Ajker Patrika

অন্যের ঘরে উঁকি দেওয়া স্বভাব

জাহাঙ্গীর আলম
আপডেট : ১৫ নভেম্বর ২০২১, ১৭: ৪৭
Thumbnail image

প্রকৃতিগতভাবেই মানুষের ঔৎসুক্য অসীম। অন্যের ঘরে উঁকিঝুঁকি মারা তার স্বভাব। ‘প্রাইভেসি’ বা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ধারণা জন্মানোর আগে কোনো ধরনের সংকোচ বা অপরাধবোধ ছাড়াই এই অভ্যাসটাকে মানুষ বেশ উপভোগই করেছে। কিন্তু আধুনিক মানুষের মূল্যবোধ ও নৈতিকতার জগতে এটি খুবই আপত্তিকর। অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলানো অত্যন্ত নীচ কাজ। কিন্তু এই দীর্ঘ মহামারি সম্ভবত সেই উঁচু নাকে সজোরে থাবা বসিয়ে থেবড়ে দিয়েছে!

তৃতীয় বিশ্বের পিছিয়ে পড়া দেশগুলোতে প্রাইভেসি নিয়ে কখনোই তেমন মাথাব্যথা ছিল না। এখনো আছে কি-না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। কারণ, সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে প্রাইভেসি নিয়ে পশ্চিমের সাধারণ মানুষ যতটা সরব, সেখানে যেভাবে বড় প্ল্যাটফর্মগুলো দৌড়ের ওপর আছে, তৃতীয় বিশ্ব ঠিক ততটাই নীরব। অবশ্য মহাজনদের ব্যক্তিগত জীবন সব যুগেই সাধারণের নাগালের বাইরে ছিল। পশ্চিমে এই ঢাক গুড়গুড় ব্যাপারটা ভাঙতে শুরু করেছে বেশ আগে থেকেই। 

মহামারিতে আমাদের নিজস্ব সামাজিক জগৎ বেশ সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল। স্মরণকালে এমন কঠোর নিয়ন্ত্রিত জীবনের অভিজ্ঞতা সম্ভবত মানুষের আর হয়নি। অতিরিক্ত কর্মঘণ্টায় শ্রান্ত-ক্লান্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের ছবিসংবলিত অত্যন্ত আবেগমথিত নিবন্ধ, রাজনীতিকদের লকডাউন ভাঙার খবর, সেলিব্রিটিদের ব্যক্তিগত জেটে চড়ে দূর দ্বীপে লকডাউন কাটানোর ছবি শেয়ার করেছি, ভালোবেসেছি, কেঁদেছি, হেসেছি, ক্ষুব্ধ হয়েছি। কেউ কেউ বাইরে উঁকি দিয়ে প্রতিবেশীর গতিবিধি দেখার চেষ্টা করেছেন। 

এ সময়টাতে মানুষ অনলাইনেও রেকর্ড পরিমাণ সময় ব্যয় করেছে। যুক্তরাজ্যের পর্যবেক্ষক সংস্থা অফকম গত জুনে দেখিয়েছে, প্রাপ্তবয়স্করা দিনের এক-চতুর্থাংশ সময় ইন্টারনেটে ব্যয় করে। যেখানে মহামারির শুরুর দিকে বিশ্বব্যাপী সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৪০ শতাংশ ভোক্তা ইন্টারনেটে অনেক বেশি সময় ব্যয় করেছেন। অবশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষের এই আকর্ষণ ব্যতিক্রম কোনো ঘটনা নয়। কারণ, মানুষ প্রজাতি হিসেবে কৌতূহলী। তাদের নিজস্ব গল্পগুলো অন্যদের জীবন ও গল্পের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন বিনিময়ের মাধ্যমে তৈরি হয়। 

অবশ্য ইদানীং অন্যের জীবন সম্পর্কে মানুষ যতটা আগ্রহী ও কৌতূহলী হয়ে উঠেছে, সেটা এক নতুন উচ্চতা। ব্যাপারটা অনেকের কাছে বেশ নোংরা শোনাতে পারে। এই কৌতূহলকে অনেকটা ‘ভয়ারিস্টিক’ ব্যাপার বলা যেতে পারে। কেবল দর্শক হিসেবে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ঘটনা উপভোগ করার মানসিকতা এটি। বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য এমন অভূতপূর্ব কোনো পরিস্থিতিতে ভয়ারিজমকে খারাপ বলে মনে করছেন না। কিছুদিন আগেও সারা বিশ্বে এমন এক পরিস্থিতি গেছে, যখন মানুষের আচরণ, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিধিগুলো যেভাবে হঠাৎ করে আরোপিত হয়েছে, প্রথম ধাক্কায় সেটি বুঝে উঠতে পারেননি বেশির ভাগ মানুষ। এই পরিস্থিতির সঙ্গে অভিযোজিত হতে এ ধরনের কৌতূহলী পর্যবেক্ষণ প্রবণতা মহামারির গতিপ্রকৃতি বুঝতে নিঃসন্দেহে মানুষকে সাহায্য করেছে। 

বিশেষ করে পশ্চিমের সমাজে এই ভয়ারিজম অবশ্য নতুন কোনো ধারণা নয়। যুক্তরাষ্ট্রে পিপল ম্যাগাজিন (প্রথম ইস্যু মার্চ ৪,১৯৭৪) আসারও আগে উনিশ শতকের সংবাদপত্রে এমন ব্যাপার দেখা গেছে। ব্যাপারটা এতটাই এগোনো ছিল যে, সেটিকে ‘আদি কার্দাশিয়ান’ যুগ বলা যেতে পারে। পরে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডগুলো রীতিমতো পাপারাজ্জি সংস্কৃতি চালু করে ফেলে। ফলে এক দশক আগেও প্রাইভেসির ধূসর দেয়াল ডিঙিয়ে উঁকি দেওয়ার নানা উপায় ছিল। এর পর এল সোশ্যাল মিডিয়া। আধুনিক মানুষ প্রবেশ করল প্রকৃত কার্দাশিয়ান যুগে। অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোও পাল্লা দিয়ে দৌড়াচ্ছে। প্রতিদিনের গল্পগুলোতে ভিন্ন মাত্রা ও আবেগ যোগ করছে প্রচুর বিস্তারিত ছবির গল্প আর নিবন্ধ। 

আমাদের হাতের কাছে এখন শুধু ফেসবুক নয়, স্মার্টফোনে ঢুকে পড়েছে ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, টিকটক। জনপ্রিয়তার শীর্ষে ডেটিং সাইটগুলো। যুক্ত হয়েছে ক্লাবহাউসের মতো মুক্ত প্ল্যাটফর্ম। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ প্ল্যাটফর্মগুলো আসলে অন্যের ওপর নজর রাখার বিভিন্ন উপায়। 

আবার ফেরা যাক ‘ভয়ারিজম’ প্রসঙ্গে। এ শব্দের পারিভাষিক অর্থ—ঘটমান কোনো অবৈধ বা যৌন আচরণ, একজন নির্লিপ্ত পর্যবেক্ষক যেটিতে অন্যদের সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে দেখেন, এবং এ ক্ষেত্রে সব সময় কিন্তু দর্শক তাদের সম্মতি নেন না। এই দেখা মানেই খারাপ এমন কিন্তু নয়। এটি শুধুই ‘মানসিক বিকারজাত মুগ্ধতা’ এমন বলা যাবে না। বিশেষ করে মহামারিতে যেমনটি ঘটেছে, এটি ছিল একজন নিষ্ক্রিয় বা নির্লিপ্ত দর্শকের সক্রিয় বিনিময়, চারপাশের বিশ্বকে বোঝার একটি প্রচেষ্টা। 

উদাহরণ হিসেবে আনা ফ্র্যাঙ্কের কথা বলা যেতে পারে। তার মতো লোকদের ঐতিহাসিক ডায়েরিতে উঠে এসেছে বহু মানুষের চিন্তা। ব্যক্তিজীবন এবং সমাজ তাদের চারপাশে কীভাবে সক্রিয় ছিল এবং প্রভাবিত করেছিল, সেই সম্পর্ক ও মিথস্ক্রিয়ার আঁচ পাওয়া যায় এসব ডায়েরিতে। একইভাবে অন্য লোকেদের পর্যবেক্ষণ মহামারির প্রতিক্ষণের গতিপ্রকৃতি বুঝতে আমাদের সহায়তা করেছে। 

কারণ, আমাদের এই পর্যবেক্ষণ আকাঙ্ক্ষা, মূলত নিজেদের সম্পর্কে গল্প বলার আকাঙ্ক্ষা থেকেই তৈরি হয়। যে সমস্ত গল্পে আমরা সরাসরি অন্য লোকদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে মুখোমুখি হই, সেখানে যেসব বিষয়ে পড়ি, দেখি, শুনি এবং সঙ্গে জড়িয়ে যাই—সেগুলোই সমাজের যৌথ বোঝাপড়া তৈরিতে এক রকম প্রভাব ফেলে। 

মহামারিতে অনেক কিছুই মানুষকে নতুন করে শিখতে হয়েছে, বুঝতে হয়েছে—এ কারণেই ব্যক্তিগত গল্পগুলোতে মানুষ বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আংশিকভাবে সব ধরনের তথ্য গ্রহণের তীব্র আকাঙ্ক্ষাই ওই সময়টার সংকুচিত জীবনের রূপ প্রতিফলিত করে। অফিসে অনুপস্থিত সহকর্মী, সন্তানের সহপাঠীর অভিভাবক বা আরও আরও আপনজনদের সঙ্গে শারীরিক বিচ্ছিন্নতা (সামাজিক বিচ্ছিন্নতা) আশপাশের লোকদের জীবন সম্পর্কে আমাদের আরও বেশি কৌতূহলী এবং আগ্রহী করে তুলে থাকতে পারে। 

চার দেয়াল থেকে পলায়নপর মানুষের জীবনে মুক্তির স্বাদ এনে দিয়েছিল ভার্চ্যুয়াল জগৎ। এই সুযোগে ভার্চ্যুয়াল বেলুনে চড়ে অন্যের ঘরে উঁকিঝুঁকি দেওয়ার অফুরন্ত অবসর আর কখনো আসেনি। যেমন আমরা গভীরভাবে নজর রেখেছি ভার্চ্যুয়াল সাক্ষাৎকারে আসা ব্যক্তিটির পেছনের ঢাউস বুকশেলফে, ডালগনা কফির মতো নানা অদ্ভুত রেসিপি দেখতে পাগলের মতো হানা দিয়েছি অন্যের রান্নাঘরে। 

অনেকে বলেন, লকডাউনকালে সোশ্যাল মিডিয়ার এই আবেশ বাস্তব জগতে সংযোগের সুযোগগুলোর একটি ‘প্লাসিবো’ হিসেবে কাজ করেছে। যদিও এই মিথস্ক্রিয়াগুলো বাস্তব জীবনের মুখোমুখি হওয়ার মতো সন্তোষজনক নাও হতে পারে। তারপরও বলতে হয়, সোশ্যাল-মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো অন্য মানুষের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংযোগ স্থাপনের যে কয়েকটি উপায় রয়েছে, তার মধ্যে একটি। টিকটক, ইনস্টাগ্রাম এবং স্ন্যাপচ্যাটের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো যে সুযোগ করে দিয়েছে, লকডাউনের সময় অন্য কোনোভাবে সেটি সম্ভব ছিল না। 

সোশ্যাল মিডিয়া খুবই দ্রুত একটি নতুন নিয়ম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা রাখে। যেমন বিয়ে বাড়িতে অতিথিদের মুখে মাস্ক না থাকার ছবি, সেলিব্রেটির অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ, প্রকৃতির কোলে বাংলোবাড়ির বারান্দায় শুয়ে ইনস্টাগ্রাম ভরিয়ে দেওয়া যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল, তাতেই বিষয়টি স্পষ্ট। এই পরিস্থিতিতে কী গ্রহণযোগ্য, কেমন আচরণ করা উচিত, কার সঙ্গে থাকা ঠিক এবং কী শেয়ার করা নিরাপদ—এসব কিছুর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে পাওয়া ইঙ্গিতগুলো বিশ্লেষণ করেছি এবং নিয়ম শিখেছি। অন্যান্য তথ্যের উৎস, নিবন্ধ পড়া, তথ্যচিত্র দেখা বা পথচারীদের পর্যবেক্ষণ করাও দ্রুত পরিবর্তনশীল সময়ে আমাদের পাঠ্যপুস্তক হয়ে ওঠে। আমরা ডেটা পয়েন্ট হিসেবে অন্যদের ব্যবহার করি। 

মানুষ নিজের জীবনের মূল্যায়ন এবং মূল্যায়ন কীভাবে করতে হয়, তা নির্ধারণ করতে এই ডেটা ব্যবহার করে। আমরা সামাজিক প্রাণী এবং আপেক্ষিকতা-ভিত্তিক বিচারের সময় আমরা অন্যদের সঙ্গে তুলনার (সম্পর্কিত তথ্য) ওপর নির্ভর করি। সোশ্যাল মিডিয়া হলো এমন প্ল্যাটফর্ম, যেখানে আমরা ইঙ্গিতগুলো বাছাই করি এবং নতুন নিয়ম শিখি। ভালো-মন্দ খবর বা কনটেন্টের নিচে অন্য মানুষের প্রতিক্রিয়া ও কমেন্টগুলো এবং সেই কমেন্টে অন্যদের লাইক দিয়ে সমর্থন জানানো একটি স্থির শান্ত ভাব সৃষ্টি করতে পারে। ভয় বা মহা-আতঙ্কের মতো ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলো নিজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং এর জন্য বাইরের কোনো উৎসকে সচেতনভাবে দোষারোপ করতে পারার মধ্যে এক ধরনের পরিত্রাণ পাওয়ার প্রশান্তি মেলে। 

তবে অতিমাত্রায় সংবাদ, প্রতিবেদন, সামাজিক মাধ্যম বা অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে জানার আগ্রহ স্বাভাবিক জীবনের জন্য একটু বেশিই। মানুষের চৈতন্য প্রক্রিয়া তথ্য চাপে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়লে চাপ বা পীড়ন সৃষ্টিকারী সংবাদগুলোই শুধু জড়ো হতে শুরু করে। এতে আরও মানসিক চাপ ও উদ্বেগ বাড়ে। 

কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় শুধু বন্ধুদের খোঁজখবর, মহামারির সম্মুখসারির যোদ্ধাদের গল্প, মহামারিতে মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয় নিয়ে নানা নিবন্ধ যখন পড়তে থাকেন, তখন সেটি আর অলস অনুসরণ থাকে না। এটা সচেতনভাবে না করলেও এই অভ্যাস আপনাকে পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সহায়তা করে, ব্যক্তিগত উদ্বেগ কমিয়ে দেয় এবং নতুন বিশ্বে অভিযোজিত হতে ধীরে ধীরে আপনার অজান্তেই আপনাকে উপযুক্ত করে তোলে। 

আমরা সব সময় অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় জানার আগ্রহ প্রকাশ করি; কারণ, অন্যের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতেই আমরা জীবনের অর্থ উৎপাদন করি। আশা করা যায়, এই মহামারি আমাদের সেই উপলব্ধিই দিয়েছে। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত