Ajker Patrika

কারাদণ্ড হলেও সাজা থেকে রেহাই, সুবিধা পেতে পারেন যেসব অপরাধী

সুলতান মাহমুদ
আপডেট : ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ০৯: ৩৪
Thumbnail image

২০১০ সালের ৩ নভেম্বর শাহবাগ থেকে এক ব্যক্তিকে পাঁচ পিস ইয়াবাসহ আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। ২০১৫ সালের ৫ জুলাই তাঁকে ছয় মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। কারাদণ্ডের পাশাপাশি তাঁকে ১ হাজার টাকা জরিমানা করেন। জরিমানা দিতে ব্যর্থ হলে আরও ১৫ দিনের কারাভোগের আদেশ দেন। ওই সময় আসামি পলাতক ছিলেন। 

২০২০ সালের ২৬ অক্টোবর আসামি গ্রেপ্তার হন এবং একই বছরের ২ নভেম্বর জামিন পেয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে আপিল করেন। আপিল শুনানির জন্য বিশেষ জজ আদালত-৬-এ মামলাটি বদলি হয়। আপিল শুনানিতে আইনজীবীর মাধ্যমে আসামি প্রবেশন আইন অনুযায়ী দোষ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। 

এ সময় বিচারক কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামির কাছে তাঁর ছেলেমেয়ে সম্পর্কে জানতে চান। আসামি বলেন, তাঁর এক ছেলে মাদ্রাসায় হাফেজি পড়ে, আর মেয়ে ছোট। বিচারক বলেন, ‘ছেলে হাফেজি পড়াচ্ছেন। আপনি মারা গেলে সে আপনার জানাজা পড়াবে। আপনার জন্য দোয়া করবে। আর আপনি ইয়াবা মামলার আসামি।’ তখন আসামি নিশ্চুপ থাকেন। বিচারকের অন্য এক প্রশ্নের জবাবে আসামি বলেন, ‘আমি মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাস করেছি।’ এরপর বিচারক বলেন, ‘ছেলে মাদ্রাসায় হাফেজি পড়ে, আপনি ফাজিল পাস। কেন ইয়াবার মামলার আসামি হলেন? আসামি বলেন, ‘স্যার আমাকে ইয়াবা দিয়ে মামলা দিয়েছে।’ 

বিচারক প্রশ্ন করেন, ‘পবিত্র কোরআনের কোন সুরায় মাদক সম্পর্কে বলা আছে জানেন?’ আসামি আবারও নিশ্চুপ থাকেন। আদালত তখন বলেন, ‘সুরা বাকারা, মায়েদা ও নিছা ভালো করে পড়বেন। মাদক সম্পর্কে তিনটি সুরায় বলা আছে। এরপর বিচারক বলেন, ‘আপনার সাজা স্থগিত করা হলো। যে আদেশ দেওয়া হয়েছে, সেটা মেনে চলবেন। সমাজসেবা দপ্তরের প্রবেশন অফিসারের তত্ত্বাবধানে থেকে এই কাজগুলো করবেন। যদি না করেন, তাহলে আবার সাজা পুনর্বহাল করা হবে। আর প্রবেশন অফিসার যদি আপনার কাজের সপক্ষে প্রতিবেদন না দেন, তাহলে আপনাকে সাজা খাটতে হবে।’ 

পবিত্র কোরআনের তিনটি সুরা ভালো করে পড়ার শর্তে আসামির সাজা স্থগিতের আদেশ দেন বিচারক। গত ৫ নভেম্বর তিনি এই আদেশ দেন। পাশাপাশি তাঁকে ৫০টি গাছ রোপণ এবং মাদ্রাসায় কিছু ধর্মীয় বই উপহার দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। প্রবেশন অফিসার তাঁর এই কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে আদালতে প্রতিবেদন দেবেন।

প্রবেশন অফিসার যদি ইতিবাচক প্রতিবেদন দেন, তাহলেও ওই আসামিকে পরে কখনো সাজা ভোগ করতে হবে কি না, জানতে চাইলে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সোলায়মান তুষার বলেন, ‘আদালত যে শর্তে আসামির সাজা স্থগিত করেছেন, সংশ্লিষ্ট প্রবেশন অফিসার যদি আদালেত সন্তোষজনক রিপোর্ট দেন, তাহলে আসামিকে ওই সাজা আর কখনো ভোগ করতে হবে না। অর্থাৎ, তাঁকে আর কারাগারে যেতে হবে না। কেননা, আদালত যে শর্ত তাঁকে দিয়েছিলেন, সেই শর্ত আসামি পূরণ করেছেন।’

প্রবেশন কী
প্রবেশন বলতে অপরাধীর শাস্তি স্থগিত রেখে, কারারুদ্ধ না করে বা কোনো প্রতিষ্ঠানে (সংশোধন কেন্দ্র) আবদ্ধ না করে সমাজে খাপ খাইয়ে চলার সুযোগ দেওয়াকে বোঝায়। প্রবেশন একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক সংশোধন কার্যক্রম। এটি অপরাধীর বিশৃঙ্খল ও বেআইনি আচরণ সংশোধনের জন্য একটি সুনিয়ন্ত্রিত কর্ম পদ্ধতি। এর মাধ্যমে অপরাধীকে আবার অপরাধ করা থেকে বিরত রাখতে এবং একজন আইন মান্যকারী নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করা হয়।

প্রবেশন সুবিধা পাবেন কারা
এক. দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অধ্যাদেশ অনুযায়ী, প্রথম অপরাধ সংঘটন বা লঘু অপরাধ করা। 
দুই. শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী, কোনো অপরাধ করে আইনের আওতায় আসা শিশু।
তিন. কারাগারে আটক সাজাপ্রাপ্ত নারীদের বিশেষ সুবিধা আইন ২০০৬ অনুয়ায়ী সুবিধাপ্রাপ্তির যোগ্য নারী।

বিশেষ সুবিধা আইনে যা বলা আছে:
 ক. কয়েদি শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি
 খ. বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ যেমন—ব্লক বা বাটিক, সূচিশিল্প, হেয়ার কাটিং, বাঁশ ও বেতের কাজ, দরজিবিজ্ঞান, কাপড়ের ফুল তৈরি ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান
 গ. কারাগারের অভ্যন্তরে থাকাকালীন বিভিন্ন ট্রেড কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কয়েদিকে কারাদণ্ড ভোগের পর সমাজে সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত করার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক আফটার কেয়ার সার্ভিস প্রদান
 ঘ. সরকার কর্তৃক, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা বিশেষ সুবিধা হিসাবে ঘোষিত অন্য যেকোনো সুবিধা

প্রবেশন বিষয়ে আইনে যা আছে
দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অধ্যাদেশ, ১৯৬০ (১৯৬৪ সংশোধিত)-এর ৪ ধারা অনুযায়ী, আগে দণ্ড বা শাস্তি পাননি কিংবা দুই বছরের বেশি মেয়াদে দণ্ড হবে না এমন অপরাধ এবং আসামির ক্ষেত্রে প্রবেশন প্রযোজ্য হবে। তবে এ ক্ষেত্রে আসামির বয়স, চরিত্র, তার সামাজিক ও পারিবারিক ইতিহাস, দৈহিক কিংবা মানসিক অবস্থা এবং অপরাধের ধরন বা অপরাধ সংঘটিত হওয়ার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিচারক শর্তসাপেক্ষে এটি প্রয়োগ করতে পারেন। 

দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অধ্যাদেশ ও ২০১৯ সালের সুপ্রিম কোর্টের পরিপত্র অনুযায়ী, এ ধরনের প্রবেশন মঞ্জুর করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক বা ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রবেশন কর্মকর্তার উপস্থিতি নিশ্চিত করে, তাঁর অধীনে আসামিকে ন্যস্ত করবেন। আসামি ওই কর্মকর্তার অধীনে দণ্ডের মেয়াদ পর্যন্ত তদারকিতে থাকবেন। 

তবে এই অধ্যাদেশের ৫ ধারা অনুযায়ী, মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হওয়ার মতো কিংবা গুরুতর কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে প্রবেশন প্রযোজ্য হবে না।

অধ্যাদেশের ৬ ধারার বিধান অনুযায়ী, আদালত যুক্তিসংগত মনে করলে অন্য কোনো শাস্তি না দিয়ে অপরাধীর হাতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং মামলার খরচ পরিশোধের আদেশও দিতে পারবেন।

প্রবেশনের ওপর আপিল বিভাগের রায়
‘নুর মোহাম্মদ বনাম সরকার এবং অন্যান্য’ শীর্ষক এক মামলায় ২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারি আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ে ১৯৬০ সালের দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অধ্যাদেশের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। রায়ে বলা হয়, বাংলাদেশে ৬২ শতাংশের বেশি মানুষ গ্রামে বাস করে, যেখানে মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক শহরের তুলনায় বেশি। তাদের মধ্যে ছোটখাটো ঝগড়াবিবাদও বেশি হয়। 

রায়ে আপিল বিভাগ বলেন, ‘দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে যে, বিচারিক আদালতের বিচারক ও আপিল আদালতের বিচারক সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেছেন যে, আমাদের দেশে দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অরডিন্যান্স, ১৯৬০ নামে একটি আইন আছে। বর্তমান মামলার প্রেক্ষাপটে সেই আইনের ৫ ধারা প্রয়োগযোগ্য।’

‘মামলার বিষয়বস্তু থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এ ঘটনা ঘটেছিল দুই প্রতিবেশীর মধ্যে তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে। এসব ক্ষেত্রে আসামিকে এক বছরের জন্য জেলে না পাঠিয়ে প্রবেশনে রাখা সমীচীন ছিল। যেহেতু দণ্ডবিধির ৩২৩ ও ৩২৫ ধারা আপসযোগ্য অপরাধ এবং দুই পক্ষ হচ্ছে পরস্পর আত্মীয়/প্রতিবেশী। কাজেই মামলাটি আপস-মীমাংসায় যুক্তিযুক্ত ছিল।’ যোগ করেন আপিল বিভাগ।

মামলার সার সংক্ষেপ, আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১৪৭ / ১৪৮ / ১৪৯ / ৩২৩ / ৩২৪ / ৩২৫ / ৩২৬ / ৩০৭ / ৩৫৪ / ৩৪ ধারায় অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। আদালতে দণ্ডবিধির ৩২৩ / ৩২৪ / ৩২৫ / ৩২৬ / ৩০৭ / ৩৪ / ১৪৭ ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়। বিচার শেষে আসামি নূর মোহাম্মদকে ৩২৫ ধারার অপরাধের জন্য এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৩২৩ ধারার অপরাধের জন্য ২ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অন্য আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদের সাজা ও জরিমানার রায় দেন। 

রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল করলে তা খারিজ হয়ে যায়। এরপর আসামিরা হাইকোর্ট বিভাগে ক্রিমিনাল রিভিশন দায়ের করলে সেটিও শুনানি শেষে খারিজ হয়। হাইকোর্ট বিভাগের ওই খারিজ আদেশে সংক্ষুব্ধ হয়ে আসামি নুর মোহাম্মদ ক্রিমিনাল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল করেন। আপিল বিভাগ এই মামলার রায়ে উল্লেখ করেন, তুচ্ছ ঘটনা থেকে উদ্ভূত এই মামলায় আসামিকে এক বছরের জন্য জেলে না পাঠিয়ে প্রবেশনে রাখা সমীচীন ছিল। এরপর আপিল বিভাগ নুর মোহাম্মদকে দোষী সাব্যস্তের আদেশ এবং জরিমানা বহাল রেখে তিনি যত দিন কারা ভোগ করেছেন তত দিনই তাঁর দণ্ড হিসেবে গণ্য করার আদেশ দেন।

স-সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত