহৎ উদ্যোক্তারাই বস্তুত উল্লিখিত সংজ্ঞার ফাঁক গলিয়ে এসএমইর নাম করে এ সময়ের মধ্যে কোটি কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা অবলীলায় ভোগ করে গেছেন এবং এখনো তা করার সমুদয় আয়োজন মোটামুটি সম্পন্ন করে রেখেছেন।

এরূপ পরিস্থিতিতে শিল্পনীতিতে শিল্পের এ ধরনের অবাস্তব সংজ্ঞা কীভাবে অন্তর্ভুক্ত হলো, সে কৌতূহল নিবৃত্ত করার জন্য প্রথমেই বলা প্রয়োজন যে এটি ঘটেছে স্বার্থান্বেষী উদ্যোক্তা, আদর্শবিবর্জিত রাজনীতিক ও পেশাদারি জ্ঞানবিহীন আমলা—এই তিন পক্ষের হীনতাপূর্ণ যোগসাজশের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বিষয়টি খোলাসা করি। ১৯৯১ সালের শিল্পনীতির খসড়াটি আসলে ওই বছর এরশাদ সরকারের পতনের বেশ আগেই প্রণীত হয়েছিল এবং তা প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল ‘শিল্পনীতি ১৯৯০’ শিরোনামে। সেখানে ক্ষুদ্রশিল্পের সর্বোচ্চ বিনিয়োগসীমা প্রস্তাব করা হয়েছিল পরে এক কোটি টাকা। কিন্তু এটি প্রকাশিত হতে যাওয়ার আগমুহূর্তে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে পড়লে সেটি আর তখন প্রকাশিত হয়নি। পরে ১৯৯১ সালে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার পর এর চূড়ান্তকরণ ও প্রকাশের দায়িত্ব স্বভাবতই নতুন সরকারের ওপর বর্তায়। কিন্তু গভীরতাপূর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ঘাটতি ও সংশ্লিষ্ট আমলাদের অপেশাদার আচরণের কারণে শিল্পনীতির নতুন খসড়ায় ক্ষুদ্রশিল্পের বিনিয়োগসীমা একলাফে ১ কোটি টাকা থেকে ১.৫০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয় এবং এ বিষয়ে উদ্যোক্তাদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) পরামর্শে তা বাড়িয়ে করা হয় তিন কোটি টাকা, যা চরম অবিশ্বাস্য গতিতে বাড়তে বাড়তে এখন ১৫ কোটি টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। এবং প্রতিবারই উদ্দেশ্যমূলকভাবে এ বৃদ্ধি ঘটেছে এসএমই নামধারী বৃহৎ উদ্যোক্তাদের বাড়তি সুযোগ দেওয়ার জন্য।

পাঠক, এ অবস্থায় আপনিই বলুন, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বলতে আমরা যাঁদের বুঝি বা বিনিয়োগসংক্রান্ত নিত্যদিনের আলোচনায় যাঁদের এসএমই উদ্যোক্তা হিসেবে অভিহিত করে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়, তাঁরা কি আসলে এই ১৫ কোটি টাকা বিনিয়োগধারী উদ্যোক্তা? যদি তা না হয়ে থাকে, তাহলে এসএমই উদ্যোক্তা পরিচয়ে রাষ্ট্রের কাছ থেকে বর্তমানে যাঁরা নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছেন, তাঁরা আসলে উল্লিখিত সংজ্ঞার সুযোগ নিয়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার অধিকারকেই ক্ষুণ্ন করছেন বৈকি! আর এরূপ কৌশলী কায়দায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ কুক্ষিগতকরণের মাধ্যমে দেশে সম্পদের যে মেরুকরণ ঘটছে, সেটিই বস্তুত সমাজে শোষণ ও বৈষম্যের জন্ম দিচ্ছে। ফলে বর্ধিত উৎপাদন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশের বিনিয়োগ কার্যক্রমে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার অংশগ্রহণ ও প্রবেশাধিকার বৃদ্ধির প্রয়োজনে শিল্পের উল্লিখিত সংজ্ঞা সংশোধন যেমনি জরুরি, তেমনি তা সমান জরুরি রাষ্ট্রীয় সম্পদের অন্যায্য ভোগ ও বণ্টন প্রতিরোধের জন্যও। কিন্তু রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে শিল্প ও ব্যবসায় খাতের উদ্যোক্তা, গবেষক ও অর্থনীতিবিদ, ভিনদেশি উন্নয়ন-সহযোগী প্রভৃতি সবাই এসএমইকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়ে যেসব গড়পড়তা বক্তব্য রাখছেন, সেখানে কারও কোনো কথাতেই সংজ্ঞা সংশোধনের এ মৌলিক বিষয়টির উল্লেখ নেই। কিন্তু সেটি না করে এসএমইকে গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়ে যত কথাই বলা হোক না কেন, তা আসলে এসএমই নামধারী বৃহৎ উদ্যোক্তার স্বার্থকেই শুধু রক্ষা করবে।

এদিকে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, উল্লিখিত সংজ্ঞা পরিবর্তন না করেই বা সে বিষয়ে কোনোরূপ চিন্তাভাবনা ছাড়াই এসএমই ফাউন্ডেশন দাতা প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় নতুন এসএমই নীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে এবং প্রকাশিত তথ্যমতে সে কাজ ইতিমধ্যে অনেকখানি এগিয়েও গেছে। কিন্তু উল্লিখিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের কে বোঝাবে যে এরূপ গতানুগতিক ধারার নীতি প্রণয়ন করা হলে তা এসএমই নামধারী কায়েমি স্বার্থবাদী উদ্যোক্তার স্বার্থকেই শুধু সংরক্ষণ করবে না, রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ও সহায়তা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রকৃত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার প্রবেশাধিকার আগের মতোই আরও কিছু বছরের জন্য সীমিত হয়ে থাকবে।

এ অবস্থায় এই মর্মে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাচ্ছে, শিল্প খাতের সামগ্রিক বিকাশের স্বার্থে শুধু এসএমই সংক্রান্ত নীতিমালা নয়, পুরো শিল্পনীতিকেই আমূল ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। আর কুটির ও মাইক্রো শিল্পসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের পোষক (রেগুলেটরি) প্রতিষ্ঠান যেহেতু বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), সেহেতু শিল্পনীতির আওতায় এ অংশটি (সিএমএসএমই) বিসিকের মাধ্যমে করাটাই শ্রেয়তর হবে। নইলে এ ক্ষেত্রে নিয়মেরই শুধু ব্যত্যয় ঘটবে না, শিল্প খাতের আওতাধীন বিনিয়োগভিত্তিক বিভিন্ন উপখাতের মধ্যে সমন্বয় রক্ষা করাও কঠিন হয়ে পড়বে। অন্যদিকে এটি যেহেতু একটি নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত, সেহেতু এর প্রণয়নের দায়িত্ব একটি নির্বাচিত সরকারের ওপর ন্যস্ত করার লক্ষ্যে আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করাই সমীচীন হবে।

কোনোই সন্দেহ নেই যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগের ব্যাপারে শিক্ষিত তরুণ ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের যত বেশি যুক্ত করা যাবে, এ খাতে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন ও নয়া কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রেও তা তত বেশি সহায়ক হবে। কিন্তু সে যুক্ততার প্রচেষ্টা কখনোই উল্লিখিত তরুণ ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার পক্ষে যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না শিল্পনীতির আওতাধীন বিভিন্ন শিল্পের বিনিয়োগসীমা সংশোধন করে এর সংজ্ঞাসমূহ পরিবর্তন করা না হয়। আর সেই সঙ্গে এটাও বলা জরুরি যে উক্ত বিনিয়োগসীমা সংশোধনের পাশাপাশি এসব শিল্পকে বর্তমানের নানা জটিল বিভাজন থেকে মুক্ত করে এগুলোকে শুধু বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র—এই তিন ভাগে ভাগ করাটাই সর্বোত্তম হবে বলে মনে করি।

লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত