Ajker Patrika

টেকসই কৃষির জন্য চাই কৃষিপণ্যের মূল্য সংযোজন

শাইখ সিরাজ
নেদারল্যান্ডসের রিমেকার খামারে পনির হাতে উদ্যোক্তা ইয়ানের সঙ্গে লেখক। ছবি: হৃদয়ে মাটি ও মানুষ
নেদারল্যান্ডসের রিমেকার খামারে পনির হাতে উদ্যোক্তা ইয়ানের সঙ্গে লেখক। ছবি: হৃদয়ে মাটি ও মানুষ

বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবিকা কৃষির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। এই কৃষি খাত শুধু খাদ্যনিরাপত্তাই নিশ্চিত করে আসছে না, বরং অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। তবে আধুনিক বিশ্বের চাহিদা অনুযায়ী কৃষির উন্নয়ন শুধু উৎপাদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না; বরং কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, মান নিয়ন্ত্রণ ও বাজারজাতকরণের প্রতি সমান গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশে কৃষিপণ্যের ভ্যালু এডিশন বা মূল্য সংযোজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কাঁচা পণ্য, যেমন ধান, টমেটো, দুধ ইত্যাদি কম দামে বিক্রি হয়। কিন্তু এগুলো প্রক্রিয়াজাত করে সস, দই বা পনিরে রূপান্তর করলে তার মূল্য বহুগুণ বেড়ে যায়। এতে কৃষকেরা তাঁদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান।

ভ্যালু অ্যাডেড পণ্যের চাহিদা থাকলে দেশজুড়ে ছোট-বড় প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে ওঠে, যেমন দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র, ফল সংরক্ষণ কারখানা। এতে কর্মসংস্থান তৈরি হয় ও গ্রামীণ শিল্পায়ন ঘটে। বাংলাদেশের কৃষিপণ্য কাঁচা অবস্থায় রপ্তানি করলে কম দামে বিক্রি হয়। কিন্তু শুকনো আম, জ্যাম, প্যাকেটজাত মসলা ইত্যাদি রপ্তানি করলে আন্তর্জাতিক বাজারে অধিক মূল্য পাওয়া যায়। অনেক কৃষিপণ্য, যেমন আম, টমেটো, দুধ ইত্যাদি দ্রুত নষ্ট হয়। ভ্যালু অ্যাড করলে যেমন আম দিয়ে আমসত্ত্ব, দুধ দিয়ে ঘি—পণ্য সংরক্ষণ করা যায় এবং অপচয় কমে। ঘরে বসেই অনেক নারী কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করে আয় করতে পারেন। যেমন আচার তৈরি, শুকনো খাবার বা ঘি উৎপাদন। এটি নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ তৈরি করে।

ভ্যালু অ্যাডের মাধ্যমে কৃষক বা উদ্যোক্তা নতুন ধরনের পণ্য বাজারে আনতে পারেন, যেমন বেবি ফুড, হেলদি স্ন্যাকস, হোল গ্রেইন সিরিয়াল ইত্যাদি। এতে ভোক্তার চাহিদা পূরণ হয় এবং বাজার প্রতিযোগিতা বাড়ে। এক কেজি কাঁচা আম বিক্রি হয় হয়তো ৪০ টাকা। কিন্তু এই আম দিয়ে আমসত্ত্ব বানিয়ে প্যাকেটজাত করলে তা বিক্রি হতে পারে ২০০-২৫০ টাকায়। এভাবেই ভ্যালু অ্যাড কৃষিপণ্যের মূল্য বাড়ায়। আগেই বলেছি, বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তা, কৃষকের উন্নয়ন এবং রপ্তানি সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কৃষিপণ্যের ভ্যালু অ্যাড অপরিহার্য। এ জন্য প্রয়োজন প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, বাজার সংযোগ ও নীতিগত সহায়তা।

বছর দুই আগে নেদারল্যান্ডস সফরের সময় একটি অনন্য অভিজ্ঞতা হয়েছে। লুনটেরে নামক একটি গ্রামে ইয়ান ডির্ক ফান ডার ভোর্ট নামক একজন খামারির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তাঁর খামারটির নাম রিমেকার, যা প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো এবং পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারক। খামার পরিচালনায় অসামান্য দক্ষতা ইয়ানের। তিনি পূর্বপুরুষের শুধু ঐতিহ্যই সংরক্ষণ করছেন না, পূর্বপুরুষের যে চেতনা, তা-ও রয়েছে তাঁর মাথায়। আজকের দিনের বাণিজ্য চিন্তাকে হিসাবের মধ্যে রেখেই বেছে নিয়েছেন শতভাগ শুদ্ধ প্রক্রিয়ায় খামার পরিচালনার পথ।

তাঁর খামারে রয়েছে ৯০টি জার্সি জাতের গাভি। আমাদের দেশের গবাদিপশুর খামারিদের মূল সমস্যা পশুর খাবার নিয়ে। তাই তাঁর কাছে জানতে চাই, কী খাবার দেওয়া হয় এই গাভিগুলোকে? ‘ঘাস’—এককথায় উত্তর দিলেন ইয়ান। তারপর একটু থেমে বললেন, ‘শীতের সময়টায় যখন বরফ পড়ে, তখন খড় খেতে দিই। আর বাকি সময়ে মাঠের ঘাসই গাভির খাদ্য।’

ইয়ান আমাকে নিয়ে গেলেন গরুর চারণভূমিতে। লম্বাচওড়া ইয়ানের পায়ে বিশেষ বুট জুতা। হাতে একটা বেলচা। যেমনটা সিনেমায় ওয়েস্টার্ন কৃষকদের দেখি। গরুর পুরো চারণভূমিটা দেখলাম। মাঝখান দিয়ে সেচের পানি আসার জন্য নালাও রয়েছে। তবে সেখানে সরকারি সহযোগিতা রয়েছে। ৪০ বছর ধরে ইয়ান এই গ্রেজিং ল্যান্ডটা অর্গানিকভাবেই রেখেছেন এবং আলাদা করে কোনো কিছুই মেশাননি ঘাসের সঙ্গে। তাই গরুগুলো একদম প্রাকৃতিক খাবার পাচ্ছে। ইয়ান বলছিলেন, প্রাকৃতিক এই ঘাসেই গরুর জন্য যথেষ্ট পুষ্টি রয়েছে। এই মাটিতে কখনো চাষাবাদ করা হয় না। বেলচা দিয়ে মাটি তুলে দেখাল মাটির গুণাগুণ। দেখলাম উর্বর মাটির নিচে প্রচুর কেঁচো রয়েছে। ইয়ান আমাকে অবাক করে দিয়ে একটা কেঁচো মুখে তুলে নিলেন। পরিষ্কার করে কেঁচোটি আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘প্রাকৃতিক এই লাঙল ছাড়া এই ভূমিতে আর কোনো চাষ হয় না। একেবারেই অর্গানিক এই মাটি আর ঘাস, যা আমার গাভিগুলোর জন্য আদর্শ খাদ্য জোগাচ্ছে। দেখো, ঘাসগুলোর শিকড় কত পুষ্ট!’

মাঠের একপাশে গরু আসার একটি নির্দিষ্ট পথ রয়েছে। মাঠের যেকোনো জায়গায় গরু মল ত্যাগ করে। ওই গোবরই ঘাসের খাদ্য। গরু, ঘাস আর কেঁচোর প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেম এখানে টিকে আছে ইয়ানের তদারকিতে। ‘সার বা কোনো খাবার দেওয়া হয় না ঘাসকে’, বলছিলেন ইয়ান। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক বলতে যা বোঝায়, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রেক্ষাপট এই ফার্মে। কোনোভাবেই গরুগুলোকে অ্যান্টিবায়োটিক দেন না ইয়ান। মাঠের গাভিগুলো বেশ স্বাস্থ্যবান ও সুঠাম দেহের। আনন্দ নিয়ে ঘাস খাচ্ছিল। মাঠে ড্যান্ডালায়ন নামের একটা প্রাকৃতিক ফুল রয়েছে, যেখান থেকে ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। যদি এই ফুলটি মাঠে না থাকত, তাহলে ক্যালসিয়াম আসত না—এমনটাই দাবি ইয়ানের। ইয়ান তাঁর খামারের লাভে শতভাগ খুশি। সম্পূর্ণ কার্বন জিরো ফার্ম হলো রিমেকার। বাইরে থেকে গরুর জন্য কোনো খাবার আনা হয় না।

৯০টি গাভি থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ১ হাজার ৪৪০ কেজি দুধ আসে। ‘দুধ কি বিক্রি করে দেন?’ ইয়ানের কাছে জানতে চাই। ‘এক ফোঁটা দুধও আমি কারও কাছে বিক্রি করি না। অন্য খামারিরা চিজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে তাদের খামারের দুধ বিক্রি করে। আমি নিজেই চিজ তৈরি করি। একেবারে অর্গানিক চিজ।’ উত্তর দিলেন ইয়ান।

এরপর নিয়ে গেলেন পনিরের ঘরে। পনিরের ঘর দেখে চোখ ছানাবড়া অবস্থা। তাকের পর তাক সাজানো পনিরে। গোল গোল পনিরের চাকতি—একেকটির ওজন ১০ কেজি। পনির সংরক্ষণ করা হয়েছে এমনভাবে, যাতে বাইরের অংশে ব্যবহার করা হয়েছে ঘি। যেই পনির যত বেশি পুরোনো, তত বেশি দামে বিক্রি হবে। আমাদের সামনেই ছিল এক বছরের পুরোনো ঘি, যেগুলোর দাম নতুন পনিরের চেয়ে অনেক বেশি। আমরা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে গেলাম। সেটিও আরেকটি পনির ঘর। ইয়ান প্রতি দুই দিনের দুধ সংরক্ষণ করার পর পনির তৈরি করেন। ১০ কেজি পনিরের দাম প্রায় ৫০০ ইউরো। অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় ৫০ হাজার টাকা। ইয়ান বলছিলেন পনিরের বয়স যত বেশি হবে, তার দাম ও চাহিদা তত বেশি। বাইরের পনিরের চেয়ে তাঁর পনিরের দাম তিন গুণ বেশি। কারণ, তাঁর পনির শতভাগ অর্গানিক। হিসাব করে দেখলাম, তাঁর ঘরে যে পরিমাণ পনির আছে, তাতে করে তিনি কয়েক শ কোটি টাকার পনিরই সংরক্ষণে রেখেছেন। চিজমেকিং প্লটে নিয়ে গেলেন ইয়ান। পনির ভেজানোর জন্য কেলটিক সমুদ্রের লবণ ব্যবহার করছেন। যেখানে ঘি প্রস্তুত হচ্ছে, সে জায়গাটাও দেখালেন তিনি। বুঝলাম দুধের ভ্যালু অ্যাড করে তিনি কীভাবে তাঁর কৃষি-বাণিজ্যকে প্রসারিত করেছেন, উৎপাদনব্যবস্থাকে করেছেন টেকসই।

বাংলাদেশে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ দুধ, শাকসবজি, ফল, মাছ ও অন্যান্য কৃষিপণ্য উৎপাদিত হয়। কিন্তু উপযুক্ত প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও পরিবহনের অভাবে এর একটি বড় অংশ নষ্ট হয়ে যায়। বিশেষ করে পচনশীল কৃষিপণ্য, যেমন টমেটো, আম, কলা, দুধ ইত্যাদি উৎপাদনের মৌসুমে কৃষকেরা সঠিক দাম পান না। এসব পণ্যের জীবনকাল বাড়াতে পারলে এবং নতুন পণ্যে রূপান্তর করে বাজারজাত করা গেলে, তা দেশের অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখতে পারত।

বর্তমানে বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত শিল্প শহরকেন্দ্রিক এবং কিছু বৃহৎ কোম্পানির হাতে সীমাবদ্ধ। ফলে গ্রামীণপর্যায়ের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকেরা এর সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকেন। অথচ গ্রামে ছোট ছোট প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র গড়ে তোলা গেলে একদিকে যেমন কর্মসংস্থান বাড়বে, অন্যদিকে নারী উদ্যোক্তারাও এতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারবেন। অনেক এলাকায় ইতিমধ্যে নারীরা গৃহস্থালি পর্যায়ে আচার, মোরব্বা, চিপস, পিঠা ইত্যাদি তৈরি করছেন। এঁদের পণ্যে মান নিয়ন্ত্রণ ও আধুনিক প্যাকেজিং প্রযুক্তি যুক্ত করা গেলে তা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে স্থান করে নিতে পারবে।

কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলাতেও ভূমিকা রাখতে পারে। প্রাকৃতিক ও জৈব কৃষি পদ্ধতির প্রসার, রাসায়নিকের ব্যবহার কমানো, খাদ্য অপচয় হ্রাস করা এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্যাকেজিংয়ের ব্যবহার—এসবের মাধ্যমে একটি পরিবেশবান্ধব কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। আমাদের এই বিষয়ে মনোযোগী হওয়ার সময় এসেছে।

লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান চ্যানেল আই

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত