আমাদের দেশে প্রতিবছরই সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি, চলচ্চিত্রসহ বিভিন্ন শাখায় পুরস্কার ঘোষণা হয়, সরকারি ও বেসরকারিভাবে। কোনো কোনো পুরস্কারের ক্ষেত্রে লেখক বা প্রকাশককে স্বপ্রণোদিত হয়ে বই জমা দিতে হয়। এই নিয়মটি আমার মতে একজন লেখকের জন্য অসম্মানের। একজন লেখক কেন পুরস্কারের জন্য নিজ উদ্যোগে প্রতিযোগিতায় শামিল হবেন?
বিধান রিবেরু
প্রতিষ্ঠানের মাপে নিজেকে ছেঁটে খাটো না করার প্রত্যয়ে ফরাসি দার্শনিক ও লেখক জঁ পল সার্ত্রে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর কথায় ‘ইনস্টিটিউশনালাইজড’ হতে চাই না, তাই সবিনয় প্রত্যাখ্যান। পুরস্কার একধরনের স্বীকৃতি। সেটি কার না পেতে ভালো লাগে? সলিমুল্লাহ খান যখন ‘লোক’ সাহিত্য পুরস্কার গ্রহণ করছিলেন ২০১৭ সালে, তখন তিনি বক্তৃতায় বলেছিলেন, পুরস্কারের বিপরীত হলো তিরস্কার। তিরস্কৃত হতে যেমন কারও ভালো লাগে না, তেমনি পুরস্কৃত হতে কার না ভালো লাগে?
কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সমাজের বিশিষ্টজনদের পুরস্কার প্রদানের রেওয়াজ পৃথিবীতে বহু পুরোনো। মানুষ এই পুরস্কার দেয় নানাভাবে। প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যেমন দেয়, তেমনি দেয় অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবেও। গণমানুষের ভালোবাসা হলো অপ্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার এবং আমার মতে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। যাঁরা সৃষ্টিশীল বা দায়িত্বশীল কাজে নিজেদের নিয়োজিত রাখেন, তাঁরা মানুষের ভালোবাসাকে অধিক গুরুত্ব দেন। প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কারকেও তাঁরা কম গুরুত্ব দেন না। নয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে আরও বহু গুণী মানুষ নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেছেন। সারা দুনিয়ায় বছরব্যাপী নানা ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার গ্রহণ করে চলেছেন গুণী ও মেধাবী মানুষেরা। তাঁদের তালিকা দিয়ে শেষ করা যাবে না। তবে পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছেন, এ রকম অনেক ব্যতিক্রমী ব্যক্তি রয়েছেন। তাঁরা অনেকটা সার্ত্রের মতোই নিজেদের খর্বাকৃতি করতে চাননি প্রতিষ্ঠানের মাপে।
উত্তর ভিয়েতনামি নেতা লি-ডুক-থো ১৯৭৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ, সে বছর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারকেও শান্তিতে নোবেল দেওয়া হয়েছিল। ভিয়েতনামের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে অন্যায় ও বর্বরতা চালিয়েছে, তারপর তাদের নেতার সঙ্গে কোনো পুরস্কার নেওয়াকেই যুক্তিযুক্ত মনে করেননি লি-ডুক।
মার্কিন অভিনেতা মার্লন ব্রান্ডো ‘গডফাদার’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ১৯৭৩ সালে অস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেয়েও গ্রহণ করেননি। স্থানীয় আমেরিকানদের প্রতি হলিউডের যে আচরণ, তার প্রতিবাদে তিনি পুরস্কারটি ফিরিয়ে দেন। ব্রান্ডো ভালো করেই জানতেন, এই পুরস্কার না নিলেও তিনি ব্রান্ডোই থাকবেন। তা ছাড়া, প্রতিবাদ জানানোটাকে তিনি কর্তব্য মনে করেছিলেন।
১৯৬৯ সালে প্রখ্যাত গায়ক জন লেনন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ‘মেম্বার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ারে’র স্বীকৃতি। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা তিনি পছন্দ করেননি। প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন প্রত্যাখ্যানের ভেতর দিয়ে। এমন গুণীজনদের তালিকা নিঃসন্দেহে ছোট, আবার এটাও ঠিক, এই মানুষগুলোকে আলাদাভাবে স্মরণ করা হয় তাঁদের প্রতিবাদের ভাষার জন্য। যে মানুষ সারা জীবন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে এসেছেন, অবস্থান নিয়েছেন রাষ্ট্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে, তাঁরা যদি জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোনো পুরস্কার গ্রহণ করেন তাহলে তাঁদের আগের কথাবার্তাগুলো ফাঁকা বুলিতে পর্যবসিত হয়। শুধু তা-ই নয়, অনেক সময় প্রতিষ্ঠান কোনো সমস্যা না হলেও, অনেকের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় পুরস্কারটি গৃহীত হবে কার হাত থেকে, সেটি। এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে হুমায়ুন আজাদের প্রবচনরূপী দুটি বাক্যকে—‘শামসুর রাহমানকে একটি অভিনেত্রীর সাথে টিভিতে দেখা গেছে। শামসুর রাহমান বোঝেন না কার সঙ্গে পর্দায়, আর কার সঙ্গে শয্যায় যেতে হয়।’
কোনো খ্যাতিমান মানুষ পুরস্কার পেলেন কি পেলেন না; পুরস্কার গ্রহণ করলেন কি করলেন না, এসব নিয়ে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, হবে। আপনি খ্যাতি অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে সমালোচনা ও মানুষের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিও আপনাকে অনুসরণ করতে থাকবে। মানুষের প্রশংসা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও পুরস্কারের পাশাপাশি নিন্দা, ঘৃণা, অশ্রদ্ধা ও তিরস্কার হাত ধরাধরি করে হাজির হবে আপনার দরজায়। বিষয়টি আসলে নির্ভর করছে সেই ব্যক্তির ওপর, যিনি পুরস্কার গ্রহণ করছেন। তিনি কার দেওয়া পুরস্কার গ্রহণ করছেন, কেন করছেন, কোন পরিস্থিতির ভেতর গ্রহণ করছেন—এসব বিবেচনায় না নিলে অনেক সময় ব্যক্তির অবস্থান স্পষ্ট হয় না। দূর থেকে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।
পুরস্কার অনেকে চাপে পড়ে গ্রহণ করতে পারেন, অনেকটা বাধ্য হয়ে। অনুরোধে ‘পুরস্কার’ গেলার মতো। আবার অনেকে স্বেচ্ছায়, সানন্দে পুরস্কার গ্রহণ করতে পারেন। তিনি ভাবতে পারেন, যাঁরা তাঁকে পুরস্কার দিচ্ছেন, তাঁরা তাঁকে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার জায়গা থেকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। কাজেই তাঁদের তিনি ফিরিয়ে না দিয়ে পুরস্কারটি গ্রহণ করেন। যদি গ্রহণ না করেন, তাহলে পুরস্কারদাতা গোষ্ঠীকে প্রকারান্তরে তিরস্কার করা হয়। ব্যক্তি সম্পর্কের জায়গা থেকে হয়তো অনেকে সেই ‘তিরস্কার’ ছুড়ে দিতে চান না, তাই পুরস্কার গ্রহণ করেন।
এখানে ভুল বোঝার কোনো অবকাশ নেই, আমি পুরস্কার গ্রহণকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখছি না। বরং যে ব্যক্তি পুরস্কার গ্রহণ করছেন, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, অবস্থান ও আন্তঃসম্পর্কের সমীকরণের দিকে নজর দিচ্ছি। একেক ব্যক্তির সমীকরণ একেক রকম। তাঁদের সেই হিসাবনিকাশই ঠিক করে দেয় কোন পুরস্কার তাঁরা নেবেন কিংবা আদৌ পুরস্কার তাঁরা নেবেন কি না, আর নিলেও কার হাত থেকে নেবেন ইত্যাদি। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না, অনেক সময় পুরস্কার খোদ, কারও কারও হাতে উঠে নিজের গৌরব বৃদ্ধি করে। ব্যক্তিটি সমাজে বা বিশ্বে এতটাই সম্মানিত ও বরণীয় যে কোনো কোনো পুরস্কার সেই ব্যক্তির মুকুটে পালক হয়ে নিজে আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এমন নজিরও খুঁজলে পাওয়া যাবে প্রচুর, দেশে ও বিদেশে।
আমাদের দেশে প্রতিবছরই সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি, চলচ্চিত্রসহ বিভিন্ন শাখায় পুরস্কার ঘোষণা হয়, সরকারি ও বেসরকারিভাবে। কোনো কোনো পুরস্কারের ক্ষেত্রে লেখক বা প্রকাশককে স্বপ্রণোদিত হয়ে বই জমা দিতে হয়। এই নিয়মটি আমার মতে একজন লেখকের জন্য অসম্মানের। একজন লেখক কেন পুরস্কারের জন্য নিজ উদ্যোগে প্রতিযোগিতায় শামিল হবেন? কেউ যদি সত্যিকার অর্থেই মনে করেন একজন যোগ্য, তাঁকে তাঁরাই আবিষ্কার করে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক পুরস্কৃত করতে পারেন। অনেক প্রতিষ্ঠান কমিটি গঠনের মাধ্যমে যোগ্য লোক খুঁজে বের করে। সে ক্ষেত্রে আমার মতে অনলাইনের মাধ্যমে সীমিত সময়ের জন্য ভোটিং সিস্টেম চালু করলে মন্দ হয় না। প্রথমে মনোনীত ব্যক্তিদের নাম ঘোষণা হলো, তারপর জনতার ভোটিং, এরপর বিচারকমণ্ডলীর বিবেচনা, সব মিলিয়ে একজনকে চূড়ান্ত নির্বাচিত করে পুরস্কৃত করা যেতে পারে।
পুরস্কার প্রদানের পর আরেকটি রেওয়াজ খুব অসম্মানের। সেটি হলো পুরস্কারপ্রাপ্তরা পেছনে দাঁড়িয়ে থাকবেন, আর দাতারা সামনে সুসজ্জিত কেদারায় বসে থাকবেন। ফটোকল বা ছবি তোলার জন্য আলাদাভাবে জায়গা করে দেওয়া যেতে পারে, যেখানে সসম্মানে পুরস্কৃত ব্যক্তিরা দাঁড়াবেন, একত্রে ও একা, দুইভাবেই। সেই ছবিতে যাঁরা পুরস্কার দিচ্ছেন তাঁদের আর থাকার প্রয়োজন নেই। কারণ, তাঁদের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণের ছবি তো একবার তোলা হচ্ছেই, আবার গ্রুপ ফটোতে তাঁদের না হলেও চলে। পুরস্কার তো প্রতিষ্ঠান দিচ্ছে, কোনো ব্যক্তি নয়। কাজেই প্রতিষ্ঠানের নাম-চিহ্ন আছে সে রকম জমিনের সামনে দাঁড়িয়ে চমৎকার আলোকচিত্র সৃষ্টি করা সম্ভব। পুরস্কারপ্রাপ্তদের জন্য সেটি হবে আরেকটি পুরস্কারের সমান।
কাজেই পুরস্কার প্রদান ও পুরস্কার গ্রহণের পর ছবি তোলার যে রীতি, উভয় ক্ষেত্রেই সংস্কার প্রয়োজন। আমরা জানি, কোনো পুরস্কার বা পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। আমরা এটাও জানি, সবকিছু নিয়েই মানুষ কথা বলতে ভালোবাসে, মানুষ কথা বলবে। যে পুরস্কারের ঐতিহ্য রয়েছে, সেটি নিয়ে মানুষের অনেক মনোযোগ ও অভিযোগ থাকবে। আবার যে মানুষ ঐতিহ্যবাহী কোনো পুরস্কার পান, সেই মানুষকেও ভালোবাসা ও ভর্ৎসনার মুখোমুখি হতে হবে। সব সময় সবার মন জুগিয়ে চলা দুঃসাধ্য কাজ। প্রতিষ্ঠান অনেক সময় অযোগ্য লোকদের পুরস্কার দিয়ে বসে। আবার যোগ্য লোক অনেক সময় তাঁর মাপের চেয়ে ছোট প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার গ্রহণ করে বসেন। তখন সমালোচনার আগুনে ঘি পড়ে। তবে শেষ কথা কি, একজন গুণী মানুষের স্বীকৃতির প্রয়োজন হয়, সে হোক তাঁর ঘরের আপন মানুষের কাছ থেকে, ঘরের বাইরের জনগণের কাছ থেকে, কিংবা কোনো ছোট বা বড় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। কে কোনটাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, সেটা সম্পূর্ণই তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার।
লেখক: বিধান রিবেরু
প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক
প্রতিষ্ঠানের মাপে নিজেকে ছেঁটে খাটো না করার প্রত্যয়ে ফরাসি দার্শনিক ও লেখক জঁ পল সার্ত্রে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর কথায় ‘ইনস্টিটিউশনালাইজড’ হতে চাই না, তাই সবিনয় প্রত্যাখ্যান। পুরস্কার একধরনের স্বীকৃতি। সেটি কার না পেতে ভালো লাগে? সলিমুল্লাহ খান যখন ‘লোক’ সাহিত্য পুরস্কার গ্রহণ করছিলেন ২০১৭ সালে, তখন তিনি বক্তৃতায় বলেছিলেন, পুরস্কারের বিপরীত হলো তিরস্কার। তিরস্কৃত হতে যেমন কারও ভালো লাগে না, তেমনি পুরস্কৃত হতে কার না ভালো লাগে?
কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সমাজের বিশিষ্টজনদের পুরস্কার প্রদানের রেওয়াজ পৃথিবীতে বহু পুরোনো। মানুষ এই পুরস্কার দেয় নানাভাবে। প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যেমন দেয়, তেমনি দেয় অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবেও। গণমানুষের ভালোবাসা হলো অপ্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার এবং আমার মতে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। যাঁরা সৃষ্টিশীল বা দায়িত্বশীল কাজে নিজেদের নিয়োজিত রাখেন, তাঁরা মানুষের ভালোবাসাকে অধিক গুরুত্ব দেন। প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কারকেও তাঁরা কম গুরুত্ব দেন না। নয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে আরও বহু গুণী মানুষ নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেছেন। সারা দুনিয়ায় বছরব্যাপী নানা ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার গ্রহণ করে চলেছেন গুণী ও মেধাবী মানুষেরা। তাঁদের তালিকা দিয়ে শেষ করা যাবে না। তবে পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছেন, এ রকম অনেক ব্যতিক্রমী ব্যক্তি রয়েছেন। তাঁরা অনেকটা সার্ত্রের মতোই নিজেদের খর্বাকৃতি করতে চাননি প্রতিষ্ঠানের মাপে।
উত্তর ভিয়েতনামি নেতা লি-ডুক-থো ১৯৭৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ, সে বছর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারকেও শান্তিতে নোবেল দেওয়া হয়েছিল। ভিয়েতনামের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে অন্যায় ও বর্বরতা চালিয়েছে, তারপর তাদের নেতার সঙ্গে কোনো পুরস্কার নেওয়াকেই যুক্তিযুক্ত মনে করেননি লি-ডুক।
মার্কিন অভিনেতা মার্লন ব্রান্ডো ‘গডফাদার’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ১৯৭৩ সালে অস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেয়েও গ্রহণ করেননি। স্থানীয় আমেরিকানদের প্রতি হলিউডের যে আচরণ, তার প্রতিবাদে তিনি পুরস্কারটি ফিরিয়ে দেন। ব্রান্ডো ভালো করেই জানতেন, এই পুরস্কার না নিলেও তিনি ব্রান্ডোই থাকবেন। তা ছাড়া, প্রতিবাদ জানানোটাকে তিনি কর্তব্য মনে করেছিলেন।
১৯৬৯ সালে প্রখ্যাত গায়ক জন লেনন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ‘মেম্বার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ারে’র স্বীকৃতি। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা তিনি পছন্দ করেননি। প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন প্রত্যাখ্যানের ভেতর দিয়ে। এমন গুণীজনদের তালিকা নিঃসন্দেহে ছোট, আবার এটাও ঠিক, এই মানুষগুলোকে আলাদাভাবে স্মরণ করা হয় তাঁদের প্রতিবাদের ভাষার জন্য। যে মানুষ সারা জীবন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে এসেছেন, অবস্থান নিয়েছেন রাষ্ট্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে, তাঁরা যদি জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোনো পুরস্কার গ্রহণ করেন তাহলে তাঁদের আগের কথাবার্তাগুলো ফাঁকা বুলিতে পর্যবসিত হয়। শুধু তা-ই নয়, অনেক সময় প্রতিষ্ঠান কোনো সমস্যা না হলেও, অনেকের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় পুরস্কারটি গৃহীত হবে কার হাত থেকে, সেটি। এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে হুমায়ুন আজাদের প্রবচনরূপী দুটি বাক্যকে—‘শামসুর রাহমানকে একটি অভিনেত্রীর সাথে টিভিতে দেখা গেছে। শামসুর রাহমান বোঝেন না কার সঙ্গে পর্দায়, আর কার সঙ্গে শয্যায় যেতে হয়।’
কোনো খ্যাতিমান মানুষ পুরস্কার পেলেন কি পেলেন না; পুরস্কার গ্রহণ করলেন কি করলেন না, এসব নিয়ে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, হবে। আপনি খ্যাতি অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে সমালোচনা ও মানুষের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিও আপনাকে অনুসরণ করতে থাকবে। মানুষের প্রশংসা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও পুরস্কারের পাশাপাশি নিন্দা, ঘৃণা, অশ্রদ্ধা ও তিরস্কার হাত ধরাধরি করে হাজির হবে আপনার দরজায়। বিষয়টি আসলে নির্ভর করছে সেই ব্যক্তির ওপর, যিনি পুরস্কার গ্রহণ করছেন। তিনি কার দেওয়া পুরস্কার গ্রহণ করছেন, কেন করছেন, কোন পরিস্থিতির ভেতর গ্রহণ করছেন—এসব বিবেচনায় না নিলে অনেক সময় ব্যক্তির অবস্থান স্পষ্ট হয় না। দূর থেকে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।
পুরস্কার অনেকে চাপে পড়ে গ্রহণ করতে পারেন, অনেকটা বাধ্য হয়ে। অনুরোধে ‘পুরস্কার’ গেলার মতো। আবার অনেকে স্বেচ্ছায়, সানন্দে পুরস্কার গ্রহণ করতে পারেন। তিনি ভাবতে পারেন, যাঁরা তাঁকে পুরস্কার দিচ্ছেন, তাঁরা তাঁকে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার জায়গা থেকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। কাজেই তাঁদের তিনি ফিরিয়ে না দিয়ে পুরস্কারটি গ্রহণ করেন। যদি গ্রহণ না করেন, তাহলে পুরস্কারদাতা গোষ্ঠীকে প্রকারান্তরে তিরস্কার করা হয়। ব্যক্তি সম্পর্কের জায়গা থেকে হয়তো অনেকে সেই ‘তিরস্কার’ ছুড়ে দিতে চান না, তাই পুরস্কার গ্রহণ করেন।
এখানে ভুল বোঝার কোনো অবকাশ নেই, আমি পুরস্কার গ্রহণকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখছি না। বরং যে ব্যক্তি পুরস্কার গ্রহণ করছেন, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, অবস্থান ও আন্তঃসম্পর্কের সমীকরণের দিকে নজর দিচ্ছি। একেক ব্যক্তির সমীকরণ একেক রকম। তাঁদের সেই হিসাবনিকাশই ঠিক করে দেয় কোন পুরস্কার তাঁরা নেবেন কিংবা আদৌ পুরস্কার তাঁরা নেবেন কি না, আর নিলেও কার হাত থেকে নেবেন ইত্যাদি। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না, অনেক সময় পুরস্কার খোদ, কারও কারও হাতে উঠে নিজের গৌরব বৃদ্ধি করে। ব্যক্তিটি সমাজে বা বিশ্বে এতটাই সম্মানিত ও বরণীয় যে কোনো কোনো পুরস্কার সেই ব্যক্তির মুকুটে পালক হয়ে নিজে আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এমন নজিরও খুঁজলে পাওয়া যাবে প্রচুর, দেশে ও বিদেশে।
আমাদের দেশে প্রতিবছরই সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি, চলচ্চিত্রসহ বিভিন্ন শাখায় পুরস্কার ঘোষণা হয়, সরকারি ও বেসরকারিভাবে। কোনো কোনো পুরস্কারের ক্ষেত্রে লেখক বা প্রকাশককে স্বপ্রণোদিত হয়ে বই জমা দিতে হয়। এই নিয়মটি আমার মতে একজন লেখকের জন্য অসম্মানের। একজন লেখক কেন পুরস্কারের জন্য নিজ উদ্যোগে প্রতিযোগিতায় শামিল হবেন? কেউ যদি সত্যিকার অর্থেই মনে করেন একজন যোগ্য, তাঁকে তাঁরাই আবিষ্কার করে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক পুরস্কৃত করতে পারেন। অনেক প্রতিষ্ঠান কমিটি গঠনের মাধ্যমে যোগ্য লোক খুঁজে বের করে। সে ক্ষেত্রে আমার মতে অনলাইনের মাধ্যমে সীমিত সময়ের জন্য ভোটিং সিস্টেম চালু করলে মন্দ হয় না। প্রথমে মনোনীত ব্যক্তিদের নাম ঘোষণা হলো, তারপর জনতার ভোটিং, এরপর বিচারকমণ্ডলীর বিবেচনা, সব মিলিয়ে একজনকে চূড়ান্ত নির্বাচিত করে পুরস্কৃত করা যেতে পারে।
পুরস্কার প্রদানের পর আরেকটি রেওয়াজ খুব অসম্মানের। সেটি হলো পুরস্কারপ্রাপ্তরা পেছনে দাঁড়িয়ে থাকবেন, আর দাতারা সামনে সুসজ্জিত কেদারায় বসে থাকবেন। ফটোকল বা ছবি তোলার জন্য আলাদাভাবে জায়গা করে দেওয়া যেতে পারে, যেখানে সসম্মানে পুরস্কৃত ব্যক্তিরা দাঁড়াবেন, একত্রে ও একা, দুইভাবেই। সেই ছবিতে যাঁরা পুরস্কার দিচ্ছেন তাঁদের আর থাকার প্রয়োজন নেই। কারণ, তাঁদের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণের ছবি তো একবার তোলা হচ্ছেই, আবার গ্রুপ ফটোতে তাঁদের না হলেও চলে। পুরস্কার তো প্রতিষ্ঠান দিচ্ছে, কোনো ব্যক্তি নয়। কাজেই প্রতিষ্ঠানের নাম-চিহ্ন আছে সে রকম জমিনের সামনে দাঁড়িয়ে চমৎকার আলোকচিত্র সৃষ্টি করা সম্ভব। পুরস্কারপ্রাপ্তদের জন্য সেটি হবে আরেকটি পুরস্কারের সমান।
কাজেই পুরস্কার প্রদান ও পুরস্কার গ্রহণের পর ছবি তোলার যে রীতি, উভয় ক্ষেত্রেই সংস্কার প্রয়োজন। আমরা জানি, কোনো পুরস্কার বা পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। আমরা এটাও জানি, সবকিছু নিয়েই মানুষ কথা বলতে ভালোবাসে, মানুষ কথা বলবে। যে পুরস্কারের ঐতিহ্য রয়েছে, সেটি নিয়ে মানুষের অনেক মনোযোগ ও অভিযোগ থাকবে। আবার যে মানুষ ঐতিহ্যবাহী কোনো পুরস্কার পান, সেই মানুষকেও ভালোবাসা ও ভর্ৎসনার মুখোমুখি হতে হবে। সব সময় সবার মন জুগিয়ে চলা দুঃসাধ্য কাজ। প্রতিষ্ঠান অনেক সময় অযোগ্য লোকদের পুরস্কার দিয়ে বসে। আবার যোগ্য লোক অনেক সময় তাঁর মাপের চেয়ে ছোট প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার গ্রহণ করে বসেন। তখন সমালোচনার আগুনে ঘি পড়ে। তবে শেষ কথা কি, একজন গুণী মানুষের স্বীকৃতির প্রয়োজন হয়, সে হোক তাঁর ঘরের আপন মানুষের কাছ থেকে, ঘরের বাইরের জনগণের কাছ থেকে, কিংবা কোনো ছোট বা বড় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। কে কোনটাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, সেটা সম্পূর্ণই তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার।
লেখক: বিধান রিবেরু
প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বিলোপের দাবিতে গত বছরের জুলাই মাসে শিক্ষার্থীদের সূচিত আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সরকার পতনের গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। যার পরিণতি ঘটে স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থানে। সে গণ-অভ্যুত্থানে পতনের মুখে দেশ থেকে সপারিষদ পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবসান হয় তাঁর সাড়ে
৯ ঘণ্টা আগেআজ সম্পাদকীয় লেখার অনেক বিষয় ছিল। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে লেখা যেত, বইমেলা নিয়ে লেখা যেত, লেখা যেত দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে। কিন্তু লিখতে গিয়ে আজকের পত্রিকার বিনোদন পাতায় একটি সংবাদের দিকে চোখ আটকে গেল। ১৫ ফেব্রুয়ারি
৯ ঘণ্টা আগেভাষা নিয়ে কিছু বলতে গেলে সে সময়ের সমাজ নিয়েও কথা বলতে হয়। কীভাবে বাংলা ভাষা জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সকলের ভাষা হয়ে উঠল, কীভাবে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনে দেশের জনগণ বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রস্তুত হলো, তার পটভূমি জানা দরকার।
১৫ ঘণ্টা আগেআটচল্লিশ থেকে বায়ান্ন এবং বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি এক মুখ্য গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। স্লোগানগুলো ছিল কখনো গানের ভাষায়, কখনো রাজপথের রুদ্র বাক্যে—‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ অথবা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। কৃষক লাঙল চালাতে চালাতে থমকে দাঁড়ায়, ‘কী ব্যাপার, মুখের ভাষা কাইড়া...
১ দিন আগে