চিররঞ্জন সরকার
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়, যেখানে পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিল। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রস্তাবিত খসড়া আইনে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রস্তাব অনুযায়ী, শুধু রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করা ব্যক্তিদের ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। অন্যদিকে, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন, প্রবাসে জনমত গঠনে ভূমিকা রেখেছেন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী-সাংবাদিক ছিলেন কিংবা মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন, তাঁদের নতুন পরিচিতি হবে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’। এই শ্রেণিবিন্যাসের ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ চার শতাধিক নেতার মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিলের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি ও মর্যাদা নিয়ে এই বিতর্কিত সংশোধনী নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে—এটি কি ইতিহাসের সত্যকে বিকৃত করার সচেতন প্রয়াস, নাকি এটাও প্রশাসনিক সংস্কারের অংশ?
এই পরিবর্তনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যাঁরা জীবন বাজি রেখে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন, তাঁরাও এই উদ্যোগের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ শুধু সামরিক যুদ্ধ ছিল না, এটি ছিল রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলনের সমন্বয়। এটি ছিল একটি জনযুদ্ধ। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ বিভিন্নভাবে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অনুযায়ী সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী দেশকে শত্রুমুক্ত করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে। এই সমন্বিত সংগ্রামে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামরিক সব ধরনের অবদানই সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে রাজনৈতিক সংগ্রাম, মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক ও প্রশাসনিক তৎপরতা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাংস্কৃতিক অবদান এবং বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখা পেশাজীবীদের অবদানকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। সবাই মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ও সংগ্রামের অংশ ছিলেন। তাঁদের অবদানকে ‘সহযোগী’ হিসেবে চিহ্নিত করা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে খণ্ডিত করার শামিল।
মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত, তাঁদের পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা ঠিক নয়। যদি কেউ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হন, তবে তাঁদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কিন্তু ঢালাওভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় বদলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নয়। মনে রাখা দরকার যে, কোনো আইন পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে বদলে দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ ইতিহাস সত্যের নিরিখে প্রতিষ্ঠিত হয়, কোনো প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বা নীতিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে নয়। মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন এ দেশের স্বাধীনতার জন্য নিবেদিতপ্রাণ যোদ্ধা, যাঁরা জীবন বাজি রেখে দেশকে মুক্ত করেছিলেন। তাঁদের অবদানকে নতুন কোনো সংজ্ঞার মাধ্যমে ছোট করে দেখানোর চেষ্টা শুধু অনৈতিকই নয়, এটি জাতির ঐতিহাসিক চেতনাকে আঘাত করার শামিল।
এ ধরনের পদক্ষেপ অপ্রয়োজনীয় ও সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করা দেশের মানুষের মধ্যে বিভেদ বাড়াবে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অপব্যাখ্যার সুযোগ সৃষ্টি করবে। বরং সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ সম্মান দেওয়া এবং তাদের কল্যাণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। একই সঙ্গে, দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষার দিকেও মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
যেসব সমস্যা সত্যিকার অর্থেই সমাধানের দাবি রাখে, যেমন বেকারত্ব দূরীকরণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং দুর্নীতি দমন—সেগুলোর জন্য সময় ও সম্পদ ব্যয় করাই হবে যথাযথ সিদ্ধান্ত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত বা পুনর্বিবেচনার নামে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা না করে দেশের অগ্রগতির দিকে মনোযোগ দেওয়া এখন সময়ের দাবি।
আইন সংশোধনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কমানো হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। মন্ত্রণালয় দাবি করেছে যে এতে কারও মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে না এবং সুযোগ-সুবিধা একই থাকবে। কিন্তু বাস্তবে, এই পরিবর্তন মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ও ইতিহাসের মূল্যায়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবদানকে খাটো করার মাধ্যমে এটি একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা হতে পারে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন ও তার পরিবর্তন নিয়ে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলমান। স্বাধীনতার পর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা একাধিকবার সংশোধিত ও পরিবর্তিত হয়েছে এবং প্রতিবারই এই প্রক্রিয়া বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ১৯৮৬ সালে প্রথম জাতীয় কমিটির তালিকায় ১,০২, ৪৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর বিভিন্ন সরকারের আমলে এই তালিকা বারবার সংশোধিত হয়েছে। ২০২৩ সালের সর্বশেষ তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ২,০৮,৮৫১। প্রতিটি তালিকা পরিবর্তনের সময়ই প্রশ্ন উঠেছে তালিকার সঠিকতা, স্বচ্ছতা এবং ন্যায্যতা নিয়ে। এবারও নতুন সংজ্ঞা প্রণয়নের ফলে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও মর্যাদা নিয়ে সংকট দেখা দিতে পারে, যা ইতিমধ্যেই জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
এই তালিকা পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুধু সংখ্যার পরিবর্তনই নয়, বরং এটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের মূল্যায়নের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। প্রতিবার তালিকা সংশোধনের সময় কিছু মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হন, আবার কিছু নাম বাদ পড়ে। এই প্রক্রিয়ায় অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের প্রাপ্য স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হন, আবার কিছু ক্ষেত্রে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নাম তালিকায় যুক্ত হওয়ার অভিযোগও উঠেছে। এবারের প্রস্তাবিত সংশোধনী তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা পরিবর্তনের মাধ্যমে যাঁরা এত দিন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন, তাঁদের অনেককেই ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ও স্বীকৃতির প্রশ্নে নতুন করে সংকট তৈরি করবে।
মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন এই সংজ্ঞার আওতায় ফেললে ইতিবাচক কোনো কিছুই ঘটবে না। বরং নেতিবাচক প্রভাব বাড়বে। এর ফলে...
১. রাজনৈতিক নেতৃত্বের মর্যাদা সংকুচিত হবে: মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূল ভিত্তি ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্ব, যাঁরা সংগ্রামের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন এবং জনগণকে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ করেছেন। তাঁদের ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা তাঁদের অবদানকে খাটো করবে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে বিকৃত করবে।
২. মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিক চরিত্র অস্বীকৃত হবে: মুক্তিযুদ্ধ শুধু সশস্ত্র যুদ্ধ ছিল না; এটি ছিল এক রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। নতুন সংজ্ঞা সেই বিস্তৃত বাস্তবতাকে সংকুচিত করে কেবল রণাঙ্গনের লড়াইয়ের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের পরিচয় সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা করছে, যা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চরিত্রের প্রতি অবিচার করবে।
৩. আইনি ও প্রশাসনিক জটিলতা বৃদ্ধি পাবে: পূর্বে স্বীকৃত ও গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ও সুবিধা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে, যা নতুন জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। এই পরিবর্তনের ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পুনর্গঠন, যাচাই-বাছাই এবং নতুন প্রশাসনিক কাঠামো তৈরির প্রয়োজন হবে, যা সময়সাপেক্ষ এবং অপ্রয়োজনীয় বিতর্কের জন্ম দেবে।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে এই বিতর্ক শুধু একটি প্রশাসনিক বা আইনি ইস্যু নয়, এটি জাতির ঐক্য ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গেও জড়িত। তাই, এই প্রক্রিয়া যাতে স্বচ্ছ, ন্যায্য এবং ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, তা নিশ্চিত করা জরুরি। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন ও সংশোধনের ক্ষেত্রে সব পক্ষের অংশগ্রহণ এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত, যাতে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান অক্ষুণ্ন থাকে।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই যুদ্ধে যাঁরা অবদান রেখেছেন, তাঁদের সবাইকে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে স্মরণ করা আমাদের কর্তব্য। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় বদলে দেওয়ার এই উদ্যোগ অপ্রয়োজনীয় ও বিভ্রান্তিকর। এটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ক্ষুণ্ন করার পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যকেও দুর্বল করতে পারে। তাই এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত এবং মুক্তিযুদ্ধের সত্য ও ইতিহাসকে অক্ষুণ্ন রাখার জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করা উচিত।
মুক্তিযুদ্ধ জাতীয় পরিচয়ের অংশ এবং একে প্রশ্নবিদ্ধ করা উচিত নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও যাচাই করা জরুরি, তবে সেটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করে নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রেণিবিন্যাস করার পরিবর্তে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মর্যাদা ও স্বীকৃতি নিশ্চিত করাই হওয়া উচিত প্রশাসনের লক্ষ্য। ইতিহাস বদলানো সম্ভব নয়, বরং ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হতে হবে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
আরও খবর পড়ুন:
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়, যেখানে পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিল। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রস্তাবিত খসড়া আইনে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রস্তাব অনুযায়ী, শুধু রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করা ব্যক্তিদের ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। অন্যদিকে, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন, প্রবাসে জনমত গঠনে ভূমিকা রেখেছেন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী-সাংবাদিক ছিলেন কিংবা মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন, তাঁদের নতুন পরিচিতি হবে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’। এই শ্রেণিবিন্যাসের ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ চার শতাধিক নেতার মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিলের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি ও মর্যাদা নিয়ে এই বিতর্কিত সংশোধনী নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে—এটি কি ইতিহাসের সত্যকে বিকৃত করার সচেতন প্রয়াস, নাকি এটাও প্রশাসনিক সংস্কারের অংশ?
এই পরিবর্তনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যাঁরা জীবন বাজি রেখে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন, তাঁরাও এই উদ্যোগের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ শুধু সামরিক যুদ্ধ ছিল না, এটি ছিল রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলনের সমন্বয়। এটি ছিল একটি জনযুদ্ধ। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ বিভিন্নভাবে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অনুযায়ী সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী দেশকে শত্রুমুক্ত করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে। এই সমন্বিত সংগ্রামে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামরিক সব ধরনের অবদানই সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে রাজনৈতিক সংগ্রাম, মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক ও প্রশাসনিক তৎপরতা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাংস্কৃতিক অবদান এবং বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখা পেশাজীবীদের অবদানকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। সবাই মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ও সংগ্রামের অংশ ছিলেন। তাঁদের অবদানকে ‘সহযোগী’ হিসেবে চিহ্নিত করা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে খণ্ডিত করার শামিল।
মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত, তাঁদের পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা ঠিক নয়। যদি কেউ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হন, তবে তাঁদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কিন্তু ঢালাওভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় বদলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নয়। মনে রাখা দরকার যে, কোনো আইন পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে বদলে দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ ইতিহাস সত্যের নিরিখে প্রতিষ্ঠিত হয়, কোনো প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বা নীতিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে নয়। মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন এ দেশের স্বাধীনতার জন্য নিবেদিতপ্রাণ যোদ্ধা, যাঁরা জীবন বাজি রেখে দেশকে মুক্ত করেছিলেন। তাঁদের অবদানকে নতুন কোনো সংজ্ঞার মাধ্যমে ছোট করে দেখানোর চেষ্টা শুধু অনৈতিকই নয়, এটি জাতির ঐতিহাসিক চেতনাকে আঘাত করার শামিল।
এ ধরনের পদক্ষেপ অপ্রয়োজনীয় ও সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করা দেশের মানুষের মধ্যে বিভেদ বাড়াবে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অপব্যাখ্যার সুযোগ সৃষ্টি করবে। বরং সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ সম্মান দেওয়া এবং তাদের কল্যাণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। একই সঙ্গে, দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষার দিকেও মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
যেসব সমস্যা সত্যিকার অর্থেই সমাধানের দাবি রাখে, যেমন বেকারত্ব দূরীকরণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং দুর্নীতি দমন—সেগুলোর জন্য সময় ও সম্পদ ব্যয় করাই হবে যথাযথ সিদ্ধান্ত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত বা পুনর্বিবেচনার নামে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা না করে দেশের অগ্রগতির দিকে মনোযোগ দেওয়া এখন সময়ের দাবি।
আইন সংশোধনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কমানো হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। মন্ত্রণালয় দাবি করেছে যে এতে কারও মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে না এবং সুযোগ-সুবিধা একই থাকবে। কিন্তু বাস্তবে, এই পরিবর্তন মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ও ইতিহাসের মূল্যায়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবদানকে খাটো করার মাধ্যমে এটি একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা হতে পারে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন ও তার পরিবর্তন নিয়ে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলমান। স্বাধীনতার পর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা একাধিকবার সংশোধিত ও পরিবর্তিত হয়েছে এবং প্রতিবারই এই প্রক্রিয়া বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ১৯৮৬ সালে প্রথম জাতীয় কমিটির তালিকায় ১,০২, ৪৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর বিভিন্ন সরকারের আমলে এই তালিকা বারবার সংশোধিত হয়েছে। ২০২৩ সালের সর্বশেষ তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ২,০৮,৮৫১। প্রতিটি তালিকা পরিবর্তনের সময়ই প্রশ্ন উঠেছে তালিকার সঠিকতা, স্বচ্ছতা এবং ন্যায্যতা নিয়ে। এবারও নতুন সংজ্ঞা প্রণয়নের ফলে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও মর্যাদা নিয়ে সংকট দেখা দিতে পারে, যা ইতিমধ্যেই জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
এই তালিকা পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুধু সংখ্যার পরিবর্তনই নয়, বরং এটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের মূল্যায়নের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। প্রতিবার তালিকা সংশোধনের সময় কিছু মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হন, আবার কিছু নাম বাদ পড়ে। এই প্রক্রিয়ায় অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের প্রাপ্য স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হন, আবার কিছু ক্ষেত্রে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নাম তালিকায় যুক্ত হওয়ার অভিযোগও উঠেছে। এবারের প্রস্তাবিত সংশোধনী তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা পরিবর্তনের মাধ্যমে যাঁরা এত দিন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন, তাঁদের অনেককেই ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ও স্বীকৃতির প্রশ্নে নতুন করে সংকট তৈরি করবে।
মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন এই সংজ্ঞার আওতায় ফেললে ইতিবাচক কোনো কিছুই ঘটবে না। বরং নেতিবাচক প্রভাব বাড়বে। এর ফলে...
১. রাজনৈতিক নেতৃত্বের মর্যাদা সংকুচিত হবে: মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূল ভিত্তি ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্ব, যাঁরা সংগ্রামের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন এবং জনগণকে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ করেছেন। তাঁদের ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা তাঁদের অবদানকে খাটো করবে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে বিকৃত করবে।
২. মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিক চরিত্র অস্বীকৃত হবে: মুক্তিযুদ্ধ শুধু সশস্ত্র যুদ্ধ ছিল না; এটি ছিল এক রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। নতুন সংজ্ঞা সেই বিস্তৃত বাস্তবতাকে সংকুচিত করে কেবল রণাঙ্গনের লড়াইয়ের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের পরিচয় সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা করছে, যা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চরিত্রের প্রতি অবিচার করবে।
৩. আইনি ও প্রশাসনিক জটিলতা বৃদ্ধি পাবে: পূর্বে স্বীকৃত ও গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ও সুবিধা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে, যা নতুন জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। এই পরিবর্তনের ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পুনর্গঠন, যাচাই-বাছাই এবং নতুন প্রশাসনিক কাঠামো তৈরির প্রয়োজন হবে, যা সময়সাপেক্ষ এবং অপ্রয়োজনীয় বিতর্কের জন্ম দেবে।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে এই বিতর্ক শুধু একটি প্রশাসনিক বা আইনি ইস্যু নয়, এটি জাতির ঐক্য ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গেও জড়িত। তাই, এই প্রক্রিয়া যাতে স্বচ্ছ, ন্যায্য এবং ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, তা নিশ্চিত করা জরুরি। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন ও সংশোধনের ক্ষেত্রে সব পক্ষের অংশগ্রহণ এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত, যাতে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান অক্ষুণ্ন থাকে।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই যুদ্ধে যাঁরা অবদান রেখেছেন, তাঁদের সবাইকে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে স্মরণ করা আমাদের কর্তব্য। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় বদলে দেওয়ার এই উদ্যোগ অপ্রয়োজনীয় ও বিভ্রান্তিকর। এটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ক্ষুণ্ন করার পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যকেও দুর্বল করতে পারে। তাই এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত এবং মুক্তিযুদ্ধের সত্য ও ইতিহাসকে অক্ষুণ্ন রাখার জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করা উচিত।
মুক্তিযুদ্ধ জাতীয় পরিচয়ের অংশ এবং একে প্রশ্নবিদ্ধ করা উচিত নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও যাচাই করা জরুরি, তবে সেটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করে নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রেণিবিন্যাস করার পরিবর্তে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মর্যাদা ও স্বীকৃতি নিশ্চিত করাই হওয়া উচিত প্রশাসনের লক্ষ্য। ইতিহাস বদলানো সম্ভব নয়, বরং ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হতে হবে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
আরও খবর পড়ুন:
এনসিপি (জাতীয় নাগরিক পার্টি) নামের নতুন রাজনৈতিক সংগঠনের দু’জন প্রথম সারির সংগঠক তাসনিম জারা ও সারজিস আলমের মধ্যে ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, সেটিকে কোনোভাবেই কেবল ব্যক্তি দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখা ঠিক হবে না।
৩ ঘণ্টা আগেএকাত্তরের যুদ্ধ সম্পর্কে পাকিস্তানি সেনাধ্যক্ষদের আত্মকথনগুলো বেশ উপভোগ্য। এরা সবাই আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন এবং দোষ চাপিয়েছেন অন্যের ঘাড়ে। হামিদুর রহমান কমিশন প্রধান অপরাধী হিসেবে ইয়াহিয়া খানকে চিহ্নিত করেছে বটে, তবে সর্বাধিক নিন্দা...
৯ ঘণ্টা আগেআমি এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যেখানে সব মানুষ সমান সুযোগ পাবে, অন্যায়-অবিচার থাকবে না, সবাই ন্যায্য অধিকার পাবে। ধনী-গরিবের মধ্যে বিশাল পার্থক্য থাকবে না, প্রত্যেকে তার প্রাপ্য সম্মান পাবে। উন্নত দেশ মানে শুধু বিল্ডিং, রাস্তা বা প্রযুক্তির
৯ ঘণ্টা আগে২৬ মার্চ বাংলাদেশের ৫৫তম স্বাধীনতা দিবস। দিনটি এক গৌরবময় অধ্যায়ের স্মারক, যেখানে বাঙালি জাতির বীরত্ব, সাহসিকতা, আত্মত্যাগ ও বিজয়ের অমর কাহিনি জড়িয়ে আছে। একাত্তরের রক্তঝরা পথ বেয়ে যে স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়েছিল, তা আজ পাঁচ দশকের বেশি সময়...
৯ ঘণ্টা আগে