Ajker Patrika

মাইলস্টোনের আঙিনা

পোড়া শরীর ও পোশাকে শিশুদের আর্তনাদ

আমানুর রহমান রনি, ঢাকা 
আপডেট : ২২ জুলাই ২০২৫, ০০: ৩৯
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাঠে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান (এফ-৭ বিজিআই) বিধ্বস্ত হয়। ছবি: আজকের পত্রিকা
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাঠে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান (এফ-৭ বিজিআই) বিধ্বস্ত হয়। ছবি: আজকের পত্রিকা

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আঙিনার বাতাস গতকাল দুপুর থেকে ভারী হয়ে ওঠে কান্নায়। বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানটি হায়দার আলী ভবনের প্রধান ফটকে পড়ে বিধ্বস্ত হতেই বেমালুম পাল্টে যায় শিক্ষাঙ্গনের প্রাণচঞ্চল পরিবেশ। বিস্ফোরণের বিকট শব্দে বিমূঢ় হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীসহ সবাই। শুরু হয় দৌড়াদৌড়ি, আর্তনাদ।

শত শত শিক্ষার্থী, অপেক্ষমাণ অভিভাবক এবং স্কুলের কর্মীদের মধ্যে দেখা দেয় বিভ্রান্তি। অভিভাবকেরা আকুল হয়ে নিজ নিজ সন্তানকে খুঁজতে থাকেন। কেউ পাচ্ছিলেন, কেউ পাচ্ছিলেন না। শিক্ষার্থীসহ অনেকে রক্তাক্ত, পোড়া পোশাক ও শরীরে ছুটছে। কেউ বসে কাতরাচ্ছে। আবার কারও নিথর দেহ পড়ে আছে মাটিতে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় এটাই ছিল ঘটনার ঠিক পরের মুহূর্তে স্কুল প্রাঙ্গণের চিত্র।

এই প্রতিবেদক বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার কিছু সময় পরই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে পৌঁছে দেখতে পান মর্মস্পর্শী দৃশ্যগুলো। স্কুলের মাঠ ও মূল ফটক ছাড়িয়ে আশপাশের গলিগুলোর পরিবেশ অভিভাবক আর স্বজনদের কান্না আর হাহাকারে ভারী হয়ে উঠেছে। সবার চোখেমুখে একটাই প্রশ্ন—‘আমার সন্তান কোথায়?’

‘ছেলেটাকে দেখতে চাই’

চোখে পানি, মুখে অস্ফুট কথা—পাগলপ্রায় আয়েশা বেগম সন্তানের খোঁজ করছিলেন। তাঁর ছেলে সজীব হোসেন পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে। স্কুলে ছুটে এসে ছেলের খোঁজ পাচ্ছিলেন না। মূল ফটকের সামনে বসে বারবার ছেলের নাম বলছিলেন তিনি। আয়েশা বেগম বলছিলেন, ‘ছেলেটাকে শুধু দেখতে চাই একবার, বাঁচল কি না জানি না, কিন্তু চোখের দেখা দেখতে চাই...।’

‘আইডি ৫১৭১’-এর মায়ের আর্তি

মিরপুর থেকে ছুটে এসেছেন শিরিন সুলতানা। তাঁর ছেলে সাজ্জাদ সাদি দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। শিরিন চিৎকার করে বলছিলেন, ‘ওর আইডি নম্বর ৫১৭১। কোনো তালিকায় কি নাম আছে? কেউ কি দেখেছে আমার ছেলেকে?’ বলতে বলতে ওড়না দিয়ে চোখ মুছছিলেন উদ্বিগ্ন মা। স্কুল গেটের বাইরে তখন তাঁর মতো আরও শত শত অভিভাবক নিজ নিজ প্রিয়জনের খোঁজে দাঁড়িয়ে।

তিনজনের খোঁজে আহাজারি

মোহাম্মদপুর থেকে এসেছেন তাজ দীঘি হোসেন। কান্না থামছিল না তাঁর। কাতর কণ্ঠে বলছিলেন, ‘আমার দুই ভাই কামরুল আর আরিফ, সাথে ভাগনে—ওরা তিনজনেই স্কুলে ছিল। কোথাও পাচ্ছি না তাদের। কেউ বলে হাসপাতালে, কেউ বলে মর্গে। আমি কোথায় যাব?’ তাজের এই প্রশ্নের উত্তর ছিল না কারও কাছে।

ছোট ছেলেটা নেই

লাকি আক্তার এসে বড় ছেলেকে খুঁজে পেয়েছেন আহত অবস্থায়। কিন্তু ছোটটি তখনো নিখোঁজ ছিল। লাকির মুখে কথা নেই। চোখের দৃষ্টি স্থির। শুধু ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন।

‘চেনাই যাচ্ছে না কাউকে’

কাঁপা কাঁপা গলায় ফেরদৌসী বেগম বললেন, ‘আমার মেয়েটা এখনো নিখোঁজ। আহতদের কেউ কেউ বের হচ্ছে; কিন্তু অনেকের মুখসহ শরীরে পোড়া। এই অবস্থায় কাউকে তো চিনতে পারছি না। মেয়ের ছবি দেখাচ্ছি। কিন্তু ছোটাছুটির মধ্যে কেউ কিছু বলতে পারছে না।’

নিরলসভাবে উদ্ধারকাজ

সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, র‍্যাব, বিজিবি, রেড ক্রিসেন্ট এবং উত্তরার বিভিন্ন থানা-পুলিশের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন। স্বজনদের স্বস্তি দিতে জীবিত কিংবা মৃত—যেভাবেই হোক, নিখোঁজদের খুঁজে বের করাই ছিল তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য।

মাইলস্টোন স্কুলের প্রতিটি ইট যেন এক মর্মন্তুদ ঘটনার সাক্ষী হলো গতকাল। ২১ জুলাই দুর্ঘটনার আগপর্যন্ত হাসি-গল্পে প্রাঙ্গণ আলো করা কত শিক্ষার্থীর পা আর কখনোই পড়বে না এই প্রাঙ্গণে! এই করুণ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকবে বাকিরা। তাদেরও অনেকের হয়তো কাছ ঘেঁষে ফিরে গেছে মৃত্যু।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তৃতীয়বার বিধ্বস্ত হলো বিমানবাহিনীর এফ-৭, এই চীনা যুদ্ধবিমানের বৈশিষ্ট্য কী

উত্তরায় বিমান বিধ্বস্ত: পাইলটসহ নিহত ২২, আহত দেড় শতাধিক, মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় শোক

৯ লাখ টন চাল কিনবে বাংলাদেশ, আশায় বুক বাঁধছেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা

উত্তরায় বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত

পাইলটের মা-বাবাকে বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজে নেওয়া হলো ঢাকায়

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত