সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
জাতীয়তাবাদে রাজনীতি থাকে, প্রশ্ন থাকে রাষ্ট্র ভাঙা ও গড়ার। ভাষা রাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যায় এবং ভাষার ভেতর নিহিত থাকে যে সম্ভাবনা, তা একাধারে ব্যাপক ও গভীর, কেবল যে গণতান্ত্রিক তা নয়, সমাজতান্ত্রিকও; কেননা ভাষার পরিচয় শ্রেণিকে অতিক্রম করে চলে যেতে পারে, ক্ষমতা রাখে যাওয়ার। আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন গণতান্ত্রিক ছিল, একাধিক অর্থে। প্রথমত, তা পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতর সংখ্যাগরিষ্ঠের অর্থাৎ বাংলাভাষীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। দ্বিতীয়ত, তা বাঙালিদের এক করতে চেয়েছিল শ্রেণি বা সম্প্রদায়গত পরিচয়ে নয়, ভাষাগত পরিচয়ে। সেখানে তার আকাঙ্ক্ষাটা সমাজতান্ত্রিক।
জাতীয়তাবাদকে যাঁরা অপছন্দ করেন, মনে করেন এ হচ্ছে নাগরিকদের গোলাম করে রাখার আরেক কায়দা, তাঁরাও ভাষার উপকারী ভূমিকার ব্যাপারে উৎসাহ প্রকাশ করেছেন। যেমন রুডলফ রকার। তিনি মনে করতেন মানুষের আসল জন্মভূমি হচ্ছে তার ভাষা। বলেছেন, ‘অব অল দ্য এভিডেন্সেস হুইচ হ্যাভ বিন সাইটেড ফর দ্য এক্সিসট্যান্স অব আ ন্যাশনাল আইডিওলজি, কমিউনিটি অব ল্যাঙ্গুয়েজ ইজ বাই ফার দ্য মোস্ট ইমপরটেন্ট’ এবং ‘ইন নাথিং ডাজ দ্য ন্যাশনাল ক্যারেক্টার, দ্য ইমপ্রিন্ট অব দ্য মেন্টাল অ্যান্ড স্পিরিচুয়াল পাওয়ার অব আ পিপল, এক্সপ্রেস ইটসেলফ অ্যাজ ক্লিয়ারলি অ্যাজ ইন ল্যাঙ্গুয়েজ।’
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু পরে সেই জাতীয়তাবাদ পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য থাকেনি। আসলে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ওই ধারণাটা ছিল কৃত্রিম। যে জন্য নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শুরুতেই তার নায়ক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (১৮৭৬-১৯৪৮) বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে ওই রাষ্ট্রে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টানের কোনো ভেদাভেদ থাকবে না, সবাই সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে। কিন্তু তিনি উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে চাইলেন। ভুল করে চাননি, এই চাওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। কেননা তাঁর আকাঙ্ক্ষা ছিল পাকিস্তানের পূর্বাংশের ওপর পশ্চিমাংশ কর্তৃত্ব করবে, এটা দেখার। সেই কর্তৃত্বেরই একটি অস্ত্র ও উপাদান হবে উর্দু ভাষা। এটা অবশ্য বলা হয়েছিল যে বাংলার তুলনায় উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হওয়ার জন্য বেশি যোগ্য, কেননা এই ভাষা ইসলামের অধিকতর নিকটবর্তী। কিন্তু সেটা অজুহাত মাত্র। আসল কথাটা হলো, পূর্বের ওপর পশ্চিমের কর্তৃত্ব।
পশ্চিম ভাবত পূর্বাঞ্চল হবে তাদের উপনিবেশ। বাঙালি মুসলমান পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়েছিল, বস্তুত তাদের ভোটের কারণেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অবিভক্ত ভারতে জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ ছিল মুসলমান, আর সেই মুসলমানদের এক-তৃতীয়াংশ বাস করত বাংলায়, তাই তারা যখন ভোট দিয়ে জানিয়ে দিল যে তারা পাকিস্তান চায়, তখন পাকিস্তানের দাবিকে অবজ্ঞা করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। বাঙালি মুসলমান পাকিস্তান চেয়েছিল সত্য, কিন্তু সেটা ইসলামের জন্য নয়, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য তো নয়ই, চেয়েছিল নিজেদের বৈষয়িক মুক্তির জন্যই। আর ওই মুক্তির পথে মস্ত এক বাধা হিসেবে উর্দু ভাষা দাঁড়িয়ে যাবে বলে আতঙ্ক তৈরি হলো। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত সেই আতঙ্ক থেকেই। এক পরাধীনতার শেষে পূর্ববঙ্গ আরেক পরাধীনতাকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল না।
জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সংকল্প প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন আটচল্লিশ সালের মার্চ মাসে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক মাস পরেই। আর তাঁর ওই ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় সঙ্গে সঙ্গেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায় এবং তাতে মূল সভাপতির ভাষণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯), যা বলেন তা তাঁর একার কথা নয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণির সচেতন অংশেরই বক্তব্য বটে: ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব সত্য। মা-প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছে যে তা মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-শাড়িতে ঢাকার জো-টি নেই।’
পাকিস্তানপন্থী মহলে এই বক্তব্য স্বাভাবিকভাবেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল। এখানে যেটি লক্ষ করার বিষয় সেটা এই যে বাঙালি মুসলমান বাংলা ভাষার জন্য আগে কখনো এমন গভীর ও প্রবল আবেগ অনুভব করেনি। এ ব্যাপারে মনে হয় পশ্চিমবঙ্গের লোকজনেরও ছাড়িয়ে গেল; এই অর্থে যে পশ্চিমবঙ্গের রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য কোনো আন্দোলন হয়নি এবং সেই আন্দোলনের পরিণতিতে স্বতন্ত্র একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি, যেমনটি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তবে বাঙালির জাতিসত্তার মূলে যে বাংলা ভাষা শহীদুল্লাহ-উল্লিখিত এই সত্য কেউই অস্বীকার করেননি। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৯০-১৯৭৭) সঙ্গে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বহু বিষয়ে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে, কিন্তু জাতীয়তাবাদের ভাষাতাত্ত্বিক ভিত্তি সম্পর্কে তাঁরা একমত। ভাষার শক্তি সম্পর্কে তাঁর উল্লেখযোগ্য ‘অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’, (কলকাতা, ১৯২৫) গ্রন্থে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন। প্রসঙ্গটি ছিল আর্যদের আধিপত্যবিষয়ক। সুনীতিকুমার লিখছেন, ‘থ্রু দিজ ভিক্টরি অব হিজ ল্যাঙ্গুয়েজ, দ্য আরিয়ানস (আর্য) গেভ আ ডিসটিংক্ট কালার উইথ হুইচ ইট বিকেম অ্যাসোসিয়েটেড।’ (পৃ. ৪১)
বিজয়ী আর্যরা যে আমাদের এই অঞ্চলের লোকজনকে পক্ষী, পিশাচ, পাপিষ্ঠ, দস্যু, রাক্ষস, দাস, কুকুর, ম্লেচ্ছ, ব্রাত্য ইত্যাদি নামে সম্বোধন করতে পেরেছে, তার প্রধান কারণ রাজনৈতিক, দ্বিতীয় কারণ ভাষাতাত্ত্বিক। এখানকার লোকজন যে ভাষায় কথা বলে, আর্য ব্রাহ্মণেরা তা বোঝেনি। তাই বলার অজুহাত পেয়ে গেছে যে—এরা বর্বর; প্রাচীন গ্রিকরা যেমন মনে করত সকল অ-গ্রিকভাষীকে। গ্রিকরাও আর্যই ছিল, এ ব্যাপারে। আর্যরা নিজদের চিহ্নিত করেছিল ভাষা দিয়েই। সেই ভাষা স্থানীয় লোকদের তারা শেখাতে চায়নি, আবার নিজেরাও যে স্থানীয় ভাষা শিখবে সেই উদারতা দেখায়নি। তার ফল খারাপ হয়নি। ভালোই হয়েছে, কেননা স্থানীয় ভাষা তৈরি হয়েছে, যেসব স্থানীয় ভাষার একটি হচ্ছে আমাদের এই বাংলা ভাষা।
আর এই বাংলা ভাষার কারণেই বাঙালি জাতির বাঙালিত্ব একটি সংজ্ঞাযোগ্য রূপ পেয়েছে। অন্যত্র সুনীতিকুমার যথার্থই বলেছেন, ‘ভাষা না হলে নেশন বা জাতি হতো না।’ এবং ওই প্রসঙ্গেই বলছেন তিনি, ‘বাঙালি জাতি বলিলে যে জনসমষ্টি বাঙ্গালা ভাষাকে মাতৃভাষা রূপে বা ঘরোয়া ভাষা রূপে ব্যবহার করে, সেই জনসমষ্টিকে বুঝি।’ সুকুমার সেনও (১৯০১-৯২) একই কথা বলেছেন: ‘ভাষা নিয়ে জাতি, জাতি নিয়ে দেশ।’ বাংলা ভাষার উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গেই বাঙালি জাতির ইতিহাস শুরু। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন আরও সুন্দর ভাষায়, ‘এতকাল যে আমাদের বাঙালি বলা হয়েছে তার সংজ্ঞা হচ্ছে আমরা বাংলা বলে থাকি। শাসনকর্তারা বাংলা প্রদেশের অংশ প্রত্যাংশ অন্য দেশে জুড়ে দিয়েছেন। কিন্তু সরকারি দফতরের কাঁচিতে তারা ভাষাকে ছেঁটে ফেলতে পারেননি।’
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-৯৯) নানা দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বাংলার কথা যত ভেবেছেন, ভারতের কথা তত ভাবেননি। রামমোহন রায়কে (১৭৭২-১৮৩৩) বলা হয়েছে ‘ভারতপথিক’; যে অর্থে বলা হয়েছে ঠিক সেই অর্থেই বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গপথিক’। তাঁর পত্রিকার নাম ‘বঙ্গদর্শন’, তাঁর ‘বন্দেমাতরম’ গান অন্য প্রদেশের লোকজনও গেয়েছে সত্য, অন্তত রণধ্বনি হিসেবে যে ব্যবহার করেছে তাতে তো সন্দেহই নেই, কিন্তু যে মাতৃমূর্তির বন্দনা গেয়েছেন তিনি, তা বৃহৎ বঙ্গের সপ্তকোটিরই, সর্বভারতের নয়। বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালির কথাই বলতে ভালোবাসতেন। তিনি মনে করতেন, ভাষাই বাঙালির ভরসা। বলেছেন, ‘জাতীয় ঐক্যের মূল ভাষার একতা’ (‘বঙ্গদর্শন’, পৌষ, ১২৮১)। প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬) হালকাভাবে গভীর কথা বলতে পছন্দ করতেন। তিনি বলেছেন, ‘বাঙালি বাঙালি মাত্রেরই স্বজন, তার কারণ ভাষার যোগ হচ্ছে মানস-কায়ে রক্তের যোগ।’ বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) সব সময়েই অতিশয় তীব্র হওয়ার পক্ষপাতী; তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘ভাষা হচ্ছে উন্নতির প্রধান উপায়, লক্ষণ।’
সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী (১৮৬৩-১৯২৯) তাঁর একটি পুস্তিকা ‘দ্য ভারনাকুলার এডুকেশন ইন বেঙ্গল’-এ অভিযোগ করেছিলেন যে ‘বাঙলা সাহিত্য মুসলমানদের পক্ষে আদরণীয় হয়ে ওঠেনি, কারণ এ-সাহিত্যে মুসলমানের জীবন অনুপস্থিত।’ সে বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন, ‘বাঙালি মুসলমানের সহিত বাঙালি হিন্দুর রক্তের সম্বন্ধ আছে এ কথা আমরা যেন না ভুলি।’
জাতীয়তাবাদে রাজনীতি থাকে, প্রশ্ন থাকে রাষ্ট্র ভাঙা ও গড়ার। ভাষা রাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যায় এবং ভাষার ভেতর নিহিত থাকে যে সম্ভাবনা, তা একাধারে ব্যাপক ও গভীর, কেবল যে গণতান্ত্রিক তা নয়, সমাজতান্ত্রিকও; কেননা ভাষার পরিচয় শ্রেণিকে অতিক্রম করে চলে যেতে পারে, ক্ষমতা রাখে যাওয়ার। আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন গণতান্ত্রিক ছিল, একাধিক অর্থে। প্রথমত, তা পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতর সংখ্যাগরিষ্ঠের অর্থাৎ বাংলাভাষীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। দ্বিতীয়ত, তা বাঙালিদের এক করতে চেয়েছিল শ্রেণি বা সম্প্রদায়গত পরিচয়ে নয়, ভাষাগত পরিচয়ে। সেখানে তার আকাঙ্ক্ষাটা সমাজতান্ত্রিক।
জাতীয়তাবাদকে যাঁরা অপছন্দ করেন, মনে করেন এ হচ্ছে নাগরিকদের গোলাম করে রাখার আরেক কায়দা, তাঁরাও ভাষার উপকারী ভূমিকার ব্যাপারে উৎসাহ প্রকাশ করেছেন। যেমন রুডলফ রকার। তিনি মনে করতেন মানুষের আসল জন্মভূমি হচ্ছে তার ভাষা। বলেছেন, ‘অব অল দ্য এভিডেন্সেস হুইচ হ্যাভ বিন সাইটেড ফর দ্য এক্সিসট্যান্স অব আ ন্যাশনাল আইডিওলজি, কমিউনিটি অব ল্যাঙ্গুয়েজ ইজ বাই ফার দ্য মোস্ট ইমপরটেন্ট’ এবং ‘ইন নাথিং ডাজ দ্য ন্যাশনাল ক্যারেক্টার, দ্য ইমপ্রিন্ট অব দ্য মেন্টাল অ্যান্ড স্পিরিচুয়াল পাওয়ার অব আ পিপল, এক্সপ্রেস ইটসেলফ অ্যাজ ক্লিয়ারলি অ্যাজ ইন ল্যাঙ্গুয়েজ।’
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু পরে সেই জাতীয়তাবাদ পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য থাকেনি। আসলে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ওই ধারণাটা ছিল কৃত্রিম। যে জন্য নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শুরুতেই তার নায়ক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (১৮৭৬-১৯৪৮) বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে ওই রাষ্ট্রে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টানের কোনো ভেদাভেদ থাকবে না, সবাই সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে। কিন্তু তিনি উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে চাইলেন। ভুল করে চাননি, এই চাওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। কেননা তাঁর আকাঙ্ক্ষা ছিল পাকিস্তানের পূর্বাংশের ওপর পশ্চিমাংশ কর্তৃত্ব করবে, এটা দেখার। সেই কর্তৃত্বেরই একটি অস্ত্র ও উপাদান হবে উর্দু ভাষা। এটা অবশ্য বলা হয়েছিল যে বাংলার তুলনায় উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হওয়ার জন্য বেশি যোগ্য, কেননা এই ভাষা ইসলামের অধিকতর নিকটবর্তী। কিন্তু সেটা অজুহাত মাত্র। আসল কথাটা হলো, পূর্বের ওপর পশ্চিমের কর্তৃত্ব।
পশ্চিম ভাবত পূর্বাঞ্চল হবে তাদের উপনিবেশ। বাঙালি মুসলমান পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়েছিল, বস্তুত তাদের ভোটের কারণেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অবিভক্ত ভারতে জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ ছিল মুসলমান, আর সেই মুসলমানদের এক-তৃতীয়াংশ বাস করত বাংলায়, তাই তারা যখন ভোট দিয়ে জানিয়ে দিল যে তারা পাকিস্তান চায়, তখন পাকিস্তানের দাবিকে অবজ্ঞা করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। বাঙালি মুসলমান পাকিস্তান চেয়েছিল সত্য, কিন্তু সেটা ইসলামের জন্য নয়, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য তো নয়ই, চেয়েছিল নিজেদের বৈষয়িক মুক্তির জন্যই। আর ওই মুক্তির পথে মস্ত এক বাধা হিসেবে উর্দু ভাষা দাঁড়িয়ে যাবে বলে আতঙ্ক তৈরি হলো। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত সেই আতঙ্ক থেকেই। এক পরাধীনতার শেষে পূর্ববঙ্গ আরেক পরাধীনতাকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল না।
জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সংকল্প প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন আটচল্লিশ সালের মার্চ মাসে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক মাস পরেই। আর তাঁর ওই ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় সঙ্গে সঙ্গেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায় এবং তাতে মূল সভাপতির ভাষণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯), যা বলেন তা তাঁর একার কথা নয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণির সচেতন অংশেরই বক্তব্য বটে: ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব সত্য। মা-প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছে যে তা মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-শাড়িতে ঢাকার জো-টি নেই।’
পাকিস্তানপন্থী মহলে এই বক্তব্য স্বাভাবিকভাবেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল। এখানে যেটি লক্ষ করার বিষয় সেটা এই যে বাঙালি মুসলমান বাংলা ভাষার জন্য আগে কখনো এমন গভীর ও প্রবল আবেগ অনুভব করেনি। এ ব্যাপারে মনে হয় পশ্চিমবঙ্গের লোকজনেরও ছাড়িয়ে গেল; এই অর্থে যে পশ্চিমবঙ্গের রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য কোনো আন্দোলন হয়নি এবং সেই আন্দোলনের পরিণতিতে স্বতন্ত্র একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি, যেমনটি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তবে বাঙালির জাতিসত্তার মূলে যে বাংলা ভাষা শহীদুল্লাহ-উল্লিখিত এই সত্য কেউই অস্বীকার করেননি। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৯০-১৯৭৭) সঙ্গে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বহু বিষয়ে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে, কিন্তু জাতীয়তাবাদের ভাষাতাত্ত্বিক ভিত্তি সম্পর্কে তাঁরা একমত। ভাষার শক্তি সম্পর্কে তাঁর উল্লেখযোগ্য ‘অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’, (কলকাতা, ১৯২৫) গ্রন্থে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন। প্রসঙ্গটি ছিল আর্যদের আধিপত্যবিষয়ক। সুনীতিকুমার লিখছেন, ‘থ্রু দিজ ভিক্টরি অব হিজ ল্যাঙ্গুয়েজ, দ্য আরিয়ানস (আর্য) গেভ আ ডিসটিংক্ট কালার উইথ হুইচ ইট বিকেম অ্যাসোসিয়েটেড।’ (পৃ. ৪১)
বিজয়ী আর্যরা যে আমাদের এই অঞ্চলের লোকজনকে পক্ষী, পিশাচ, পাপিষ্ঠ, দস্যু, রাক্ষস, দাস, কুকুর, ম্লেচ্ছ, ব্রাত্য ইত্যাদি নামে সম্বোধন করতে পেরেছে, তার প্রধান কারণ রাজনৈতিক, দ্বিতীয় কারণ ভাষাতাত্ত্বিক। এখানকার লোকজন যে ভাষায় কথা বলে, আর্য ব্রাহ্মণেরা তা বোঝেনি। তাই বলার অজুহাত পেয়ে গেছে যে—এরা বর্বর; প্রাচীন গ্রিকরা যেমন মনে করত সকল অ-গ্রিকভাষীকে। গ্রিকরাও আর্যই ছিল, এ ব্যাপারে। আর্যরা নিজদের চিহ্নিত করেছিল ভাষা দিয়েই। সেই ভাষা স্থানীয় লোকদের তারা শেখাতে চায়নি, আবার নিজেরাও যে স্থানীয় ভাষা শিখবে সেই উদারতা দেখায়নি। তার ফল খারাপ হয়নি। ভালোই হয়েছে, কেননা স্থানীয় ভাষা তৈরি হয়েছে, যেসব স্থানীয় ভাষার একটি হচ্ছে আমাদের এই বাংলা ভাষা।
আর এই বাংলা ভাষার কারণেই বাঙালি জাতির বাঙালিত্ব একটি সংজ্ঞাযোগ্য রূপ পেয়েছে। অন্যত্র সুনীতিকুমার যথার্থই বলেছেন, ‘ভাষা না হলে নেশন বা জাতি হতো না।’ এবং ওই প্রসঙ্গেই বলছেন তিনি, ‘বাঙালি জাতি বলিলে যে জনসমষ্টি বাঙ্গালা ভাষাকে মাতৃভাষা রূপে বা ঘরোয়া ভাষা রূপে ব্যবহার করে, সেই জনসমষ্টিকে বুঝি।’ সুকুমার সেনও (১৯০১-৯২) একই কথা বলেছেন: ‘ভাষা নিয়ে জাতি, জাতি নিয়ে দেশ।’ বাংলা ভাষার উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গেই বাঙালি জাতির ইতিহাস শুরু। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন আরও সুন্দর ভাষায়, ‘এতকাল যে আমাদের বাঙালি বলা হয়েছে তার সংজ্ঞা হচ্ছে আমরা বাংলা বলে থাকি। শাসনকর্তারা বাংলা প্রদেশের অংশ প্রত্যাংশ অন্য দেশে জুড়ে দিয়েছেন। কিন্তু সরকারি দফতরের কাঁচিতে তারা ভাষাকে ছেঁটে ফেলতে পারেননি।’
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-৯৯) নানা দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বাংলার কথা যত ভেবেছেন, ভারতের কথা তত ভাবেননি। রামমোহন রায়কে (১৭৭২-১৮৩৩) বলা হয়েছে ‘ভারতপথিক’; যে অর্থে বলা হয়েছে ঠিক সেই অর্থেই বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গপথিক’। তাঁর পত্রিকার নাম ‘বঙ্গদর্শন’, তাঁর ‘বন্দেমাতরম’ গান অন্য প্রদেশের লোকজনও গেয়েছে সত্য, অন্তত রণধ্বনি হিসেবে যে ব্যবহার করেছে তাতে তো সন্দেহই নেই, কিন্তু যে মাতৃমূর্তির বন্দনা গেয়েছেন তিনি, তা বৃহৎ বঙ্গের সপ্তকোটিরই, সর্বভারতের নয়। বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালির কথাই বলতে ভালোবাসতেন। তিনি মনে করতেন, ভাষাই বাঙালির ভরসা। বলেছেন, ‘জাতীয় ঐক্যের মূল ভাষার একতা’ (‘বঙ্গদর্শন’, পৌষ, ১২৮১)। প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬) হালকাভাবে গভীর কথা বলতে পছন্দ করতেন। তিনি বলেছেন, ‘বাঙালি বাঙালি মাত্রেরই স্বজন, তার কারণ ভাষার যোগ হচ্ছে মানস-কায়ে রক্তের যোগ।’ বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) সব সময়েই অতিশয় তীব্র হওয়ার পক্ষপাতী; তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘ভাষা হচ্ছে উন্নতির প্রধান উপায়, লক্ষণ।’
সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী (১৮৬৩-১৯২৯) তাঁর একটি পুস্তিকা ‘দ্য ভারনাকুলার এডুকেশন ইন বেঙ্গল’-এ অভিযোগ করেছিলেন যে ‘বাঙলা সাহিত্য মুসলমানদের পক্ষে আদরণীয় হয়ে ওঠেনি, কারণ এ-সাহিত্যে মুসলমানের জীবন অনুপস্থিত।’ সে বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন, ‘বাঙালি মুসলমানের সহিত বাঙালি হিন্দুর রক্তের সম্বন্ধ আছে এ কথা আমরা যেন না ভুলি।’
কোম্পানি শাসনামলে অদ্ভুতভাবে বাংলার সকল মুসলমান হঠাৎ করেই ভাবতে শুরু করল, এককালের শাসকশ্রেণি ছিল তারাই। যে মুসলিম শাসকেরা ব্রিটিশ আমলের আগে শাসন করত, তাদের শাসনামলে স্থানীয় ধর্মান্তরিত মুসলমানেরা যে প্রশাসন বা রাজকার্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, সে কথা আগেই বলা হয়েছে।
৫ ঘণ্টা আগেমাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গভীর পরিবর্তন ঘটেছে। গত আগস্টে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি, এরপর অক্টোবরে চীন ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত চুক্তি এবং গত মাসে দুবাইয়ে ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাৎ—প্রতিটি ঘটনাই এ অঞ্চলের ভূরা
৫ ঘণ্টা আগেএমন একটা সময় ছিল, গলায় হারমোনিয়াম নিয়ে আলোর মানুষ হেঁটে যেতেন কেউ, ঘাসের ওপর পা দিয়ে, সঙ্গে আরও মানুষ। চোখে থাকত ভালোবাসার কথামালা—‘আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্ব ভরা প্রাণ’, বুকের ভেতর আগুন ‘জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’ আর কণ্ঠে সেই প্রিয় সুর, যা হৃদয়ের অদৃশ্য তন্ত্রী থেকে বেজে উঠত, ‘আমি ক
৫ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রথম ‘মরণব্যাধি’ ক্যানসার নিয়ে গবেষণায় উঠে এসেছে ভয়াবহ তথ্য। সেই গবেষণার উপাত্ত থেকে জানা যায়, দেশে বছরে প্রতি লাখ মানুষের মধ্যে নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে ৫৩ জন। বর্তমানে ১ লাখ মানুষের মধ্যে ক্যানসার রোগী রয়েছে ১০৬ জন। আর দেশে মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশের জন্য দায়ী প্রাণঘ
৫ ঘণ্টা আগে