Ajker Patrika

উপদেষ্টা ও বিশেষ সহকারী

এপিএসের বেতন ১ বছরে বেড়েছে ১৮ বছরের সমান

  • নবম গ্রেড থেকে পঞ্চম গ্রেডের বেতন কম!
  • ত্রাণ উপদেষ্টার পিএস পদে নজিরবিহীন নিয়োগ।
  • এটা আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি: জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ
শহীদুল ইসলাম, ঢাকা
এপিএসের বেতন ১ বছরে বেড়েছে ১৮ বছরের সমান

অন্তর্বর্তী সরকারের ১৪ জন উপদেষ্টা ও বিশেষ সহকারীর সহকারী একান্ত সচিবদের (এপিএস) বেতন একলাফে ৩১ হাজার টাকার বেশি বেড়েছে। এটিকে আর্থিক অনিয়ম হিসেবেই দেখছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।

উপদেষ্টা ও বিশেষ সহকারীর এপিএসদের বেতন প্রথমে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ীই নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদের শেষের দিকে এসে তা একবারে ৩১ হাজার ৬০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। উপদেষ্টা ও বিশেষ সহকারীদের আধা সরকারি পত্র (ডিও লেটার) পাওয়ার পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ ব্যবস্থা নিয়েছে।

বর্তমান বেতনকাঠামো অনুযায়ী, বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর একজন সরকারি কর্মকর্তা নবম গ্রেডের শুরুর ধাপে, অর্থাৎ ২২ হাজার টাকা মূল বেতনে চাকরি শুরু করেন। এরপর ১৮ বছরে ১৮টি ইনক্রিমেন্ট যোগ হলে নবম গ্রেডের কোনো কর্মকর্তার বেতন দাঁড়াবে ৫৩ হাজার ৬০ টাকা, এটিই এ গ্রেডের সর্বোচ্চ ধাপ। এপিএসদের বেতন ৩১ হাজার ৬০ টাকা বাড়িয়ে নবম গ্রেডের সর্বোচ্চ ধাপে নির্ধারণ করা হয়েছে।

শুরুর নিয়োগে বেতন ২২ হাজার

২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৪ আগস্ট থেকে গত ১০ এপ্রিল পর্যন্ত ১৪ জন উপদেষ্টা ও বিশেষ সহকারীর এপিএসদের ২২ হাজার টাকা বেতনে নিয়োগ দেওয়া হয়।

সমাজকল্যাণ উপদেষ্টার এপিএস নাজমুস সাদাত, ক্রীড়া উপদেষ্টার এপিএস মো. মোয়াজ্জেম হোসেন, শিল্প উপদেষ্টার এপিএস আমান সাদিক, পরিবেশ উপদেষ্টার এপিএস আশিকুর রহমান সমী, বস্ত্র উপদেষ্টার এপিএস সাজ্জাদ নাঈম, শিক্ষা উপদেষ্টার এপিএস কামরুন নাহার, স্বাস্থ্য উপদেষ্টার এপিএস ফারহানুল হক, ধর্ম উপদেষ্টার এপিএস মো. আশিকুল ইসলাম, পররাষ্ট্র উপদেষ্টার এপিএস মুনিম সিদ্দিকী, ত্রাণ উপদেষ্টার এপিএস মো. আমিরুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারীর এপিএস শিমসাদ নারমীন, প্রয়াত ভূমি উপদেষ্টার এপিএস মো. আবিদ চৌধুরী এবং গণশিক্ষা উপদেষ্টার এপিএস আবিদ সরকার সোহাগের নিয়োগ ২২ হাজার টাকা বেতনে হয়।

উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেনের দপ্তর বদলে নৌপরিবহন এবং শ্রম উপদেষ্টার এপিএস হিসেবে সাজ্জাদ নাঈমকে ২২ হাজার টাকা বেতনে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়-সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকীর এপিএস সিফাত মাহমুদ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারীর এপিএস হিসেবে আশিক এলাহীর নিয়োগও ২২ হাজার বেতনে হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী নিজের এপিএস পদে তৎকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বর্তমান নাম বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) সাপোর্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. সাউফ উদ্দিন সরকারকে নিয়োগ দেন।

একলাফে বেতন বেড়ে ৫৩ হাজার

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, প্রথমে একজন উপদেষ্টা তাঁর এপিএসের বেতন বাড়ানোর জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আধা সরকারি পত্র দেন। এরপর মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সভা করে কীভাবে এপিএসের বেতন বাড়ানো যায়, সেই সিদ্ধান্তে আসেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘একজন উপদেষ্টার কাছ থেকে এমন চিঠি পাওয়ার পর আমরা দেখলাম, আগে এভাবে কারও বেতন বাড়ানো হয়নি। যেহেতু এপিএসদের মর্যাদা সহকারী সচিবদের সমান, আর সহকারী সচিবদের সর্বোচ্চ বেতন স্কেল ৫৩ হাজার ৬০ টাকা, সে কারণে উপদেষ্টা ও বিশেষ সহকারীদের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের এপিএসদের বেতন ৫৩ হাজার ৬০ টাকা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়। তবে সহকারী সচিব পদে চাকরি শুরু হয় ২২ হাজার টাকা বেতনে। এটি নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন উঠতে পারে বলে আলোচনা হয়েছে।’

আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, উপদেষ্টা ও বিশেষ সহকারীরা যেভাবে চেয়েছেন, সেভাবেই তাঁদের এপিএসদের বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অনেক কিছুই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কর্মকর্তাদের মধ্যেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা রয়েছে।

গত ২৬ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার ‘হাই রিপ্রেজেন্টিটিভ’ ড. খলিলুর রহমানের ‘অভিপ্রায় অনুযায়ী’ মো. রেজাউল হককে নবম গ্রেডের সর্বোচ্চ ধাপ ৫৩ হাজার ৬০ টাকা মূল বেতনে তাঁর এপিএস নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৬ মার্চ তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টার এপিএস পদে মো. আব্দুল আহাদ, ১২ মে প্রধান উপদেষ্টার প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়নবিষয়ক সহকারীর এপিএস পদে আমিরুল ইসলাম, গত ২ জুলাই মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টার এপিএস পদে মো. আব্দুর রহমান এবং ১৬ জুলাই স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার এপিএস পদে মো. আয়মন হাসান রাহাতকে ৫৩ হাজার ৬০ টাকা বেতনে নিয়োগ দেওয়া হয়।

১৯ মে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারীর এপিএস মো. সাইফ উদ্দিন সরকার, স্বাস্থ্য উপদেষ্টার এপিএস মো. ফারহানুল হক ও পরিবেশ উপদেষ্টার এপিএস আশিকুর রহমান সমী; ২৭ মে শিল্প উপদেষ্টার এপিএস আমান সাদিক, ২৮ মে ধর্ম উপদেষ্টার এপিএস মো. আশিকুল ইসলাম, ৯ জুলাই পরিকল্পনা উপদেষ্টার এপিএস কামরুন নাহার, ২৮ জুলাই নৌপরিবহন উপদেষ্টার এপিএস সাজ্জাদ নাঈম এবং ১০ আগস্ট ত্রাণ উপদেষ্টার এপিএস মো. আমিরুল ইসলামের বেতন ২২ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৩ হাজার ৬০ টাকা করা হয়। তবে নিয়োগের তারিখ থেকেই তাঁদের নতুন বেতন স্কেল কার্যকর ধরা হয়। গত ৬ মার্চ প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় নিয়োজিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের এপিএস হিসেবে উদ্ভাষন চাকমার বেতনও ৫৩ হাজার ৬০ টাকা করা হয়।

বেতন পঞ্চম গ্রেডের থেকেও বেশি!

উপদেষ্টা ও বিশেষ সহকারীদের এপিএসদের বেতন রাতারাতি বাড়ানোর ফলে পঞ্চম গ্রেডে নিয়োগ পাওয়া একজন পিএসের বেতন এখন তাঁদের থেকে কম। পঞ্চম গ্রেডের শুরুর বেতন ৪৩ হাজার টাকা। ১৫ জুন আপিল বিভাগের বিচারপতির পদমর্যাদায় নিয়োজিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের একান্ত সচিব পদে মুহাম্মদ শিহাব উদ্দীনকে পঞ্চম বেতন গ্রেডের শুরুর স্কেলে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে তাঁর বর্তমান বেতন ৪৩ হাজার টাকা, যা নবম গ্রেডে নিযুক্ত এপিএসদের চেয়ে অনেকটাই কম।

যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের এপিএস মো. মোয়াজ্জেমকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে গত ২১ এপ্রিল প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ৯ জুলাই প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকীর এপিএস সিফাত মাহমুদকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

সূত্র জানায়, প্রয়াত ভূমি উপদেষ্টা হাসান আরিফের এপিএস আবিদ চৌধুরী তাঁর বেতন বাড়ানোর জন্য উপদেষ্টাকে অনুরোধ করেন। তখন উপদেষ্টা তাঁর এপিএসকে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে বলেন। তবে আবিদ চৌধুরী নিজে সেই আবেদন করেননি।

বিগত সরকারের আমলে এপিএসদের মধ্যে কারও বেতন এভাবে বাড়ানো হয়েছিল কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট উইংয়ের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য দিতে পারেননি। তবে তাঁরা বলেছেন, জানামতে এর আগে এভাবে এপিএসদের বেতন বাড়ানো হয়নি। বিগত সরকারের মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর চারজন এপিএসের সঙ্গে কথা বলেছে আজকের পত্রিকা। তাঁরা সবাই ২২ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করার কথা জানিয়েছেন।

ত্রাণ উপদেষ্টার নজিরবিহীন কাজ

কর্মরত সরকারি কর্মকর্তাদের বাইরে থেকে পিএস নিয়োগ দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। কিন্তু ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজমের অভিপ্রায় অনুযায়ী, তাঁর পিএস পদে সাবেক লে. কর্নেল মো. আব্দুল গাফ্ফারকে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আব্দুল গাফ্ফারকে যুগ্ম সচিবের পদমর্যাদা দিয়েছে। এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, তাঁর পদমর্যাদা ভবিষ্যতে এ পদের জন্য নজির হবে না।

আইনে কী আছে

মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর (পারিশ্রমিক এবং সুযোগ-সুবিধা) আইন অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তা বা যে কাউকে এপিএস পদে নিয়োগ দেওয়া যায়। সরকারি চাকরিজীবীদের বাইরে থেকে এপিএস নিয়োগ দিলে তাঁকে প্রথম শ্রেণির চাকরি পাওয়ার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতাধারী হতে হয়। সরকারি কর্মকর্তাদের বাইরে থেকে এপিএস নিয়োগ দিলে তাঁর মর্যাদা নির্ধারণ করে দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে এপিএসদের মর্যাদা ধরা হয় সহকারী সচিবের সমান। ফলে তাঁদের নবম বেতন গ্রেডের শুরুর ধাপে নিয়োগ হয়। আর সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে এপিএস নিয়োগ দিলে ওই কর্মকর্তা যে দপ্তরে যে বেতনে চাকরি করতেন, সেই বেতনেই এপিএসের দায়িত্ব পালন করবেন। শুধু তাঁকে প্রেষণে এপিএস নিয়োগ দেওয়া হবে।

অন্যদিকে একান্ত সচিব (পিএস) নিয়োগ দেওয়া হয় উপসচিবদের মধ্য থেকে। তবে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী চাইলে প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্য থেকেও পিএস নিয়োগ দিতে পারেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বিলুপ্ত হওয়ার পর উপদেষ্টা বা বিশেষ সহকারীর কোনো পদ নেই। ফলে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর (পারিশ্রমিক এবং সুযোগ-সুবিধা) আইন অনুযায়ী উপদেষ্টা ও বিশেষ সহকারীদের সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করা হচ্ছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. এরফানুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এপিএসদের যে স্কেলে যোগদান করানো হয়, তার থেকে তাঁদের বেতন বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এই সরকারের মেয়াদ খুব বেশি নেই। ফলে এখন অনেকেই আমাদের কাছে বেতন বাড়ানোর আবেদন করছেন, সেসব আবেদন ধরে অনেকের বেতন বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’

এটা আর্থিক অনিয়ম

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বিষয়টি আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, ‘কোন কর্তৃত্ববলে সর্বোচ্চ ধাপে বেতন নির্ধারণ করল? সর্বোচ্চ ধাপে বেতন নির্ধারণ করতে হলে বিধি জারি করে করতে হবে। এসব কী হচ্ছে! সরকারি কর্মকর্তারা কি বিধিবিধান জানেন না? অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের কাছ থেকে তো মানুষ এসব আশা করে না। পিএস সরকারি কর্মকর্তাদের বাইরে থেকে নিয়োগ দেওয়ার নিয়ম নেই। দেখবেন এগুলো নিয়ে ভবিষ্যতে মামলা হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জোরপূর্বক অপুর স্বীকারোক্তি নিয়েছেন বিএনপির ইশরাক, এনসিপির ব্যবস্থা করা সংবাদ সম্মেলনে দাবি স্ত্রীর

‘মিরপুরের উইকেটের পাশে পুঁইশাক বের হচ্ছে, এত বছর হয়নি কেন’

ভোররাতে হাঁসের মাংস খেতে ৩০০ ফুটে যান আসিফ মাহমুদ, না পেয়ে যান ওয়েস্টিনে

উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ভুলভাবে কথা বলেছেন: প্রেস সচিব

নীলা মার্কেটের হাঁসের মাংস নাকি ওয়েস্টিনের—কোনটি সেরা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত