Ajker Patrika

জনরোষের মুখে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়েছিল মেরি নামের হাতিটিকে

ইশতিয়াক হাসান
আপডেট : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৫: ৫৭
Thumbnail image

হাতিকে ফাঁসি দেওয়ার কথা শুনেছেন কখনো? অবিশ্বাস্য শোনালেও এমন একটি ঘটনা সত্যি ঘটেছিল। তবে সেটা আজ থেকে ১০০ বছরেরও বেশি আগের কাহিনি। 

গায়ে-গতরে বিশাল এক হাতি ছিল মেরি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্পার্কস ওয়ার্ল্ড ফেমাস শোজ সার্কাসে খেলা দেখাত সে। টেনেসির কিংসপোর্টে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিকে মেরে ফেলে সে। এ অপরাধেই ফাঁসিতে ঝুলতে হয় তাকে। পৃথিবীর ইতিহাসে জানামতে, হাতিকে ফাঁসিতে ঝোলানোর এই একটিই নজির আছে। 

১৯১৬ সালে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয় হাতিটির। তার মৃত্যুকে কখনো কখনো বিশ শতকের গোড়ার দিকে সার্কাসের পশু নির্যাতনের একটি নৃশংস উদাহরণ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। 

স্পার্কস ওয়ার্ল্ড ফেমাস শোজ সার্কাসের পোস্টার। ছবি: সংগৃহীতমেরির গল্প শুরু উনিশ শতকের শেষ দিকে, চার্লি স্পার্কসের হাত ধরে। আট বছর বয়স থেকেই স্পার্কস সার্কাসের খেলা দেখাতে শুরু করেন। পরে তিনি ওয়ার্ল্ড ফেমাস শোজ সার্কাসটির মালিক হন। নানা ধরনের খেলা দেখানো হতো সেখানে। সিংহ, হাতিসহ নানা ধরনের প্রাণী ছিল তাদের। মেরি এগুলোর একটি। স্পার্কসের বাবা মেরিকে কেনার সময় এর বয়স ছিল চার। চার্লি ও তাঁর স্ত্রী অ্যাডি মিচেল হাতিটিকে আদর-যত্নেই বড় করে তুলেছিলেন। 

গায়ে গতরে বিশাল হয়ে ওঠায় বিগ মেরি নাম পেয়ে যায় সে। বলা হয়, সার্কাসে খেলা দেখানোর জন্য নাম কামানো আরেক বিশালদেহী হাতি ‘জাম্বু’র (১৮৬০-১৮৮৫) থেকেও উচ্চতা বেশি ছিল তার। শহর থেকে শহরে বন্দর থেকে বন্দরে দর্শনার্থীদের রোমাঞ্চিত ও মুগ্ধ করত মেরি খেলা দেখিয়ে। বাদ্যযন্ত্র বাজানো, মাথার ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ানো, এমনকি বেসবল ধরা—এমন নানা মনোমুগ্ধকর খেলা দেখিয়ে শান্ত এই ‘দৈত্য’ মুগ্ধ করে দর্শনার্থীদের। মেরি একপর্যায়ে সার্কাসটির বড় আকর্ষণে পরিণত হয়। বছরের পর বছর ধরে স্পার্কসের শোতে অনেক দর্শক টেনে এনেছে সে। 

মেরিকে ফাঁসিতে ঝোলানো দেখতে হাজির হওয়া মানুষ। ছবি: সংগৃহীততারপরই এল সেই ভয়াল দিন। কিছুটা মতভেদ থাকলেও যদ্দুর জানা যায় তারিখটা ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯১৬। ওয়াল্টার এলড্রিজ নামের লাল চুলো এক লোককে হাতির প্রশিক্ষকের সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেয় স্পার্কস ওয়ার্ল্ড ফেমাস শোজ সার্কাস। লাল চুলের কারণে রেড নামে পরিচিত ছিলেন তিনি। 

রেডের হাতি সামলানোর কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না আগে। অবশ্য মূলত হাতিটিকে খাওয়ানো, গোসল করানোর দায়িত্ব ছিল তাঁর। বলা হয়, ঘটনাটি ঘটার সময় হাতির শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন এলড্রিজ মেরির পিঠে বসে। কেউ কেউ আবার বলেন, পানি খাওয়ানোর জন্য কাছের জলাশয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি হাতিটিকে। 

এলড্রিজের মৃত্যু নিয়ে নানা ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়। এর মধ্যে একটা বর্ণনা ডব্লিউ এইচ কোলম্যান নামের এক ব্যক্তির। ঘটনা কাছ থেকে দেখেছিলেন বলে দাবি কোলম্যানের। তাঁর বক্তব্য হলো, হাতিটি একটি তরমুজের খোসা খাওয়ার জন্য নিচু হলে একটি হুক বা ‘হাতির লাঠি’র চোখা অংশ দিয়ে প্রাণীটির কানের পেছনে খোঁচা দেন এলড্রিজ। এখানে বলে রাখা ভালো, এলিফ্যান্ট স্টিক হলো এক প্রান্তে একটি ধারালো বর্শাসহ একটি লাঠি। 

আর খোঁচা খেয়ে ক্ষেপে গিয়ে হাতিটা শুঁড় দিয়ে টেনে ওপরে তুলে ফেলে এলড্রিজকে। তারপর ছুড়ে ফেলে দেয় লোকটিকে এবং মাথায় পা দিয়ে মাড়িয়ে সেটিকে পিষে দেয়। 

কেউ কেউ অবশ্য দাবি করেন, হাতিটি কেবল তার শুঁড় দিয়ে এলড্রিজের মাথায় আঘাত করেছিল। এতেই মারাত্মক আঘাত পেয়ে সে মারা যায়। 

আতঙ্কিত দর্শক চিৎকার করে পালাতে শুরু করে। এ সময় একজন কামার তার পিস্তল থেকে হাতিটির দিকে গুলি ছোড়েন। একে একে পাঁচটি গুলি করেন তিনি। তবে প্রাণীটির পুরু চামড়ায় এর প্রভাব পড়ে কমই। 

তখন হাতিটি স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং হঠাৎ আবার শান্ত হয়ে পড়ে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছিল গুলি এবং হট্টগোল করতে থাকা মানুষদের ‘হাতিটিকে হত্যা করো, হাতিটিকে হত্যা করো’ স্লোগান সম্পর্কে পুরোপুরি বিস্মৃত হয়েছিল সে। 

সার্কাসের আরেক বিখ্যাত হাতি জাম্বু। ছবি: সংগৃহীতসার্কাসটির মালিক চার্লস স্পার্কস মেরিকে পেলে-পুষে বড় করলেও বুঝতে পারলেন ফুঁসতে থাকা জনতাকে সামলানোর একমাত্র উপায় হলো প্রকাশ্যে হাতিটিকে মেরে ফেলা। না হলে তাঁর সার্কাসের ব্যবসাই লাটে উঠবে। অনেক ভেবেচিন্তে একটি ক্রেনের সাহায্যে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে মারার সিদ্ধান্ত হয় প্রাণীটিকে। 

পরদিন, অর্থাৎ ১৩ সেপ্টেম্বর ছিল বৃষ্টিস্নাত ও কুয়াশাচ্ছন্ন। ট্রেনে করে মেরিকে নিয়ে আসা হলো পাশের শহর আরউইনে। সেখানে ক্লিনটফিল্ড রেইলরোড ইয়ার্ডে জড়ো হয়েছিল আড়াই হাজারের বেশি মানুষ। 

ওই উঠোনের দিকে যখন মেরিকে নিয়ে যাওয়া হলো, সার্কাসের অপর চারটি হাতি তাকে অনুসরণ করে। প্রত্যেকে তাদের শুঁড় সামনের হাতিটির লেজে জড়িয়ে রাখছিল, ঠিক যেমনটি তারা আগের অসংখ্য শোভাযাত্রায় করেছে। চার্লি স্পার্কস আশা করেছিলেন যে তাদের উপস্থিতি হাতিটিকে শান্ত রাখবে। মেরির গলায় যখন একটি চেইন আটকে দেওয়া হলো তখন বাকি হাতিরা করুণ কণ্ঠে ডেকে উঠল, যেন মেরিকে বিদায় দিচ্ছিল তারা। স্পার্কস আশঙ্কায় ছিলেন, মেরি হয়তো পালানোর চেষ্টা করবে। 

এটি যাতে না ঘটে তার জন্য তার একটি পা রেলগাড়ির সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়। একসময় ক্রেনের সাহায্যে হাতিটিকে শূন্যে তোলা হয়। তবে তাকে পাঁচ ফুটের বেশি ওঠানো সম্ভব হয়নি। কারণ মেরির গলায় আটকানো শিকল ভেঙে যায়। এতে এটি মাটিতে আছড়ে পড়ে এবং নিতম্ব ভেঙে যায়। 

সব সময়ই সার্কাসের বড় আকর্ষণ হাতির খেলা। ছবি: সংগৃহীতএকটু পর ক্রেনটির সাহায্যে আবার মেরিকে শূন্যে তোলা হলো। যন্ত্রণায় বিশাল পাগুলো ছুঁড়ছিল হাতিটা। নিচের মানুষের উল্লাসধ্বনি ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছিল তার চিৎকার। 

একসময় হাতিটা নীরব হয়ে পড়ে এবং আধা ঘণ্টা সেখানে ঝুলে থাকে। এ সময় স্থানীয় একজন পশুচিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই সময় মেরির যে ছবিটি তোলা হয়, সেটি এতটাই হৃদয়বিদারক যে অনেকেই দেখে ভেবেছিল এটিতে কারসাজি আছে। কিন্তু অন্যান্য দলিল ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা নিশ্চিত করে এর সত্যতা। আর এভাবেই মর্মান্তিক এক ঘটনার মাধ্যমে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে যায় মেরি। 

সূত্র: রেয়ার হিস্টরিকাল ফটোজ, এল দেট ইন্টারেস্টিং, উইকিপিডিয়া, ডেইলি মেইল

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত