Ajker Patrika

ক্ষমতা কখনোই স্থায়ী নয়

আনোয়ারুল হক
ক্ষমতা কখনোই স্থায়ী নয়

ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়—বিরোধী দলে থাকলে সবাই এ কথা বলে, কিন্তু শাসকে পরিণত হলে তা ভুলে যায়। বঙ্গবন্ধুর মতো জনপ্রিয় নেতাও এই চিরন্তন সত্যের ব্যতিক্রম ছিলেন না। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে যাওয়া তরুণদের কাছেও শেখ মুজিব ছিলেন প্রথম সহায়—সেই মুজিব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় থেকেও একসময় পাকিস্তানিদের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব বাংলার গণরায় তাঁকে অবিসংবাদিত নেতা বানায়। অথচ সেই গণরায় অস্বীকার করে পাকিস্তানিরাই দেশ ভাঙার পথ প্রশস্ত করে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে, কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের মাথায় একদলীয় শাসনের দিকে যাত্রা, রাজনৈতিক গণতন্ত্র সংকোচন এবং রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা—সব মিলিয়ে তা দ্রুত হ্রাস পায়। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে ১৯৭৫ সালে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তাঁর পতন ঘটে।

এরপর সামরিক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল জিয়া। স্বাধীনতাযুদ্ধের ঘোষক ও জেড ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে পরিচিত হলেও তাঁর শাসনকালে সামরিক আইন বজায় থাকে এবং ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করেন। বহুদলীয় রাজনীতি ফিরিয়ে আনার কৃতিত্ব থাকলেও ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে পুনরায় রাজনীতির ময়দানে আনার সুযোগ দিয়ে তিনি মৌলবাদের পুনরুৎপত্তির দ্বার খুলে দেন। যদিও মুখে বলতেন, ‘ধর্ম রাজনীতিতে অবদান রাখতে পারে, তবে রাজনৈতিক দল ধর্মভিত্তিক হওয়া উচিত নয়।’

নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিতদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে সামরিক শাসনের মধ্যেই গণভোট ও নির্বাচন আয়োজনের কারণে সমালোচিত হন। তারপর সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হন জিয়া।

পরবর্তী শাসক জেনারেল এরশাদ প্রথমে সামরিক, পরে নির্বাচনের নামে মিডিয়া-ক্যু করে দীর্ঘ ৯ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। গণ-অভ্যুত্থানে তাঁর পতনের মধ্য দিয়ে জনগণের ভোটে সরকার পরিবর্তনের যে ধারা সূচিত হয়েছিল, তা কিন্তু নিয়মিত টিকে থাকেনি।

১৯৯১ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বিএনপি সরকার গঠন করে। ভোটের হারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রায় সমান হলেও আসনে পার্থক্য ছিল বড়। এই সময় থেকে দেশে দ্বিদলীয় রাজনীতির একচেটিয়া প্রভাব দেখা দেয়। ১৯৯৬ সালে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ আন্দোলনের পর স্বল্পমেয়াদি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে এ দাবি মেনে নেওয়া হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে।

২০০১ সালে আওয়ামী লীগ অপেক্ষাকৃত বেশি ভোট পেলেও বিএনপি-জামায়াত জোট আসনসংখ্যায় এগিয়ে গিয়ে সরকার গঠন করে। ক্ষমতায় এসেই সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা শুরু হয়, দ্বিদলীয় সম্পর্ক আরও শত্রুতাপূর্ণ হয়ে ওঠে।

এ সময় সন্ত্রাসী ও জঙ্গি কার্যকলাপ ভয়াবহ মাত্রায় বেড়ে যায়। বাংলাভাইয়ের উত্থান, সারা দেশে একযোগে বোমা হামলা, গ্রেনেড হামলা এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের ওপর হত্যাচেষ্টা জনমনে গভীর শঙ্কা সৃষ্টি করে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা ছিল এক নজিরবিহীন ঘটনা। এসবের পাশাপাশি হাওয়া ভবনের সমান্তরাল ক্ষমতাবলয়ের ফলে বিএনপির জনসমর্থন ক্ষয়ে যেতে থাকে।

২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে রাজনৈতিক কৌশলের কারণে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সেনাবাহিনী সমর্থিত ১/১১-এর সরকার ক্ষমতায় আসে। এই সরকার রাজনৈতিক সংস্কারের নামে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা প্রয়োগের চেষ্টা করে। অনেকেই এই উদ্যোগকে সমর্থন করলেও তা ব্যর্থ হয়। ড. ইউনূস রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করেও সফল হননি।

এই সরকারও শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে বিদায় নেয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়, কিন্তু ১/১১-এর সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বাতিল ঘটিয়ে পরপর একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে বিরোধী দলকে ক্ষমতার বাইরে রাখা নিশ্চিত করা হয়। এর ফলে গণতান্ত্রিক পরিসর আরও সংকুচিত হয়।

শেখ হাসিনার দীর্ঘমেয়াদি শাসনের শেষে যে ক্ষোভ, অসন্তোষ ও রাজনৈতিক স্থবিরতা তৈরি হয়েছে, তার ফল দেখা গেল জুলাই অভ্যুত্থানে। অভ্যুত্থান সফল হলে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, তা নিয়ে এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এনসিপি নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হলেও তাদের অবস্থান এখনো অনির্ধারিত এবং ডানপন্থী ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা অনেক প্রশ্ন তুলেছে।

এই সুযোগে জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক উত্থানও লক্ষণীয়। দীর্ঘকাল পর তারা এমন সুযোগ পেয়েছে, যা জিয়া-খালেদা এমনকি এরশাদের সময়েও পায়নি। বর্তমান সরকার ‘কণ্ঠ ছাড়ো জোরে’ নীতির সুযোগ দিয়ে তাদের অপ্রত্যাশিত স্বাভাবিকতায় নিয়ে এসেছে, যদিও এ দেশের সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী জনগণও রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার পছন্দ করে না।

এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, নির্বাচন হলে বিএনপির বিজয়ের সম্ভাবনা প্রবল। যদিও দলটি চাঁদাবাজি, সহিংসতা এবং দুর্বৃত্তায়নের অভিযোগে নিন্দিত হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবতা হলো—আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে ভালো বিকল্প না থাকায় জনগণ বাধ্য হয়েই বিএনপির দিকে ঝুঁকবে। এটা সেই পুরোনো মন্দের ভালো কৌশল। আওয়ামী লীগও যে কারণে অনেকের সমর্থন পেয়েছিল।

বর্তমানে সরকার, বিরোধী দল, নতুন উদীয়মান শক্তি—সবাই ব্যস্ত নিজেদের জায়গা পাকাপোক্ত করতে। প্রধান উপদেষ্টার কিছু সিদ্ধান্ত এবং নীরবতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। বিশেষ করে প্রধান বিচারপতি ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে তাঁর আনুষ্ঠানিক বৈঠক, উপদেষ্টা পরিষদে এনসিপি সংশ্লিষ্টদের অবস্থান—সবকিছু মিলিয়ে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ বাড়ছে।

নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। বলা হয়েছিল, সংক্ষিপ্ত সংস্কার হলে ডিসেম্বর, আর বড় সংস্কার হলে জুন ২০২৫-এর মধ্যে নির্বাচন হবে। কিন্তু এখন ফেব্রুয়ারির সম্ভাবনা তুলে ধরে আবার ঝুলিয়ে রাখার কৌশল দেখা যাচ্ছে। এতে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও ঘনীভূত হচ্ছে।

অথচ ইতিহাস বলছে, শুধু অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমেই শান্তিপূর্ণ শাসক পরিবর্তন সম্ভব। অন্যথায় হত্যা, ষড়যন্ত্র বা গণ-অভ্যুত্থানই হয়ে ওঠে বিকল্প পথ, যার পরিণতি কখনোই মঙ্গলজনক নয়।

আজকের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর সহকর্মীরা যদি সম্মানজনক প্রস্থানের পথ খুঁজে নিতে চান, তবে একটি নিরপেক্ষ, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আয়োজনই হতে পারে একমাত্র বিকল্প। যত দ্রুত তাঁরা এ সত্য উপলব্ধি করবেন, ততই দেশের জন্য কল্যাণকর হবে।

কোনো শাসকই অপরাজেয় নয়—ক্ষমতার চাকা ঘুরে যায়, ইতিহাস তা বারবার প্রমাণ করেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত