Ajker Patrika

জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট

কান্না, রক্তের আকুতি

শাহরিয়ার হাসান, ঢাকা
আপডেট : ২২ জুলাই ২০২৫, ০১: ০১
স্ট্রেচারে করে নেওয়া হচ্ছে আহত শিক্ষার্থীকে। গতকাল রাজধানীর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। ছবি: আজকের পত্রিকা
স্ট্রেচারে করে নেওয়া হচ্ছে আহত শিক্ষার্থীকে। গতকাল রাজধানীর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। ছবি: আজকের পত্রিকা

একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স আসছে। ভেতর থেকে বের করে আনা হচ্ছে কোমলমতি শিশুদের। তাদের কারও হাত-পা, কারও মুখমণ্ডল, আবার কারও শরীরের অধিকাংশই দগ্ধ। তাদের আর্তনাদ ও স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে রাজধানীর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট।

গতকাল সোমবার রাজধানীর দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ ৬০ শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে ভর্তি করা হয়েছে বার্ন ইনস্টিটিউটে। হাসপাতালে ঢোকার মুখেই চোখে পড়ে রক্তের জন্য আকুতি। রোগীকে বাঁচাতে ‘রক্ত চাই’। বিভিন্ন গ্রুপের পজিটিভ রক্ত মিললেও নেগেটিভ রক্তের জন্য ছিল হাহাকার। একজন বাবা কাঁপা কণ্ঠে বললেন, ‘রক্ত না পেলে আমার ছেলেটা বাঁচবে না।’

হাসপাতালের ছয়তলায় উঠে দেখা যায়, ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক মা। তাঁর পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে নুরে জান্নাত ইউশার শরীরের ৬ শতাংশ পুড়ে গেছে। মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে মা ছটফট করছেন। বলছিলেন, ‘আমার একমাত্র মেয়ে, আল্লাহ ওকে যেন বাঁচিয়ে দেয়।’

হাসপাতালের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে একজন বাবা চিৎকার করছেন, ‘আমার ছেলেটা কোথায়? এই অ্যাম্বুলেন্সে আমার ছেলেটা আছে? ওর নাম সামি।’ কিন্তু তিনি তাঁর ছেলের দেখা পাননি। ছুটে গেলেন অন্য হাসপাতালে।

গতকাল বিকেল গড়াতে না গড়াতেই বার্ন ইনস্টিটিউটের দেয়ালগুলো যেন হয়ে ওঠে কান্নার প্রাচীর। ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুজনের মৃত্যু হয় ততক্ষণে। কিন্তু তখনো তাদের স্বজনেরা জানেন না প্রিয় মানুষটি চলে গেছে।

রাতে হাসপাতালের ৭০৫ নম্বর ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁর মেয়ে মুনতাহা তোয়া মাইলস্টোন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। দুর্ঘটনার খবর শুনে ছুটে যান ঘটনাস্থলে। তখনো ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছায়নি।

কাঁদতে কাঁদতে আবুল কালাম জানান, গিয়ে দেখেন ১০-১৫টা লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। সব পুড়ে ছাই। দেড় ঘণ্টা পোড়া লাশের পাশে দাঁড়িয়ে মেয়ের খোঁজ করেছেন। একসময় একজন শিক্ষক ফোন করে বলেন, মেয়েকে জীবিত পাওয়া গেছে। এরপর এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটতে থাকেন। শেষে বার্ন ইনস্টিটিউটে মেয়েকে পান। এই বাবা বলেন, ‘এসে দেখি আমার মেয়ের সোনা মুখটা পুড়ে কালো হয়ে গেছে। একবার চোখ মেলে দেখলেও বাবা ডাকতে পারেনি।’

‘শুধু পোশাক দেখে শনাক্ত করার চেষ্টা’

হাসপাতালের নিচতলায় অসংখ্য স্বজন ছুটে আসছেন নিখোঁজ শিশুদের খুঁজতে। কেউ কাপড় দেখে চেনার চেষ্টা করছেন। কেউ ছবি দেখিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছে জানতে চাইছেন, ‘এই মেয়েটিকে কি আনা হয়েছে?’ জবাব নেই কারও মুখে। পরে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াদের তালিকায় নাম খুঁজে না পেয়ে কেউ কেউ অচেতন হয়ে পড়ছেন।

সামিয়া নামের তৃতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে খুঁজছেন তার চাচা রাকিব। তাঁর ভাই এক হাসপাতালে, ভাবি এক হাসপাতালে আর তিনি এসেছেন বার্ন ইনস্টিটিউটে। কিন্তু কোথাও নেই সামিয়া। রাকিব বলেন, এই অবুঝ বাচ্চাদের সঙ্গে এমন কেন হলো। কীভাবে সহ্য করবে মা-বাবা।

এদিকে দুর্ঘটনার খবরের পর থেকেই বার্ন ইনস্টিটিউট চত্বর যেন হয়ে ওঠে এক মানবিক যুদ্ধক্ষেত্র। ছাত্র, চিকিৎসক, নার্স, স্বেচ্ছাসেবক—সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ হল থেকে শিক্ষার্থীরা সারবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে অ্যাম্বুলেন্স চলাচলের জন্য রাস্তা করে দিচ্ছেন। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট, রোভার স্কাউট, বুয়েট ও মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা রক্তের জন্য সংগ্রহ অভিযান চালাচ্ছেন।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় গুরুতর দগ্ধ অন্তত ৬০ জন শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে ভর্তি করা হয়েছে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। আহতদের অধিকাংশের বয়স ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। তাদের মধ্যে ২৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। কারও কারও শরীরের ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত পুড়ে গেছে। অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় ১০ জনকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। তাদের মধ্যে দুজন ইতিমধ্যে মারা গেছে।

জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন শাওন বিন রহমান বলেন, এ পর্যন্ত ৬০ জনের বেশি আহত ভর্তি হয়েছে, যাদের বেশির ভাগই স্কুলের শিক্ষার্থী। প্রায় সবাই গুরুতর অবস্থায় রয়েছে। কারও কারও শরীর কম দগ্ধ হলেও গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পুড়ে যাওয়ায় তাদের অবস্থা খারাপ।

বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রোগীদের একটি তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দগ্ধ অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। দগ্ধদের মধ্যে নাফির শরীরের ৯৫ শতাংশ, আব্দুল্লাহ শামীমের ৯০ শতাংশ, শায়ান ইউসুফের ৯৫ শতাংশ, শামিমার ২০ শতাংশ, মাহিয়া তাসনিমের ৪৫ শতাংশ, আফনান ফাইয়াজের ৯৫ শতাংশ, বাপ্পি সরকারের ৩৫ শতাংশ ও মাসুদার শরীরের ৯৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। অন্যদিকে তাসনিয়ার ৩৫ শতাংশ, ১১ বছর বয়সী আরিয়ানের ৫৫ শতাংশ, আশরাফুল ইসলামের ১৫ শতাংশ, রোহানের ৫০ শতাংশ, শ্রেয়ার ৫ শতাংশ, কাব্যর ২০ শতাংশ, ইউশার ৬ শতাংশ ও রূপী বড়ুয়ার ৬ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। আরও অনেক শিক্ষার্থীর শরীরের বিভিন্ন মাত্রায় পোড়া রয়েছে। হাসপাতালের তালিকায় নওরিন ও মাসুকা নামের দুজন রোগী রয়েছে, যাদের বয়স ও কোন মাত্রায় দগ্ধ, তা উল্লেখ করা হয়নি।

জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে কথা হয় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষকের সঙ্গে। ঘটনার ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে ওই শিক্ষক বলেন, ঘটনাটি এতটা আকস্মিক ছিল যে কেউ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেনি। স্কুল ছুটির ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই ছাত্রছাত্রীরা লাইনে দাঁড়িয়েছিল, তখন বিমানটি ভবনের ওপর ভেঙে পড়ে। মুহূর্তেই আগুন ও ধোঁয়ায় চারপাশ ঢেকে যায়।

এই ঘটনায় বিকেল থেকে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সাধারণ মানুষ হাসপাতালের বাইরে ভিড় করে। জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম তলায় দগ্ধদের চিকিৎসা চলছে। স্বজনেরা বারান্দা ও করিডরে দাঁড়িয়ে আহাজারি করছেন।

আহতদের দেখতে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে গিয়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা। সেই সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারাও ছিলেন। এতে হাসপাতালের সামনে ব্যাপক ভিড় হয়। বিকেলে এই হাসপাতালে যান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান।

এর আগে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল; বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়বিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা) অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম প্রমুখ হাসপাতালটিতে যান।

হাসপাতালের সামনে ব্যাপক ভিড় সৃষ্টি হওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে সেখানে। দুর্ঘটনার পরপরই জরুরি চিকিৎসা সহায়তার জন্য জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে একটি হটলাইন চালু করা হয়েছে, যার নম্বর ০১৯৪৯০৪৩৬৯৭।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তৃতীয়বার বিধ্বস্ত হলো বিমানবাহিনীর এফ-৭, এই চীনা যুদ্ধবিমানের বৈশিষ্ট্য কী

উত্তরায় বিমান বিধ্বস্ত: পাইলটসহ নিহত ২২, আহত দেড় শতাধিক, মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় শোক

৯ লাখ টন চাল কিনবে বাংলাদেশ, আশায় বুক বাঁধছেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা

উত্তরায় বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত

পাইলটের মা-বাবাকে বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজে নেওয়া হলো ঢাকায়

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত