সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
বাংলাদেশে মৌলবাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এক দিক দিয়ে এটা অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত। কেননা বাংলাদেশের অভ্যুদয় ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান ও পরাভূত করে। কিন্তু পরাভূত শক্তি আবার ফিরে এসেছে। তার পরাজয়টা কেবল যে সশস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে ঘটেছিল তা নয়, ঘটেছিল আদর্শিকভাবেও। তাহলে কেন তার পুনরুত্থান? কেমন করে?
বোঝা যায় যে মৌলবাদীরা তাদের আদর্শিক পরাজয়টিকে মেনে নেয়নি। দৈহিকভাবে হেরে গিয়ে এবং ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে ছিল মাত্র, পরে পরিস্থিতি আগের মতো প্রতিকূল নেই দেখে ফিরে এসেছে। এই যে পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়া, এর প্রধান উপাদান কী? সেটা হলো পুঁজিবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। ওই যে ব্যক্তি বড় হয়ে উঠছে সমষ্টির তুলনায়—এই নীতিটি আগের রাষ্ট্রগুলোতে কার্যকর ছিল, মনে হয়েছিল বাংলাদেশে তা থাকবে না, কেননা বাংলাদেশ হবে প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক, সেখানে রাষ্ট্র হবে সবার সাধারণ সম্পত্তি, যার দরুন রাষ্ট্র তার শোষণকারী ভূমিকা ছেড়ে রক্ষাকারীর ভূমিকা নেবে এবং সমাজে অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। সেটাই ছিল স্বপ্ন। স্বপ্ন ভেঙে গেছে। যার ফলে অধিকাংশ মানুষের জীবনে দুঃস্বপ্ন নেমে এসেছে, এমন দুঃস্বপ্ন যা ছিল কল্পনার বাইরে, কারণ মুক্তিযুদ্ধে বিজয় তাদেরকে আশা দিয়েছিল, ভাববার সাহস জুগিয়েছিল যে স্বপ্ন দূরে নয়, নিকটবর্তী বটে।
চোখ কচলে মানুষ দেখেছে যে যুদ্ধ করল সবাই, কিন্তু সুফল চলে যাচ্ছে ধনীদের গৃহে। উনিশ শ সাতচল্লিশের স্বাধীনতাতে যারা উপকৃত হয়েছিল, একাত্তরের স্বাধীনতাতে তারাই উপকার পাচ্ছে, দ্বিতীয়বার। কে মুক্তিযোদ্ধা আর কে রাজাকার সেটা কোনো বিবেচনার বিষয় রইল না, সত্য হয়ে উঠল শ্রেণি। সাধারণ মানুষ আরও দেখল মুক্তিযোদ্ধা নাম নিয়ে কিছু মানুষ এমন আচরণ করছে যে তারা যেন পাকিস্তানিদের পরাজিত করেনি, যেন নিজেদের দেশকেই জয় করেছে; কাজেই দেশ তাদের, তারা এখন লুটপাট করবে, আগে পাকিস্তানিরা যেমন লুটপাট করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সর্বত্র ভূলুণ্ঠিত হলো।
রাষ্ট্র আবার সেই পুরোনো পুঁজিবাদী পথ ধরে এগোতে থাকল। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বিদায় নিল, সমাজতন্ত্রকে ছেঁটে ফেলা হলো এবং গণতন্ত্রের পরিবর্তে কখনো বৈধ কখনো অবৈধ স্বৈরশাসন কায়েমি হয়ে বসে রইল। দারিদ্র্য, বৈষম্য ও অজ্ঞতা বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করল। অধিকাংশের স্বার্থ না দেখে কতিপয়ের স্বার্থ রক্ষা করবার দায়িত্ব গ্রহণ করে রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়াল পীড়নকারী প্রতিষ্ঠান, যার কাছে আশ্রয় নেই, ভরসা নেই ন্যায়বিচারের।
কথা ছিল শিক্ষা হবে অভিন্ন ও সর্বজনীন। তা হয়নি। পাকিস্তানি রাষ্ট্রে এবং তারও আগে যে তিন ধরনের শিক্ষাধারা প্রচলিত ছিল, সেগুলো প্রবল বেগে ফিরে এসেছে। গরিব মানুষকে উৎসাহিত করা হয়েছে মাদ্রাসায় সন্তানদের পাঠাতে। সেখানে গিয়ে তারা আরও গরিব হয়েছে এবং ধর্মনিরপেক্ষতায় আস্থা হারিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে শাসকশ্রেণির অস্বস্তি ছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে তারা সব ধর্মের অবাধ চর্চা বুঝেছে এবং কার্যত ধর্মচর্চাকে উৎসাহিত করেছে।
এটাও দেখা গেছে, ধনীরা মনে করেছে যে তারা ধনী হয়েছে ভাগ্যগুণে। তারা আরও ধনী হতে চায়। আবার ভেতরে-ভেতরে অপরাধবোধও কাজ করেছে, কেননা তারা জানে যে ধনার্জনের পথটা যে সৎ ছিল তা নয়, ছিল অপরাধাচ্ছন্ন। সৌভাগ্যের অত্যাশ্চর্য তৎপরতার জন্য কৃতজ্ঞতা এবং অপরাধবোধের বোঝা এই দুইয়ের তাড়নায় ধনীরা ধর্মকার্য ধরেছে। তারা মোটেই ধার্মিক নয়, ধর্মের আনুষ্ঠানিকতাটাই করে, আধ্যাত্মিকতার বালাই নেই। কিন্তু তাদের দৃষ্টান্ত কম বিত্তবানদের অস্থির করে ধর্মের পথ ধরতে।
সমাজের প্রায় সবাই এখন পুঁজিবাদী। ব্যক্তিগত মুনাফা চায়। অন্যের ভালোমন্দ সম্পর্কে আগ্রহ কমছে, ক্রমাগত সংকীর্ণ, স্বার্থবুদ্ধিসর্বস্ব ও হতাশ হয়ে পড়ছে। হতাশা একটি ভয়ংকর ব্যাধি। ধর্মসহ নানাবিধ মাদকাসক্তি ওই ভূমিতে লালিত-পালিত হয়।
প্রতিশ্রুতি ছিল যে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রতিষ্ঠিত করবে। রাষ্ট্র তা করেনি। বস্তুত রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতাকে কেবল যে সংবিধান থেকে বাদ দিয়েছে তা নয়, সেখানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে যুক্ত করেছে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের তৎপরতা তো রয়েছেই, জাতীয়তাবাদী বলে পরিচিত বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলও প্রায় প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতিতেই ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে চলেছে।
এসব মিলিয়েই বাস্তবতা। এই বাস্তবতা রাজনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষতা ও দার্শনিক ইহজাগতিকতাকে উৎসাহিত করছে না, বরং মানুষকে প্ররোচিত করছে উল্টো দিকে যেতে। ধর্মনিরপেক্ষতার ধারকেরা দুই ভাগে বিভক্ত, উদারনীতিক ও বামপন্থী। উদারনীতিতে বিশ্বাসী যাঁরা, তাঁরা জনগণের ওপর প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়েছেন। সেটা অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। কেননা তাঁরা ভদ্রলোক এবং জনবিচ্ছিন্ন। তদুপরি তাঁরা হচ্ছেন বিদ্যমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সমর্থক, যে ব্যবস্থাকে শ্রমজীবী মানুষ মনেপ্রাণে ঘৃণা করে, যদিও প্রকাশ করবার পথ পায় না। উদারনীতিকেরা ব্যক্তির বিকাশকে সমর্থন করেন, সমষ্টির বিপরীতে। তাঁরা রাষ্ট্রের অনুগ্রহপুষ্ট, নানাভাবে। তাঁদের দৃষ্টান্ত বা আদর্শ কোনোটাই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইহজাগতিকতার প্রকৃত সমর্থক হচ্ছেন বামপন্থীরা। কিন্তু কিছুটা নিজেদের দার্শনিক দুর্বলতা, কিছুটা পরদেশনির্ভরতা এবং অনেকটা রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার বৈরিতার কারণে তাঁরা প্রবল হতে পারেননি। স্মরণীয় যে, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্রীয় নীতি ছিল রাজাকারদের ক্ষমা করা এবং বামপন্থীদের প্রয়োজনে হত্যা করা। জনগণ বিক্ষুব্ধ, তাদের সেই বিক্ষোভ বাম দিকে যাবে—এমন পথ এখনো তৈরি হয়নি। ফলে সাধারণ মানুষ ডান দিকেই যাচ্ছে এবং ডানপন্থীদেরও ডানে যাদের অবস্থান সেই মৌলবাদীরা সুবিধা করে নিচ্ছে।
আসল অপরাধ পুঁজিবাদের। সেই দুর্বৃত্ত নানা অপরাধের জন্ম দিচ্ছে এবং প্রায় কোনো অপরাধেরই যথোপযুক্ত বিচার নেই। বিচারব্যবস্থা যে দুর্বল হবে তার নিশ্চিত পূর্বাভাস পাওয়া গেছে তখনই, যখন দেখা গেছে যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসর স্থানীয় রাজাকারদের বিচার হয়নি। বিচার হয়নি তো বটেই, বিচারের আগ্রহও দেখা যায়নি। যে রাষ্ট্রে অত বড় অপরাধীদের শাস্তি হয় না, সেখানে অন্য অপরাধীরা শাস্তি পাবে এমন ভরসা জনগণ পায়নি। আসল সত্য তো এটাই যে যাঁরা ক্ষমতা পেয়েছিলেন, তাঁরা ব্যস্ত ছিলেন নিজেদের স্বার্থ নিয়ে। সবার স্বার্থ দেখার মতো সময়ের অভাব ছিল তাঁদের দিক থেকে। তাঁরা নিজেরাও তো সহযোগীই ছিলেন পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার। পুঁজিবাদী বিশ্ব বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করেছিল এই রাষ্ট্র সমাজতন্ত্রীদের হাতে চলে যাবে—এই রকমের আশঙ্কা থেকে। পরে তারা ঋণ, সাহায্য, পরামর্শ সর্বোপরি আদর্শ দানের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে টেনে নিয়েছে তাদের বৃত্তে। বাংলাদেশের শাসকশ্রেণি সেই ব্যবস্থারই অধীনতা মেনে নিয়েছে, পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি যার অধীনে ছিল। তফাৎটা আদর্শগত নয়। স্বার্থগত। পুঁজিবাদী আদর্শের অনুসারীরা ওই একই আদর্শের উগ্র সমর্থক যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের শাস্তি দিতে উৎসাহ পাবে, এটা স্বাভাবিক নয়। উৎসাহ তারা পায়ওনি। বরং ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের নৃশংস তৎপরতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে।
তাহলে পথ কী? পথ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। যে চেতনার মূল বিষয় ব্যক্তির নয়, সমষ্টির স্বার্থকে বিকশিত করা। সম্পদ উৎপাদন তো বটেই, সম্পদের সুষম বণ্টনও প্রয়োজন হবে। শত্রু চলে গেছে মনে করছি, কিন্তু শত্রু মোটেই যায়নি। শত্রু হচ্ছে ব্যক্তির স্বার্থকে বড় করে তোলা এবং সেই গুরুত্বদানের পেছনে কাজ করছে পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও আদর্শ-শত্রু তারাও। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আসলেই শেষ হয়নি। সেই যুদ্ধে হেরে গেলে কেবলই পেছন দিকে হাঁটতে থাকব, এখন যেমন হাঁটছি ক্রমাগত।
বাংলাদেশে মৌলবাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এক দিক দিয়ে এটা অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত। কেননা বাংলাদেশের অভ্যুদয় ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান ও পরাভূত করে। কিন্তু পরাভূত শক্তি আবার ফিরে এসেছে। তার পরাজয়টা কেবল যে সশস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে ঘটেছিল তা নয়, ঘটেছিল আদর্শিকভাবেও। তাহলে কেন তার পুনরুত্থান? কেমন করে?
বোঝা যায় যে মৌলবাদীরা তাদের আদর্শিক পরাজয়টিকে মেনে নেয়নি। দৈহিকভাবে হেরে গিয়ে এবং ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে ছিল মাত্র, পরে পরিস্থিতি আগের মতো প্রতিকূল নেই দেখে ফিরে এসেছে। এই যে পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়া, এর প্রধান উপাদান কী? সেটা হলো পুঁজিবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। ওই যে ব্যক্তি বড় হয়ে উঠছে সমষ্টির তুলনায়—এই নীতিটি আগের রাষ্ট্রগুলোতে কার্যকর ছিল, মনে হয়েছিল বাংলাদেশে তা থাকবে না, কেননা বাংলাদেশ হবে প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক, সেখানে রাষ্ট্র হবে সবার সাধারণ সম্পত্তি, যার দরুন রাষ্ট্র তার শোষণকারী ভূমিকা ছেড়ে রক্ষাকারীর ভূমিকা নেবে এবং সমাজে অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। সেটাই ছিল স্বপ্ন। স্বপ্ন ভেঙে গেছে। যার ফলে অধিকাংশ মানুষের জীবনে দুঃস্বপ্ন নেমে এসেছে, এমন দুঃস্বপ্ন যা ছিল কল্পনার বাইরে, কারণ মুক্তিযুদ্ধে বিজয় তাদেরকে আশা দিয়েছিল, ভাববার সাহস জুগিয়েছিল যে স্বপ্ন দূরে নয়, নিকটবর্তী বটে।
চোখ কচলে মানুষ দেখেছে যে যুদ্ধ করল সবাই, কিন্তু সুফল চলে যাচ্ছে ধনীদের গৃহে। উনিশ শ সাতচল্লিশের স্বাধীনতাতে যারা উপকৃত হয়েছিল, একাত্তরের স্বাধীনতাতে তারাই উপকার পাচ্ছে, দ্বিতীয়বার। কে মুক্তিযোদ্ধা আর কে রাজাকার সেটা কোনো বিবেচনার বিষয় রইল না, সত্য হয়ে উঠল শ্রেণি। সাধারণ মানুষ আরও দেখল মুক্তিযোদ্ধা নাম নিয়ে কিছু মানুষ এমন আচরণ করছে যে তারা যেন পাকিস্তানিদের পরাজিত করেনি, যেন নিজেদের দেশকেই জয় করেছে; কাজেই দেশ তাদের, তারা এখন লুটপাট করবে, আগে পাকিস্তানিরা যেমন লুটপাট করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সর্বত্র ভূলুণ্ঠিত হলো।
রাষ্ট্র আবার সেই পুরোনো পুঁজিবাদী পথ ধরে এগোতে থাকল। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বিদায় নিল, সমাজতন্ত্রকে ছেঁটে ফেলা হলো এবং গণতন্ত্রের পরিবর্তে কখনো বৈধ কখনো অবৈধ স্বৈরশাসন কায়েমি হয়ে বসে রইল। দারিদ্র্য, বৈষম্য ও অজ্ঞতা বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করল। অধিকাংশের স্বার্থ না দেখে কতিপয়ের স্বার্থ রক্ষা করবার দায়িত্ব গ্রহণ করে রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়াল পীড়নকারী প্রতিষ্ঠান, যার কাছে আশ্রয় নেই, ভরসা নেই ন্যায়বিচারের।
কথা ছিল শিক্ষা হবে অভিন্ন ও সর্বজনীন। তা হয়নি। পাকিস্তানি রাষ্ট্রে এবং তারও আগে যে তিন ধরনের শিক্ষাধারা প্রচলিত ছিল, সেগুলো প্রবল বেগে ফিরে এসেছে। গরিব মানুষকে উৎসাহিত করা হয়েছে মাদ্রাসায় সন্তানদের পাঠাতে। সেখানে গিয়ে তারা আরও গরিব হয়েছে এবং ধর্মনিরপেক্ষতায় আস্থা হারিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে শাসকশ্রেণির অস্বস্তি ছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে তারা সব ধর্মের অবাধ চর্চা বুঝেছে এবং কার্যত ধর্মচর্চাকে উৎসাহিত করেছে।
এটাও দেখা গেছে, ধনীরা মনে করেছে যে তারা ধনী হয়েছে ভাগ্যগুণে। তারা আরও ধনী হতে চায়। আবার ভেতরে-ভেতরে অপরাধবোধও কাজ করেছে, কেননা তারা জানে যে ধনার্জনের পথটা যে সৎ ছিল তা নয়, ছিল অপরাধাচ্ছন্ন। সৌভাগ্যের অত্যাশ্চর্য তৎপরতার জন্য কৃতজ্ঞতা এবং অপরাধবোধের বোঝা এই দুইয়ের তাড়নায় ধনীরা ধর্মকার্য ধরেছে। তারা মোটেই ধার্মিক নয়, ধর্মের আনুষ্ঠানিকতাটাই করে, আধ্যাত্মিকতার বালাই নেই। কিন্তু তাদের দৃষ্টান্ত কম বিত্তবানদের অস্থির করে ধর্মের পথ ধরতে।
সমাজের প্রায় সবাই এখন পুঁজিবাদী। ব্যক্তিগত মুনাফা চায়। অন্যের ভালোমন্দ সম্পর্কে আগ্রহ কমছে, ক্রমাগত সংকীর্ণ, স্বার্থবুদ্ধিসর্বস্ব ও হতাশ হয়ে পড়ছে। হতাশা একটি ভয়ংকর ব্যাধি। ধর্মসহ নানাবিধ মাদকাসক্তি ওই ভূমিতে লালিত-পালিত হয়।
প্রতিশ্রুতি ছিল যে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রতিষ্ঠিত করবে। রাষ্ট্র তা করেনি। বস্তুত রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতাকে কেবল যে সংবিধান থেকে বাদ দিয়েছে তা নয়, সেখানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে যুক্ত করেছে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের তৎপরতা তো রয়েছেই, জাতীয়তাবাদী বলে পরিচিত বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলও প্রায় প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতিতেই ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে চলেছে।
এসব মিলিয়েই বাস্তবতা। এই বাস্তবতা রাজনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষতা ও দার্শনিক ইহজাগতিকতাকে উৎসাহিত করছে না, বরং মানুষকে প্ররোচিত করছে উল্টো দিকে যেতে। ধর্মনিরপেক্ষতার ধারকেরা দুই ভাগে বিভক্ত, উদারনীতিক ও বামপন্থী। উদারনীতিতে বিশ্বাসী যাঁরা, তাঁরা জনগণের ওপর প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়েছেন। সেটা অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। কেননা তাঁরা ভদ্রলোক এবং জনবিচ্ছিন্ন। তদুপরি তাঁরা হচ্ছেন বিদ্যমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সমর্থক, যে ব্যবস্থাকে শ্রমজীবী মানুষ মনেপ্রাণে ঘৃণা করে, যদিও প্রকাশ করবার পথ পায় না। উদারনীতিকেরা ব্যক্তির বিকাশকে সমর্থন করেন, সমষ্টির বিপরীতে। তাঁরা রাষ্ট্রের অনুগ্রহপুষ্ট, নানাভাবে। তাঁদের দৃষ্টান্ত বা আদর্শ কোনোটাই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইহজাগতিকতার প্রকৃত সমর্থক হচ্ছেন বামপন্থীরা। কিন্তু কিছুটা নিজেদের দার্শনিক দুর্বলতা, কিছুটা পরদেশনির্ভরতা এবং অনেকটা রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার বৈরিতার কারণে তাঁরা প্রবল হতে পারেননি। স্মরণীয় যে, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্রীয় নীতি ছিল রাজাকারদের ক্ষমা করা এবং বামপন্থীদের প্রয়োজনে হত্যা করা। জনগণ বিক্ষুব্ধ, তাদের সেই বিক্ষোভ বাম দিকে যাবে—এমন পথ এখনো তৈরি হয়নি। ফলে সাধারণ মানুষ ডান দিকেই যাচ্ছে এবং ডানপন্থীদেরও ডানে যাদের অবস্থান সেই মৌলবাদীরা সুবিধা করে নিচ্ছে।
আসল অপরাধ পুঁজিবাদের। সেই দুর্বৃত্ত নানা অপরাধের জন্ম দিচ্ছে এবং প্রায় কোনো অপরাধেরই যথোপযুক্ত বিচার নেই। বিচারব্যবস্থা যে দুর্বল হবে তার নিশ্চিত পূর্বাভাস পাওয়া গেছে তখনই, যখন দেখা গেছে যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসর স্থানীয় রাজাকারদের বিচার হয়নি। বিচার হয়নি তো বটেই, বিচারের আগ্রহও দেখা যায়নি। যে রাষ্ট্রে অত বড় অপরাধীদের শাস্তি হয় না, সেখানে অন্য অপরাধীরা শাস্তি পাবে এমন ভরসা জনগণ পায়নি। আসল সত্য তো এটাই যে যাঁরা ক্ষমতা পেয়েছিলেন, তাঁরা ব্যস্ত ছিলেন নিজেদের স্বার্থ নিয়ে। সবার স্বার্থ দেখার মতো সময়ের অভাব ছিল তাঁদের দিক থেকে। তাঁরা নিজেরাও তো সহযোগীই ছিলেন পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার। পুঁজিবাদী বিশ্ব বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করেছিল এই রাষ্ট্র সমাজতন্ত্রীদের হাতে চলে যাবে—এই রকমের আশঙ্কা থেকে। পরে তারা ঋণ, সাহায্য, পরামর্শ সর্বোপরি আদর্শ দানের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে টেনে নিয়েছে তাদের বৃত্তে। বাংলাদেশের শাসকশ্রেণি সেই ব্যবস্থারই অধীনতা মেনে নিয়েছে, পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি যার অধীনে ছিল। তফাৎটা আদর্শগত নয়। স্বার্থগত। পুঁজিবাদী আদর্শের অনুসারীরা ওই একই আদর্শের উগ্র সমর্থক যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের শাস্তি দিতে উৎসাহ পাবে, এটা স্বাভাবিক নয়। উৎসাহ তারা পায়ওনি। বরং ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের নৃশংস তৎপরতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে।
তাহলে পথ কী? পথ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। যে চেতনার মূল বিষয় ব্যক্তির নয়, সমষ্টির স্বার্থকে বিকশিত করা। সম্পদ উৎপাদন তো বটেই, সম্পদের সুষম বণ্টনও প্রয়োজন হবে। শত্রু চলে গেছে মনে করছি, কিন্তু শত্রু মোটেই যায়নি। শত্রু হচ্ছে ব্যক্তির স্বার্থকে বড় করে তোলা এবং সেই গুরুত্বদানের পেছনে কাজ করছে পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও আদর্শ-শত্রু তারাও। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আসলেই শেষ হয়নি। সেই যুদ্ধে হেরে গেলে কেবলই পেছন দিকে হাঁটতে থাকব, এখন যেমন হাঁটছি ক্রমাগত।
পাকিস্তান সে দেশে বসবাস করা আফগান শরণার্থীদের ব্যাপকভাবে বহিষ্কার করতে শুরু করেছে। চলতি এপ্রিলের মধ্যে ৮০ হাজার শরণার্থীকে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্য রয়েছে পাকিস্তান সরকারের। বলা যায়, এই সিদ্ধান্ত আফগান শরণার্থীদের কাছে বজ্রাঘাতের মতো হয়ে এসেছে। কোথায় যাবে তারা? তালেবানশাসিত আফগানিস্তানে ফেরার মতো অবস্থা
৩ ঘণ্টা আগেআমরা যুদ্ধবিরোধী। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বা যেকোনো দেশে যুদ্ধ মানেই মানুষের বিপদ। খেয়াল করবেন, বিশ্ব বদলে গেছে। আগে দুনিয়ার যেকোনো জায়গায় একটা বোমা ফাটলেই মানুষ নড়েচড়ে বসত। খবর হয়ে যেত সারা পৃথিবীতে। এখন আর তেমন হয় না। গাজায় আক্রান্ত সভ্যতা ও মানুষের জীবন। যারা মারছে তারা বেপরোয়া। অথচ মানুষের মনে আফসোস
৩ ঘণ্টা আগেলালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলায় চলবলা ইউনিয়নের শিয়ালখোওয়া এলাকার শিয়ালখোওয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং শিয়ালখোওয়া উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ মাঠে সপ্তাহে প্রতি শনি ও বুধবার হাট বসে। এ ছাড়া বাকি পাঁচ দিনই প্রতিষ্ঠানটির মাঠে বসে দৈনিক বাজার। হাটের কার্যক্রম শুরু হয় সকাল থেকে। সারা দিন চলে বেচাকেনা। এ মাঠে আর
৩ ঘণ্টা আগেনারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালার ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদনটি সমাজে নারী-পুরুষ সমতার বাস্তবায়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বলে বিবেচিত হচ্ছে। কমিশন যে সুপারিশগুলো দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে কিছু সুস্পষ্টভাবে নারীর অধিকারে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম, আবার কিছু সুপারিশ কাঠামোগত ও প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের
১৯ ঘণ্টা আগে