সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
একাত্তরের যুদ্ধ সম্পর্কে পাকিস্তানি সেনাধ্যক্ষদের আত্মকথনগুলো বেশ উপভোগ্য। এরা সবাই আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন এবং দোষ চাপিয়েছেন অন্যের ঘাড়ে। হামিদুর রহমান কমিশন প্রধান অপরাধী হিসেবে ইয়াহিয়া খানকে চিহ্নিত করেছে বটে, তবে সর্বাধিক নিন্দা জানিয়েছে নিয়াজিকে। অদক্ষতা, কাপুরুষতা, লাম্পট্য, পান-চোরাচালানে সংযুক্তি, কোনো কিছুরই অভাব দেখা যায়নি এই মহাবীরের কাজকর্মে। কিন্তু তিনিই আবার অন্যদের দুষেছেন তাঁদের ব্যর্থতার জন্য।
‘বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’ নামে একটি বই লিখে তিনি পিন্ডিওয়ালাদের তো বটেই, রণাঙ্গনে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধাদের বিরুদ্ধেও খারাপ খারাপ কথা বলেছেন। বলেছেন যে ‘২৫ মার্চ টিক্কা অহেতুক রক্তপাত ঘটিয়েছেন, এক রাত্রেই ৫০ হাজার মানুষ মেরে ফেলেছেন এবং নিজের আয়ত্তাধীন সব শক্তিকে এমনভাবে লেলিয়ে দিয়েছেন যেন নিজের দেশের বিপথে-পরিচালিত ও বিপথগামী মানুষদের সঙ্গে নয়, বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইতে নেমেছেন।’
নিয়াজি জানাচ্ছেন যে টিক্কাকে লোকে চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, জেনারেল ডায়ার ইত্যাদির সঙ্গে তুলনা করেছে। ২০০২ সালে উর্দু ‘ডাইজেস্ট’ নামের একটি পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাও ফরমান আলী সম্পর্কে তিনি অভিযোগ করেন যে ওই সেনা অফিসারটি ভারতীয়দের দেওয়া শর্তে দ্রুত আত্মসমর্পণ করে বাঙালিদের হাত থেকে বাঁচতে চাইছিলেন, কারণ ২৫ মার্চের অভিযানে জড়িত থাকার দরুন বাঙালিরা তাঁকে ভীষণ ঘৃণা করত।
নিয়াজি কোন ধরনের মানুষ ছিলেন সে বিষয়ে খাদিম হোসেন রাজার সাক্ষ্য আমরা পেয়েছি। সিদ্দিক সালিকের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে ওই সেনাপতিটির বীরত্বের প্রমাণ। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই নিয়াজি মাটির নিচে তৈরি তাঁর হেডকোয়ার্টার্সে আশ্রয় নেন। ৪ ডিসেম্বর গুজব রটে গিয়েছিল যে পাকিস্তানি বাহিনী অমৃতসর দখল করে নিয়েছে। এই গুজব শোনার সঙ্গে সঙ্গে নিয়াজি তাঁর চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে কুস্তিগিরের মতো নর্তনকুর্দন শুরু করেন। দ্রুত গভর্নরকে ফোন করে তিনি শুভ সংবাদটি জানালেন। পরে ওটি যখন গুজব বলে প্রমাণিত হলো, তখন সেই যে চুপসে গেলেন আর সতেজ হতে পারলেন না!
তবে ৭ ডিসেম্বর তাঁকে একবার আত্মপ্রকাশ করতে হয়েছিল, কেননা গভর্নর ডা. এম এ মালিক তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন গভর্নমেন্ট হাউসে। সেখানে গিয়ে নিয়াজি কোনো কথা বলছেন না দেখে মালিক সাহেব তাঁর পিঠে হাত বুলিয়ে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করেন। আর তখনই ঘটে মস্ত এক ঘটনা। জেনারেল সাহেবের নাদুসনুদুস দেহটি কেঁপে কেঁপে উঠল এবং তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। দু-হাতে মুখ ঢেকে তিনি শিশুর মতো ফোঁপাতে শুরু করলেন। ঠিক সেই সময়ে একজন বাঙালি ওয়েটার ট্রেতে করে কফি ও স্ন্যাকস সাজিয়ে নিয়ে কামরায় ঢুকে পড়ে। ‘কুকুরের মতো গর্জন’ করে তাকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হলো। ওয়েটারটি বের হয়ে এল ঠিকই, কিন্তু সে তার বাঙালি সহকর্মীদের জানাতে ভুল করল না যে সাহেবরা সবাই মিলে কান্নাকাটি করছেন।
১২ তারিখে নিয়াজি আবার বের হন, এবার তিনি সামরিক হাসপাতালে যান। সেখানে ছয়জন নার্স তাঁর কাছে কোনোমতে এসে বলতে সক্ষম হয় যে তারা মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে বাঁচার ব্যবস্থা চায়। জেনারেল সাহেব তাদের আশ্বস্ত করে বলেন যে ভয়ের কোনো কারণ নেই, কেননা খুব বড় রকমের সাহায্য (অর্থাৎ চীনারা) রওনা হয়ে গেছে। আর সাহায্য যদি না-ই আসে তাহলেও চিন্তা নেই: ‘মুক্তিবাহিনীর হাতে তোমাদের আমরা কিছুতেই পড়তে দেব না, তার আগে আমরাই তোমাদের মেরে ফেলব।’ ওই যাত্রাতেই সাংবাদিকেরা তাঁকে ঘেরাও করে ফেলেন; তাঁদের কাছে তিনি দম্ভভরে বলেন, ‘ঢাকার পতন ঘটবে আমার মৃতদেহের ওপর দিয়ে।’ বলে নিজের বুক নিজেই চাপড়ে দিয়েছিলেন। সিদ্দিক সালিক জানাচ্ছেন যে ১৬ তারিখে খুব সকালে আহত মেজর জেনারেল রহিম ও আরও কয়েকজন যখন তিনটি হেলিকপ্টারে করে বার্মায় পাড়ি দিলেন, তখন তাতে নার্সদের নেওয়া গেল না, কারণ তাদেরকে তাদের হোস্টেল থেকে ‘সংগ্রহ করা’ সম্ভব হয়নি।
সিদ্দিক সালিকের বইটি তথ্যে সমৃদ্ধ। তাঁর দেওয়া একটি তথ্য তো বেশ কৌতূহলের সৃষ্টি করেছিল। সেটি হলো ২৫ মার্চ রাতের। গণহত্যা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাকি বেতারে শেখ মুজিবুর রহমানের নিজের কণ্ঠে রেকর্ড করা স্বাধীনতার একটি ঘোষণা শোনা গিয়েছিল। এই তথ্যকে কেউ কেউ স্বাধীনতা ঘোষণার অকাট্য প্রমাণ বলে ধরে নিয়েছিলেন, অন্যরা প্রশ্ন তুলেছেন অন্য কেউ যা শুনল না তিনি কী করে তা শুনলেন? একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে যে তথ্যটা তাঁর নিজের দেওয়া নয়, একজন বিদেশি সাংবাদিকের লেখা থেকে উদ্ধৃতি মাত্র, এবং সে উৎসটি তিনি পাদটীকাতে উল্লেখও করেছেন, সেই সঙ্গে পরের প্যারাতেই তিনি জানাচ্ছেন যে ‘বেতার বার্তাটা আমি নিজে শুনিনি, আমি তখন কেবল রকেট-লঞ্চারের ভয়ংকর ভয়ংকর সব শব্দ শুনছিলাম। অন্যকিছু শোনা সম্ভব ছিল না।’ প্রশ্ন থাকে, নিজে যদি না-ই শুনে থাকেন তাহলে ওই তথ্য সরবরাহের কি কোনো প্রয়োজন ছিল? হ্যাঁ, ছিল। প্রয়োজন ছিল এটা বোঝাবার জন্য যে পাকিস্তানিরা সময়মতো আক্রমণ না করলে তারা নির্ঘাৎ আক্রান্ত হতো; আওয়ামী লীগ সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল, স্বাধীনতার রেকর্ড করা একটি ঘোষণাসহ।
গভর্নমেন্ট হাউসে কুকুরের মতো গর্জন করে উঠেছিলেন যে সেনাকর্তারা, কিছুদিন পরেই সারমেয়দের যে অপর স্বভাব, লেজ গুটিয়ে পলায়ন, সেটিই তাঁদের করতে হয়েছে। সিদ্দিক সালিকের লেখায় অবশ্য আরেকটি কুকুরের কথা আছে, সেটি বাস্তবিক কুকুর, কিন্তু প্রতীকের রূপে মূর্তিমান। পঁচিশ তারিখের রাত্রি পোহানোর পর ছাব্বিশ তারিখের অতি প্রত্যুষের ঘটনা। টিক্কা খান সারা রাত ধরে সোফায় বসে অপারেশনের খবরাখবর নিয়ে ভোর ৫টায় সন্তোষের সঙ্গে নিজের অফিসে গেছেন, কিছুক্ষণ পর রুমালে চশমা মুছতে মুছতে তিনি দৃশ্যমান হয়েছেন এবং চারদিকে তাকিয়ে বলেছেন, ‘কোথাও তো কেউ নেই দেখছি।’
সিদ্দিক সালিক পাশেই ছিলেন। জেনারেলের স্বগতোক্তি শুনে নিজেও আশপাশে তাকিয়ে দেখেছেন, ঘটনা সত্যি, কেউ নেই, তবে একটি কুকুরকে দেখা গেল পেছনের দুই পায়ের নিচে লেজটি গুঁজে শহরের দিকে চলে যাচ্ছে, চুপিচুপি। যেন সমগ্র বাংলাদেশের প্রতিনিধি!
সেভাবেই দেখেছিলেন তিনি, বিবরণ পাঠে তা-ই মনে হয়। কিন্তু হায়, বোঝেননি যে ৯ মাস পরে তাঁদের নিজেদেরও ওই একই দশা হবে; আর কেউ না দেখুক, ইতিহাস দেখবে। এবং দেখেছেও। আর কুকুর তো তখন ডাকতই। সন্ধ্যার পর, কারফিউ থাকুক আর না-ই থাকুক, মানুষ বের হতো না, তবে কুকুরদের ছিল অবাধ স্বাধীনতা।
যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ১৫ জন পদস্থ আমলা এসেছিলেন, প্রশাসন চালু রাখার জন্য। তাঁদের একজন হাসান জহীর। তিনিও একটি বই লিখেছেন, নাম দিয়েছেন ‘দি সেপারেশন অব ইস্ট পাকিস্তান: দি রাইজ অ্যান্ড রিয়ালাইজেশন অব বেঙ্গলি মুসলিম ন্যাশনালিজম’। দৃষ্টিভঙ্গিটা অস্পষ্ট নয়, বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মানতে প্রস্তুত নন, সঙ্গে মুসলিমের উপাদান যোগ করে স্বাদের কটুত্ব দূর করতে চাইছেন। হাসান জহীর তাঁর নিজের একটি বিশেষ অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের মিশন এসেছিল ঢাকায়; আপ্যায়নের জন্য গভর্নমেন্ট হাউসে ডিনারের আয়োজন করেছিলেন গভর্নর টিক্কা খান। তখন বাইরে প্রথমে শোনা গেল বোমার আওয়াজ, পরে মেশিনগানের এবং সেই সঙ্গে কুকুরের। বোমা ছুড়ছিল বাঙালিরা, মেশিনগান পাঞ্জাবিদের; আর কুকুর? পাঞ্জাবিরা তো কুকুর আনেনি সঙ্গে করে। কুকুরগুলো নিশ্চয়ই বাংলাদেশেরই, চিৎকার করে তারা কী বলছিল? বলছিল কি যে ডাকাত পড়েছে? তা ডাকাত পড়েছিল বইকি। অমন ডাকাত কেউ কখনো দেখেনি।
তবে শাসকশ্রেণির প্রতিনিধিরা অনিচ্ছাসত্ত্বে হলেও অনেক সত্য স্বীকার করেছেন। তাঁদের ভেতর বাস্তববাদী যাঁরা, তাঁরা ভয় পেয়েছেন নিজেদের পরিণতির কথা ভেবে। সিদ্দিক লিখেছেন, ডিসেম্বরের ৮-৯ তারিখের দিকে ‘কাঁধে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ধাতু বহনকারী’ দুজন অফিসার তাঁকে একা পেয়ে বলেছিলেন, ‘জেনারেল নিয়াজির কাছে তো তোমার যাতায়াত আছে, তাঁকে গিয়ে বলো না কেন বাস্তববাদী হতে? নইলে আমরা সবাই কুকুরের মতো মারা পড়ব।’ সালিক অবশ্য সেই বাণী বহন করে নিয়ে যেতে সাহস করেননি। তবে কুকুরেরা যে নানারূপে ঘোরাঘুরি করছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কর্তাব্যক্তিরা সর্বত্র ঘৃণা দেখতে পাচ্ছিলেন। খাদিম হোসেন পূর্ববঙ্গে প্রথম আসেন ১৯৬৮ সালে। সংক্ষিপ্ত সেই অবস্থানে তিনি বিস্ময় ও দুঃখের সঙ্গে দেখেন বাঙালিরা অবাঙালিদের সহ্য করতে পারছে না। ‘শালা পাঞ্জাবি’, ‘শালা বিহারি’ এসব বলছে। অবাঙালিদের কাছে জিনিসপত্র পর্যন্ত বিক্রি করছে না। তখনই তাঁর মনে হয়েছে যে নিজ দেশে তিনি পরবাসী হয়ে যাচ্ছেন।
পাকিস্তানিরা হিসাব করে দেখতে পাচ্ছিল যে পূর্ববঙ্গে তাদের নিয়মিত বাহিনী ও ইপিআর মিলিয়ে সৈন্য হবে ২৫ হাজার; তাদের দিয়ে সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে দাবিয়ে রাখবে কীভাবে? সৈন্য ও সরঞ্জাম বাড়ানো হচ্ছিল, কিন্তু কতটা বাড়ানো যাবে? বাঙালি ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ, কোনো বাহিনীর ওপরই নির্ভর করার উপায় ছিল না। তাদের শঙ্কা ছিল যে নিয়মিত বাহিনী ও ইপিআরের সদস্যরা হুকুম দিলে শুনবে না, বাঙালিদের তারা গুলি করে মারতে চাইবে না এবং শেখ মুজিব যদি ডাক দেন তবে তারা বিদ্রোহ করবে। অসহযোগের সময় বেসামরিক প্রশাসন আওয়ামী লীগের নির্দেশ অনুযায়ী চলছিল, এমনকি সেনাছাউনির বেসামরিক কর্মচারীরাও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আগের মতো সহযোগিতা করছিল না। জ্বালানি, খাদ্য ও চলাফেরার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল।
এই পরিস্থিতিতেই ইয়াহিয়ার নির্দেশে খাদিম হোসেন ও ফরমান আলী দুজনে মিলে হামলার একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন, নাম দেন ‘অপারেশন সার্চলাইট’। কাজটা করতে হয়েছে অত্যন্ত গোপনে। পরিকল্পনাটির মুখবন্ধে বলা হচ্ছে, ‘অ্যাজ আওয়ামী লীগ হ্যাজ ওয়াইডস্প্রেড সাপোর্ট ইভেন অ্যামাংস্ট দ্য ইস্ট পাকিস্তানি এলিমেন্টস ইন দ্য আর্মি, দ্য অপারেশন হ্যাজ টু বি লঞ্চড উইথ গ্রেট কানিংনেস, সারপ্রাইজ, ডিসেপশন অ্যান্ড স্পিড কম্বাইন্ড উইথ শক অ্যাকশন।’ (সেনাবাহিনীর পূর্ব পাকিস্তানি সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ব্যাপক সমর্থন আছে। তাই অভিযানটি অত্যন্ত সুচিন্তিত কৌশলে পরিচালনা করতে হবে, যাতে দ্রুততার সঙ্গে প্রচণ্ড আঘাত করে শত্রুপক্ষকে সম্পূর্ণ হতবাক ও পর্যুদস্ত করা যাবে।)
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
একাত্তরের যুদ্ধ সম্পর্কে পাকিস্তানি সেনাধ্যক্ষদের আত্মকথনগুলো বেশ উপভোগ্য। এরা সবাই আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন এবং দোষ চাপিয়েছেন অন্যের ঘাড়ে। হামিদুর রহমান কমিশন প্রধান অপরাধী হিসেবে ইয়াহিয়া খানকে চিহ্নিত করেছে বটে, তবে সর্বাধিক নিন্দা জানিয়েছে নিয়াজিকে। অদক্ষতা, কাপুরুষতা, লাম্পট্য, পান-চোরাচালানে সংযুক্তি, কোনো কিছুরই অভাব দেখা যায়নি এই মহাবীরের কাজকর্মে। কিন্তু তিনিই আবার অন্যদের দুষেছেন তাঁদের ব্যর্থতার জন্য।
‘বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’ নামে একটি বই লিখে তিনি পিন্ডিওয়ালাদের তো বটেই, রণাঙ্গনে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধাদের বিরুদ্ধেও খারাপ খারাপ কথা বলেছেন। বলেছেন যে ‘২৫ মার্চ টিক্কা অহেতুক রক্তপাত ঘটিয়েছেন, এক রাত্রেই ৫০ হাজার মানুষ মেরে ফেলেছেন এবং নিজের আয়ত্তাধীন সব শক্তিকে এমনভাবে লেলিয়ে দিয়েছেন যেন নিজের দেশের বিপথে-পরিচালিত ও বিপথগামী মানুষদের সঙ্গে নয়, বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইতে নেমেছেন।’
নিয়াজি জানাচ্ছেন যে টিক্কাকে লোকে চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, জেনারেল ডায়ার ইত্যাদির সঙ্গে তুলনা করেছে। ২০০২ সালে উর্দু ‘ডাইজেস্ট’ নামের একটি পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাও ফরমান আলী সম্পর্কে তিনি অভিযোগ করেন যে ওই সেনা অফিসারটি ভারতীয়দের দেওয়া শর্তে দ্রুত আত্মসমর্পণ করে বাঙালিদের হাত থেকে বাঁচতে চাইছিলেন, কারণ ২৫ মার্চের অভিযানে জড়িত থাকার দরুন বাঙালিরা তাঁকে ভীষণ ঘৃণা করত।
নিয়াজি কোন ধরনের মানুষ ছিলেন সে বিষয়ে খাদিম হোসেন রাজার সাক্ষ্য আমরা পেয়েছি। সিদ্দিক সালিকের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে ওই সেনাপতিটির বীরত্বের প্রমাণ। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই নিয়াজি মাটির নিচে তৈরি তাঁর হেডকোয়ার্টার্সে আশ্রয় নেন। ৪ ডিসেম্বর গুজব রটে গিয়েছিল যে পাকিস্তানি বাহিনী অমৃতসর দখল করে নিয়েছে। এই গুজব শোনার সঙ্গে সঙ্গে নিয়াজি তাঁর চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে কুস্তিগিরের মতো নর্তনকুর্দন শুরু করেন। দ্রুত গভর্নরকে ফোন করে তিনি শুভ সংবাদটি জানালেন। পরে ওটি যখন গুজব বলে প্রমাণিত হলো, তখন সেই যে চুপসে গেলেন আর সতেজ হতে পারলেন না!
তবে ৭ ডিসেম্বর তাঁকে একবার আত্মপ্রকাশ করতে হয়েছিল, কেননা গভর্নর ডা. এম এ মালিক তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন গভর্নমেন্ট হাউসে। সেখানে গিয়ে নিয়াজি কোনো কথা বলছেন না দেখে মালিক সাহেব তাঁর পিঠে হাত বুলিয়ে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করেন। আর তখনই ঘটে মস্ত এক ঘটনা। জেনারেল সাহেবের নাদুসনুদুস দেহটি কেঁপে কেঁপে উঠল এবং তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। দু-হাতে মুখ ঢেকে তিনি শিশুর মতো ফোঁপাতে শুরু করলেন। ঠিক সেই সময়ে একজন বাঙালি ওয়েটার ট্রেতে করে কফি ও স্ন্যাকস সাজিয়ে নিয়ে কামরায় ঢুকে পড়ে। ‘কুকুরের মতো গর্জন’ করে তাকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হলো। ওয়েটারটি বের হয়ে এল ঠিকই, কিন্তু সে তার বাঙালি সহকর্মীদের জানাতে ভুল করল না যে সাহেবরা সবাই মিলে কান্নাকাটি করছেন।
১২ তারিখে নিয়াজি আবার বের হন, এবার তিনি সামরিক হাসপাতালে যান। সেখানে ছয়জন নার্স তাঁর কাছে কোনোমতে এসে বলতে সক্ষম হয় যে তারা মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে বাঁচার ব্যবস্থা চায়। জেনারেল সাহেব তাদের আশ্বস্ত করে বলেন যে ভয়ের কোনো কারণ নেই, কেননা খুব বড় রকমের সাহায্য (অর্থাৎ চীনারা) রওনা হয়ে গেছে। আর সাহায্য যদি না-ই আসে তাহলেও চিন্তা নেই: ‘মুক্তিবাহিনীর হাতে তোমাদের আমরা কিছুতেই পড়তে দেব না, তার আগে আমরাই তোমাদের মেরে ফেলব।’ ওই যাত্রাতেই সাংবাদিকেরা তাঁকে ঘেরাও করে ফেলেন; তাঁদের কাছে তিনি দম্ভভরে বলেন, ‘ঢাকার পতন ঘটবে আমার মৃতদেহের ওপর দিয়ে।’ বলে নিজের বুক নিজেই চাপড়ে দিয়েছিলেন। সিদ্দিক সালিক জানাচ্ছেন যে ১৬ তারিখে খুব সকালে আহত মেজর জেনারেল রহিম ও আরও কয়েকজন যখন তিনটি হেলিকপ্টারে করে বার্মায় পাড়ি দিলেন, তখন তাতে নার্সদের নেওয়া গেল না, কারণ তাদেরকে তাদের হোস্টেল থেকে ‘সংগ্রহ করা’ সম্ভব হয়নি।
সিদ্দিক সালিকের বইটি তথ্যে সমৃদ্ধ। তাঁর দেওয়া একটি তথ্য তো বেশ কৌতূহলের সৃষ্টি করেছিল। সেটি হলো ২৫ মার্চ রাতের। গণহত্যা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাকি বেতারে শেখ মুজিবুর রহমানের নিজের কণ্ঠে রেকর্ড করা স্বাধীনতার একটি ঘোষণা শোনা গিয়েছিল। এই তথ্যকে কেউ কেউ স্বাধীনতা ঘোষণার অকাট্য প্রমাণ বলে ধরে নিয়েছিলেন, অন্যরা প্রশ্ন তুলেছেন অন্য কেউ যা শুনল না তিনি কী করে তা শুনলেন? একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে যে তথ্যটা তাঁর নিজের দেওয়া নয়, একজন বিদেশি সাংবাদিকের লেখা থেকে উদ্ধৃতি মাত্র, এবং সে উৎসটি তিনি পাদটীকাতে উল্লেখও করেছেন, সেই সঙ্গে পরের প্যারাতেই তিনি জানাচ্ছেন যে ‘বেতার বার্তাটা আমি নিজে শুনিনি, আমি তখন কেবল রকেট-লঞ্চারের ভয়ংকর ভয়ংকর সব শব্দ শুনছিলাম। অন্যকিছু শোনা সম্ভব ছিল না।’ প্রশ্ন থাকে, নিজে যদি না-ই শুনে থাকেন তাহলে ওই তথ্য সরবরাহের কি কোনো প্রয়োজন ছিল? হ্যাঁ, ছিল। প্রয়োজন ছিল এটা বোঝাবার জন্য যে পাকিস্তানিরা সময়মতো আক্রমণ না করলে তারা নির্ঘাৎ আক্রান্ত হতো; আওয়ামী লীগ সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল, স্বাধীনতার রেকর্ড করা একটি ঘোষণাসহ।
গভর্নমেন্ট হাউসে কুকুরের মতো গর্জন করে উঠেছিলেন যে সেনাকর্তারা, কিছুদিন পরেই সারমেয়দের যে অপর স্বভাব, লেজ গুটিয়ে পলায়ন, সেটিই তাঁদের করতে হয়েছে। সিদ্দিক সালিকের লেখায় অবশ্য আরেকটি কুকুরের কথা আছে, সেটি বাস্তবিক কুকুর, কিন্তু প্রতীকের রূপে মূর্তিমান। পঁচিশ তারিখের রাত্রি পোহানোর পর ছাব্বিশ তারিখের অতি প্রত্যুষের ঘটনা। টিক্কা খান সারা রাত ধরে সোফায় বসে অপারেশনের খবরাখবর নিয়ে ভোর ৫টায় সন্তোষের সঙ্গে নিজের অফিসে গেছেন, কিছুক্ষণ পর রুমালে চশমা মুছতে মুছতে তিনি দৃশ্যমান হয়েছেন এবং চারদিকে তাকিয়ে বলেছেন, ‘কোথাও তো কেউ নেই দেখছি।’
সিদ্দিক সালিক পাশেই ছিলেন। জেনারেলের স্বগতোক্তি শুনে নিজেও আশপাশে তাকিয়ে দেখেছেন, ঘটনা সত্যি, কেউ নেই, তবে একটি কুকুরকে দেখা গেল পেছনের দুই পায়ের নিচে লেজটি গুঁজে শহরের দিকে চলে যাচ্ছে, চুপিচুপি। যেন সমগ্র বাংলাদেশের প্রতিনিধি!
সেভাবেই দেখেছিলেন তিনি, বিবরণ পাঠে তা-ই মনে হয়। কিন্তু হায়, বোঝেননি যে ৯ মাস পরে তাঁদের নিজেদেরও ওই একই দশা হবে; আর কেউ না দেখুক, ইতিহাস দেখবে। এবং দেখেছেও। আর কুকুর তো তখন ডাকতই। সন্ধ্যার পর, কারফিউ থাকুক আর না-ই থাকুক, মানুষ বের হতো না, তবে কুকুরদের ছিল অবাধ স্বাধীনতা।
যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ১৫ জন পদস্থ আমলা এসেছিলেন, প্রশাসন চালু রাখার জন্য। তাঁদের একজন হাসান জহীর। তিনিও একটি বই লিখেছেন, নাম দিয়েছেন ‘দি সেপারেশন অব ইস্ট পাকিস্তান: দি রাইজ অ্যান্ড রিয়ালাইজেশন অব বেঙ্গলি মুসলিম ন্যাশনালিজম’। দৃষ্টিভঙ্গিটা অস্পষ্ট নয়, বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মানতে প্রস্তুত নন, সঙ্গে মুসলিমের উপাদান যোগ করে স্বাদের কটুত্ব দূর করতে চাইছেন। হাসান জহীর তাঁর নিজের একটি বিশেষ অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের মিশন এসেছিল ঢাকায়; আপ্যায়নের জন্য গভর্নমেন্ট হাউসে ডিনারের আয়োজন করেছিলেন গভর্নর টিক্কা খান। তখন বাইরে প্রথমে শোনা গেল বোমার আওয়াজ, পরে মেশিনগানের এবং সেই সঙ্গে কুকুরের। বোমা ছুড়ছিল বাঙালিরা, মেশিনগান পাঞ্জাবিদের; আর কুকুর? পাঞ্জাবিরা তো কুকুর আনেনি সঙ্গে করে। কুকুরগুলো নিশ্চয়ই বাংলাদেশেরই, চিৎকার করে তারা কী বলছিল? বলছিল কি যে ডাকাত পড়েছে? তা ডাকাত পড়েছিল বইকি। অমন ডাকাত কেউ কখনো দেখেনি।
তবে শাসকশ্রেণির প্রতিনিধিরা অনিচ্ছাসত্ত্বে হলেও অনেক সত্য স্বীকার করেছেন। তাঁদের ভেতর বাস্তববাদী যাঁরা, তাঁরা ভয় পেয়েছেন নিজেদের পরিণতির কথা ভেবে। সিদ্দিক লিখেছেন, ডিসেম্বরের ৮-৯ তারিখের দিকে ‘কাঁধে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ধাতু বহনকারী’ দুজন অফিসার তাঁকে একা পেয়ে বলেছিলেন, ‘জেনারেল নিয়াজির কাছে তো তোমার যাতায়াত আছে, তাঁকে গিয়ে বলো না কেন বাস্তববাদী হতে? নইলে আমরা সবাই কুকুরের মতো মারা পড়ব।’ সালিক অবশ্য সেই বাণী বহন করে নিয়ে যেতে সাহস করেননি। তবে কুকুরেরা যে নানারূপে ঘোরাঘুরি করছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কর্তাব্যক্তিরা সর্বত্র ঘৃণা দেখতে পাচ্ছিলেন। খাদিম হোসেন পূর্ববঙ্গে প্রথম আসেন ১৯৬৮ সালে। সংক্ষিপ্ত সেই অবস্থানে তিনি বিস্ময় ও দুঃখের সঙ্গে দেখেন বাঙালিরা অবাঙালিদের সহ্য করতে পারছে না। ‘শালা পাঞ্জাবি’, ‘শালা বিহারি’ এসব বলছে। অবাঙালিদের কাছে জিনিসপত্র পর্যন্ত বিক্রি করছে না। তখনই তাঁর মনে হয়েছে যে নিজ দেশে তিনি পরবাসী হয়ে যাচ্ছেন।
পাকিস্তানিরা হিসাব করে দেখতে পাচ্ছিল যে পূর্ববঙ্গে তাদের নিয়মিত বাহিনী ও ইপিআর মিলিয়ে সৈন্য হবে ২৫ হাজার; তাদের দিয়ে সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে দাবিয়ে রাখবে কীভাবে? সৈন্য ও সরঞ্জাম বাড়ানো হচ্ছিল, কিন্তু কতটা বাড়ানো যাবে? বাঙালি ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ, কোনো বাহিনীর ওপরই নির্ভর করার উপায় ছিল না। তাদের শঙ্কা ছিল যে নিয়মিত বাহিনী ও ইপিআরের সদস্যরা হুকুম দিলে শুনবে না, বাঙালিদের তারা গুলি করে মারতে চাইবে না এবং শেখ মুজিব যদি ডাক দেন তবে তারা বিদ্রোহ করবে। অসহযোগের সময় বেসামরিক প্রশাসন আওয়ামী লীগের নির্দেশ অনুযায়ী চলছিল, এমনকি সেনাছাউনির বেসামরিক কর্মচারীরাও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আগের মতো সহযোগিতা করছিল না। জ্বালানি, খাদ্য ও চলাফেরার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল।
এই পরিস্থিতিতেই ইয়াহিয়ার নির্দেশে খাদিম হোসেন ও ফরমান আলী দুজনে মিলে হামলার একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন, নাম দেন ‘অপারেশন সার্চলাইট’। কাজটা করতে হয়েছে অত্যন্ত গোপনে। পরিকল্পনাটির মুখবন্ধে বলা হচ্ছে, ‘অ্যাজ আওয়ামী লীগ হ্যাজ ওয়াইডস্প্রেড সাপোর্ট ইভেন অ্যামাংস্ট দ্য ইস্ট পাকিস্তানি এলিমেন্টস ইন দ্য আর্মি, দ্য অপারেশন হ্যাজ টু বি লঞ্চড উইথ গ্রেট কানিংনেস, সারপ্রাইজ, ডিসেপশন অ্যান্ড স্পিড কম্বাইন্ড উইথ শক অ্যাকশন।’ (সেনাবাহিনীর পূর্ব পাকিস্তানি সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ব্যাপক সমর্থন আছে। তাই অভিযানটি অত্যন্ত সুচিন্তিত কৌশলে পরিচালনা করতে হবে, যাতে দ্রুততার সঙ্গে প্রচণ্ড আঘাত করে শত্রুপক্ষকে সম্পূর্ণ হতবাক ও পর্যুদস্ত করা যাবে।)
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কয়েক দিন ধরেই সেনাবাহিনী নিয়ে গণমাধ্যমে বেশ আলোচনা হচ্ছে। নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ ও আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) নামক অপর একটি দলের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান...
৯ ঘণ্টা আগেএখনই রাজনীতির মাঠের উত্তাপ বাড়াটা স্বাভাবিক ঘটনা। সম্ভাব্য নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসবে, রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা যত বাড়তে থাকবে এবং রাজনীতির মাঠের উত্তাপ ততই বেশি করে অনুভূত হতে থাকবে। এখন সেটাই দেখা যাচ্ছে। তবে নির্বাচনের সময়সূচি...
৯ ঘণ্টা আগেআমরা সবাই পাপী; আপন পাপের বাটখারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি—কাজী নজরুল ইসলামের এই পঙ্ক্তিটি আমাদের সমাজের চিরন্তন বাস্তবতার নগ্ন প্রতিচিত্র। সময়ের পরিক্রমায় সভ্যতার অগ্রগতি হয়েছে, মানুষ বিজ্ঞানের চূড়ান্ত উৎকর্ষে পৌঁছেছে...
৯ ঘণ্টা আগেএসপি হতে পারেন তিনি। কিন্তু এ কথা তো সত্য, তিনি চলেন জনগণের করের টাকায়। যে দেশে বাস করেন, সে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে অপমান করেও দিব্যি তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
৯ ঘণ্টা আগে