আলী আজম, ঢাকা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যখন আমরা প্রবেশ করি তখন সময় বিকেল সাড়ে ৪টা। আমরা শাহবাগ দিয়ে ঢুকছিলাম। জাতীয় জাদুঘরের সামনে তখন জটলা পাকিয়ে সমাবেশ করছে সরকার সমর্থক একদল মানুষ। মাইকে তারা কোটা আন্দোলনকারীদের গোষ্ঠী উদ্ধার করছিলেন। ভিড় ঠেলে যেই ক্যাম্পাসের সীমানায় পা বাড়ালাম কানে ভেসে এল মুহুর্মুহু সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ। সেই শব্দ শুনে টিএসসির দিকে ছুটে যাই। সেন্ট্রাল লাইব্রেরির ও কেন্দ্রীয় মসজিদের গেট পেরোতেই নাকে আসে ঝাঁজাল গন্ধ। চোখ দুটো খোলা রাখতে পারছিলাম না টিয়ারশেলের ধোঁয়ায়। কয়েকজন ছাত্রকে দেখলাম দিগ্বিদিক ছুটোছুটি করতে।
মধুর ক্যানটিনের দিক থেকে আসা দুই জন ছাত্র শাহবাগের দিকে যেতে চাইলেন। একজন তাদের নিষেধ করে বললেন, ওদিকে যেও না ছাত্রলীগ আছে, মেরে ফেলবে। কথা ভুল বলেননি তিনি। আমরাও দেখেছি শাহবাগের মোড়ে যেখানে সমাবেশ হচ্ছে তার আশপাশে ঘুরঘুর করছে মাথায় হেলমেট পরা কয়েকজন যুবক। সবার হাতে ছিল রড ও লাঠি। উপায় না দেখে ছাত্র দুটি দেয়াল টপকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকে গেল, যাতে প্রাণে বাঁচা যায়।
আর আমরা হাঁটলাম টিএসসির দিকে। রাজু ভাস্কর্যের সামনে গিয়ে দেখি শত শত পুলিশ, বিজিবি ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্য রণ সাজে দাঁড়িয়ে আছে।
উপাচার্য ভবনের দিকে যেতেই রোকেয়া হলের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়াতে হয়। ছাত্রীদের ওই হলের উল্টোপাশে গুরুদুয়ারা নানকশাহির সামনের রাস্তায় পড়ে আছে দুটি কফিন। পাশেই ফুটপাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু নারী–পুরুষের স্যান্ডেল আর জাতীয় পতাকা বাঁধা বাঁশ–কাঠের লাঠি। মাত্র আধা ঘণ্টা আগেই যে জায়গাটি শত শত শিক্ষার্থীর স্লোগানে মুখর ছিল, সেখানে এখন নীরবতা।
উপাচার্যের বাসভবনের সামনের রাস্তায় গিয়েও দেখা গেল বিপুলসংখ্যক পুলিশ-বিজিবি মারমুখী অবস্থানে। এদিকে হলপাড়া থেকে তখনো থেমে থেমে সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেলের শব্দ আসছিল।
সাংবাদিকদের হাতে মোবাইল ফোন ও ক্যামেরা ছিল, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় কেউ ছবি ও ফুটেজ অফিসে পাঠাতে পারছিলেন না।
আমরা আরও কিছুক্ষণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নীলক্ষেতের দিকে হাঁটা দিলাম। মহসিন হলের গেটে গিয়ে দেখি শিক্ষার্থীরা দলে দলে হল ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সবার চোখেমুখে ক্ষোভ ও বিষাদের ছাপ। একটা ছেলে শহীদ বসুনিয়ার ভাস্কর্যের পাশে গিয়ে খুব কান্না করল।
সাংবাদিকদের ছবি তুলতে দেখে ক্ষোভ ঝাড়লেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। এক ছাত্র বললেন, ‘আমাদের যখন পেটাচ্ছিল তখন আপনারা কোথায় ছিলেন?’
মইনুদ্দিন–ফখরুদ্দিন সরকারের আমলে ২০-২২ আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের কথা মনে পড়ে যায় তখন। ওই আন্দোলন দমাতে সরকার কারফিউ ঘোষণা করলে আমরাও সেদিন এভাবেই হল থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। সন্ধ্যায় কারফিউ শুরু হয়ে গেলে ঢাকা শহরে আটকে পড়া আমি সেদিন রাতে রিকশাশ্রমিকদের মেসে আশ্রয়ে ছিলাম। আমাদের সেই আন্দোলন সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দিন সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল বটে, তবে পরে কি সত্যিকারের গণতন্ত্র ফিরে পেয়েছি? বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া স্বৈরশাসক এরশাদের সঙ্গে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা রাজনৈতিক দল কীভাবে জোট বেঁধেছে?
মন খারাপ করা পরিস্থিতি দেখে যখন ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন শাহবাগ মোড়ে এসে যা আশঙ্কা করেছি তা-ই সত্য হলো। বাসায় ফিরে আসার জন্য রিকশায় উঠতেই চোখে পড়ল, শাহবাগ মোড়ে একজন শিক্ষার্থীকে জটলা পাকিয়ে বেধড়ক পেটাচ্ছে হেলমেট পড়া কয়েকজন যুবক, যেভাবে মানুষ হিংস্র জানোয়ারকে পেটায় সেভাবে মারছিল প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে। আরও দুইজন তরুণ হামলাকারীদের হাত থেকে বাঁচতে আমাদের রিকশার পিছু পিছু দৌড়াচ্ছিল। রিকশার গতি বেশি ছিল, জানি না তারা রক্ষা পেয়েছিল কিনা!
লেখক: যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আজকের পত্রিকা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যখন আমরা প্রবেশ করি তখন সময় বিকেল সাড়ে ৪টা। আমরা শাহবাগ দিয়ে ঢুকছিলাম। জাতীয় জাদুঘরের সামনে তখন জটলা পাকিয়ে সমাবেশ করছে সরকার সমর্থক একদল মানুষ। মাইকে তারা কোটা আন্দোলনকারীদের গোষ্ঠী উদ্ধার করছিলেন। ভিড় ঠেলে যেই ক্যাম্পাসের সীমানায় পা বাড়ালাম কানে ভেসে এল মুহুর্মুহু সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ। সেই শব্দ শুনে টিএসসির দিকে ছুটে যাই। সেন্ট্রাল লাইব্রেরির ও কেন্দ্রীয় মসজিদের গেট পেরোতেই নাকে আসে ঝাঁজাল গন্ধ। চোখ দুটো খোলা রাখতে পারছিলাম না টিয়ারশেলের ধোঁয়ায়। কয়েকজন ছাত্রকে দেখলাম দিগ্বিদিক ছুটোছুটি করতে।
মধুর ক্যানটিনের দিক থেকে আসা দুই জন ছাত্র শাহবাগের দিকে যেতে চাইলেন। একজন তাদের নিষেধ করে বললেন, ওদিকে যেও না ছাত্রলীগ আছে, মেরে ফেলবে। কথা ভুল বলেননি তিনি। আমরাও দেখেছি শাহবাগের মোড়ে যেখানে সমাবেশ হচ্ছে তার আশপাশে ঘুরঘুর করছে মাথায় হেলমেট পরা কয়েকজন যুবক। সবার হাতে ছিল রড ও লাঠি। উপায় না দেখে ছাত্র দুটি দেয়াল টপকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকে গেল, যাতে প্রাণে বাঁচা যায়।
আর আমরা হাঁটলাম টিএসসির দিকে। রাজু ভাস্কর্যের সামনে গিয়ে দেখি শত শত পুলিশ, বিজিবি ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্য রণ সাজে দাঁড়িয়ে আছে।
উপাচার্য ভবনের দিকে যেতেই রোকেয়া হলের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়াতে হয়। ছাত্রীদের ওই হলের উল্টোপাশে গুরুদুয়ারা নানকশাহির সামনের রাস্তায় পড়ে আছে দুটি কফিন। পাশেই ফুটপাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু নারী–পুরুষের স্যান্ডেল আর জাতীয় পতাকা বাঁধা বাঁশ–কাঠের লাঠি। মাত্র আধা ঘণ্টা আগেই যে জায়গাটি শত শত শিক্ষার্থীর স্লোগানে মুখর ছিল, সেখানে এখন নীরবতা।
উপাচার্যের বাসভবনের সামনের রাস্তায় গিয়েও দেখা গেল বিপুলসংখ্যক পুলিশ-বিজিবি মারমুখী অবস্থানে। এদিকে হলপাড়া থেকে তখনো থেমে থেমে সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেলের শব্দ আসছিল।
সাংবাদিকদের হাতে মোবাইল ফোন ও ক্যামেরা ছিল, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় কেউ ছবি ও ফুটেজ অফিসে পাঠাতে পারছিলেন না।
আমরা আরও কিছুক্ষণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নীলক্ষেতের দিকে হাঁটা দিলাম। মহসিন হলের গেটে গিয়ে দেখি শিক্ষার্থীরা দলে দলে হল ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সবার চোখেমুখে ক্ষোভ ও বিষাদের ছাপ। একটা ছেলে শহীদ বসুনিয়ার ভাস্কর্যের পাশে গিয়ে খুব কান্না করল।
সাংবাদিকদের ছবি তুলতে দেখে ক্ষোভ ঝাড়লেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। এক ছাত্র বললেন, ‘আমাদের যখন পেটাচ্ছিল তখন আপনারা কোথায় ছিলেন?’
মইনুদ্দিন–ফখরুদ্দিন সরকারের আমলে ২০-২২ আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের কথা মনে পড়ে যায় তখন। ওই আন্দোলন দমাতে সরকার কারফিউ ঘোষণা করলে আমরাও সেদিন এভাবেই হল থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। সন্ধ্যায় কারফিউ শুরু হয়ে গেলে ঢাকা শহরে আটকে পড়া আমি সেদিন রাতে রিকশাশ্রমিকদের মেসে আশ্রয়ে ছিলাম। আমাদের সেই আন্দোলন সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দিন সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল বটে, তবে পরে কি সত্যিকারের গণতন্ত্র ফিরে পেয়েছি? বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া স্বৈরশাসক এরশাদের সঙ্গে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা রাজনৈতিক দল কীভাবে জোট বেঁধেছে?
মন খারাপ করা পরিস্থিতি দেখে যখন ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন শাহবাগ মোড়ে এসে যা আশঙ্কা করেছি তা-ই সত্য হলো। বাসায় ফিরে আসার জন্য রিকশায় উঠতেই চোখে পড়ল, শাহবাগ মোড়ে একজন শিক্ষার্থীকে জটলা পাকিয়ে বেধড়ক পেটাচ্ছে হেলমেট পড়া কয়েকজন যুবক, যেভাবে মানুষ হিংস্র জানোয়ারকে পেটায় সেভাবে মারছিল প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে। আরও দুইজন তরুণ হামলাকারীদের হাত থেকে বাঁচতে আমাদের রিকশার পিছু পিছু দৌড়াচ্ছিল। রিকশার গতি বেশি ছিল, জানি না তারা রক্ষা পেয়েছিল কিনা!
লেখক: যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আজকের পত্রিকা
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে চলমান যুদ্ধ-সংঘাত, দুরবস্থা, দ্বৈতনীতি, পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদির ভেতর বাংলাদেশ কেমন আছে? ফুটন্ত তেলের কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলা, আবার চুলা থেকে টগবগে কড়াই—এই তো চলছে এ দেশের জনগণকে নিয়ে। বরং যত দিন যাচ্ছে কড়াইয়ের তেল ও চুলার আগুন উভয়ই আরও উত্তপ্ত ও পরাবাস্তব হয়ে উঠছে।
১০ ঘণ্টা আগেগত আট মাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক ব্যতিক্রমী দৃশ্যমানতা তৈরি হয়েছে ২৬টি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে। ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের রেশ না কাটতেই একে একে এদের উত্থান অনেককেই বিস্মিত করেছে, কেউ কেউ দেখেছেন সম্ভাবনার নতুন আলো, আবার কেউ কেউ দেখেছেন এটি বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিরতারই
১০ ঘণ্টা আগেশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ডিআইএতে নিয়োগ নিয়ে যা হয়ে গেল, তাকে ‘ম্যাজিক কারবার’ বলা হলে ভুল বলা হবে না। সকালে পরীক্ষা নিয়ে রাতেই ফল প্রকাশ করার এক অতি মানবীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ডিআইএ। তারাই প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেছে, তারাই খাতা মূল্যায়নের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিল। সুতরাং এই ম্যাজিকের জন্মদাতা কে—তা
১০ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশে এখন প্রেমও রাজনৈতিক। আগে প্রেমে পড়লে মানুষ কবিতা লিখত, এখন ফেসবুক স্ট্যাটাস দেয়। একসময় ‘কিছু বলব না, বুঝে নিও’ টাইপ প্রেমিকা ছিল—এখন ‘টক্সিসিটিই প্রেমের সৌন্দর্য’ বলে নিজের ফ্যান-ফলোয়ারদের মাঝে থ্রো করে দেয় একখানা থিওরিটিক্যাল বোমা।
১০ ঘণ্টা আগে