Ajker Patrika

ঝিলাম নদীর কান্নায় বাংলাদেশের উদ্বেগ

জুবায়ের হাসান
জুবায়ের হাসান। ছবি: সংগৃহীত
জুবায়ের হাসান। ছবি: সংগৃহীত

কাশ্মীরের বুক চিরে বয়ে চলেছে ঝিলাম নদী। কাশ্মীর উপত্যকা হলো ঝিলামের উত্তর ভাগের অংশ। উপত্যকাটি ১৩৭ কিলোমিটার লম্বা এবং ৩০ থেকে ৪০ কিমি চওড়া। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কারণে কাশ্মীরকে বলা হয় ভূস্বর্গ। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর্ষণে সেখানে অনেকে বেড়াতে যান। ১৯৪৭ সালের আগে কেউ ভাবতে পারেননি যে কাশ্মীর হয়ে উঠবে একদিন ভয়াবহ রণক্ষেত্র। আর সেখানে সমাবেশ ঘটবে বিপুল সৈন্যের।

এই কাশ্মীর উপত্যকায় একসময় ছিল বাংলাদেশের মতোই একটা মুসলিম স্বাধীন সালতানাত, যা প্রতিষ্ঠা করেন শাহ মির্জা, ১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দে। মির্জা ছিলেন একজন ভাগ্যান্বেষী ব্যক্তি। তিনি বর্তমান পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের সোয়াত অঞ্চল থেকে যান কাশ্মীরে। তিনি নিজ যোগ্যতাবলে হয়ে ওঠেন কাশ্মীরের হিন্দু রাজার খুব বিশ্বস্ত উচ্চপদস্থ কর্মচারী। পরে রাজার মৃত্যু হলে তিনি হন কাশ্মীরের শাসক, যাকে বলা হয় সুলতান। তিনি বিয়ে করেন কাশ্মীরের বিধবা রানিকে। ১৩৪৬ সালে সুলতান শাহ মির্জার প্রতিষ্ঠিত সেই সালতানাতের মুসলিম সুলতানেরা তখন থেকে প্রায় আড়াই শ বছর কাশ্মীর শাসন করেন। এরপর কাশ্মীরের সুলতানের হাত থেকে সম্রাট আকবর কাশ্মীর দখল করেন ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে। ফলে কাশ্মীর চলে যায় মোগল সম্রাটদের নিয়ন্ত্রণে। কাশ্মীরে দীর্ঘকাল একটি স্বাধীন মুসলিম সালতানাত থাকার কারণে সে সময় সেখানে গড়ে উঠেছিল পৃথক জাতীয় বৈশিষ্ট্য। কাশ্মীরের মুসলমানরা ঘরে বলে কাশ্মীরি ভাষা; কিন্তু এখন তাঁদের সাংস্কৃতিক ভাষা হলো উর্দু। তবে এই উর্দুকে বলা হয় কাশ্মীরি উর্দু।

পঞ্চদশ শতাব্দীতে ভারত যখন লোদি বংশের মুসলিম শাসনাধীন ছিল, তখন শিখ ধর্মের উদ্ভব ও বিস্তার ঘটতে থাকে। শিখ ধর্মের প্রবর্তক হলেন গুরু নানক (জন্ম-মৃত্যু: ১৪৬৯-১৫৩৯ খ্রিষ্টাব্দ)। তাঁর প্রচেষ্টায় সে সময় পাঞ্জাব এবং এর আশপাশ অঞ্চলের বিপুলসংখ্যক লোক শিখ ধর্মমত গ্রহণ করেন। একসময় পাঞ্জাবের শিখ রাজা রণজিৎ সিংয়ের (১৭৮০-১৮৩৯) নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল বিরাট একটা শিখ সাম্রাজ্য; যার রাজধানী ছিল লাহোর। মোগল সম্রাজ্যের পতনের যুগে তাদের হাত থেকে এই শিখ রাজা রণজিৎ সিং কাশ্মীর দখল করেন ১৮১৯-১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে। আর তাঁর প্রধান সেনাপতি গুলাব সিং জয় করেন জম্মু। রণজিৎ সিং ধর্মের দিক থেকে গোঁড়া শিখ হলেও তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি গুলাব সিং ছিলেন পাঞ্জাবি ডোগরা হিন্দু। তিনি গুলাব সিংকে দেন জম্মু শাসনের ভার।

শিখ রাজা রণজিৎ সিংয়ের মৃত্যুর পর ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি পাঞ্জাব দখল করে ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে। অতঃপর ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কাশ্মীর দখল করে। জম্মুর হিন্দু রাজা গুলাব সিং ওই যুদ্ধে থাকেন নিরপেক্ষ। এ সময় গুলাব সিং ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে কাশ্মীর কিনে নেন ১০ লাখ স্টার্লিং পাউন্ড দিয়ে। সে সময় থেকে তিনি হন জম্মু-কাশ্মীরের করদ মহারাজা এবং ইংরেজদের মিত্র। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে যাওয়ার প্রাক্কালে জম্মু-কাশ্মীরের হিন্দু রাজা ছিলেন গুলাব সিংয়ের বংশের স্যার হরি সিং। তিনি কাশ্মীরকে ভারতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। হরি সিং ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে যোগ দেন ভারতীয় ইউনিয়নে। ফলে কাশ্মীর নিয়ে বাধে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ।

ব্রিটিশ শাসনামলে ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্য ছিল দুটি অংশে বিভক্ত। এক ভাগকে বলা হতো ব্রিটিশ ভারত, যা চলত সরাসরি ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে। আর অন্য অংশকে বলা হতো দেশীয় রাজাদের শাসিত অংশ, যা ছিল মূলত করদ রাজ্য। করদ রাজ্যের রাজারা ব্রিটিশ প্রশাসনকে প্রতিবছর নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদানের বিনিময়ে তাদের রাজ্য এক প্রকার স্বাধীনভাবেই শাসন করত। ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যে এ ধরনের করদ রাজ্যের সংখ্যা ছোট-বড় মিলিয়ে ছিল প্রায় ৫৮৪টি, যা ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের মোট আয়তনের প্রায় ৫ ভাগের ২ ভাগ। কাশ্মীর ছিল এমনই দেশীয় রাজাদের শাসনের অধীন একটি করদ রাজ্য। ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় প্রশ্ন ওঠে, ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হলে এসব করদ রাজ্য ও দেশীয় রাজাদের অবস্থা কী দাঁড়াবে। সিদ্ধান্ত হয়, দেশীয় রাজারা তাদের আপন ইচ্ছা-মর্জিতে ভারতে অথবা পাকিস্তানে যোগ দিতে পারবেন, কিংবা থাকতে পারবেন স্বাধীন।

ভারতের বর্তমান গুজরাট রাজ্যের অধীন জুনাগড় ছিল ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের একটি করদ রাজ্য। সে সময় জুনাগড়ের শাসক ছিলেন মুসলমান। কিন্তু বেশির ভাগ প্রজা ছিলেন হিন্দু। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের সময় জুনাগড়ের শাসক (নবাব) পাকিস্তানে যোগ দেন। কিন্তু ভারত জুনাগড় দখল করে এই যুক্তিতে যে জুনাগড় হিন্দুপ্রধান এবং তা পাকিস্তান থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। দক্ষিণ ভারতে বিরাট আরেকটি ব্রিটিশ করদ রাজ্য ছিল হায়দরাবাদ। একে শাসন করতেন মুসলমান নবাব (হায়দরাবাদের নিজাম)। ১৯৪৭ সালে হায়দরাবাদের নিজাম ভারত কিংবা পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে স্বাধীন থাকতে চান। কিন্তু ভারত এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ১৯৪৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর হায়দরাবাদ আক্রমণ করে। ভারতীয় আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে হায়দরাবাদের নিজামের সেনাবাহিনী এবং হায়দরাবাদের মুসলমানদের নিয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী সম্মিলিতভাবে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তবে ৬ দিনের মধ্যেই ভারতীয় সৈন্যবাহিনী হায়দরাবাদ দখল করে নেয়। নিহত হয় অনেক মুসলমান। এভাবে উৎখাত করা হয় হায়দরাবাদের ৬০০ বছরের মুসলমান শাসন। ২ লাখ ১৪ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনসংবলিত সেকালের বিশাল হায়দরাবাদ রাজ্য এখন ভারতের দক্ষিণের তিন রাজ্য তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের মধ্যে বিভক্ত হয়ে বিলীন হয়েছে।

১৯৪৭ সালে কাশ্মীরের হিন্দু রাজা হরি সিং যোগ দিয়েছিলেন ভারতে। কিন্তু কাশ্মীরের বেশির ভাগ প্রজাই ছিলেন মুসলমান এবং তাঁদের আবাসভূমি পাকিস্তানের সঙ্গে লাগোয়া। কাশ্মীরের মুসলমানরা রাজা হরি সিংয়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আর তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে আসে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া অঞ্চলের পাঠান সৈন্যরা। পাকিস্তান সেনাবাহিনী দখলে নিয়ে নেয় কাশ্মীরের বিশাল এক অংশ। পৌঁছে যায় শ্রীনগরের উপকণ্ঠে। এভাবেই কাশ্মীর নিয়ে শুরু হয়েছিল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরু কাশ্মীর সমস্যাকে সমাধানের জন্য নিয়ে যান জাতিসংঘে। পাকিস্তান কাশ্মীর সমস্যাকে জাতিসংঘে নিয়ে যায়নি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বলে যুদ্ধবিরতি করতে এবং কাশ্মীরে গণভোটের মাধ্যমে গণ-অভিমত (Plebiscite) গ্রহণ করতে। নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের ফলে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত হয় এবং দেশ দুটির মধ্যে স্থির হয় একটি যুদ্ধবিরোধী রেখা। এটাই হলো কাশ্মীরকে বিভাজনকারী সীমান্তরেখা লাইন অব কন্ট্রোল (এলওসি)। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৭ সালের মধ্যে মোট পাঁচবার প্রস্তাব পাস করে বলে দেয় যে কাশ্মীরিরা পাকিস্তানে যোগ দেবে, নাকি ভারতে যোগ দেবে, সে সম্পর্কে কাশ্মীরের জনগণের কাছ থেকে গণ-অভিমত গ্রহণ করতে আয়োজন করতে হবে গণভোট। নেহরু প্রথমে গণভোটের প্রস্তাব মেনে নিলেও পরবর্তীকালে তা অমান্য করেন। তবে পাকিস্তান সম্মত হয় গণভোট গ্রহণে এবং এখনো তাতে স্থির আছে। ভারত সরকার ১৯৫৭ সালের ২৬ জানুয়ারি তাদের প্রজাতন্ত্র দিবসে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে কাশ্মীরকে ভারতের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে। পাকিস্তান এর বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীরে গণ-অভিমত গ্রহণের পুনর্বার দাবি জানায়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন তাতে ভেটো দেয়। ফলে কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে গণ-অভিমত নেওয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

সাবেক জম্মু-কাশ্মীরের ৩ ভাগের ১ ভাগ অংশ পাকিস্তান দখল করেছিল। এই অংশ এখনো পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে আছে। একে বলা হয় আজাদ কাশ্মীর। পাকিস্তান এখনো কাশ্মীরিদের গণ-অভিমত গ্রহণে রাজি থাকায় সেই সাবেক জম্মু-কাশ্মীরের যে অংশ দখল করেছে, তাকে বলছে না পাকিস্তানের অংশ। দেশটি আজাদ কাশ্মীরকে এখন পর্যন্ত ঘোষণা করেনি নিজের কোনো প্রদেশ হিসেবে। আজাদ কাশ্মীরের রয়েছে একটি পৃথক পতাকা, আলাদা জাতীয় সংসদ, একজন প্রধানমন্ত্রী ও একজন প্রেসিডেন্ট। আজাদ কাশ্মীরের জনগণ পাকিস্তানি পাসপোর্টের পরিবর্তে একটি বিশেষ পাসপোর্ট ব্যবহার করেন। গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করার লক্ষ্যে পাকিস্তান এমন ব্যবস্থা নিয়েছে।

জম্মু-কাশ্মীরের পূর্বাংশে অবস্থিত লাদাখ অঞ্চল একসময় ছিল চীনের তিব্বতের অংশ। ব্রিটিশ শাসনামলে জম্মুর হিন্দু রাজা গুলাব সিং ব্রিটিশ সৈন্যদের সহযোগিতায় ১৮৩৪ থেকে ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তিব্বতের লাদাখ অঞ্চল জয় করেন। এরপর ব্রিটিশদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলা গুলাব সিং ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে কাশ্মীর কিনে নেন। এভাবে জম্মু, কাশ্মীর ও লাদাখ নিয়ে গঠিত হয় বৃহত্তর জম্মু-কাশ্মীর। লাদাখের মানুষ দেখতে অবিকল তিব্বতিদের মতো। তারা তিব্বতি ভাষায় কথা বলে। ধর্মে তারা হিন্দু নয়, মুসলমানও নয়। তারা হলো তিব্বতিদের মতো লামা বৌদ্ধ। ১৯৬২ সালে চীন ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকা লাদাখের ৩২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করে নেয়। চীনের দখল করা লাদাখ অঞ্চলের নতুন নামকরণ হয় আকসাই চীন। এদিকে ১৯৬৩ সালে চীন-পাকিস্তানের মধ্যে এক সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তান তার দখলে থাকা লাদাখ অঞ্চলের ৫ হাজার ১৮০ বর্গকিলোমিটার এলাকা চীনকে উপহার দেয়। ফলে চীন তার জিন জিয়াং বা উইঘুর প্রদেশ থেকে আকসাই চীন অঞ্চলের মধ্যে চলাচলের সংযোগ স্থাপনের সুযোগ লাভ করে। এভাবে কাশ্মীরের মহারাজাদের শাসনাধীন ব্রিটিশ আমলের করদ রাজ্য জম্মু-কাশ্মীর এখন তিন অংশে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এক অংশ আছে পাকিস্তানের হাতে, আর এক অংশ আছে ভারতের হাতে এবং অন্য অংশ আছে মহাচীনের নিয়ন্ত্রণে। কাশ্মীর সমস্যা তাই হয়ে উঠেছে আগের তুলনায় অনেক জটিল। এখন সাবেক জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে ভারত, পাকিস্তান ও চীন—এই তিন রাষ্ট্রের স্বার্থ। কাশ্মীর সমস্যা আর হয়ে নাই কেবলই ভারত-পাকিস্তান সমস্যা। কাশ্মীর সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চীনেরও প্রসঙ্গ। বর্তমানে ভারত কাশ্মীর সমস্যাকে সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে প্রচার করে। কাশ্মীর সংকট সমাধানে পাকিস্তান-ভারত দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করতে ভারত নিজের খেয়ালখুশিমতো রাজি হয়। তবে ভারত কাশ্মীরবিষয়ক আলোচনায় কোনোভাবেই সম্পৃক্ত করতে চায় না তৃতীয় কোনো দেশকে। কিন্তু বাস্তবে কাশ্মীর হলো আন্তর্জাতিক সমস্যা, যা প্রথমে ভারতই নিয়ে গিয়েছিল জাতিসংঘে। বর্তমানে ভারত পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে থাকা আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিট বাল্টিস্তান, চীনের দখলে থাকা আকসাই চীন, পাকিস্তান কর্তৃক চীনকে উপহার দেওয়া লাদাখের অংশ—এসবের সমন্বয়ে গঠিত পুরো অঞ্চলকেই নিজের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি করে। তবে ভারত চীনের কাছে হারানো আকসাই চীন এলাকা ফিরে পাওয়ার জন্য দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। ভারত কেবলই চাচ্ছে পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মীর নিয়ে উত্তেজনা বজায় রাখতে।

ভারত সরকার শুরুতে অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরকে দিয়েছিল যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসন। যেমন কাশ্মীরে ছিল পৃথক রাষ্ট্রপতি। তিনি নির্বাচিত হতেন কাশ্মীরের নির্বাচকমণ্ডলী দিয়ে। কাশ্মীরের রাষ্ট্রপতিকে বলা হতো সর্দার-ই-রিয়াসত। তাঁর ছিল যথেষ্ট ক্ষমতা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরু এটা করতে পেরেছিলেন কাশ্মীরের নেতা শেখ আব্দুল্লাহর সঙ্গে খাতির জমিয়ে। শেখ আব্দুল্লাহ থাকতে চেয়েছিলেন ভারতের অনুগত হয়ে। ভারত দীর্ঘদিন এই শেখ আব্দুল্লাহ ও তাঁর পরিবার এবং তাঁদের রাজনৈতিক দলকে (ন্যাশনাল কনফারেন্স) কাশ্মীরের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে রাখে। অতঃপর সুযোগমতো ভারত সরকার ধাপে ধাপে কাশ্মীরকে প্রদত্ত বিশেষ স্বায়ত্তশাসন বিলুপ্ত করে এবং শেখ আব্দুল্লাহর পরিবার কাশ্মীরের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েন।

কাশ্মীর এখন ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যমাত্র। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারতের বিজেপি সরকার দেশটির সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ এবং অনুচ্ছেদ ৩৫(ক) বাতিল করে। এর মাধ্যমে ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের যে সীমিত স্বায়ত্তশাসন ও বিশেষ মর্যাদা ছিল, সেটি বিলুপ্ত হয়। এরপর ভারতীয় আইনসভায় জম্মু-কাশ্মীর পুনর্গঠন বিল পাস হয়। এই আইনের মাধ্যমে বৃহত্তর জম্মু-কাশ্মীরকে দ্বিখণ্ডিত করে জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ নামে পৃথক দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল (Union Territory) সৃষ্টি করা হয়। এভাবে কাশ্মীর ভারতের পুরোপুরি হস্তগত হয়। আর কাশ্মীরের যেসব রাজনৈতিক নেতা দীর্ঘদিন ধরে ভারতের অনুগত হয়ে থেকে ছিলেন, তাঁরা বিমর্ষ ও হতবাক হয়ে যান।

ভারতীয় শাসনতন্ত্রের ৩৬৭ নম্বর ধারার ৩ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ভারত ছাড়া যেকোনো রাষ্ট্রই বিদেশি রাষ্ট্র, তবে রাষ্ট্রপতি কোনো রাষ্ট্রকে ‘বিদেশি রাষ্ট্র নয়’ বলে ঘোষণা করতে পারেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি তাঁদের সংবিধানের এই ধারা অনুসারে কাশ্মীরকে করে নিয়েছেন ভারতীয় রাষ্ট্রের অংশ। ভারতের রাষ্ট্রপতি যে ভবিষ্যতে আর কোনো দেশকে এভাবে ভারতের অংশ করে নিতে চাইবেন না, সেটা বলা যায় না। ভারতীয় সংবিধানের এই ধারার জন্য বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে। ভারত ১৯৪৮ সালে করেছিল হায়দরাবাদ দখল। এরপর ১৯৭৫ সালে দখল করে সিকিম। ভারতের এই সিকিম দখলে সে সময় বাংলাদেশ হয়েছিল বিশেষভাবে শঙ্কিত।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরুর পিতামহ গঙ্গাধর নেহরু ছিলেন কাশ্মীরের অধিবাসী। এ কারণে জওহর লাল নেহরু ব্যক্তিগতভাবে কাশ্মীরের জন্য অনুভব করতেন বিশেষ মমতা। তাই তিনি চান, কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে যুক্ত থাকুক। একসময় অনেকে ভাবতেন, কাশ্মীর সমস্যার একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান হতে পারে জম্মু-কাশ্মীরে ভারত ও পাকিস্তানের যৌথ শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। যেমন যৌথ শাসন আছে ফ্রান্স ও স্পেনের মধ্যে অ্যান্ডোরা (Andorra) নামক রাষ্ট্রে। অ্যান্ডোরা শাসিত হয় ফ্রান্স ও স্পেনের মাধ্যমে। অ্যান্ডোরার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করে না এই দুই রাষ্ট্র। কেবল পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষানীতির ক্ষেত্রে অ্যান্ডোরাকে আলোচনা করতে হয় ফ্রান্স ও স্পেনের সঙ্গে। এখন যদি জম্মু-কাশ্মীরকে পাকিস্তান এবং ভারতের যৌথ শাসনে আনা যায়, তবে উভয় দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে শান্তি। দূর হবে উভয় দেশের কোটি কোটি মানুষের দারিদ্র্য।

কাশ্মীর একসময় ছিল একটি পৃথক সালতানাত। কাশ্মীরিদের আছে একটি পৃথক ভাষা এবং এর সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক মুসলিম। তাই কাশ্মীরিরা হতে চাইতে পারে বাংলাদেশের মানুষের মতোই স্বাধীন। কাশ্মীরিরা পৃথক স্বাধীন কাশ্মীরি রাষ্ট্র গঠনের জন্য কিছুদিন আগেও ভারতের বিরুদ্ধে করেছে প্রচণ্ড সংগ্রাম। বর্তমানে তা ভারতীয় সামরিক বাহিনীর দমন অভিযানে স্তিমিত হয়ে এলেও পুনরায় তা যেকোনো সময় প্রচণ্ড রূপ ধারণ করতে পারে। ভারতীয়দের ভাষায় কাশ্মীরদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে বলা হচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবাদ। কিন্তু ইতিহাস বলছে, এটা হলো কাশ্মীরিদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। ব্রিটিশ শাসনামলেও কাশ্মীর ছিল একটি পৃথক দেশীয় রাজ্য। তখনো কাশ্মীর ছিল না ভারতের অংশ। কাশ্মীরের এই পার্থক্য চেতনা তাদের উদ্বুদ্ধ করছে স্বাধীন কাশ্মীর রাষ্ট্র গঠনের। তাই একে বলা চলে না ভারতীয় ভাষায় বিচ্ছিন্নতাবাদ। বস্তুত ভারত কাশ্মীরকে কবজায় রাখতে এ ধরনের অনেক ভাষায় প্রয়োগ করতে পারে। একসময় অনেকে বলতেন, কাশ্মীরের উচিত হবে ভারতের সঙ্গে থাকা। কারণ, ভারত হলো একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্র আর পাকিস্তান হলো ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র। কিন্তু বর্তমানে ভারতের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গিয়ে পড়েছে হিন্দুত্ববাদী বিজেপির হাতে। বিজেপির নেতারা এখন গ্রহণ করতে চাচ্ছেন অনেকটা হিটলারের আর্যবাদের তত্ত্বকে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত