Ajker Patrika

৫ কারণে দেশ ছাড়ছেন শিক্ষার্থীরা

রাহুল শর্মা, ঢাকা 
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা

দেশে মানসম্মত শিক্ষার ঘাটতি আছে। রয়েছে কর্মসংস্থানের অভাব, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা। এতে তরুণদের বড় অংশের মধ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা কাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে উন্নত ভবিষ্যতের আশায় বিদেশমুখী হচ্ছেন তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীরা। জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেসকো) তথ্য বলছে, উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক দশকে দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিগত ৯ অর্থবছরে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে বৈধ চ্যানেলে দেশ থেকে বেরিয়ে গেছে প্রায় ৩১১ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩০ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা (হিসাবটি গত ৯টি অর্থবছরের ডলারের দর অনুযায়ী)।

শিক্ষার্থীদের দেশ ছাড়ার প্রবণতা বাড়ার কারণ জানতে বিদেশে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থী, বিদেশে পড়তে যেতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থী এবং তাঁদের অভিভাবক, শিক্ষকসহ অন্তত ৩০ জনের সঙ্গে কথা বলেছে আজকের পত্রিকা। তাঁরা মোটাদাগে পাঁচটি কারণের কথাই বলেছেন। কারণগুলো হলো মানসম্মত উচ্চশিক্ষার অভাব, কর্মসংস্থানের ঘাটতি ও বেকারত্ব বৃদ্ধি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, উন্নত ভবিষ্যতের হাতছানি এবং নিরাপদ ও আধুনিক জীবনযাত্রার আকাঙ্ক্ষা। এর সঙ্গে একমত শিক্ষাবিদেরাও। তাঁরা বলছেন, দেশে উচ্চশিক্ষার মান ও গবেষণার সুযোগ এবং কর্মসংস্থান না বাড়লে এই প্রবণতা আরও বাড়বে।

সার্বিক বিষয়ে মন্তব্য জানতে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব রেহানা পারভীনের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তাঁরা সাড়া দেননি। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় যোগাযোগ করা হলে তাঁরা দেশের উচ্চশিক্ষা দেখভালের দায়িত্বে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।

জানতে চাইলে ইউজিসি সদস্য ১৯ অক্টোবর অধ্যাপক ড. মো. সাইদুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আপাতদৃষ্টে যে চিত্র আপনারা তুলে এনেছেন, তার সঙ্গে আমি একমত।’ মানসম্মত উচ্চশিক্ষার বিষয়টি সামগ্রিক শিক্ষার ওপর নির্ভর করে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে যে শিক্ষার ঘাটতি তৈরি হয়েছে, এর প্রভাব পড়ছে উচ্চশিক্ষায়। এটা সত্য যে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ-শিক্ষার মান এক নয়; বিশেষ করে নতুন প্রতিষ্ঠিত হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

কেন বিদেশমুখীনতা

গত এক সপ্তাহে রাজধানীর গুলশান ও বনানীতে অবস্থিত ভিএফএস গ্লোবাল (বিভিন্ন দেশের সরকার ও দূতাবাসের জন্য ভিসা আবেদন প্রক্রিয়াকরণে সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান) অফিসের সামনে অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা সবাই এখানে এসেছেন উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে ভিসার আবেদন জমা দেওয়ার জন্য।

উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার উদ্দেশ্য জানতে চাইলে ওই সব শিক্ষার্থীর ভাষ্য, দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই, অথবা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। কেউ কেউ দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার বিষয়টি বিবেচনা করে উন্নত ভবিষ্যৎ, আধুনিক ও নিরাপদ জীবনের জন্য বিদেশকে বেছে নিচ্ছেন বলে জানান।

গুলশানে ভিএফএস গ্লোবাল অফিসের সামনে কথা হয় ২০২৪ সালে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করা শাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, দেশে পড়াশোনার মান দিন দিন কমছে। তাই পরিবার চাইছে বিদেশে উচ্চশিক্ষা শেষে সেখানেই ক্যারিয়ার গড়তে। আর দেশের পরিস্থিতি তো দিন দিন খারাপ হচ্ছে, তাই না?

দেশের উচ্চশিক্ষার মান কমার বিষয়টি উঠে এসেছে বিশ্বব্যাংকের চলতি বছর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি শিশু ১৮ বছর বয়সে সাধারণত ১১ বছর মেয়াদি আনুষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন করে (প্রথম শ্রেণি থেকে একাদশ শ্রেণি)। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের শেখার মান আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বিবেচনায় ৬ দশমিক ৫ বছরের সমতুল্য। অর্থাৎ শিক্ষায় আন্তর্জাতিক মানে অন্তত সাড়ে ৪ বছর পিছিয়ে বাংলাদেশ।

বিদেশে পড়াশোনা শেষে সেখানেই স্থায়ী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যায় স্নাতকোত্তর পাস করা মো. শাহরিয়ার। কথা হলে তিনি জানান, দেশে চাকরির নিশ্চয়তা কম। এ ছাড়া যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরিও পাওয়া যাচ্ছে না। তাই সব মিলিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে দেশে মোট ২৬ লাখ ২৪ হাজার বেকার ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ৮ লাখ ৮৫ হাজার ছিলেন স্নাতক ডিগ্রিধারী।

ভিসার আবেদন জমা দিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট থেকে পাস করা জহির রায়হান জয়ের সঙ্গে এসেছিলেন তাঁর বাবা তবিরুল রায়হান। উচ্চশিক্ষার জন্য ছেলেকে বিদেশে পাঠানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দিন দিন আমাদের পড়ালেখার মান কমে যাচ্ছে। এ তো সবাই জানে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ছেলেকে বিদেশে পড়তে পাঠাব। পড়াশোনা শেষে যেন সে সেখানেই চাকরি পায়।’

সম্প্রতি উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপের দেশ সুইডেনে গিয়েছেন সাইম আখন্দ। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশকে বেছে নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে সেখান থেকে তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা যুগোপযোগী নয়, বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করার মতো নয়। এ জন্যই বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে আসা।

উচ্চশিক্ষার জন্য মেধাবীদের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ার পেছনে পাঁচ কারণের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. আলী জিন্নাহ। তাঁর মতে, এই কারণগুলোর পাশাপাশি আরও কিছু ছোটখাটো কারণ থাকতে পারে।

আলী জিন্নাহ বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা তো আছেই, ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি, কর্মসংস্থানের ঘাটতি, উপযুক্ত সম্মান, মেধার ভিত্তিতে চাকরি পাওয়ার নিশ্চয়তা না থাকা, বসবাসের অনুপযুক্ততা, জীবনমান নিম্নমুখী হওয়া—এমন বহুমাত্রিক কারণে দেশ ছাড়ছেন মেধাবী শিক্ষার্থীরা। মেধাবীদের দেশে রাখতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন এই অধ্যাপক।

একই ভাষ্য ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদের। তিনি বলেন, ‘আমাদের শিক্ষা-দীক্ষার অবস্থা খুবই শোচনীয়। যোগ্যতা অনুযায়ী উপযুক্ত কর্মসংস্থানেরও ঘাটতি রয়েছে। এগুলোই প্রধান কারণ। এ ছাড়া রাজনৈতিক, সামাজিক নানান সংকট তো রয়েছেই।’

বছরে বিদেশে যান অর্ধলক্ষাধিক শিক্ষার্থী

ইউনেসকোর সর্বশেষ ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ৫৫টি দেশে পড়াশোনার জন্য গেছেন ৫২ হাজার ৭৯৯ শিক্ষার্থী। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৪৯ হাজার ১৫১ আর ২০২১ সালে ৪৪ হাজার ৩৩৮ জন। এ সংখ্যা ২০১৩ সালে ছিল ২৪ হাজার ১১২ জন।

তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ১০ বছরের ব্যবধানে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়া শিক্ষার্থী বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। অ্যাডমিশন অ্যান্ড ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. জুলফিকার আলী জুয়েল বলেন, ইউনেসকোর যে পরিসংখ্যান, তার চেয়ে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গেছেন।

রাজধানীতে আইইএলটিএস ও জিআরই কোচিং করায় এমন প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভিড় বাড়া দেখেই বোঝা যায়, শিক্ষার্থীদের বিদেশে যাওয়ার আগ্রহ কতটা। বর্তমানে অনলাইনেও বাড়ছে ইংরেজি শেখা ও আইইএলটিএস, টোয়েফল, জিআরই এবং বিভিন্ন দেশের ভাষা শেখার আগ্রহ।

রাবেয়া তানহা নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘দেশের অনিরাপদ পরিবেশ আমাকে খুবই ভাবাচ্ছে। তাই বিদেশে পড়তে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

বৈধ পথেই ৯ বছরে গেছে ৩০ হাজার কোটি টাকা

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশ করা বিগত ৯ অর্থবছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশে উচ্চশিক্ষা বাবদ ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠানো টাকার পরিমাণ প্রতিবছর বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশিদের বিদেশে শিক্ষার ব্যয় ছিল ৬৬ কোটি ২০ লাখ ডলার, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ। বাংলাদেশি মুদ্রায় ব্যয় করা এই অর্থের পরিমাণ ৮ হাজার ৭৬ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসাবে)। একইভাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫৩ কোটি ৩২ লাখ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫২ কোটি ৮ লাখ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪১ কোটি ৪৫ লাখ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪ কোটি ৩১ লাখ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২১ কোটি ৮০ লাখ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৯ কোটি ৬১ লাখ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৭ কোটি ৭ লাখ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৫ কোটি ৪ লাখ ডলার বৈধ চ্যানেলে নিয়ে গেছেন শিক্ষার্থীরা।

টাকা বেশি যাচ্ছে অবৈধ পথে

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা সাধারণত ভর্তি ফি, এক সেমিস্টারের টিউশন ফি এবং বাসস্থান ও অন্যান্য ফি ইত্যাদি দিয়ে বিদেশে পড়তে চলে যান। এ টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে দুটি পথ—একটি ব্যাংকিং চ্যানেল, অন্যটি অবৈধ পথ হুন্ডি।

একাধিক স্টুডেন্ট কাউন্সেলিং ফার্মের কর্ণধার এবং একাধিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বৈধ পথে বা ব্যাংকের মাধ্যমে যত টাকা যায়, তার চার-পাঁচ গুণ টাকা অবৈধ পথে যায়। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষার অর্থ পাঠানোর নামে অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে। গত ১০ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, একজন তাঁর সন্তানের টিউশন ফি হিসেবে এক সেমিস্টারেই ৪০০-৫০০ কোটি টাকা পাঠিয়েছেন।

হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর কারণ জানতে চাইলে একটি কাউন্সেলিং প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার জানান, কোনো শিক্ষার্থী বিদেশে পড়াশোনার জন্য যেতে চাইলে স্থানীয় ব্যাংকে স্টুডেন্ট অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। ওই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে (বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে) বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় ফি পরিশোধ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে আয়ের উৎস জানাতে অভিভাবকের অনীহা থাকে। ফলে তাঁরা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠান। আবার অনেকে কিছু ব্যাংকের মাধ্যমে আর কিছু হুন্ডিতে পাঠান। আবার অনেকে টাকা পাচারের জন্যও শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সম্প্রতি কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে গেছেন ঢাকার ধানমন্ডির এক তরুণ। তিনি জানান, বৈধ পথে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচই আনা সম্ভব হয়। এর বাইরে আরও অনেক খরচ রয়েছে। হুন্ডির মাধ্যমে এই টাকা আনা অনেক সহজ। ওই তরুণ বলেন, তাঁর পরিচিত এক কনসালট্যান্ট ফার্মকে নগদ টাকা দিয়েছেন, তারাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করেছে।

বিষয়টি নজরে আনা হলে অ্যাডমিশন অ্যান্ড ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. জুলফিকার আলী জুয়েল অবশ্য বলেন, ‘আমাদের সদস্যদের কঠোরভাবে নির্দেশনা দিয়েছি, এ ধরনের বেআইনি কাজ যেন কেউ না করে। এতে দেশের ক্ষতি হয়।’

প্রতারণার শিকার হচ্ছেন অনেকে

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য চটকদার বিজ্ঞাপনে প্রতারিত হচ্ছেন অনেক শিক্ষার্থী। রাজধানীতে গড়ে ওঠা একাধিক কনসালট্যান্সি ফার্ম এসব প্রতারণার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, সরকারের মনিটরিং না থাকা এবং বিদেশ গমনে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ায় প্রতারক চক্রগুলো এখন লাগামহীন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চটকদার প্রচারণার মাধ্যমে অসাধু এজেন্সিগুলো প্রধানত তিন ধরনের প্রতারণা করে। এগুলো হচ্ছে শিক্ষার্থীদের টাকা আত্মসাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপ্রক্রিয়া অসম্পূর্ণ রাখা এবং বিদেশে না পাঠানো, আগ্রহী প্রার্থীদের ভুয়া কাগজ তৈরি করে টাকা আত্মসাৎ করা এবং ভিসা করে বাইরে পাঠিয়ে প্রতিশ্রুত সুযোগ-সুবিধা না দেওয়া।

এরই মধ্যে গত বছরের ১৭ অক্টোবর ক্যামব্রিয়ান এডুকেশন গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান মো. খায়রুল বাশার বাহার এবং তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে ১ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর ২০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ জানান ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা। পরে গত ১৪ জুলাই খায়রুল বাশারকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

ভিসাপ্রাপ্তিও কঠিন হচ্ছে

শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ভিসা জটিলতায় ইউরোপের অনেক দেশে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ, ইউরোপের বেশ কিছু দেশের ভিসা নিতে শিক্ষার্থীদের ভারতে যেতে হয়। কিন্তু এখন ভারতের ডাবল এন্ট্রি ভিসা পাওয়া কঠিন হওয়ায় ইউরোপে যাওয়া জটিল হয়ে পড়ছে। এর বাইরে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর সারা বিশ্বের জন্য ভিসা নীতিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছেন।

এ ছাড়া শুধু জার্মানিতে ভিসা আবেদনে ব্যয় হয় লম্বা সময়। জার্মান দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী, তারা বছরে দুই হাজার আবেদন প্রক্রিয়াকরণ করতে পারে। কিন্তু এর বিপরীতে প্রায় ৪০ গুণ আবেদন জমা পড়ে জার্মান দূতাবাসে। যে কারণে এই ধীরগতি।

৮ অক্টোবর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, জার্মানিতে শিক্ষাব্যবস্থা খুবই উচ্চমানের এবং সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো ফি লাগে না। কাজেই বাংলাদেশি ছাত্ররা খুবই আগ্রহী হয়ে উঠেছেন জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যাওয়ার জন্য। ৮০ হাজার আবেদন পড়েছে।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও বলেন, জার্মান রাষ্ট্রদূত কয়েক দিন আগে চলে গেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘দেখুন, আমার কিছুই করার নেই। কারণ, আমার মোট সামর্থ্যই হচ্ছে দুই হাজার কেস প্রতিবছর ডিল করা। তার মানে, এত আবেদন তাঁরা গ্রহণ করতে পারবেন না।’

দেশে কমছে বিদেশি শিক্ষার্থী

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশের ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬৩৩ জন। তাঁদের মধ্যে ছাত্রী ১৭১ ও ছাত্র ৪৬২। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৬৭০ জন। সেই হিসাবে ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে বিদেশি শিক্ষার্থী কমেছে ৩৭ জন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...