Ajker Patrika

নারীর প্রতি সাইবার অপরাধ রুখে দাঁড়াতে আইনি অধিকার জানতে হবে

ব্যারিস্টার ইফফাত গিয়াস আরেফিন
আপডেট : ২৩ জুলাই ২০২৫, ০৯: ১৯
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। বন্ধুদের সঙ্গে সংযোগ, মতপ্রকাশ, ব্যবসা, এমনকি সচেতনতা তৈরির কাজেও এখন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা হচ্ছে। এই প্রযুক্তির আলোর নিচে গাঢ় হয়ে উঠেছে এক নতুন অন্ধকার, যাকে বলা হয় সাইবার হয়রানি। এই অন্ধকারের বড় শিকার হচ্ছে নারীরা। ২০২২ সালে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের এক সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৬৩ দশমিক ৫১ শতাংশ নারী উত্তরদাতা জানিয়েছেন, তাঁরা অনলাইন সহিংসতার শিকার। ২০২১ সালে এই হার ছিল ৫০ দশমিক ১৯ শতাংশ।

সম্প্রতি বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে দেখা যাচ্ছে, নারীদের বিরুদ্ধে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক,

এক্স এবং ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে নির্যাতন, কটূক্তি, ছবি বিকৃতি ও ব্ল্যাকমেলের মতো অপরাধ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলছে। সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন অ্যান্ড চাইল্ডের রেকর্ড অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে ২৯টি অনলাইন ও প্রযুক্তিসংক্রান্ত সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাগুলো গোপন ভিডিও, এআই-জেনারেটেড অশ্লীল ছবি এবং ব্যক্তিগত তথ্য অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো বিপজ্জনক কাজগুলোতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সমাজের যেকোনো বিষয় উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো পোস্ট করা হলে সেখানে অবলীলায় যে কেউ পোস্টদাতা নারীকে আজেবাজে মন্তব্য থেকে শুরু করে ধর্ষণের হুমকি পর্যন্ত দিয়ে দিচ্ছে।

এবং ব্যক্তিগত তথ্য অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো বিপজ্জনক কাজগুলোতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সমাজের যেকোনো বিষয় উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো পোস্ট করা হলে সেখানে অবলীলায় যে কেউ পোস্টদাতা নারীকে আজেবাজে মন্তব্য থেকে শুরু করে ধর্ষণের হুমকি পর্যন্ত দিয়ে দিচ্ছে।

সামাজিক মাধ্যমে হয়রানির বিরুদ্ধে একজন নারী ধাপে ধাপে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারে। ধাপগুলো জেনে রাখা জরুরি।

হয়রানির ধরন চিহ্নিত করা

আপনি ঠিক কোন ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন, সেটি চিহ্নিত করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাধারণত যেসব হয়রানি হয়—

  • অশ্লীল বার্তা বা ছবি পাঠানো
  • অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও প্রকাশ
  • কটূক্তি, বডি শেমিং, গালিগালাজ
  • মিথ্যা তথ্য বা গুজব ছড়ানো
  • ব্ল্যাকমেলিং বা হুমকি দেওয়া
  • ফেক প্রোফাইল খুলে ভুয়া কনটেন্ট ছড়ানো

এগুলো আইনের আওতায় পড়লে তা সাইবার ক্রাইম হিসেবে গণ্য হয়।

ছবি: আজকের পত্রিকা
ছবি: আজকের পত্রিকা

প্রমাণ সংরক্ষণ করা

  • আইনি লড়াইয়ে প্রমাণই মুখ্য অস্ত্র। কাজেই স্ক্রিনশট বা ভিডিও রেকর্ড করে সংরক্ষণ করতে হবে আলামত।
  • বিশেষভাবে, তারিখ, সময়সহ হ্যারেজমেন্টের স্ক্রিনশট
  • হুমকির ভয়েস মেসেজ বা ভিডিও
  • ওই ব্যবহারকারীর প্রোফাইল লিংক
  • যেসব পোস্ট বা মন্তব্যে হয়রানি করা হয়েছে, সেগুলোর ইউআরএল

সোশ্যাল মিডিয়ায় রিপোর্ট করা

যেকোনো প্ল্যাটফর্মেই থাকে রিপোর্টিং মেকানিজম। সেখানে রিপোর্ট করুন।

  • ফেসবুকে: নির্দিষ্ট পোস্ট বা মন্তব্যে গিয়ে ফাইন্ড সাপোর্ট অর রিপোর্টে ক্লিক করে রিপোর্ট করুন।
  • ইনস্টাগ্রাম/টিকটক: প্রোফাইল বা কনটেন্ট অপশন থেকে রিপোর্ট করা যায়।
  • ইউটিউব: ভিডিওর নিচে ফ্ল্যাগ আইকনে ক্লিক করে রিপোর্ট করা যায়।

যদিও সব সময় এসব রিপোর্ট দ্রুততম সময়ে কাজ করে না। তবে এটি আপনার পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়ক হবে। কারণ, আপনি প্রমাণ করতে পারবেন যে নিজেই আগে রিপোর্ট করেছেন।

স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাহায্য নেওয়া

বাংলাদেশে সাইবার অপরাধের জন্য যোগাযোগ করতে পারেন—

  • সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন
  • বাংলাদেশ পুলিশের সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন ফেসবুক পেজ
  • ১১১ (জাতীয় হেল্পলাইন)
  • ৯৯৯ (জরুরি সেবা নম্বর)
  • এ ছাড়া চাইলে সরাসরি থানায় সাধারণ ডায়েরি করা যাবে। তবে ভালো হয় সাইবার ক্রাইম ইউনিটে অভিযোগ করা।

অনলাইন এফআইআর বা অভিযোগ দাখিল

দেশে এখন অনলাইনেও অভিযোগ করা যায়। এ জন্য cid.gov.bd ওয়েবসাইটে গিয়ে Complaint অপশনে গিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য দিন। তারপর স্ক্রিনশট ও ডকুমেন্ট আপলোড করুন।

লিগ্যাল সাপোর্ট চাওয়া

ভুক্তভোগী চাইলে নারী সহায়তা সংস্থা বা নির্দিষ্ট এনজিও অথবা আইনজীবীর সহায়তা নিতে পারেন। এ জন্য যোগাযোগ করা যায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এবং ব্র্যাকের লিগ্যাল এইড বিভাগে।

মামলা করার পথ

পর্নোগ্রাফি আইন ভঙ্গ, হুমকি বা ব্ল্যাকমেল, সম্মানহানিকর ভিডিও বা ছবি ছড়ানোর মতো গুরুতর অপরাধ হলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ অনুযায়ী মামলা করা যায়। এ ক্ষেত্রে মানহানিকর তথ্য প্রকাশের জন্য ২৪, অপপ্রচার, গুজবের জন্য ২৫, সম্মানহানিকর ডিজিটাল কনটেন্ট ছড়ানোর জন্য ২৯ এবং নৈতিক অবক্ষয় বা ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য ৩১ ধারায় মামলা করা যাবে।

গোপনীয়তা রক্ষা ও সুরক্ষা চাওয়া

অনেক নারী আইনি ব্যবস্থা নিতে ভয় পান সমাজ, পরিবার বা পরিচিতদের কারণে। ভুক্তভোগী চাইলে, আদালতে বা পুলিশের কাছে নাম ও তথ্য গোপন রাখার আবেদন করতে পারেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে নারীর গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।

প্রতিবাদ মানেই লাইভে এসে কান্না করা নয়। প্রতিবাদ মানে আইনকে হাতিয়ার করে অপরাধীর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। প্রযুক্তির অপব্যবহারে যারা নারীদের সম্মানহানি করে, তাদের রুখে দাঁড়াতে নারীদের আইনি অধিকার সম্পর্কে জানা থাকা চাই। আমরা সবাই মিলে যদি জানি, জানাই এবং পাশে দাঁড়াই; তবেই সম্ভব হবে একটি নিরাপদ অনলাইন সমাজ গড়ে তোলা।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত