Ajker Patrika

ভাষার প্রাসঙ্গিকতা অপরিহার্য

মযহারুল ইসলাম বাবলা 
ভাষার প্রাসঙ্গিকতা অপরিহার্য

পৃথিবীর প্রতিটি জাতির আত্মপরিচয়ের মাপকাঠি হচ্ছে জাতীয়তা আর প্রধান অনুষঙ্গ ভাষা। ভাষা দিয়েই জাতীয়তার পরিচয় নির্ধারণ করা যায়। বিশ্বের অগণিত জাতিসত্তার মানুষ কে কোন জাতীয়তার, সেটা নিরূপণ করা যায় ভাষার দ্বারাই। ভাষা মানুষের অবিচ্ছেদ্য এবং সার্বক্ষণিক সঙ্গী। ভাষাবিহীন মানুষ অচল। ভাষাই মানুষকে পরস্পরের সঙ্গে সংলগ্ন করে। পরস্পরের নৈকট্য স্থাপনেও প্রধান ভূমিকা পালন করে ভাষা। তাই ভাষাবিহীন আমরা অচল। বিশ্বের অগণিত মানুষের ভাষা অভিন্ন নয়। জাতিভেদে ভাষার ভিন্নতা রয়েছে। এমনকি একই দেশে একই জাতিসত্তার মানুষের ভিন্ন ভিন্ন স্থানীয় বা আঞ্চলিক ভাষাও রয়েছে। যেগুলো বর্ণমালাহীন, মানুষের মুখে মুখে থাকে। বর্ণমালা না থাকার কারণে ওইসব ভাষা লিখিত হওয়ার উপায় থাকে না। তাই ওই ভাষার সাহিত্যও থাকে না। এসব আঞ্চলিক কথ্য-ভাষার পাশাপাশি জাতিগত অভিন্ন ভাষাও রয়েছে। জাতিগত সর্বাধিক ব্যবহৃত ভাষাই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত। জাতি-পরিচয়ে আঞ্চলিক ভাষা নয়, রাষ্ট্রভাষাকেই গণ্য করা হয়।

এক জাতির মানুষ অপর জাতির মানুষের সঙ্গে কথোপকথনে বিকল্প ভাষার সাহায্য নেয়। কেননা, একের ভাষা অন্যের জানা-বোঝা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে বিশ্বে দ্বিতীয় বা বিকল্প ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষার বহুল ও ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বব্যাপী উপনিবেশ গড়ে তুলে শতসহস্র বছর প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে রেখেছিল। ফলে বিকল্প ভাষা হিসেবে ইংরেজি বিশ্বজুড়ে স্থায়ী হয়ে আছে। এমনকি অনেক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের নিজস্ব ভাষা বদলে ইংরেজি ভাষা চাপিয়ে দিয়েছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে ইংরেজি ভাষার প্রচলন ঘটিয়ে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে স্থায়ীরূপে ইংরেজি ভাষা বিশ্বজুড়ে যেমন বিস্তার লাভ করে আছে, তেমনি বিকল্প ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বিকল্প ভাষায় সবাই যে পারদর্শী, তা কিন্তু বলা যাবে না। ইংরেজ শাসকেরা তাদের উপনিবেশগুলোতে মিশনারিদের নিয়ে এসে ইংরেজি শিক্ষার কার্যক্রম শুরু করে দুটি উদ্দেশ্যে। এক. স্থানীয় ভাষার বিপরীতে ঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অভিপ্রায়ে। দুই. উপনিবেশের স্থানীয়দের যুক্ত করে শাসনকার্য পরিচালনার সহযোগী হিসেবে নিয়োগের লক্ষ্যে। কেননা, একটি উপনিবেশে ব্রিটিশ নাগরিকদের এনে পুরো প্রশাসনিক, সামরিক কার্যাদি সম্পন্ন করা ছিল অসম্ভব। তাই স্থানীয়দের যুক্ত করে একটি কেরানি শ্রেণি সৃষ্টি অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। সেই লক্ষ্যে স্থানীয়দের ইংরেজি শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী করে তাদের শাসনকার্যের সহযোগী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। ফলে প্রতিটি উপনিবেশে ব্রিটিশ অনুগত একটি কেরানি শ্রেণি গড়ে ওঠে। তারাই স্থানীয় শাসক-সহযোগী শ্রেণি এবং ‘শিক্ষিত-সমাজ’ হিসেবে সমাজে-মর্যাদাপূর্ণ সামাজিক অবস্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছিল।

সমষ্টিগত মানুষ শিক্ষাবঞ্চিত থাকার ফলে ইংরেজি ভাষা সর্বস্তরে বিস্তার লাভ করেনি। কতিপয়ের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাই আমাদের উপমহাদেশেও ইংরেজি জানা মানুষদেরই শিক্ষিত হিসেবে গণ্য করার সংস্কৃতি আজও চালু রয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসকদের ইচ্ছাপূরণে যারা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রকে শক্তি জুগিয়েছিল, অভিজাত ওই শ্রেণির সঙ্গে স্থানীয় স্বদেশিদের বিস্তর দূরত্বের সৃষ্টি হয়। অনিবার্য কারণে স্থানীয়রা যেমন ঔপনিবেশিক ইংরেজ এবং স্থানীয় কেরানি শ্রেণির মিলিত শাসনাধীনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। ভাষাও যে শোষণের মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা পালন করেছিল সেটাও অসত্য নয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর ওই ইংরেজি শিক্ষিত শ্রেণিই উপনিবেশমুক্ত দেশগুলোর শাসকশ্রেণি রূপে ব্রিটিশদের আইন-কানুনের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার সুযোগ লাভ করেছিল। তাই ঔপনিবেশিক শাসনের সংস্কৃতির অবসান হয়নি। বরং ঔপনিবেশিক ভাষা-সংস্কৃতি আজও বিরাজমান। বিদ্যমান ঔপনিবেশিক আইন-আমলাতন্ত্র এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাও।

ভাষার ভিন্নতায় অনেক সময়ই অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে। এখানে ব্যক্তিগত স্মৃতি উল্লেখ করছি। ১৯৮১ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় ঢাকা থেকে বিমানে দুটি দেশে যাত্রাবিরতির পর কুয়েত পৌঁছাই। ইরাকে যাত্রীবাহী বিমান চলমান নিষিদ্ধ থাকার ফলে কুয়েত থেকে সড়কপথে বাগদাদ যেতে হয়েছিল। কুয়েত বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে আমার স্বদেশি দুজন শ্রমিক ছুটে এসে আমাকে জানায় তাদের ইমিগ্রেশনের লোক বেরোতে দিচ্ছে না, আটকে রেখেছে। আরবি ও ইংরেজি ভাষায় প্রশ্ন করছে কিন্তু তারা ওই দুই ভাষা না জানার ফলে উত্তর দিতে পারেনি। অগত্যা আমি এগিয়ে গিয়ে ইমিগ্রেশনের লোকদের জিজ্ঞেস করি, এদের সমস্যা কী? উত্তরে জানায়, ‘তোমার এই দুই স্বদেশিকে তাঁদের নাম জিজ্ঞেস করলে তাঁরা কোনো সদুত্তর না দেওয়ার জন্য দাঁড় করিয়ে রেখেছি। তুমি দুজনকে ডেকে একে একে ওদের নাম বলতে বলো।’ আমি দুজনকে ওদের সামনে দাঁড় করিয়ে একজনকে বলি তোমার নাম কী? সে বলে, তারিক মিয়া। এটা শোনামাত্র ইমিগ্রেশনের লোকগুলো তীব্র হাসিতে ফেটে পড়ে। আমিও বিস্মিত হই ওদের হাসাহাসিতে। দ্বিতীয় জনকে বলি, তোমার নাম কী বলো? সে বলে জামাল মিয়া। এটা শুনে তারা অঙ্গভঙ্গি করে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে। অগত্যা তাদের হাসির কারণ জিজ্ঞেস করলে ইমিগ্রেশনের লোকেরা বলে, ‘পাসপোর্টে ওদের নাম দেখেই বিস্ময়ে ওদের দাঁড় করিয়ে রেখেছি।’ ওদের একজনের নাম তারিক মিয়া আরবি ভাষান্তরে ‘একশত রাস্তা’। আর দ্বিতীয়জনের নাম জামাল মিয়া অর্থাৎ ‘একশত উট’। আরবি ভাষায় মিয়া হচ্ছে একশত, তারিক হচ্ছে রাস্তা, জামাল হচ্ছে উট। এরপর দুজনকে ইমিগ্রেশন থেকে অব্যাহতি দিয়ে আমিও দ্রুত স্থান ত্যাগ করি।

দিল্লির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজার দর্শনে গিয়ে এক বিব্রতকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। মাজার চত্বরে আমাদের আদালতে বসা ভেন্ডারদের আদলে কিছু উর্দুভাষী লোক বসে থাকে চাতকের মতো। বিদেশি দেখলে দ্রুত আগত দর্শনার্থীদের সাদরে তাদের পাশে বসিয়ে অভিনব কায়দায় অর্থ আদায় করে। আমাকেও লম্বা সালাম দিয়ে করমর্দন শেষে একপ্রকার জোর করে তাঁর পাশে বসিয়ে কোথা থেকে এসেছি ইত্যাদি প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। আমি বাংলাদেশের ঢাকা থেকে এসেছি বলার পর জানতে চায় ঢাকার কোথা থেকে। আমি আমার বাসস্থানের ঠিকানা বলার পর সে আশপাশের প্রায় সব এলাকার নাম বলে এবং তাঁর রেজিস্টার খাতা খুলে আমাকে দেখায় আমাদের অঞ্চলের বিভিন্ন ব্যক্তির নাম ও ঠিকানা। যারা এখানে এসে তাঁর নিকট দরগায় অর্থ প্রদান করে গেছেন। তিনি কলম হাতে রেজিস্টারে আমার নাম লেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে আমাকে বলেন, ‘জনাব আপকা ইসমে শরিফ?’ আমি এই উর্দু ভাষায় করা প্রশ্ন না বুঝে মুখ ফসকে বলে বসি, ‘কোরআন শরিফ’। তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে তীব্র ভর্ৎসনা করে বলেন, ‘আমি আপনার নাম জিজ্ঞেস করেছি। কিন্তু আপনি পবিত্র গ্রন্থের নাম বলছেন কেন?’ আমি হতভম্ব। নিরুপায়ে ভুল স্বীকার করে মার্জনা চেয়ে কিছু অর্থদণ্ড দিয়ে পরিত্রাণ লাভ করি। উর্দু ভাষার ‘আপকা ইসমে শরিফ’ বঙ্গানুবাদ ‘আপনার নাম কী’। যেটি আমি জীবনে কখনো শুনিনি। এমনকি পাকিস্তান রাষ্ট্রাধীন থাকার সময়েও কোনো উর্দুভাষীর মুখে শুনিনি। চোস্ত উর্দু ভাষার প্রশ্নের জবাব দেওয়া সংগত কারণেই সম্ভব হয়নি।

কেবল ভাষার ভিন্নতার কারণেই ঘটনা দুটি ঘটেছিল। এ রকম অজস্র ঘটনা সবার জীবনেই কম-বেশি ঘটে থাকে। ভাষা আমাদের নিকটবর্তী করে। পরস্পরকে সংলগ্ন হতে সাহায্য করে। ভাষা বিচ্ছিন্নতার অবসানে সক্রিয় ভূমিকাও পালন করে। আরবীয় উপাখ্যান ‘আলীবাবা’ আমাদের উপমহাদেশে বহুল পঠিত। চলচ্চিত্র, নাটক হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। আলীবাবা কিন্তু ব্যক্তিটির নাম নয়। আরবি ভাষায় আলীবাবা অর্থ চোর। উপাখ্যানটির বঙ্গানুবাদ ‘চোর’। ভাষার বৈপরীত্যে আমরা বিভ্রান্তও হয়ে থাকি। ভাষা যে মানবজাতির প্রধান অনুষঙ্গ সেটা কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত