আজাদুর রহমান চন্দন
বাংলাদেশে উগ্রপন্থার উত্থান নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন ঘিরে সরকারি মহল থেকে যেসব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে, তা আগের আমলের নীতিনির্ধারকদের কথাবার্তারই যেন প্রতিধ্বনি। ‘অ্যাজ বাংলাদেশ রিইনভেন্টস ইটসেলফ, ইসলামিস্ট হার্ড লাইনারস সি অ্যান ওপেনিং’ শিরোনামে ১ এপ্রিল দেড় হাজার শব্দের বেশি আকারের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে পশ্চিমা নিও-লিবারেলদের অন্যতম প্রভাবশালী মুখপত্র হিসেবে বিবেচিত সংবাদপত্রটি। প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু এরই মধ্যে জানা হয়ে গেছে পাঠকদের। প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার দিনেই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সেটিকে ‘বিভ্রান্তিকর ও একপেশে’ আখ্যা দেওয়া হয়। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ‘বিভ্রান্তিকর ও একপেশে’ বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে, যেন বাংলাদেশ ধর্মীয় চরমপন্থীদের দখলে চলে যাওয়ার কাছাকাছি অবস্থায় রয়েছে। পরদিন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ‘উগ্রবাদের উত্থানের’ অভিযোগ নাকচ করে দেন। সরকারের অস্বীকার করার এই প্রবণতা সম্পর্কে মানবাধিকারকর্মী নূর খান ডয়চে ভেলে বাংলাকে বলেছেন, ‘এটা সব সরকারের সময়ই দেখা গেছে। এই সরকারও বাস্তব পরিস্থিতি স্বীকার না করে অস্বীকার করছে। কোনো কোনো নীতিনির্ধারকের অতিকথন আওয়ামী লীগের আমলে যেমন ছিল, তেমনি এখনো আছে। এই অতিকথনওয়ালারাই এখন রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা।’
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে যেসব ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলোর কোনো কোনোটি দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে এর আগেই। সরকার যতই অস্বীকার করুক না কেন, প্রকৃতপক্ষে উগ্রপন্থার উত্থান, নারীবিদ্বেষ ও প্রতিক্রিয়াশীলতার যত ঘটনা ঘটেছে, প্রতিবেদনে তার অনেক কিছুই উঠে আসেনি। ফলে প্রতিবেদনটিকে ‘টিপ অব দি আইসবার্গ’ বা মগ্ন মৈনাকচূড়ার সঙ্গে তুলনা করা যায়। প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পরবর্তী দুই-তিন দিনের মধ্যেও বেশ কয়েকটি ঘটনার কথা উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যমে। যেমন, গাজীপুরের কাপাসিয়ায় মসজিদ কমিটির বাধায় ‘আপন দুলাল’ নাটকের মঞ্চায়ন বাতিল, কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ম্যুরালে কালো কালি মেখে দেওয়া ইত্যাদি। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে ৩ এপ্রিল ঈদ পুনর্মিলনী উপলক্ষে বাউলসন্ধ্যার এক আসর তো মাঝপথে বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন নিজেই। সরকার এখন অস্বীকার করলেও গত ১৮ জানুয়ারি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পুলিশই জানিয়েছিল, ৪ আগস্টের পর থেকে ৪০টি মাজারে ৪৪ বার হামলা হয়েছে। আর বিশ্ব সুফি সংস্থা ২৩ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৮০টি মাজারে হামলা হয়েছে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স গত ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছেন, ‘সাড়ে সাত মাস পরে এসে দেখছি, ওই গণ-অভ্যুত্থানে নানা উগ্র শক্তির আবির্ভাব ছিল। তারা শুরুতেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, ঐতিহ্যের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করল। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী কোনো চক্রান্ত এবং ষড়যন্ত্র সহ্য করা হবে না।’ এই মন্তব্যের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রিন্সকে তুলোধোনা করা হচ্ছে বিশেষ মহল থেকে। জানি না, নিজ দলের ভেতরের ‘অতিবিপ্লবীরা’ তাঁকে কী ভাষায় আক্রমণ করছে! এই উগ্র শক্তি সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু কথা সিপিবির সাধারণ সম্পাদককে বলেছিলাম গত জুলাই মাসে নরসিংদী কারাগার ভেঙে অস্ত্র লুট করার প্রাথমিক সংবাদ পাওয়ার পরপর। তখনো জানা যায়নি যে ওই কারাগার থেকে বন্দী জঙ্গিদের মুক্ত করে নেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া জুলাই মাসেই সাপ্তাহিক একতার একটি প্রতিবেদনে অস্ত্র লুটসহ নানা ঘটনায় ‘ওরা কারা’, সে প্রশ্ন তোলায় দলের ভেতরে কাউকে কাউকে তো রীতিমতো তদন্তের মুখেও পড়তে হয়েছিল।
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের একটি প্রধান জন-আকাঙ্ক্ষা ছিল রাষ্ট্র সংস্কার। সে আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি প্রথম প্রকাশ পায় মূলত ৩ আগস্ট বামপন্থীদের আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘দ্রোহযাত্রা’য়। এরপর ৫ আগস্ট থেকে নতুন নতুন পরিভাষায় সংস্কারের নানা রকম বয়ান শোনা যাচ্ছে, যেগুলোর সঙ্গে সরকারি ভাষ্যেরও অনেক মিল পাওয়া যায়। যা হোক, পুরোনো দলগুলো দিয়ে দেশে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তনের আশা অনেকেই পোষণ করেন না। কী হতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে কারও কারও স্পষ্ট উপলব্ধি থাকলেও অনেকেরই প্রত্যাশা ছিল—গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে হয়তো একটি নতুন রাজনৈতিক দলের অভ্যুদয় ঘটবে, যেটি হবে তারুণ্যের শক্তিতে ভরপুর, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত এবং অবশ্যই বৈষম্যবিরোধী। তারুণ্যনির্ভর নতুন দলের আত্মপ্রকাশ কিন্তু ঘটেছে। কিন্তু মানুষ কি তাদের নিয়ে ততটা আশাবাদী আর আছে?
অনেকটাই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আত্মপ্রকাশের ব্যয়বহুল অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে পাঁচ তারকা হোটেলে ইফতার মাহফিল, নেতাদের হেলিকপ্টার ভ্রমণ ও বিশাল মোটর শোভাযাত্রা—এসব ঘটনায় জনমনে বাড়ছে কৌতূহল ও প্রশ্ন। কোনো কোনো নেতার পক্ষ থেকে ঈদ শুভেচ্ছা জানিয়ে পত্রিকার প্রথম পাতার অর্ধেকজুড়ে চাররঙা বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতেও দেখা গেছে। এগুলো সবই পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এসব কাজের জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থ লাগছে, তার জোগান কোথা থেকে আসছে, তা নিয়ে প্রশ্ন কিন্তু এরই মধ্যে বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বলা হচ্ছে, অর্থদাতাদের নিরাপত্তার খাতিরে তাদের পরিচয় প্রকাশ করা যাচ্ছে না। এটাও প্রচলিত বড় দলগুলোর পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির চেয়ে আলাদা কিছু নয়। আর রাজনৈতিক দলগুলোর টাকা জোগাড় করার এমন উপায়ের কারণেই মূলত লুটেরা ধনিক ও করপোরেট জগৎ বরাবরই জবাবদিহির বাইরে থেকে যাচ্ছে।
বড়লোকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার প্রভাব কেমন হয়, তার কিছু আলামত কিন্তু স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য ৫০ লাখ টাকার চেক দিয়েছিলেন নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। এবার ঈদুল ফিতরের আগে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস না দিয়ে কয়েক শ পোশাক কারখানা বিনা নোটিশে তালা দিয়ে মালিকেরা মোবাইল ফোন বন্ধ করে রাখেন। ফলে বেতন- বোনাসের দাবিতে তখন প্রতিদিনই সড়কে নামেন শ্রমিকেরা। একই দাবিতে শ্রম ভবনের সামনে আন্দোলনরত অবস্থায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান ৪০ বছর বয়সী রামপ্রসাদ সিং। তিনি গাজীপুরের স্টাইল ক্রাফট লিমিটেডে কর্মরত ছিলেন। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের গাজীপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক জালাল হাওলাদারকে পুলিশ ৪ এপ্রিল গ্রামের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। বামপন্থী রাজনৈতিক দলের কর্মীরা ছাড়া অন্য কাউকে দেখা যায়নি শোষিত-নিপীড়িত শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতে। এটা করতে গিয়ে উল্টো তাঁদের ‘ষড়যন্ত্রকারী’র অপবাদ গায়ে মাখতে হয়েছে।
কাজেই নিঃসংকোচে বলা যায়, আমাদের শুধু নতুন রাজনৈতিক দল হলেই হবে না, লাগবে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতিও, যাতে নিশ্চিত হবে জবাবদিহি, স্বচ্ছতা ও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র। সর্বোপরি প্রয়োজন হবে সঠিক শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গিরও। ধনিকশ্রেণির স্বার্থ রক্ষাকারী কোনো রাজনৈতিক দল যত ভালো কথাই বলুক না কেন, তার পক্ষে বৈষম্য দূর করা কখনোই সম্ভব হবে না। আবার এটাও ঠিক যে আমাদের দেশে শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাগাড়ম্বর যত আছে, বাস্তব কাজ সে তুলনায় অনেক কম। অতিবিপ্লবী বুলি আওড়িয়ে দলের ভেতরে প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঘায়েল করা সহজ হওয়ায় এর আশ্রয় নেন অনেক বামপন্থী নেতা-কর্মী। আর সেই সুযোগ কাজে লাগায় বুর্জোয়া শ্রেণিও। লাল পতাকা দিয়ে লাল পতাকা ঠেকানোর কৌশল খাটানো এতে সহজ হয়। ফলে পরিবর্তন আবশ্যক বিদ্যমান বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোতেও। কারণ, দলগুলোতে ‘অমুকের দোসর’, ‘তমুকের দালাল’ নিয়ে চর্চা যত আছে, সে তুলনায় সমাজ-অর্থনীতির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও তর্ক-বিতর্ক যথেষ্ট কম। পুঁজি যে নজরদারিমূলক চরিত্রের মতো নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য লাভ করছে, সে নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা কি তেমন আছে? তথ্যপ্রযুক্তির দু-একটি প্রতিষ্ঠান বিশ্বের কয়েক শ কোটি মানুষের ওপর অবাধে নজরদারি করে চলেছে কিছু অ্যাপ-টুল দিয়ে। ব্যক্তির পছন্দমাফিক কনটেন্ট ও বিজ্ঞাপন সরবরাহ করা হচ্ছে অ্যাপগুলোতে। এর পরিপ্রেক্ষিতে করণীয় কী, সে আলোচনা নজরেই পড়ে না। চর্চা ও প্রয়োগের এমন দীনদশার সুযোগে বিস্তার ঘটছে ‘বামপন্থার বাল্যব্যাধির’। অথচ আশির দশকেও এতটা দৈন্য ছিল না। এই পরিস্থিতির উত্তরণও জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
বাংলাদেশে উগ্রপন্থার উত্থান নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন ঘিরে সরকারি মহল থেকে যেসব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে, তা আগের আমলের নীতিনির্ধারকদের কথাবার্তারই যেন প্রতিধ্বনি। ‘অ্যাজ বাংলাদেশ রিইনভেন্টস ইটসেলফ, ইসলামিস্ট হার্ড লাইনারস সি অ্যান ওপেনিং’ শিরোনামে ১ এপ্রিল দেড় হাজার শব্দের বেশি আকারের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে পশ্চিমা নিও-লিবারেলদের অন্যতম প্রভাবশালী মুখপত্র হিসেবে বিবেচিত সংবাদপত্রটি। প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু এরই মধ্যে জানা হয়ে গেছে পাঠকদের। প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার দিনেই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সেটিকে ‘বিভ্রান্তিকর ও একপেশে’ আখ্যা দেওয়া হয়। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ‘বিভ্রান্তিকর ও একপেশে’ বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে, যেন বাংলাদেশ ধর্মীয় চরমপন্থীদের দখলে চলে যাওয়ার কাছাকাছি অবস্থায় রয়েছে। পরদিন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ‘উগ্রবাদের উত্থানের’ অভিযোগ নাকচ করে দেন। সরকারের অস্বীকার করার এই প্রবণতা সম্পর্কে মানবাধিকারকর্মী নূর খান ডয়চে ভেলে বাংলাকে বলেছেন, ‘এটা সব সরকারের সময়ই দেখা গেছে। এই সরকারও বাস্তব পরিস্থিতি স্বীকার না করে অস্বীকার করছে। কোনো কোনো নীতিনির্ধারকের অতিকথন আওয়ামী লীগের আমলে যেমন ছিল, তেমনি এখনো আছে। এই অতিকথনওয়ালারাই এখন রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা।’
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে যেসব ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলোর কোনো কোনোটি দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে এর আগেই। সরকার যতই অস্বীকার করুক না কেন, প্রকৃতপক্ষে উগ্রপন্থার উত্থান, নারীবিদ্বেষ ও প্রতিক্রিয়াশীলতার যত ঘটনা ঘটেছে, প্রতিবেদনে তার অনেক কিছুই উঠে আসেনি। ফলে প্রতিবেদনটিকে ‘টিপ অব দি আইসবার্গ’ বা মগ্ন মৈনাকচূড়ার সঙ্গে তুলনা করা যায়। প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পরবর্তী দুই-তিন দিনের মধ্যেও বেশ কয়েকটি ঘটনার কথা উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যমে। যেমন, গাজীপুরের কাপাসিয়ায় মসজিদ কমিটির বাধায় ‘আপন দুলাল’ নাটকের মঞ্চায়ন বাতিল, কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ম্যুরালে কালো কালি মেখে দেওয়া ইত্যাদি। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে ৩ এপ্রিল ঈদ পুনর্মিলনী উপলক্ষে বাউলসন্ধ্যার এক আসর তো মাঝপথে বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন নিজেই। সরকার এখন অস্বীকার করলেও গত ১৮ জানুয়ারি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পুলিশই জানিয়েছিল, ৪ আগস্টের পর থেকে ৪০টি মাজারে ৪৪ বার হামলা হয়েছে। আর বিশ্ব সুফি সংস্থা ২৩ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৮০টি মাজারে হামলা হয়েছে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স গত ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছেন, ‘সাড়ে সাত মাস পরে এসে দেখছি, ওই গণ-অভ্যুত্থানে নানা উগ্র শক্তির আবির্ভাব ছিল। তারা শুরুতেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, ঐতিহ্যের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করল। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী কোনো চক্রান্ত এবং ষড়যন্ত্র সহ্য করা হবে না।’ এই মন্তব্যের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রিন্সকে তুলোধোনা করা হচ্ছে বিশেষ মহল থেকে। জানি না, নিজ দলের ভেতরের ‘অতিবিপ্লবীরা’ তাঁকে কী ভাষায় আক্রমণ করছে! এই উগ্র শক্তি সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু কথা সিপিবির সাধারণ সম্পাদককে বলেছিলাম গত জুলাই মাসে নরসিংদী কারাগার ভেঙে অস্ত্র লুট করার প্রাথমিক সংবাদ পাওয়ার পরপর। তখনো জানা যায়নি যে ওই কারাগার থেকে বন্দী জঙ্গিদের মুক্ত করে নেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া জুলাই মাসেই সাপ্তাহিক একতার একটি প্রতিবেদনে অস্ত্র লুটসহ নানা ঘটনায় ‘ওরা কারা’, সে প্রশ্ন তোলায় দলের ভেতরে কাউকে কাউকে তো রীতিমতো তদন্তের মুখেও পড়তে হয়েছিল।
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের একটি প্রধান জন-আকাঙ্ক্ষা ছিল রাষ্ট্র সংস্কার। সে আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি প্রথম প্রকাশ পায় মূলত ৩ আগস্ট বামপন্থীদের আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘দ্রোহযাত্রা’য়। এরপর ৫ আগস্ট থেকে নতুন নতুন পরিভাষায় সংস্কারের নানা রকম বয়ান শোনা যাচ্ছে, যেগুলোর সঙ্গে সরকারি ভাষ্যেরও অনেক মিল পাওয়া যায়। যা হোক, পুরোনো দলগুলো দিয়ে দেশে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তনের আশা অনেকেই পোষণ করেন না। কী হতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে কারও কারও স্পষ্ট উপলব্ধি থাকলেও অনেকেরই প্রত্যাশা ছিল—গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে হয়তো একটি নতুন রাজনৈতিক দলের অভ্যুদয় ঘটবে, যেটি হবে তারুণ্যের শক্তিতে ভরপুর, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত এবং অবশ্যই বৈষম্যবিরোধী। তারুণ্যনির্ভর নতুন দলের আত্মপ্রকাশ কিন্তু ঘটেছে। কিন্তু মানুষ কি তাদের নিয়ে ততটা আশাবাদী আর আছে?
অনেকটাই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আত্মপ্রকাশের ব্যয়বহুল অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে পাঁচ তারকা হোটেলে ইফতার মাহফিল, নেতাদের হেলিকপ্টার ভ্রমণ ও বিশাল মোটর শোভাযাত্রা—এসব ঘটনায় জনমনে বাড়ছে কৌতূহল ও প্রশ্ন। কোনো কোনো নেতার পক্ষ থেকে ঈদ শুভেচ্ছা জানিয়ে পত্রিকার প্রথম পাতার অর্ধেকজুড়ে চাররঙা বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতেও দেখা গেছে। এগুলো সবই পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এসব কাজের জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থ লাগছে, তার জোগান কোথা থেকে আসছে, তা নিয়ে প্রশ্ন কিন্তু এরই মধ্যে বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বলা হচ্ছে, অর্থদাতাদের নিরাপত্তার খাতিরে তাদের পরিচয় প্রকাশ করা যাচ্ছে না। এটাও প্রচলিত বড় দলগুলোর পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির চেয়ে আলাদা কিছু নয়। আর রাজনৈতিক দলগুলোর টাকা জোগাড় করার এমন উপায়ের কারণেই মূলত লুটেরা ধনিক ও করপোরেট জগৎ বরাবরই জবাবদিহির বাইরে থেকে যাচ্ছে।
বড়লোকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার প্রভাব কেমন হয়, তার কিছু আলামত কিন্তু স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য ৫০ লাখ টাকার চেক দিয়েছিলেন নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। এবার ঈদুল ফিতরের আগে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস না দিয়ে কয়েক শ পোশাক কারখানা বিনা নোটিশে তালা দিয়ে মালিকেরা মোবাইল ফোন বন্ধ করে রাখেন। ফলে বেতন- বোনাসের দাবিতে তখন প্রতিদিনই সড়কে নামেন শ্রমিকেরা। একই দাবিতে শ্রম ভবনের সামনে আন্দোলনরত অবস্থায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান ৪০ বছর বয়সী রামপ্রসাদ সিং। তিনি গাজীপুরের স্টাইল ক্রাফট লিমিটেডে কর্মরত ছিলেন। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের গাজীপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক জালাল হাওলাদারকে পুলিশ ৪ এপ্রিল গ্রামের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। বামপন্থী রাজনৈতিক দলের কর্মীরা ছাড়া অন্য কাউকে দেখা যায়নি শোষিত-নিপীড়িত শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতে। এটা করতে গিয়ে উল্টো তাঁদের ‘ষড়যন্ত্রকারী’র অপবাদ গায়ে মাখতে হয়েছে।
কাজেই নিঃসংকোচে বলা যায়, আমাদের শুধু নতুন রাজনৈতিক দল হলেই হবে না, লাগবে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতিও, যাতে নিশ্চিত হবে জবাবদিহি, স্বচ্ছতা ও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র। সর্বোপরি প্রয়োজন হবে সঠিক শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গিরও। ধনিকশ্রেণির স্বার্থ রক্ষাকারী কোনো রাজনৈতিক দল যত ভালো কথাই বলুক না কেন, তার পক্ষে বৈষম্য দূর করা কখনোই সম্ভব হবে না। আবার এটাও ঠিক যে আমাদের দেশে শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাগাড়ম্বর যত আছে, বাস্তব কাজ সে তুলনায় অনেক কম। অতিবিপ্লবী বুলি আওড়িয়ে দলের ভেতরে প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঘায়েল করা সহজ হওয়ায় এর আশ্রয় নেন অনেক বামপন্থী নেতা-কর্মী। আর সেই সুযোগ কাজে লাগায় বুর্জোয়া শ্রেণিও। লাল পতাকা দিয়ে লাল পতাকা ঠেকানোর কৌশল খাটানো এতে সহজ হয়। ফলে পরিবর্তন আবশ্যক বিদ্যমান বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোতেও। কারণ, দলগুলোতে ‘অমুকের দোসর’, ‘তমুকের দালাল’ নিয়ে চর্চা যত আছে, সে তুলনায় সমাজ-অর্থনীতির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও তর্ক-বিতর্ক যথেষ্ট কম। পুঁজি যে নজরদারিমূলক চরিত্রের মতো নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য লাভ করছে, সে নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা কি তেমন আছে? তথ্যপ্রযুক্তির দু-একটি প্রতিষ্ঠান বিশ্বের কয়েক শ কোটি মানুষের ওপর অবাধে নজরদারি করে চলেছে কিছু অ্যাপ-টুল দিয়ে। ব্যক্তির পছন্দমাফিক কনটেন্ট ও বিজ্ঞাপন সরবরাহ করা হচ্ছে অ্যাপগুলোতে। এর পরিপ্রেক্ষিতে করণীয় কী, সে আলোচনা নজরেই পড়ে না। চর্চা ও প্রয়োগের এমন দীনদশার সুযোগে বিস্তার ঘটছে ‘বামপন্থার বাল্যব্যাধির’। অথচ আশির দশকেও এতটা দৈন্য ছিল না। এই পরিস্থিতির উত্তরণও জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
বিশ্ববাণিজ্যের বাস্তবতা দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রতিটি দেশের সরকার তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা ও অভ্যন্তরীণ বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আমদানি ও রপ্তানির ওপর বিভিন্ন ধরনের শুল্ক বা কর আরোপ করে থাকে।
৭ ঘণ্টা আগে৫ আগস্টের পর থেকে আমরা ঢাকাসহ সারা দেশেই জাস্টিসের নমুনা দেখেছি। কিছু লোক একত্রে জড়ো হয়ে একটি গুজব ছড়িয়ে, কোনো ব্যক্তির ওপর চড়াও হয়ে তাকে শারীরিকভাবে আঘাত করে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেরে ফেলে।
৭ ঘণ্টা আগেসিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিএমইউ) উপাচার্যদের একের পর এক অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা বিশ্ববিদ্যালয়টির ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় উপাচার্যের বিতর্কিত নিয়োগ ও কর্মকাণ্ডের পর বর্তমান উপাচার্যও যেন সেই পথেই হাঁটছেন।
৭ ঘণ্টা আগেগতকাল বিকেল ৪টা ৩৬ মিনিটে দেশের এক প্রভাবশালী নেতার হাঁচি রাজনীতিতে নতুন ঝড় তুলেছে। হাঁচি সাধারণত শারীরিক প্রতিক্রিয়া হলেও, যেহেতু এটি একজন জাতীয় নেতার মুখ থেকে এসেছে...
১ দিন আগে