Ajker Patrika

এই গাড়ি হাওয়ায় চালিত!

অর্ণব সান্যাল
আপডেট : ২২ নভেম্বর ২০২১, ০৯: ৫৯
Thumbnail image

সমস্যাবিহীন কোনো দেশ, জাতি বা সমাজ নেই। এমনকি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনও সমস্যায় ভরপুর। কিন্তু কিছু কিছু সমস্যা আছে, যেগুলো মানুষের আঁতে ঘা দেয়, জীবনের যেনতেন যাপনও অসম্ভব করে তোলে। তখন মাঝে মাঝে মনে হয়, আচ্ছা আমাদের কি বেঁচে থাকাটাই পাপ?

কথা থেকে কবিতা এবং আবার কবিতা হয়ে কথায় ফেরা সেই আপ্তবাক্য—‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’। এতে যেমন সন্ত্রাসের কথা ছিল, তেমনি ছিল পান্তায় নুনের অভাব। এখন কি অবস্থা কিছুটা বদলেছে? হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমাদের মাথাপিছু আয়ে অনেক অঙ্ক যোগ হয়েছে। কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। আরও বেড়েছে নানামাত্রিক শুল্ক। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন নসিহত। কিন্তু পান্তায় নুনের অভাব কি মিটেছে? নাকি শোনা যায় না কোনো নিষ্পেষিতের প্রতিবাদ বা আর্তনাদ? বুকে হাত দিয়ে বলা যাবে তো, এ মাসে কেউ কারও কাছে ভাতের জন্য হাত পাতেনি?

নাহ্‌, বলা যাবে না। বরং আজকেও কিছু লিখতে গেলে অনেক বছর আগে লেখা কবিতার পঙ্‌ক্তি আসে ঘুরেফিরে। এসব কথা তুললে কেউ কেউ অবশ্য শোনাবেন গভীর আর্থসামাজিক তত্ত্ব। কেউ বলবেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে আমাদের কী করার আছে!’ আর দিন শেষে শোনা যাবে, জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে, তাই যাতায়াতের ভাড়া বাড়বে। অথবা বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, তাই দেশীয় বাজারেও তার প্রভাব অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু কেউ ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাবে না, কেন আমনের বাম্পার ফলনের পরও বাড়ছে চালের দাম। তখন রাজামশাই নিশ্চুপ! কানে তাঁর হেডফোন, আর তাতে চলে ঠুমরির তাল।

এবার একটু সমস্যার অতলে হারানো যাক। সংবাদপত্রে নিয়মিত বিরতিতে প্রতি সপ্তাহান্তে বাজারদর নিয়ে প্রতিবেদন হয়। তাতে জানা যায়, আলু থেকে উচ্ছে—সব পণ্যের দাম বাড়ছে। পাইকার বলে এক কথা, খুচরা ব্যবসায়ী বলে আরেক কথা। কখনো কখনো একে–অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপায়। আর প্রতিটি প্রতিবেদনের শুরু বা শেষে আমরা পাই সাধারণের ভোগান্তির বিলাপ। ওটি দিয়েই একেকটি সংবাদ পূর্ণতা পায় হয়তো। কিন্তু এই বিলাপ যে আর শেষ হয় না।

ওদিকে এসবের কারণ হিসেবে আমরা বছরের পর বছর নানা ক্লিশে কারণ শুনে যাই। কখনো কাঠগড়ায় ওঠে জ্বালানি তেলের বর্ধিত মূল্য, কখনো রাস্তায় রাস্তায় নেওয়া চাঁদার পরিমাণ। কর্তৃপক্ষ এসব দেখে, তাদের শুধালে আশ্বাস দিয়ে জানায়, ‘বিষয়টি আমরা দেখছি।’ তবে সেই ‘বিষয়টি’র রূপ এতই ভয়ানক যে অবিনাশী দর্শন-প্রক্রিয়া শেষ হয় না। এই যেমন বেশ কিছুদিন হলো রাজপথের গ্যাসচালিত অনেক যানের ডিজেলে চলার খবর মিলল, বাড়তি ভাড়া সবাই আদায় করাও শুরু করে দিল। কেউ কিন্তু বলল না যে সেবাটাও বাড়তি দেওয়া হবে! বরং আদায়ের ভাবটা এমন যে ‘এ তো মোর পাওনা’। এমন দৃশ্য খুঁজলে ঢের পাওয়া যাবে, গুনে কূল পাওয়া যাবে না তখন।

চলতি সময়ে হাফ ভাড়ার দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছে বেশ কিছুদিন হলো। আসলে মানুষ তো আর সাধে রাস্তায় নামে না, অসহ্য হলেই নামে। তখন হুমকি-ধমকির তোয়াক্কা কেউ করে না। যদিও ঘরে বসে থাকার সবক চলছে। আর তার জন্য প্রয়োজন হলে ধর্ষণের হুমকি দিতেও ছাড়ছে না সংশ্লিষ্টরা। সংবাদমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, শিক্ষার্থী হিসেবে হাফ ভাড়া দিতে চাইলে এক কলেজছাত্রীকে নাকি ধর্ষণের হুমকি দিয়েছে বাসচালকের সহকারীরা! আর বাস থেকে চূড়ান্ত অপমান করে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেওয়ার তুলনামূলক ‘সাধারণ’ হুমকি তো আছেই।

ডিজেলের দাম বাড়তেই রাজপথের গ্যাসচালিত অনেক যানের ডিজেলে চলার খবর মিললশিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া দেওয়া নিয়ে এই ক্যাচাল অবশ্য আজকের নয়। শিক্ষার্থীদের প্রতি সদয় হতে বাসমালিক ও চালকদের অনীহা অনেক দিনের। তাঁরা সবাইকেই সাধারণ যাত্রী হিসেবে দেখতে চান, তাদের কাছ থেকে সমান ভাড়া চান। ওই অনেকটা মুক্তবাজার অর্থনীতির মতো। তাতে মুনাফাও বাড়ে আর বাড়তি মুনাফা কে না চায়! কিন্তু বাড়তি বা নিদেনপক্ষে কাঙ্ক্ষিত সাধারণ মানের সেবাটা দেওয়া হয় তো? কোনো দিন মহানগরে বাসে চড়ে থাকলে, আশা করি আপনাদের কাছে সেই উত্তর আছে।

যদিও তা নিয়ে অভিযোগ-অনুযোগ করে আগেও কিছু হয়নি, এখনো হয় না। একে-অন্যকে দোষারোপ করেই দিন কাটিয়ে দেওয়া হয়। এবার পরিবহনশ্রমিকদের অভিযোগ, ওয়েবিলে বাসমালিকেরা শিক্ষার্থীদের ছাড় না দেওয়াতেই হাফ পাস নিয়ে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। আবার ওয়েবিলের কথা বলে অল্প দূরত্বেও যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে পরিবহনশ্রমিকদের বিরুদ্ধে। মালিকেরা ও সরকারি কর্তারাও এ বিষয়ে নিশ্চয়ই মূল্যবান কিছু বলবেন। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট যে বাসভাড়া বাড়ানোর সময় যে কর্মতৎপরতা সবার মধ্যে ছিল, শিক্ষার্থী বা জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে রাস্তায় নেমে তারস্বরে চেঁচালেও তা ঠিক চোখে পড়ে না।

জন্মের পর থেকে এতদ্‌ঞ্চলে থাকলে নিশ্চয়ই কেউ এহেন অলসতার কারণ জিজ্ঞেস করে লজ্জা দেবেন না। কারণ, এ ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা কবীর সুমনের গানের লাইনের মতো, ‘প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা…’।

সেই চেনা-জানা পরিচিত পথেই আমরা বুঝতে শিখি যে কীভাবে রাতারাতি মুড়ি-মুড়কির এক দরের মতো বেশির ভাগ গণপরিবহনের কাচে বসে যায় পোস্টার, তাতে লেখা থাকে ‘এই গাড়ি ডিজেলে চালিত’। শুধু গণতন্ত্রের ভাষায়, সরকারের ভাগ্যনিয়ন্তাদের কোনোরূপ পরিবর্তন আসে না।

আমরা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের কেবল দেখি। আর বুঝতে শিখি, আমাদের ‘এই গাড়ি হাওয়ায় চালিত’। তাতে কোনো ডিজেল-পেট্রল লাগে না, সুতরাং দামও বাড়ে না সময়ে সময়ে। শুধু হাওয়া খেয়েই আমাদের দিন চলে দিব্যি। ভাগ্যিস, হাওয়ার ওপর ট্যাক্স বসেনি এখনো!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত