Ajker Patrika

জীবন বিলিয়ে দিয়ে উত্তরার মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীদের বাঁচালেন, কে এই মাহরীন চৌধুরী

­­ জসিম উদ্দিন, নীলফামারী
আপডেট : ২২ জুলাই ২০২৫, ২২: ৫৩
মাহরীন চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
মাহরীন চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

শিক্ষার্থীদের প্রতি মমত্ববোধ ও দায়িত্ববোধের অসাধারণ উদাহরণ তৈরি করে গেলেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাহসী শিক্ষক মাহরীন চৌধুরী। গতকাল সোমবার (২১ জুলাই) বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমানটি তাঁর প্রতিষ্ঠানে বিধ্বস্ত হয়, তখনো তিনি অক্ষত ও সুস্থ ছিলেন। কিন্তু বিপদের মুখেই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন নিজের সন্তানের মতো ছাত্রছাত্রীদের বাঁচাতে। বিনিময়ে নিজের প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছেন।

ঢাকার জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় গতকাল রাতে মারা যান মাহরীন চৌধুরী। তাঁর শরীরের ১০০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল বলে আবাসিক সার্জন শাওন বিন রহমান জানান। লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার আগে স্বামী মনছুর হেলালের সঙ্গে তাঁর শেষ কথা হয়েছিল।

আজ মঙ্গলবার বিকেলে নীলফামারীর জলঢাকা পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বগুলাগাড়ী এলাকার রাজারহাট চৌধুরীপাড়ায় নিজ বাড়িতে সাংবাদিকদের সামনে সেসব কথা তুলে ধরেন তিনি।

‘মাঝরাতে হাসপাতালের আইসিইউতে মাহরীনের সাথে আমার শেষ কথা হয়। এ সময় আমার হাত তার নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বলেছিল, তোমার সাথে আর বুঝি দেখা হবে না!’, চাপা কান্নার সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন মনছুর হেলাল।

মনছুর হেলাল জানান, ক্লাস শেষে মাহরীন চৌধুরী শিক্ষার্থীদের নিয়ে বের হওয়ার সময় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। এ সময় তিনি সামান্য আঘাত পান। কিন্তু চোখের সামনে দেখতে পান, ২০-২৫ জন শিক্ষার্থী ভেতরে আটকা পড়ে গেছে। তাদের উদ্ধারে তিনি ভেতরে ঢুকে পড়েন এবং বেশ কয়েকজনকে উদ্ধার করেন। এমন সময় আবার বিধ্বস্ত বিমানে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

মাহরীন চৌধুরী নীলফামারীর জলঢাকার মৃত মহিতুর রহমান চৌধুরীর মেয়ে ও জলঢাকা বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি। দুই মাস আগে এই দায়িত্ব নেন। তিনি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই বড় হয়েছেন। তবে বাবার জন্মস্থানে তিনি বারবার এসেছেন এবং দাদুবাড়িতে রাত কাটিয়েছেন। এ সময় গ্রামের মানুষদের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়িয়েছেন।

মাহরীন চৌধুরীর খালাতো ভাই ঢাকায় দৈনিক জনকণ্ঠে কর্মরত সংবাদকর্মী রুমি চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মাহরীনের বাবা মহিতুর রহমান চৌধুরী ছিলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আপন খালাতো ভাই। জলঢাকার এ বাড়িতে জিয়াউর রহমান বেশ কয়েকবার এসেছিলেন।’

মাহরীন চৌধুরী সব সময় এলাকার গরিব মানুষদের খোঁজখবর নিতেন, সামর্থ্য অনুয়ায়ী আর্থিক সহযোগিতা করতেন।

তাঁদের প্রতিবেশী আব্দুস সামাদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, দুই ঈদ ছাড়াও মাঝেমধ্যে গ্রামে আসতেন মাহরীন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কালভার্ট নির্মাণে সহযোগিতা করেছেন। ফলে শিক্ষানুরাগী হিসেবে বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হিসেবে তাঁকে মনোনীত করেছে এলাকাবাসী।

মাহরীন চৌধুরীকে নিয়ে ফেসবুকে স্মৃতিচারণা করেন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী আলী আহমেদ মাবরুর। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মাহরীন আপা আমার মানারাতের সহপাঠী ছিলেন। আমরা একই সাথে মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে মাস্টার্স করেছিলাম। বয়সে আমার একটু সিনিয়র হবেন। বনেদি ঘরের মানুষ, তবে একদম সাদামাটাভাবে চলাফেরা করতেন। আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন। তিনি উত্তরায় থাকতেন, সে হিসেবে আমার প্রতিবেশীও। উত্তরায় যখন হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ ছিল, বেশির ভাগ অংশই যখন জলাভূমি ও গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ, তখন থেকে এই এলাকায় তাঁদের বসতি।’

গত কয়েক বছরের মধ্যে মা-বাবাকে হারান মাহরীন চৌধুরী। সেই তথ্য তুলে ধরে মাবরুর লিখেছেন, ‘পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে সকল ভাই-বোন বরাবরই তাঁকে অভিভাবক হিসেবে গণ্য করতেন। তাঁর দুই ছেলে। ওরাও বড় হয়ে গেছে।’

আলী আহমেদ মাবরুর আরও লেখেন, ‘মাহরীন আপা অনেক বছর যাবৎ মাইলস্টোন প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত। তাঁকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শাখায় তারা কাজে লাগিয়েছে। আপা এখন সিনিয়র টিচার। সেই হিসেবে বাড়তি কিছু দায়িত্বও ছিল তাঁর দিয়াবাড়ি শাখায়। গতকাল যখন স্কুলের ওপর বিমানটি আছড়ে পড়ে, তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। নিশ্চিত আগুনে পুড়ে যাওয়া থেকে ২০ জনের বেশি ছাত্রছাত্রীকে তিনি সেভ করেছেন। কিন্তু এই সাহসী ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে গিয়ে কখন নিজের জীবনকেই বিপন্ন করে ফেলেছেন, তা হয়তো তিনি বুঝতেও পারেননি। দুর্ঘটনার পরই তাঁর সঙ্গে পরিবারের সবার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। মধ্যরাতে তাঁর লাশ যখন বাসায় আনা হয়, আমি দেখতে গিয়েছিলাম। তাঁর স্বামী আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। বললেন, জানিস, তোর আপা পরশু রাতেও তোর কথা বলেছিল।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জীবন বিলিয়ে দিয়ে উত্তরার মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীদের বাঁচালেন, কে এই মাহরীন চৌধুরী

প্রধানমন্ত্রী দলীয় প্রধান থাকতে পারবেন না, সনদে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়ার সুযোগ

পাচার করা ৭৮১ কোটি টাকা ফেরত দিতে চেয়েও জামিন পেলেন না নাসার চেয়ারম্যান নজরুল

মেয়ের কফিনে বাবার চুমু

মেয়েকে আনতে স্কুলে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন গাংনীর রজনী

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত