Ajker Patrika

কানুপাড়ায় শোক, পুরুষশূন্য সুনসান মোশড়াপাড়া

রিমন রহমান, রাজশাহী
আপডেট : ১২ জুলাই ২০২৩, ১০: ১৩
কানুপাড়ায় শোক, পুরুষশূন্য সুনসান মোশড়াপাড়া

মোশড়াপাড়া গ্রামে ঢুকতেই ছোট্ট একটা মোড়। মোড়ের সব দোকানপাট বন্ধ। বসে আছেন একদল পুলিশ সদস্য। তাঁদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মফিজুল ইসলাম। গ্রামের ভেতরে ঢুকে আর একজন পুরুষকেও দেখা গেল না। সুনসান নীরবতা। কোনো কোনো বাড়ির নারীরাও আত্মগোপনে।

গতকাল সোমবার রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ইয়াজপুর মাঠে প্রতিপক্ষের হামলায় চারজন নিহত হয়। আজ মঙ্গলবার দুপুরে মোশড়াপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায় ওপরের চিত্র। ওই ঘটনায় করা মামলার বেশির ভাগ আসামি এই গ্রামের বাসিন্দা। মামলায় ২১ আসামির নাম উল্লেখ আছে। অজ্ঞাতনামা আসামি আরও ৫০ থেকে ৬০ জন। হামলায় অংশ নেননি এমন মানুষও ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছেন। গ্রামটিতে এখন থমথমে পরিবেশ।

মামলার এক নম্বর আসামি পাকড়ী পশ্চিমপাড়া গ্রামের আশিকুর রহমান চাঁদ। তাঁর দাদার প্রায় ৫০০ বিঘা জমি ছিল। এসব জমি এখন হাজি মানিকউল্লা শেখ ওয়াক্ফ এস্টেটের। এর মোতোয়ালি হিসেবে সবকিছু দেখাশোনা করেন চাঁদ। তিনি দাবি করছেন, এই এস্টেটের ১৪ বিঘা জমি কয়েকজন ব্যক্তি নিজেদের নামে করে নিয়েছেন। তাঁদের একজন সোহেল রানা ছোটন (৪৫)। আশিকুর রহমানের লোকজনের হামলায় সোহেল রানা প্রাণ হারিয়েছেন।

সোহেলের বাড়ি রাজশাহী নগরীর ভাটাপাড়া এলাকায়। এ ছাড়া হামলায় জমিগুলোর বর্গাচাষি পাকড়ীর বড়গাছি কানুপাড়া গ্রামের নাইমুল ইসলাম (৮০), তাঁর ভাই মেহের আলী (৭০) এবং গুসিরা গ্রামের চাষি মো. মনিরুল (৪৫) ইসলাম নিহত হয়েছেন।

এ ঘটনায় রাতে গোদাগাড়ী থানায় হত্যা মামলা করেন নিহত সোহেলের ছোট ভাই মো. হৃদয় (৩৩)। তিনি এজাহারে উল্লেখ করেছেন, তাঁর ভাই এক বছর আগে কেনা জমিতে বর্গাচাষিদের নিয়ে ধান রোপণ করতে গিয়েছিলেন। এ সময় অতর্কিতভাবে প্রতিপক্ষরা চারপাশ থেকে ঘিরে তাঁদের ওপর হামলা করেন।

স্থানীয়রা জানান, সোহেল রানার পক্ষে নেতৃত্ব দেন তাঁর খালাতো ভাই সেলিম রেজা। তিনি রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের উপসহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা। এই পক্ষ দাবি করছে, আশিকুর রহমানের বাবা তমির উদ্দিন শেখ জীবিত থাকাকালে তাঁর কাছ থেকে তাঁরা জমি কিনেছেন। এরপর খাজনা-খারিজও করেছেন। তবে আশিকুর বলছেন, ওয়াক্ফ এস্টেটের জমি হস্তান্তর করা যায় না। সোহেল রানাদের দলিল জাল। তবে এই জমি সোহেল রানাদেরই দখলে আছে। তাঁরা বর্গা দিয়ে জমি চাষও করান। 

পুলিশ জানিয়েছে, জমি নিয়ে বিবাদের কারণে সম্প্রতি দুই পক্ষ থানায় বসেছিল। সেখানে সোহেল রানার পক্ষে জমির কাগজপত্র দেখা যায়। তবে ওয়াক্ফ এস্টেটের জমি কারও নামে হয় না বলে দাবি করেন আশিকুর। তাই তাঁকে আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি মামলা না করে এক মাস আগে চাষাবাদে বাধা দিতে মারামারি করেছিলেন। তখন সোহেল রানার পক্ষ মামলা করেছিল। এই মামলায় কয়েকজন গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। এরাই জামিনে এসে আবার সংঘর্ষে জড়িয়েছেন। এতে চারজনের প্রাণ গেছে।

কানুপাড়ায় শোক
কানুপাড়া গ্রামে বর্গাচাষি নাইমুল ইসলাম ও তাঁর ভাই মেহের আলীর পাশাপাশি বাড়ি। মঙ্গলবার দুপুরে গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ এখনো গ্রামে আসেনি। মরদেহের জন্য দুটি খাটিয়া এনে রাখা হয়েছে। পাশেই পারিবারিক কবরস্থানে দুই ভাইয়ের পাশাপাশি দুটি কবর কাটা হচ্ছে। আত্মীয়স্বজন আর গ্রামের শোকাহত লোকজন বাড়ির সামনে বসে আছে। মাথায় ব্যান্ডেজ লাগানো অবস্থায় নিহতদের ভাতিজা উজির বাদশাকে পাওয়া গেল। তিনি জানালেন, ১৪ বিঘা জমি তাঁরা সাতজন কৃষক চাষ করতেন। এর আগেও এই জমি চাষ করতে আশিকুরদের পক্ষ থেকে তাঁরা বাধা পেয়েছেন। তাই সোমবার ধান রোপণের সময় জমির মালিক হিসেবে তাঁরা সোহেল রানাকেও ডেকেছিলেন। তাঁরা ১৫ জন যখন কাজ করছিলেন, তখন চারপাশ ঘিরে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাঁদের ওপর আক্রমণ করেন ৫০ থেকে ৬০ জন। তাঁরা প্রতিরোধ করার সুযোগ পাননি।

চোখের পানি মুছতে মুছতে নিহত মেহেরের স্ত্রী আয়েশা বেগম বলেন, ‘জমির মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব। জমিদার-জমিদার মারামারি করবে, আমরা চাষিদের মারল কেন? আমরা এর বিচার চাই।’ তিনি বলেন, ‘মোশড়াপাড়া গ্রামের লোকজন আশিকুর চাঁদের অন্য জমি চাষ করে। তাই তাঁর কথায় ওই গ্রামের লোকজন হামলা চালিয়েছে। অন্য গ্রামেরও ভাড়া করা লোকজন ছিল।’ 

থমথমে মোশড়াপাড়া
কানুপাড়া, গুসিরা ও মোশড়াপাড়া যাওয়ার আগে কাঁকনহাট বাজারেই মঙ্গলবার দুপুরে পুলিশের দুটি ভ্যান দেখা গেল। কাঁকনহাট পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সামনেও প্রস্তুত দুই ভ্যান পুলিশ। মোশড়াপাড়া থেকে দুই কিলোমিটার দূরেই হাজির মোড় দিয়ে যারা যাচ্ছিলেন তাদের তল্লাশি করতে দেখা গেল একদল পুলিশ সদস্যকে। আবার মোশড়াপাড়া থেকে এক কিলোমিটার দূরে পাকড়ী ইউনিয়ন পরিষদ বাজারে সতর্ক অবস্থানে দেখা গেল একদল পুলিশ সদস্যকে। মোশড়াপাড়ায় ঢোকার আগে জামতলী গ্রামে অবস্থান করতে দেখা গেল একদল পুলিশ সদস্যকে। 

মোশড়াপাড়া গ্রামের শুরুতেও সতর্ক অবস্থায় দেখা গেল আরেক ভ্যান পুলিশ। পুরো গ্রামটি ঘুরে শুধু ইউপি সদস্য ছাড়া গ্রামের অন্য কোনো পুরুষকে দেখা গেল না। 

বড়গাছি কানুপাড়া গ্রামে পাশাপাশি কাটা হচ্ছে দুই ভাইয়ের কবর।গ্রামের প্রথম বাড়িটি আবু তালেবের। তিনি বাড়িতে নেই। তাঁর স্ত্রী ছবি বেগম বললেন, ‘আমার স্বামী কারও কাঁচা আইলে পা দেন না। মারামারির সময় মাঠে নিজের জমিতে কাজ করছিলেন। আমার ছেলেও বাড়িতে ছিল না। এখন গাঁয়ের যে অবস্থা, বুঝতেই পারছেন। কাউকেই বাড়িতে রাখতে পারছি না। দোষ না করেও হুট করে ধরে নিয়ে চলে গেলে বিপদ হয়ে যাবে। আজ আমাদের নিজেদেরই জমি লাগানোর কথা ছিল। সেটা আর হলো না।’ 

গ্রামের শেষ বাড়িটি সাদিকুল ইসলামের। এই বাড়িতেও কোনো পুরুষ নেই। সাদিকুলের স্ত্রী তাজকেরা বেগম এবং মা কদবানু বিবি বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁরা জানালেন, মারামারিতে ছিল না এমন ব্যক্তিকেও জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। অল্প বয়সী ছেলেদেরও পুলিশ ধরছে। তাই পুরুষদের সরিয়ে রাখা হয়েছে। কোনো কোনো বাড়ির নারীরাও ঘরে তালা দিয়ে চলে গেছেন। 

গ্রেপ্তার ৭, রিমান্ডের আবেদন
চারজনকে হত্যার এ মামলায় পুলিশ এ পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁরা হলেন—মোশড়াপাড়া গ্রামের ইউনুস আলী (২২), ওমর ফারুক (৪০), আনারুল ইসলাম (৪৫), মঞ্জুর রহমান (৩০), মোহনপাড়া গ্রামের মো. আতাউর (৫০), হায়দার আলী (৪৫) এবং কাশিয়াডাঙ্গা ফেত্তাপাড়ার রজব আলী (৩৯)। তাঁদের মধ্যে ইউনুস ও রজব রামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। 

গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম জানান, সাত আসামির মধ্যে পাঁচজনকে দুপুরে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক শম্ভু চাঁদ মণ্ডল পাঁচ দিন করে রিমান্ডের আবেদন করেছেন। আবেদনের শুনানি এখনো হয়নি। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। আর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দুই আসামি সুস্থ হলে তাঁদের আদালতে তোলা হবে। 

ওসি আরও বলেন, ‘গ্রামে লাশ যাওয়ার পর লোকজন উত্তেজিত হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। মোশড়াপাড়ায় আক্রমণ করে জ্বালাও-পোড়াও হতে পারে। সেই আশঙ্কায় এলাকায় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে গ্রাম থেকে পুলিশ সরিয়ে নেওয়া হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তৃতীয়বার বিধ্বস্ত হলো বিমানবাহিনীর এফ-৭, এই চীনা যুদ্ধবিমানের বৈশিষ্ট্য কী

উত্তরায় বিমান বিধ্বস্ত: পাইলটসহ নিহত ২২, আহত দেড় শতাধিক, মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় শোক

৯ লাখ টন চাল কিনবে বাংলাদেশ, আশায় বুক বাঁধছেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা

উত্তরায় বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত

পাইলটের মা-বাবাকে বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজে নেওয়া হলো ঢাকায়

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত