Ajker Patrika

পাকিস্তানিরা তাজউদ্দীনকে সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করত

বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের জন্মশতবার্ষিকী আজ ২৩ জুলাই। বাবার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন তাঁর পুত্র তানজীম আহমদ সোহেল তাজ। এই লেখায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকা, শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সম্পর্ক এবং তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শের কথা।

আপডেট : ২৩ জুলাই ২০২৫, ১৮: ১০
বাবার কোলে ছোট সোহেল তাজ। ছবি: সংগৃহীত
বাবার কোলে ছোট সোহেল তাজ। ছবি: সংগৃহীত

আমাদের সৌভাগ্য যে, আমার বাবা মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেই দুঃসময়ে, যখন বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি আর্মিরা ধরে নিয়ে যায়। সেই সময়ে বাবার দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং সবার সম্মিলিত চেষ্টায় আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম। আমার পিতাকে হত্যা করা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে, আমার মা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেন এবং তিনিও নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, পরিবারকে উৎসর্গ করে দেশ ও জাতির জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন—আমি সেই পরিবারের সন্তান। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব পড়বে আমার ওপর। মনস্তাত্ত্বিকভাবে সেই প্রভাবটা ছোটবেলা থেকেই পড়েছে। বাবার সম্পর্কে জেনেছি, সবাই বলে, ‘তোমার বাবা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন’ বা তাঁর গল্প-কাহিনি যখন লোকমুখে শুনেছি ছোটবেলায়, তখন অবশ্যই এটা আমাকে গর্বিত করেছে। আমার মা-ও চেষ্টা করেছেন আমাদের ছোটবেলা থেকে সেই আদর্শ ধারণ করাতে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ভেতর একটা বীজ বপন করা ছিল।

আমি নিজের চেষ্টায় আমেরিকায় লেখাপড়া শেষ করেছি। একটা সময় আমেরিকায় আমার ভালোই জীবন ছিল। কিন্তু আমার বাবা-মায়ের ভেতর যে দেশপ্রেম দেখেছি, সেই দেশপ্রেম, সেই ভালোবাসা থেকে মনে হয়েছে যে, আমারও কিছু করা প্রয়োজন—সেটা যা-ই হোক। এখনো আমার মতো এ রকম আবেগ নিয়ে অনেক বাংলাদেশি আছেন, যারা প্রবাস থেকে দেশে চলে আসতে চান এবং তাঁরা চান, সুযোগ থাকলে যদি কিছু করা যেত দেশে। কারণ, আমরা কিন্তু সবাই দেশকে ভালোবাসি। তাই এমন চিন্তা থেকে এবং বাবা যে অবদান রেখেছেন, যেটার স্বীকৃতি তিনি পাননি, রাজনীতিতে আসার জন্য এটাও ছিল আমার জন্য একটা মোটিভেশনাল ফ্যাক্টর। আমার মনে হয়েছিল, দেশের জন্য কিছু যদি করতে পারি, কোনো উপকার যদি করতে পারি! তাই আমার সবকিছু ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছিলাম ১৯৯৮ সালে। দেখা গেল যে, আমার বাবার জন্মস্থান গাজীপুরের কাপাসিয়ার রাজনীতির সঙ্গে আমি ধীরে ধীরে জড়িয়ে গেলাম।

আমি যখন প্রথম নির্বাচন করতে আসি, আমার এলাকার মুরব্বিরা আমাকে একটা কথা বলেছিলেন যে, ‘তুমি তো তাইজুদ্দিনের ছেলে, তোমারে তো আমরা চিনি না ওইভাবে। কিন্তু তোমার বাপরে চিনতাম। তোমার বাপের নীতি-আদর্শ আমরা জানি। প্রথমবার ভোট দিয়াম তোমার বাপের নামে। দ্বিতীয়বার দিয়াম তোমার কামের ওপর।’ দ্বিতীয়বার আমি যখন ভোট চাইতে গিয়েছি, কাপাসিয়ার ইতিহাসে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে আমি জয়লাভ করেছি।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতি নয় মাস। এই নয় মাসে যে মুজিবনগর সরকারের অধীনে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়, সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আমার বাবা এবং এই সরকার গঠনের পরিকল্পনা কিন্তু তাঁর মাথা থেকে আসে। তিনি যখন বাংলাদেশ থেকে চলে যাচ্ছিলেন, তখন ৩১ মার্চ যশোর দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন এবং অনেক জায়গায় বলেছেন, ‘আমি একটা সেতুর নিচে যখন বসেছিলাম, তখন আমার মাথায় এসেছিল যে একটা সরকার গঠন করতে হবে।’ কারণ, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন কোনো সময় সফল হয়নি পৃথিবীর ইতিহাসে। এটার একটা আইনগত ভিত্তি লাগবে এবং আমাদের সত্তরের নির্বাচনের যে ফলাফল ছিল, ওটাকে ভিত্তি করে তিনি একটা সরকার গঠনের প্রস্তাব ইন্দিরা গান্ধীর কাছে দেন। তিনি কিন্তু একজন লিডিং স্টেটসম্যান হিসেবে ভারতে প্রবেশ করেন। তাঁকে বলা হয়েছিল র-এর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি বলেছেন, ‘না, আমি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করব।’ তো এটাও আপনাকে বলে দেয় যে, তাঁর উদ্দেশ্য কী ছিল। তিনি জানতেন, তাঁর জায়গাটা কোথায় হতে হবে।

কারণ, এখানে কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় রয়েছে। ভারতের রাজনৈতিক সরকার ছিল এবং তাদের একটা ‘ডিপস্টেট’ আছে, মানে তাদের একটা নীতি, যেটা সাধারণত পরিচালনা করে র ও গোয়েন্দা সংস্থা। তারা কখনোই চায়নি বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাক। কেন? কারণ, ভারতেরও কিন্তু অনেক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন রয়েছে। তাদের ভয় ছিল, বাংলাদেশ যদি স্বাধীন হয়, তাহলে সেখানেও এই আন্দোলনগুলো ছড়িয়ে যেতে পারে। র চেয়েছিল এখানে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা এবং এই পরিস্থিতির কারণে পাকিস্তানিরা হয়তো মেনে নিত এবং বঙ্গবন্ধুকে হয়তো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করত। র-এর উদ্দেশ্য ছিল সেটা। কিন্তু আমাদের সরকার, বাংলাদেশ সরকার যেটা তাজউদ্দীন আহমদ গঠন করেছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ, তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতা। আমি কেন এত দৃঢ়তার সঙ্গে বলছি, কারণ, তাজউদ্দীন আহমদের ট্র্যাক রেকর্ড আমরা যদি দেখি, তাঁর স্কুলবেলা থেকে তাঁর ডায়েরিতে যদি আমরা দেখি, ওখানে কিন্তু স্পষ্ট হয়ে আসবে, তিনি স্বাধীনতাচেতা ছিলেন। তিনি কিন্তু ছোটবেলা থেকে চেয়েছিলেন স্বাধীনতা। আমার মতে, তিনি ভারতকে ব্যবহার করেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য। হি ইউজড অল মিনস টু গেট ইনডিপেনডেন্স ফর বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধু যখন দেশ স্বাধীনের পর ফিরে আসলেন এবং তিনি আমার বাবার কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রিত্ব নিলেন, তিনি প্রথমে এসেই আমার বাবাকে বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রী হব’ এবং আমার বাবা তখন সেটা ছেড়ে দিয়েছিলেন। যাইহোক, পরে আমি শুনেছি, আমার বোনদের কাছে, আমার মায়ের মুখ থেকে যে, আমার বাবা খুব আক্ষেপ করতেন—এই যে নয় মাস আমরা কীভাবে এক কোটি শরণার্থীকে ম্যানেজ করে, আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিকে ম্যানেজ করে, মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে পাকিস্তানের মতো একটা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা সজ্জিত মিলিটারি ফোর্সকে, সে সময় তারা কিন্তু পৃথিবীতে শীর্ষ দশ মিলিটারি ফোর্স ছিল, তাদের কী করে আমরা মোকাবিলা করলাম এবং কী করে আমরা ভারতকে ম্যানেজ করলাম। অনেকে অপপ্রচার করছে যে বাংলাদেশকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল। এ রকম কোনো কিছুই হয়নি। আমার বাবা বাংলাদেশের মর্যাদা ও আত্মপ্রকাশকে সবচেয়ে শীর্ষপর্যায়ে মেইনটেন করেছেন। আমার বাবার এই আক্ষেপ ছিল যে—বঙ্গবন্ধু এক দিনও আমাকে জিজ্ঞেস করেনি যে, এটা কীভাবে হলো।

এখান থেকে আমরা কিছু চিত্র পাই। ওই যে বললাম, ছাত্রনেতাদের ভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কেন? বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করলেন না। কেন? পরে বাকশাল করা হলো, আমার বাবা বিরোধিতা করেছিলেন এবং তিনি বঙ্গবন্ধুকে পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন, ‘আপনি এখন যে পদক্ষেপটা নিলেন, আপনি কিন্তু আপনাকে শান্তিপূর্ণভাবে সরাবার উপায় বন্ধ করে দিলেন। আপনি নিজে মরবেন এবং আমাদের সবাইকে নিয়ে মরবেন।’

এসব কারণেই বঙ্গবন্ধু ও বাবার মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, আমার বাবা বরাবর ছিলেন স্বাধীনতাকেন্দ্রিক। তিনি কিন্তু কোনো ছাড় দিতে চাননি। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। আমরা যদি পাকিস্তানি জেনারেলদের সাক্ষাৎকারগুলো দেখি, যেমন রাও ফরমান আলী, তিনি কিন্তু একজন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়। তিনি একটা সাক্ষাৎকারে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগের ভেতরে তিনটা গ্রুপ ছিল—একটা বাম, একটা ডান, আরেকটা তাজউদ্দীন। তাজউদ্দীন মানে, তিনি চেয়েছিলেন সরাসরি স্বাধীনতা এবং আমরা তাজউদ্দীনকে সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করতাম। কারণ, তিনি ছাড় দিতে চাইতেন না।’ স্বাধীনতার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই।

গণহত্যা যখন শুরু হলো ২৫ মার্চ, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের কাছে গ্রেপ্তার হলেন, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে আমার বাবা সে রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ছিলেন। তিনি একটা টেপ রেকর্ডার নিয়ে গিয়েছিলেন। কথা ছিল যে, বঙ্গবন্ধু এই টেপ রেকর্ডারে এই স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন এবং একটা কাগজে স্বাক্ষর দেওয়ার কথা ছিল একই মর্মে। সেই সময়ে শাহবাগে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে সব সাংবাদিক অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেই রেকর্ডেড মেসেজটা দেননি এবং ওই কাগজে স্বাক্ষর দেননি। আমার বাবা পরে বাসায় চলে আসেন। আমার মা-বোনদের মুখ থেকে শুনেছি, বাবা বাসায় এসে সব ফাইলপত্র ফেলে, তছনছ করে বলছিলেন, ‘আমাদের ২৩ বছরের আন্দোলন নষ্ট হয়ে গেল।’

অনুলিখন: সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জমকালো দোতলা বাড়িতে দূতাবাস, সামনে সারি সারি কূটনৈতিক গাড়ি—৭ বছর পর জানা গেল ভুয়া

অবশেষে রাজি ভারত, ‘জিতেছে বাংলাদেশ’

বেনজীরের এক ফ্ল্যাটেই ১৯ ফ্রিজ, আরও বিপুল ব্যবহার সামগ্রী উঠছে নিলামে

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতাকে শুভেচ্ছা জানাতে বিমানবন্দরে পলাতক আসামি

বাংলাদেশ ব্যাংকে নারীদের শর্ট স্লিভ ড্রেস ও লেগিংস নিষেধ, পরতে হবে ‘শালীন’ পোশাক-হিজাব

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত