Ajker Patrika

স্কুইড গেমের গণতন্ত্র

বিধান রিবেরু
‘স্কুইড গেম’ সিরিজের মতোই যেন চলছে বাংলাদেশের রাজনীতি। ছবি: সংগৃহীত
‘স্কুইড গেম’ সিরিজের মতোই যেন চলছে বাংলাদেশের রাজনীতি। ছবি: সংগৃহীত

স্কুইড গেম, যাঁরা অনলাইনে ধারাবাহিক দেখতে পছন্দ করেন, তাঁদের কাছে বেশ পরিচিত নাম। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে যখন দক্ষিণ কোরিয়ার এই ডিসটোপিয়ান সারভাইবাল থ্রিলার টিভি সিরিজটি দর্শক প্রথম দেখে, তখন থেকেই একটা উন্মাদনা তৈরি হয়। সম্প্রতি এর দ্বিতীয় মৌসুম চলছে। যেখানে দেখা যায় মরণখেলায় অংশ নেওয়া খেলোয়াড়েরা ভোটাভুটি করে। সেখানে তারা সিদ্ধান্ত নেয় দুই দলে ভাগ হয়ে। ক্রস চিহ্নের পক্ষে যারা, তারা এই ভয়ংকর খেলায় আর মরতে চায় না। তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে চায়। শূন্য চিহ্নের পক্ষে যারা, তারা এই খেলাটা জীবন বাজি রেখে খেলতে চায়, কারণ তারা অর্থ চায়। অন্যের জানপ্রাণের বিনিময়ে হলেও তাদের অর্থ চাই-ই চাই। অর্থাৎ একদল নিজেদের ভুল বুঝে বাড়ি ফিরতে চায়, অন্যরা লোভের বশবর্তী হয়ে শেষ পর্যন্ত খেলতে চায়, এতে যে তাদেরও প্রাণ যাওয়ার শঙ্কা আছে, সে বিষয়ে তারা উদাসীন। কিন্তু গোটা খেলাটাই আয়োজন করা হয় সমাজের এলিট, উচ্চবিত্ত শ্রেণির জন্য। এই যে ঋণগ্রস্ত, হতাশায় ডুবে থাকা মানুষগুলো মুখে রক্ত তুলে অর্থের জন্য কামড়াকামড়ি করে নিজেদের ভেতর, এটা দেখে সেই এলিট গোষ্ঠী মজা পায়। তারা সবাই দর্শক, মুখোশধারী। তাদের অঢেল অর্থ, কিন্তু মনে সুখ নেই। তাই এই বিকৃত খেলার আয়োজন। খেলাটি তাদের হয়ে পরিচালনা করে ফ্রন্ট ম্যান নামের একজন।

খেলাতে যতই বলা হোক না কেন নির্বাচনে তোমরা স্বাধীন, আসলে তারা স্বাধীন নয়। খেলায় অংশগ্রহণকারীদের বলা হয়, তোমাদের বেশির ভাগ যদি চাও খেলা বন্ধ করে প্রাপ্য অর্থ নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারবে। সেটা বেচারা খেলোয়াড়েরা বিশ্বাসও করে। আদৌ কি আসলে স্কুইড গেম এতটা উদার? সিরিজের দ্বিতীয় মৌসুমে আমরা দেখি ফ্রন্ট ম্যান নিজেই খেলোয়াড় সেজে ভিড়ে যায় অংশগ্রহণকারীদের মাঝে এবং পুরো নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে সে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। খেলোয়াড়দের ভেতর বিদ্বেষ ও রেষারেষি সৃষ্টি করে এই কাজটি সম্পন্ন হয়। যেন অনেকটা ব্রিটিশদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল। খেলোয়াড়দের গোপনে কাঁটাচামচের মতো ধারালো জিনিস দিয়ে দেওয়া হয়, যাতে ওরা নিজেরাই মারামারি করে মারা যায়। মজার বিষয় হলো, যারা গণতন্ত্র পাচ্ছে বলে খুশিতে বেশ গদগদ হয়ে প্রতিটি প্রাণঘাতী খেলার পর ভোট দেয়, তারা বুঝতেও পারে না, এই ভোট নেওয়াটাই একটা ধাপ্পাবাজি। একটা নিষ্ঠুর খেলার অংশ মাত্র। এলিট শ্রেণির চাই রক্তাক্ত প্রতিযোগিতা। জিনিসটিকে একটু চিনির প্রলেপ মাখাতেই খেলোয়াড়দের জন্য এই নির্বাচনের ব্যবস্থা। কিন্তু স্কুইড গেমের মূল চরিত্র সিওং গি-হুন পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারে ও বিদ্রোহ করার চেষ্টা করে।

স্কুইড গেমের এর পরের কাহিনি আর বলার প্রয়োজন নেই। শুধু এটুকুই বলতে পারি, মানুষের ভেতরকার লোভ, হিংসা, বিদ্বেষ, জিঘাংসাকে পুঁজি করে, ওপর-ওপর একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশের কথা বলে, স্কুইড গেমের প্রভুরা যে খেলাটা খেলে চলেছে, তার সঙ্গে বাংলাদেশের বিগত ৫৩ বছরের যদি মিল খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না।

আমরা কী দেখেছি? দেখেছি নির্বাচনের নামে প্রহসন, দেখেছি নির্বাচনী খেলা নিজের দিকে টেনে আনার জন্য হেন কোনো নীচুতা নেই, যেটা এলিট শ্রেণির সহায়তায় রাজনীতিবিদেরা করেননি। আমাদের তথাকথিত গণতান্ত্রিক খেলার ফ্রন্ট ম্যান হলো রাজনীতিবিদেরা। আর পেছনে রয়েছে বুর্জোয়া এলিট। যে ফ্রন্ট ম্যানই আসুক না কেন, তাদের অর্থ দিয়ে খেলাটা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। খেলায় না চাইলেও আমাকে, আপনাকে অংশ নিতে হয়। দ্রব্যমূল্য থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের যত দমন-নিপীড়নমূলক আইন, সবকিছুর ভেতরেই দেখবেন স্কুইড গেমের মতো চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটি রয়েছে এবং সেখানে প্রায় কোনো কিছুই সাধারণ মানুষের পক্ষে নেই। খেলার নিয়মটা অন্যে সাজিয়ে দিচ্ছে, জনগণ অংশগ্রহণ করছে মাত্র।

প্রতিটি ক্ষেত্র ধরে ধরে এটা প্রমাণ করা যায় যে মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার চোখে ধুলা দিয়ে, তাদের উদারনৈতিক মানবিক গুণাবলিকে ধ্বংস করার জন্য যা যা করা দরকার, সবটাই করা হয় নির্বাচনী খেলার ভেতর দিয়ে। সে জন্য রাজনীতিবিদদেরও বলতে শোনা যায়: খেলা হবে! সেখানে মানুষের জন্য প্রকৃত গণতন্ত্র নেই, আছে ক্ষমতা দখলের বীভৎস অভীপ্সা। শিক্ষাক্ষেত্রেও দেখবেন স্কুইড গেমের মতো বিভেদ তৈরি করে রাখা হয়েছে। একটি বিভেদের ধর্মশিক্ষা। ধর্ম বই পৃথক হওয়ার কারণে একই শ্রেণির বন্ধুরা আলাদা হয়ে যায় ধর্ম ক্লাসের সময়। অথচ সব ধর্ম একটি গ্রন্থে এনে সবাইকে পড়ানো যেত। ধর্ম ছাড়াও দেখবেন, যে সরকার ক্ষমতায় আসে তারা হীরক রাজার মতো মগজ ধোলাইয়ের কাজ করতে চায় পাঠ্যবইতে নিজেদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ঢুকিয়ে দিয়ে।

চিকিৎসাক্ষেত্রে দেখুন। আপনি অসহায়ের মতো, যত দামি ওষুধই হোক না কেন, কিনতে বাধ্য। কারণ, সেখানে জীবনের প্রশ্ন জড়িত। এমনকি একই কথা খাটে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও। একই টেস্ট দেখবেন পাশাপাশি দুই জায়গায় দুই রকম এবং তাদের খরচও একেক রকম। বেশি টাকা দিলে ভালো চিকিৎসা, কম টাকা দিলে অবহেলা। তারপরও মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে পরিবার-পরিজনের জীবন বাঁচাতে চায়। রক্ত মুখে তুলে তারা অর্থ জোগাড় করে, আর হাসপাতালের কৃষ্ণগহ্বরে ঢালে। তারপরও সুচিকিৎসা সুনিশ্চিত নয়। কারণ দেশের মেডিকেল কলেজের শিক্ষাব্যবস্থাকেও পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও যত্রতত্র মেডিকেল কলেজ খুলে গণহারে শিক্ষার্থী ভর্তির মাধ্যমে। আমরা একবারও ভাবিনি, চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার এবং এটা নিয়ে বাণিজ্য চলে না। কিন্তু অর্থ বানানোর খেলাটা আমরা খেলে চলেছি, ফ্রন্ট ম্যানরাই সেই আয়োজন করে দিচ্ছে এলিটদের জন্য।

এখন কথা হলো, এসব খেলায় জনগণ গিনিপিগ হতে চায় না। কিন্তু না হয়ে কি উপায় আছে? স্কুইড গেমে যেমন ভয় ও লোভের সংস্কৃতি গড়ে তুলে তারপর অসহায় মানুষগুলোকে ক্রীড়নকে পরিণত করা হয়, ঠিক তেমনি আমাদের রাষ্ট্রেও দেখি ভয় ও চাপের ভেতর ফেলে নানা কিছুর ভেতর জনগণকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনা বিশেষ করে ঘটে নির্বাচনের সময়। ভয়ভীতি ও লোভ সেখানে বড় হাতিয়ার ও টোপ হিসেবে কাজ করে। অথচ মানুষ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে না এসব প্রহসনের নির্বাচন আসলে একটি সভ্যসমাজ ও সুন্দর রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। মানুষ নির্বাচন হলেই খুশি! কেউ ভাবে না এই নির্বাচনের পর দেশে কী হবে? খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, কর্মসংস্থানের কোনো গতি হবে কি না। দিনের পর দিন নির্বাচন হয়, কিন্তু ওসব মৌলিক বিষয় থাকে তথৈবচ। এমন অবস্থা থেকে বেরোবার উপায় আছে নিশ্চয়ই। প্রভু ও ভৃত্যের খেলায় ভৃত্য পিঠ দেখাতে পারে, এমনকি পাশাখেলা উল্টেও দিতে পারে। যত দিন ভৃত্য তার পরাধীন ও ক্রীড়নক থাকার ব্যাপারে আপত্তি তুলবে না, তত দিন আসলে অবস্থারও পরিবর্তন ঘটবে না।

নির্বাচন খুবই জরুরি বিষয়, কারণ এতে সর্বসাধারণের মতের প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু তার সঙ্গে এটাও নজরে রাখা জরুরি—নির্বাচনপ্রক্রিয়া তথা গণতান্ত্রিক পরিবেশ যেন প্রহসনমূলক, নকল ও ভঙ্গুর না হয়।

বিশ্বে যারা গণতন্ত্রের চর্চা করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে, তাদের দেখেও আমরা শিখতে পারছি না। এর কারণ হলো আমাদের গোড়ায় গন্ডগোল আছে। আমাদের বেড়ে ওঠার ভেতরেই বড় ধরনের ফাঁক রয়ে যাচ্ছে। যে কারণে অন্যদের মতো উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করা যাচ্ছে না। আমরা যদি শুধু ওদের পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে লক্ষ করি, তাহলেও বুঝতে পারব আমরা কোথায় পিছিয়ে আছি। কেন আমরা শিক্ষিত জাতি তৈরি করতে পারছি না। কেন আমরা চিন্তা ও চেতনায় উন্নত সংস্কৃতি ধারণ করতে পারছি না। এত হাজার কোটি টাকা খরচ করে এত স্থাপনা তৈরি করতে পারছি, অথচ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মানুষের মতো মানুষ তৈরি করতে পারছি না। এই দায় যাঁরা খেলাটা সাজাচ্ছেন এবং যাঁরা খেলাটা পরিচালনা করছেন, তাঁদের ওপরই বেশি বর্তায়। মানুষ যদি একবার সচেতন হয়, তাহলে আর তারা দাবার ঘুঁটি হবে না। তবে সচেতনতা এমনি এমনি বিনা মূল্যে অর্জিত হয় না। এটা মনে রাখা দরকার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

লুটপাটে শেষ ৫ কোটির প্রকল্প

‘ওরা সোনার তৈরি, আমরা মাটির’, কারখানার ভেতর আত্মহত্যার আগে শ্রমিকের ফেসবুক পোস্ট

যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৫ হাজার শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল, বেশির ভাগই ভারতীয়, আছে বাংলাদেশিও

আওয়ামী লীগকেও পথভ্রষ্ট করেছেন শেখ হাসিনা

গণহত্যার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা ও বাংলাদেশের ক্ষতিপূরণ দাবির উল্লেখ নেই পাকিস্তানের বিবৃতিতে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত