Ajker Patrika

আইনশৃঙ্খলার অবনতি: অপরাধীর খুঁটি রাজনৈতিক দল, মব দমনে ব্যর্থ পুলিশ

  • বদলির শঙ্কায় শক্ত পদক্ষেপ নিতে ভয় পুলিশে।
  • রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা চান আইজিপি।
  • গত ৬ মাসে ১৯৩০ জন খুন, পুলিশ লাঞ্ছিতের ঘটনাও বেড়েছে।
শহীদুল ইসলামশাহরিয়ার হাসান, ঢাকা 
আপডেট : ১৪ জুলাই ২০২৫, ০৯: ৪৪
মিটফোর্ড এলাকায় নিহত মো. সোহাগের ওপর হামলার ঘটনার চিত্র। তিনি এলাকায় ভাঙারিসামগ্রীর ব্যবসা করতেন। ছবি: সংগৃহীত
মিটফোর্ড এলাকায় নিহত মো. সোহাগের ওপর হামলার ঘটনার চিত্র। তিনি এলাকায় ভাঙারিসামগ্রীর ব্যবসা করতেন। ছবি: সংগৃহীত

সবার সামনে পিটিয়ে হত্যা, পাথরে শরীর থেঁতলে দেওয়া, নিজের বাড়ির সামনে গুলি করে পায়ের রগ কেটে হত্যা, অস্ত্র দেখিয়ে সর্বস্ব ছিনতাই, চাঁদা না পেয়ে গুলি—এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনা কয়েক দিন ধরে বেশ আলোচিত। কিন্তু পুলিশ অনেকটাই নির্বিকার। প্রতিটি ঘটনার সিটিটিভি ফুটেজ থাকলেও সব অপরাধীকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। অন্তর্বর্তী সরকারের ১১ মাসেও দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে তেমন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। এতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন নাগরিকেরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো শক্তিশালী ভূমিকা না রাখায় অপরাধের মাত্রা বাড়ছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

অন্যদিকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তারা মাঠে থাকলেও তাঁদের দৃশ্যমান তৎপরতা সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছেন বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা ছাড়া সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নয়ন অসম্ভব।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজকের পত্রিকাকে বলেন, এখন থানাগুলোয় একধরনের ভীতি কাজ করে। কথায় কথায় থানা ঘেরাও হচ্ছে। অনেক সময় দোষ না থাকলেও দাবির মুখে পুলিশ সদস্যদের বদলি করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে কেউ নিজ থেকে কিছু করতে চান না। নিরাপদে দিন পার করার দিকেই সবার নজর। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও কাউকে জোর করে কিছু করাতে পারছেন না। অনেক ক্ষেত্রে কোনো ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের পক্ষে বাহিনী কথা বলছে না। এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব সহজে বদলাবে না।

পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দেশে যত মানুষ খুন হয়েছিল, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে তার থেকে ৩৮৭ জন মানুষ বেশি খুন হয়েছে। এই সময়ে পুলিশ সদস্যদের লাঞ্ছিত করার ঘটনাও বেড়েছে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলো এখন নিজেদের ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিষয়গুলোকে কীভাবে তা হ্যান্ডেল করছে, সেটিও দেখার বিষয়। পুলিশ ঠিকমতো কাজ না করলেও সেনাবাহিনীর তো ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা আছে, তারা এখন কী করছে, সেদিকেও নজর দেওয়ার বিষয় আছে।

রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বাহিনীগুলোকে গড়ে তোলার চেষ্টা করবে বলে মত দিয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব কামাল উদ্দিন আহমেদ। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, পুলিশের মনোবল এখনো ফিরে আসেনি, তাদের আরও বুস্ট করার দরকার আছে। তাহলে তারা আরও ভালো কাজ করতে পারবে। তবে তারা আগের থেকে একটু অ্যাকটিভ হয়েছে।

পুলিশ কেন আলোচিত সব ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারে না, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকায় অনেক সময় আসামি ধরেও আটকে রাখা যায় না। কিছু ক্ষেত্রে সরকারের উচ্চ মহল থেকেও এসব বিষয়ে নির্দেশনা আসে। তিনি বলেন, পুলিশের অনেক সদস্যও এখন কাজে নামতে দ্বিধায় ভুগছেন। কারণ, অনেকের মধ্যে এখনো আক্রমণের শিকার হওয়ার আতঙ্ক রয়ে গেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত কিছু ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে বলে ধারণা করছে পুলিশ। পুলিশ সূত্র জানায়, কিছু কিছু ঘটনা রেকর্ড রেখেই সবার সামনে আনা হচ্ছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল অস্থিরতা বাড়াচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। কারণ, তাড়াতাড়ি নির্বাচন আয়োজন এবং নির্বাচন পেছানোর দুই দাবিই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রয়েছে। ফলে পুলিশকেও এসব হিসাবে রেখে কাজ করতে হচ্ছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত শনিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, নির্বাচন নেই বলে আজকে দেশে এই ঘটনাগুলো ঘটছে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে, মৃত্যু বাড়ছে, দুর্বৃত্তরা সুযোগ নিচ্ছে। একটা নির্বাচিত সরকার এলে নিঃসন্দেহে সেটা শক্তিশালী সরকার হবে।

জানতে চাইলে পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে প্রশাসন পুনরায় সংগঠিত হতে সময় নিচ্ছে। পুলিশকে কার্যকরভাবে কাজে ফেরানো এবং অপরাধ দমন দুটিই একই সঙ্গে চালানো চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। তিনি আশাবাদী, শিগগির পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা ছাড়া সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নয়ন অসম্ভব বলে মনে করেন আইজিপি।

অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, চুরি, ছিনতাই, মব সহিংসতাসহ সব ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার যেকোনো সময় চিহ্নিত অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের ধরতে বিশেষ বা চিরুনি অভিযান পরিচালনা করতে পারে।

আলোচিত ঘটনায়ও সব আসামি গ্রেপ্তার নেই

গত বুধবার ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে বিকেলে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে কুপিয়ে এবং পাথর মেরে হত্যা করা হয়। গত বৃহস্পতিবার খুলনার দৌলতপুরে যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান মোল্লাকে নিজ বাড়ির সামনে গুলি করে ও রগ কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। গত শুক্রবার চাঁদপুরে মসজিদের ভেতরেই কোপানো হয় ইমামকে। একই দিনে ঢাকার শ্যামলীতে ছিনতাইকারীরা এক যুবকের পরনের কাপড় ও স্যান্ডেল পর্যন্ত নিয়ে যায়। আর পল্লবীতে এক আবাসন প্রতিষ্ঠানে চাঁদা না পেয়ে গুলি চালায় সন্ত্রাসীরা।

গত সাত দিনে সংঘটিত এসব ঘটনার বেশির ভাগেরই সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ্যে এসেছে। এরপরও সব আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এসব ঘটনায় আসামিদের গ্রেপ্তার নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক দলের নেতারাও।

জানতে চাইলে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, বাহিনীগুলো শক্তিশালী কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। অপরাধীরা জানে তারা আইনের আওতায় আসবে না, তারা ছাড় পাবে—এই বিশ্বাস থেকেই তারা অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে চলেছে।

অপরাধ বেড়েছে কতটা

পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাসে সারা দেশে ১ হাজার ৯৩০ জন খুন হয়েছে। প্রতি মাসেই খুনের সংখ্যা বেড়েছে। জানুয়ারিতে ২৯৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩০০ জন, মার্চে ৩১৬ জন, এপ্রিলে ৩৩৬ জন, মেতে ৩৪১ এবং জুন মাসে ৩৪৪ জন মানুষ খুন হয়েছে। এ ছাড়া গত ছয় মাসে সারা দেশে ৩৬৬টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। চুরির ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪ হাজার ৫৩৮টি। এই সময়ে ৫১৬ জন অপহরণ, ৩২৯ জন পুলিশ লাঞ্ছিত এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের ১১ হাজার ৮টি ঘটনা পুলিশের কাছে নথিভুক্ত হয়েছে।

অন্যদিকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাসে সারা দেশে ১ হাজার ৫৪৩ জন খুন এবং ২৮১ জনকে অপহরণ করা হয়। এই সময়ে ২৮১ জন পুলিশ সদস্য লাঞ্ছিত হন এবং ৬৮৮টি ডাকাতি ও ৪ হাজার ৭১৭টি চুরির ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতনের ৯ হাজার ২টি ঘটনা পুলিশের কাছে নথিভুক্ত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মিটফোর্ডে সোহাগ হত্যা মামলার আসামি দুই ভাই নেত্রকোনায় গ্রেপ্তার

পারটেক্স এমডি রুবেল আজিজের ১১৬ কোটি টাকার সম্পত্তি নিলামে তুলছে ব্যাংক এশিয়া

‘নৌকা আউট, শাপলা ইন’, সিইসির সঙ্গে বৈঠক শেষে এনসিপির চাওয়া

যশোরে কেন্দ্রের ভুলে বিজ্ঞানের ৪৮ জন ফেল, সংশোধনে জিপিএ-৫ পেল সবাই

পাওনা টাকা চাওয়ায় ব্যবসায়ীকে মারধরের পর বললেন, ‘আমি যুবদলের সভাপতি, জানস?’

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত