ড. মইনুল ইসলাম
২০২৪-এর ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়ে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, হাসিনাকে প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির নানা অপচেষ্টায় সহায়তা করার ব্যাপারে ভারতের সরকার ও মিডিয়ার সরাসরি সায় রয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, শেখ হাসিনা উৎখাত হয়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে গিয়ে শুধু নিজেকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে চিরতরে মুছে ফেলেননি বরং তিনি বঙ্গবন্ধুকেও এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে সাময়িকভাবে হলেও নির্বাসিত করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। আওয়ামী লীগের লাখ লাখ নেতা-কর্মীকেও তিনি ফ্যাসিবাদের দোসর বানিয়ে বেলাগাম দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের ঘৃণিত প্রতীকে পরিণত করে পতনের ও বিপর্যয়ের গহ্বরে নিক্ষেপ করেছেন। এই গিরিখাত থেকে আওয়ামী লীগ আদৌ মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসতে পারবে কী? আগামী এক দশকের মধ্যে আওয়ামী লীগ এ দেশের রাজনীতিতে আবার অন্যতম প্রধান দলে পরিণত হওয়ার ভালো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন না ওয়াকিবহাল মহল। কাউকে কাউকে অধুনালুপ্ত মুসলিম লীগের মতো আওয়ামী লীগেরও চিরতরে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করতে শোনা যাচ্ছে। আমি অবশ্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার সংগ্রামে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ঐতিহাসিক নেতৃত্বদানের বিবেচনায় ইতিহাস থেকে এই দুটো সংগঠনের চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার তত্ত্বকে সমর্থন করি না। কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে বলছি, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে পুনর্গঠিত করার যেকোনো উদ্যোগ নিতে হবে পতিত স্বৈরশাসক হাসিনা, তাঁর পরিবার ও আত্মীয়স্বজন, তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, আমলা ও পুঁজি লুটেরা অলিগার্ক ব্যবসায়ীদের দল থেকে সম্পূর্ণভাবে ছুড়ে ফেলার মাধ্যমে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, পতনের বিপর্যয়কর গহ্বর থেকে মুক্ত হয়ে এবং অসহনীয় মানসিক ও আর্থিক আঘাত কাটিয়ে উঠে আওয়ামী লীগের অতি ক্ষুদ্র অংশই পারবে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ও সাহস সঞ্চয় করতে।
অনেকগুলো প্রতারণামূলক কায়দা-কানুন অনুসরণ করে হাসিনা সরকার এ দেশের জনগণের উচ্চ মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দেখানোর ব্যবস্থা করত, যা অর্থনীতির প্রকৃত গতিশীলতা ও সুস্বাস্থ্যের প্রতিফলন ছিল না। তাত্ত্বিকভাবে জিডিপি হলো: (ভোগ ব্যয়+বিনিয়োগ ব্যয়+সরকারি ব্যয়+রপ্তানি আয়+আমদানি ব্যয়)। বিনিয়োগ ব্যয় দেশের সঞ্চিত পুঁজি থেকে হয়েছে, নাকি বৈদেশিক ঋণের অর্থে হয়েছে, সেটা এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য নয়, উভয় ক্ষেত্রেই জিডিপি বাড়ার ক্ষেত্রে কোনো তারতম্য হয় না। তেমনিভাবে সরকারি ব্যয় সরকারি রাজস্বের অর্থায়নে হয়েছে, নাকি দেশীয় অভ্যন্তরীণ ঋণ ও বৈদেশিক ঋণের অর্থায়নে হয়েছে, সেটাও জিডিপিতে সরকারি ব্যয়ের অবদান নির্ধারণে তারতম্য সৃষ্টি করে না। হাসিনার সরকার সাড়ে ১৫ বছর ধরে যেনতেনভাবে অজস্র অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ করে বিনিয়োগ ব্যয় ও সরকারি ব্যয় বাড়ানোর নীতি বাস্তবায়ন করায় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রতিবছর উচ্চস্তরে দেখানো যাচ্ছিল, যা মোটেও টেকসই প্রবৃদ্ধি ছিল না। বৈদেশিক ঋণ নেওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগ ব্যয় এক দশক ধরে প্রতিবছর জিডিপির অনুপাত হিসাবে ২৩-২৪ শতাংশে ঘুরপাক খাচ্ছে। সরকারি খাতে অজস্র ঋণ করে ঘি খাওয়ার মতো অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণের অর্থ ব্যয় করায় জিডিপি বেড়ে গেছে। সরকারি রাজস্ব আহরণ এ দেশে কমতে কমতে জিডিপির শতাংশ হিসেবে ৮ শতাংশে নেমে যাওয়া সত্ত্বেও বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণের অর্থে প্রতিবছর সরকারি ব্যয় বাড়ানোয় জিডিপি দ্রুত বেড়ে গেছে। ঋণ বাড়িয়ে সরকারি ব্যয় বাড়ালে তা জিডিপিকে বাড়িয়ে দেয়, সরকারি ঋণ বাড়লে জিডিপি কমে না।
গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে হাসিনা ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বিশাল ঋণের সাগরে দেশের জনগণকে নিমজ্জিত করে প্রতিবছর মাথাপিছু জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে চলেছিলেন, যা ছিল ‘নিকৃষ্টতম শুভংকরের ফাঁকি’ ও জনগণের সঙ্গে ভয়ানক প্রতারণা।
২০২৪ সালে প্রত্যেক বাংলাদেশির ঋণের বোঝা ১ লাখ টাকার বেশি। হাসিনার শাসনামলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার অজুহাতে একের পর এক মেগা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পাশাপাশি সারা দেশে বাস্তবায়িত হয়েছে শত শত উন্নয়ন প্রকল্প। প্রতিটি মেগা প্রকল্পে প্রকৃত ব্যয়ের তিন-চার গুণ বেশি দেখানোর মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে লাখ লাখ কোটি টাকা, যে জন্য এসব প্রকল্পের ব্যয় ‘বিশ্বের সর্বোচ্চ’ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল যখন পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন, তখন থেকেই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে ‘ডেটা ডক্টরিং’-এর কেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁর নির্দেশে ওই সময় থেকে ডেটা ডক্টরিংয়ের সহায়তায় মোট জিডিপিকে বাড়িয়ে দেখানো এবং মোট জনসংখ্যাকে কমিয়ে দেখানো পরিসংখ্যান ব্যুরোর খাসলতে পরিণত হয়েছিল। পরিকল্পনামন্ত্রীর নির্দেশে ২০১৪ সাল থেকে এহেন বানোয়াট (ম্যানুফেকচারড) তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে প্রতিবছর বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি বাড়িয়ে দেখিয়েছে পরিসংখ্যান ব্যুরো। এক দশক ধরে উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে কাহিনি প্রচার করে হাসিনার সরকার দেশ-বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছিল, তার সিংহভাগই ছিল ভুয়া ও ভিত্তিহীন।
হাসিনার পতিত স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে ১৫ বছর ধরে দেশটাকে লুটেপুটে ছারখার করে দিয়েছে, যে অর্থের সিংহভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের পুত্র সোহেল তাজ অভিযোগ করেছেন, ২০০৯ সালেই শেখ হাসিনা বলেছিলেন ‘বিএনপি অনেক টাকা কামিয়েছে। এখন আমাদেরকে দুই হাতে টাকা বানাতে হবে।’ এই বক্তব্য থেকে অকাট্য প্রমাণ মিলছে যে ২০০৯ সাল থেকেই হাসিনার নির্দেশে আওয়ামী লীগ দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনে নির্বিচারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, যার কারণে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের প্রায় সব নেতা-কর্মীই সাড়ে ১৫ বছরে কোনো না কোনোভাবে অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কোটিপতি হওয়ার মিশনে অংশগ্রহণ করেছে। স্বৈরশাসক হাসিনার পতনের পর ইতিমধ্যেই সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্পকারখানাগুলো হয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, নয়তো লুটতরাজ ও ভাঙচুরের কবলে পড়ে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। অনেক আওয়ামী কোটিপতি এরই মধ্যে পথের ভিখারি হয়ে পড়েছেন বলে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে। হাসিনা ও তাঁর পরিবার-আত্মীয়স্বজন হয়তো বিদেশে পাচার করা অর্থে আরাম-আয়েশে দিন গুজরান করতে পারবে, কিন্তু লাখ লাখ আওয়ামী নেতা-কর্মীদের জীবন আরও বহুদিন ধরে দুর্বিষহ দারিদ্র্যপীড়িত হয়ে থাকবে নিশ্চিতভাবে। এহেন পরিণতি আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে বরণ করতে হবে, সেটা কি কেউ স্বপ্নেও ভেবেছিল!
শেখ হাসিনাকে প্রথম বিচারের সম্মুখীন হতে হবে ৮০০-এর বেশি মানুষকে হত্যার মামলায়। এর সঙ্গে থাকবে দুই হাজারের বেশি মানুষকে আহত, অন্ধ ও পঙ্গু করার মামলাগুলো। এরপর আসবে গুমের মামলা এবং কয়েক লাখ কোটি টাকা লুটপাট ও বিদেশে পাচারের অভিযোগে করা মামলাগুলোর বিচারপর্ব। তাঁর পরিবার ও আত্মীয়স্বজন, তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীরা এবং আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতা-কর্মী যাঁরা এই লুটপাটে অংশগ্রহণকারী, তাঁদেরও আগামী কয়েক বছর হয় দেশে-বিদেশে পালিয়ে থাকতে হবে, নয়তো জেলহাজতে বন্দী থেকে মামলাগুলো সামলাতে গলদঘর্ম হতে হবে।
তাই আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন করার জন্য জেলের বাইরে থাকা দুর্নীতিমুক্ত ও লুটপাটের মামলার হয়রানি থেকে মুক্ত নেতা-কর্মীর সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা কয়েকজনে সীমিত হওয়ার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এমনকি, যাঁরাই আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে রাতারাতি নতুন মামলা করার আশঙ্কা থাকবে নিশ্চিতভাবে। এনসিপির নেতারা (অধুনালুপ্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা) সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়াবে এভাবে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের পুনরুত্থান প্রয়াসকে নস্যাৎ করার জন্য। তবে প্রত্যক্ষভাবে আওয়ামী লীগের হাল ধরার ঝুঁকি আদৌ কেউ নেবেন কি না, সেটা বলা কঠিন। এর মানে, আগামী এক-দেড় বছর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য কারও মাঠে নামার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলতেই হবে। অন্যদিকে, হাসিনা খুব জোরেশোরে চেষ্টা চালিয়ে যাবেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কেবল তাঁর হাতে রেখে দেওয়ার জন্য। তাঁর বিরোধিতা করে সহজে অন্য কাউকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দখল করতে দেবেন না তিনি। আওয়ামী লীগের অল্প কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি যাঁরা দুর্নীতিমুক্ত হিসেবে দেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারেন, তাঁরা কেউ নেতৃত্বে আসার ব্যাপারে হাসিনার সমর্থন পাবেন না। সোশ্যাল মিডিয়ায় শিরীন শারমিন চৌধুরী, সোহেল তাজ, সাবের হোসেন চৌধুরী, সেলিনা হায়াৎ আইভী কিংবা সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের নাম মাঝেমধ্যে শোনা গেলেও তাঁদের কাউকেই প্রকাশ্যে নেতৃত্ব ছেড়ে দেবেন না শেখ হাসিনা। তাঁরাও হাসিনাকে সরাসরি দল থেকে ঝেড়ে ফেলে নেতৃত্ব গ্রহণের ঝুঁকি নেবেন বলে মনে হয় না।
২০২৪-এর ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়ে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, হাসিনাকে প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির নানা অপচেষ্টায় সহায়তা করার ব্যাপারে ভারতের সরকার ও মিডিয়ার সরাসরি সায় রয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, শেখ হাসিনা উৎখাত হয়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে গিয়ে শুধু নিজেকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে চিরতরে মুছে ফেলেননি বরং তিনি বঙ্গবন্ধুকেও এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে সাময়িকভাবে হলেও নির্বাসিত করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। আওয়ামী লীগের লাখ লাখ নেতা-কর্মীকেও তিনি ফ্যাসিবাদের দোসর বানিয়ে বেলাগাম দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের ঘৃণিত প্রতীকে পরিণত করে পতনের ও বিপর্যয়ের গহ্বরে নিক্ষেপ করেছেন। এই গিরিখাত থেকে আওয়ামী লীগ আদৌ মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসতে পারবে কী? আগামী এক দশকের মধ্যে আওয়ামী লীগ এ দেশের রাজনীতিতে আবার অন্যতম প্রধান দলে পরিণত হওয়ার ভালো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন না ওয়াকিবহাল মহল। কাউকে কাউকে অধুনালুপ্ত মুসলিম লীগের মতো আওয়ামী লীগেরও চিরতরে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করতে শোনা যাচ্ছে। আমি অবশ্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার সংগ্রামে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ঐতিহাসিক নেতৃত্বদানের বিবেচনায় ইতিহাস থেকে এই দুটো সংগঠনের চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার তত্ত্বকে সমর্থন করি না। কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে বলছি, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে পুনর্গঠিত করার যেকোনো উদ্যোগ নিতে হবে পতিত স্বৈরশাসক হাসিনা, তাঁর পরিবার ও আত্মীয়স্বজন, তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, আমলা ও পুঁজি লুটেরা অলিগার্ক ব্যবসায়ীদের দল থেকে সম্পূর্ণভাবে ছুড়ে ফেলার মাধ্যমে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, পতনের বিপর্যয়কর গহ্বর থেকে মুক্ত হয়ে এবং অসহনীয় মানসিক ও আর্থিক আঘাত কাটিয়ে উঠে আওয়ামী লীগের অতি ক্ষুদ্র অংশই পারবে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ও সাহস সঞ্চয় করতে।
অনেকগুলো প্রতারণামূলক কায়দা-কানুন অনুসরণ করে হাসিনা সরকার এ দেশের জনগণের উচ্চ মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দেখানোর ব্যবস্থা করত, যা অর্থনীতির প্রকৃত গতিশীলতা ও সুস্বাস্থ্যের প্রতিফলন ছিল না। তাত্ত্বিকভাবে জিডিপি হলো: (ভোগ ব্যয়+বিনিয়োগ ব্যয়+সরকারি ব্যয়+রপ্তানি আয়+আমদানি ব্যয়)। বিনিয়োগ ব্যয় দেশের সঞ্চিত পুঁজি থেকে হয়েছে, নাকি বৈদেশিক ঋণের অর্থে হয়েছে, সেটা এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য নয়, উভয় ক্ষেত্রেই জিডিপি বাড়ার ক্ষেত্রে কোনো তারতম্য হয় না। তেমনিভাবে সরকারি ব্যয় সরকারি রাজস্বের অর্থায়নে হয়েছে, নাকি দেশীয় অভ্যন্তরীণ ঋণ ও বৈদেশিক ঋণের অর্থায়নে হয়েছে, সেটাও জিডিপিতে সরকারি ব্যয়ের অবদান নির্ধারণে তারতম্য সৃষ্টি করে না। হাসিনার সরকার সাড়ে ১৫ বছর ধরে যেনতেনভাবে অজস্র অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ করে বিনিয়োগ ব্যয় ও সরকারি ব্যয় বাড়ানোর নীতি বাস্তবায়ন করায় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রতিবছর উচ্চস্তরে দেখানো যাচ্ছিল, যা মোটেও টেকসই প্রবৃদ্ধি ছিল না। বৈদেশিক ঋণ নেওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগ ব্যয় এক দশক ধরে প্রতিবছর জিডিপির অনুপাত হিসাবে ২৩-২৪ শতাংশে ঘুরপাক খাচ্ছে। সরকারি খাতে অজস্র ঋণ করে ঘি খাওয়ার মতো অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণের অর্থ ব্যয় করায় জিডিপি বেড়ে গেছে। সরকারি রাজস্ব আহরণ এ দেশে কমতে কমতে জিডিপির শতাংশ হিসেবে ৮ শতাংশে নেমে যাওয়া সত্ত্বেও বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণের অর্থে প্রতিবছর সরকারি ব্যয় বাড়ানোয় জিডিপি দ্রুত বেড়ে গেছে। ঋণ বাড়িয়ে সরকারি ব্যয় বাড়ালে তা জিডিপিকে বাড়িয়ে দেয়, সরকারি ঋণ বাড়লে জিডিপি কমে না।
গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে হাসিনা ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বিশাল ঋণের সাগরে দেশের জনগণকে নিমজ্জিত করে প্রতিবছর মাথাপিছু জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে চলেছিলেন, যা ছিল ‘নিকৃষ্টতম শুভংকরের ফাঁকি’ ও জনগণের সঙ্গে ভয়ানক প্রতারণা।
২০২৪ সালে প্রত্যেক বাংলাদেশির ঋণের বোঝা ১ লাখ টাকার বেশি। হাসিনার শাসনামলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার অজুহাতে একের পর এক মেগা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পাশাপাশি সারা দেশে বাস্তবায়িত হয়েছে শত শত উন্নয়ন প্রকল্প। প্রতিটি মেগা প্রকল্পে প্রকৃত ব্যয়ের তিন-চার গুণ বেশি দেখানোর মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে লাখ লাখ কোটি টাকা, যে জন্য এসব প্রকল্পের ব্যয় ‘বিশ্বের সর্বোচ্চ’ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল যখন পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন, তখন থেকেই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে ‘ডেটা ডক্টরিং’-এর কেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁর নির্দেশে ওই সময় থেকে ডেটা ডক্টরিংয়ের সহায়তায় মোট জিডিপিকে বাড়িয়ে দেখানো এবং মোট জনসংখ্যাকে কমিয়ে দেখানো পরিসংখ্যান ব্যুরোর খাসলতে পরিণত হয়েছিল। পরিকল্পনামন্ত্রীর নির্দেশে ২০১৪ সাল থেকে এহেন বানোয়াট (ম্যানুফেকচারড) তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে প্রতিবছর বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি বাড়িয়ে দেখিয়েছে পরিসংখ্যান ব্যুরো। এক দশক ধরে উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে কাহিনি প্রচার করে হাসিনার সরকার দেশ-বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছিল, তার সিংহভাগই ছিল ভুয়া ও ভিত্তিহীন।
হাসিনার পতিত স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে ১৫ বছর ধরে দেশটাকে লুটেপুটে ছারখার করে দিয়েছে, যে অর্থের সিংহভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের পুত্র সোহেল তাজ অভিযোগ করেছেন, ২০০৯ সালেই শেখ হাসিনা বলেছিলেন ‘বিএনপি অনেক টাকা কামিয়েছে। এখন আমাদেরকে দুই হাতে টাকা বানাতে হবে।’ এই বক্তব্য থেকে অকাট্য প্রমাণ মিলছে যে ২০০৯ সাল থেকেই হাসিনার নির্দেশে আওয়ামী লীগ দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনে নির্বিচারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, যার কারণে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের প্রায় সব নেতা-কর্মীই সাড়ে ১৫ বছরে কোনো না কোনোভাবে অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কোটিপতি হওয়ার মিশনে অংশগ্রহণ করেছে। স্বৈরশাসক হাসিনার পতনের পর ইতিমধ্যেই সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্পকারখানাগুলো হয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, নয়তো লুটতরাজ ও ভাঙচুরের কবলে পড়ে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। অনেক আওয়ামী কোটিপতি এরই মধ্যে পথের ভিখারি হয়ে পড়েছেন বলে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে। হাসিনা ও তাঁর পরিবার-আত্মীয়স্বজন হয়তো বিদেশে পাচার করা অর্থে আরাম-আয়েশে দিন গুজরান করতে পারবে, কিন্তু লাখ লাখ আওয়ামী নেতা-কর্মীদের জীবন আরও বহুদিন ধরে দুর্বিষহ দারিদ্র্যপীড়িত হয়ে থাকবে নিশ্চিতভাবে। এহেন পরিণতি আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে বরণ করতে হবে, সেটা কি কেউ স্বপ্নেও ভেবেছিল!
শেখ হাসিনাকে প্রথম বিচারের সম্মুখীন হতে হবে ৮০০-এর বেশি মানুষকে হত্যার মামলায়। এর সঙ্গে থাকবে দুই হাজারের বেশি মানুষকে আহত, অন্ধ ও পঙ্গু করার মামলাগুলো। এরপর আসবে গুমের মামলা এবং কয়েক লাখ কোটি টাকা লুটপাট ও বিদেশে পাচারের অভিযোগে করা মামলাগুলোর বিচারপর্ব। তাঁর পরিবার ও আত্মীয়স্বজন, তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীরা এবং আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতা-কর্মী যাঁরা এই লুটপাটে অংশগ্রহণকারী, তাঁদেরও আগামী কয়েক বছর হয় দেশে-বিদেশে পালিয়ে থাকতে হবে, নয়তো জেলহাজতে বন্দী থেকে মামলাগুলো সামলাতে গলদঘর্ম হতে হবে।
তাই আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন করার জন্য জেলের বাইরে থাকা দুর্নীতিমুক্ত ও লুটপাটের মামলার হয়রানি থেকে মুক্ত নেতা-কর্মীর সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা কয়েকজনে সীমিত হওয়ার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এমনকি, যাঁরাই আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে রাতারাতি নতুন মামলা করার আশঙ্কা থাকবে নিশ্চিতভাবে। এনসিপির নেতারা (অধুনালুপ্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা) সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়াবে এভাবে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের পুনরুত্থান প্রয়াসকে নস্যাৎ করার জন্য। তবে প্রত্যক্ষভাবে আওয়ামী লীগের হাল ধরার ঝুঁকি আদৌ কেউ নেবেন কি না, সেটা বলা কঠিন। এর মানে, আগামী এক-দেড় বছর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য কারও মাঠে নামার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলতেই হবে। অন্যদিকে, হাসিনা খুব জোরেশোরে চেষ্টা চালিয়ে যাবেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কেবল তাঁর হাতে রেখে দেওয়ার জন্য। তাঁর বিরোধিতা করে সহজে অন্য কাউকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দখল করতে দেবেন না তিনি। আওয়ামী লীগের অল্প কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি যাঁরা দুর্নীতিমুক্ত হিসেবে দেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারেন, তাঁরা কেউ নেতৃত্বে আসার ব্যাপারে হাসিনার সমর্থন পাবেন না। সোশ্যাল মিডিয়ায় শিরীন শারমিন চৌধুরী, সোহেল তাজ, সাবের হোসেন চৌধুরী, সেলিনা হায়াৎ আইভী কিংবা সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের নাম মাঝেমধ্যে শোনা গেলেও তাঁদের কাউকেই প্রকাশ্যে নেতৃত্ব ছেড়ে দেবেন না শেখ হাসিনা। তাঁরাও হাসিনাকে সরাসরি দল থেকে ঝেড়ে ফেলে নেতৃত্ব গ্রহণের ঝুঁকি নেবেন বলে মনে হয় না।
বিশ্ববাণিজ্যের বাস্তবতা দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রতিটি দেশের সরকার তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা ও অভ্যন্তরীণ বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আমদানি ও রপ্তানির ওপর বিভিন্ন ধরনের শুল্ক বা কর আরোপ করে থাকে।
১৮ ঘণ্টা আগে৫ আগস্টের পর থেকে আমরা ঢাকাসহ সারা দেশেই জাস্টিসের নমুনা দেখেছি। কিছু লোক একত্রে জড়ো হয়ে একটি গুজব ছড়িয়ে, কোনো ব্যক্তির ওপর চড়াও হয়ে তাকে শারীরিকভাবে আঘাত করে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেরে ফেলে।
১৮ ঘণ্টা আগেসিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিএমইউ) উপাচার্যদের একের পর এক অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা বিশ্ববিদ্যালয়টির ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় উপাচার্যের বিতর্কিত নিয়োগ ও কর্মকাণ্ডের পর বর্তমান উপাচার্যও যেন সেই পথেই হাঁটছেন।
১৮ ঘণ্টা আগেগতকাল বিকেল ৪টা ৩৬ মিনিটে দেশের এক প্রভাবশালী নেতার হাঁচি রাজনীতিতে নতুন ঝড় তুলেছে। হাঁচি সাধারণত শারীরিক প্রতিক্রিয়া হলেও, যেহেতু এটি একজন জাতীয় নেতার মুখ থেকে এসেছে...
১ দিন আগে