এ কে এম শামসুদ্দিন
গত সপ্তাহে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আশাজাগানিয়া একটি খবর প্রচারিত হওয়ার পর দেশব্যাপী বেশ আলোচনা চলছে। ৫ এপ্রিল থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী ইউ থান শিউ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমানকে বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়ার যোগ্য বলে জানিয়েছেন। মূলত এ তথ্যটি প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজে পোস্ট দেওয়ার পর চারদিকে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে আরও জানা যায়, বাংলাদেশের দেওয়া তালিকায় থাকা ৮ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে মিয়ানমার ১ লাখ ৮০ হাজার প্রত্যাবাসনের জন্য যোগ্য বিবেচিত হলেও চূড়ান্ত যাচাই-বাছাইয়ের পর্যায়ে ৭০ হাজার রোহিঙ্গার নাম ও ছবি আরও ভালোভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এর বাইরে আরও সাড়ে ৫ লাখ রোহিঙ্গার যাচাই-বাছাইয়ের কাজ জরুরি ভিত্তিতে করবে বলে জান্তা সরকার জানিয়েছে।
২০১৮-২০ সালে বাংলাদেশ মোট ছয় ধাপে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের তালিকা দেয়। ওই তালিকা দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালে ১ হাজার ১০০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্পও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটি সফল হয়নি। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে চীনের মধ্যস্থতায় রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল মিয়ানমার। চুক্তি স্বাক্ষরের দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর কথাও ছিল। এ চুক্তি নিয়ে তখন ব্যাপক সমালোচনাও হয়েছিল। কারণ, তখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান ও নিজ বাস্তুভিটায় ফেরার ব্যাপারে মিয়ানমার জান্তার পক্ষে কোনো পজিটিভ সাড়া না পাওয়ায় প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হয়নি। ফিরে যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গা শরণার্থীরা তখন আট দফা দাবি পেশ করেছিল। সেসব বিষয়েও কোনো মীমাংসা হয়নি সে সময়ে। সুতরাং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে এত দিন নিশ্চুপ থাকার পর হঠাৎ এভাবে মিয়ানমার সরকারের ঘুম ভাঙার খবরে সবাই যেন নড়চড়ে বসেছে। তাদের সবারই অভিমত, রাখাইনে আরাকান আর্মির কাছে জান্তা বাহিনী উপর্যুপরি মার খাওয়ার পর ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা ফেরতযোগ্য ঘোষণা, মিয়ানমার সরকারের কোনো অপকৌশল কি না ভেবে দেখতে হবে।
মিয়ানমারের এই ঘোষণা কূটনৈতিক কৌশল হিসেবেই দেখছেন দেশের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা। রাখাইন অঞ্চল এখন আর মিয়ানমার জান্তার নিয়ন্ত্রণে নেই। ওই অঞ্চলের অধিকাংশ ভূখণ্ড এখন আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রণ করছে। এমতাবস্থায় জান্তা গোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের কোথায় পুনর্বাসন করবে, তা নিয়ে আছে ধোঁয়াশা। কারও কারও অভিমত যে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার এখন তাদের ইতিবাচক ভাবমূর্তি রক্ষায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আলোচনা করছে। তারা কিন্তু আগের কোনো প্রতিশ্রুতিই রক্ষা করেনি। এসব হলো তাদের রাজনৈতিক অর্থহীন কথাবার্তা, যার কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই। মনে রাখতে হবে, জান্তা সরকার রাজি হলেও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন আদৌ সম্ভব কি না, তা ভেবে দেখতে হবে। আরাকান আর্মিকে পাশ কাটিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। রাখাইনের যেসব এলাকায় রোহিঙ্গাদের বসতি, সেগুলো এখন আরাকান আর্মির দখলে। রাখাইনের জনসংখ্যা ৩০ লাখের বেশি। সেখানকার মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ বৌদ্ধ এবং ৩৫ শতাংশ মুসলিম রোহিঙ্গা। জনসংখ্যার বিচারে রোহিঙ্গাদের অবস্থান নেহাত কম নয়। তারপরও কথা থেকে যায়। কয়েক বছর যাবৎ আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে মিয়ানমার জান্তা কৌশলে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করেছে। ফলে রোহিঙ্গাদের ওপর আরাকান আর্মির ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক। এই বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।
কয়েক বছর আগে আরাকান আর্মির প্রধান মেজর জেনারেল তোয়াই ম্রা নাইং ঢাকার এক সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি ও পূর্ণ মর্যাদায় তাদের গ্রহণ করার কথা বলেছিলেন। রাখাইন তখন জান্তা সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল। আরাকান আর্মি রাখাইনকে স্বাধীন করতে তখন আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছিল। রোহিঙ্গাদের প্রতি যেহেতু আন্তর্জাতিক মহল সহানুভূতিশীল, কাজেই তাদের সমর্থন পেতে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হওয়ার কথা বলেছিল। তারা ভেবেছিল, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব স্বীকার করে নিয়ে পুনর্বাসনের অঙ্গীকার করলে তারা হয়তো যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন পাবে। সে কারণে সেই সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেছিলেন, ধর্ম বিবেচ্য নয়, জন্মসূত্রেই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। রোহিঙ্গাদের জন্মভূমিতে ফিরিয়ে এনে যত দ্রুত সম্ভব নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা উচিত। ১৯৮২ সালের যে আইনের বলে মিয়ানমার সামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব হরণ করেছিল; তারা সেই আইন সংশোধন/বিলোপের অঙ্গীকারও করেছিল।
তবে মিয়ানমার জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরাকান আর্মি তখন অনানুষ্ঠানিকভাবে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সহায়তা কামনা করেছিল। শেখ হাসিনা সরকার তাদের সে অনুরোধে কর্ণপাত করেনি। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আরাকান আর্মির কোনো যোগাযোগ ঘটেছে কি না, জিজ্ঞেস করলে উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি নানান সময়। প্রত্যাশিত সাড়া পেয়েছি বলতে পারব না। আমার দিক থেকে সিদ্ধান্ত রয়েছে, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনার। আমরা যথাযথ সাড়ার অপেক্ষা করছি।’ এরপর বাংলাদেশের গোয়েন্দা সদস্য পর্যায়ে কিছুটা যোগাযোগের চেষ্টা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কারণ, গোয়েন্দা সদস্যরা তো বাংলাদেশের কোনো অথরিটি নয়। এভাবে কয়েক বছর যোগাযোগ রক্ষা করা হলেও বাংলাদেশের তৎকালীন সরকারের আন্তরিকতার অভাবে এ বিষয়ে আর অগ্রগতি হয়নি।
অথচ মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও ভারত নিজ স্বার্থে আরাকান আর্মির সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। সর্বশেষ এক তথ্যে জানা গেছে, আরাকান আর্মির উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা সম্প্রতি দিল্লি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। রাখাইন প্রদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের অর্থায়নে কালাদান মাল্টিমোডাল প্রকল্পের কাজ চলছে। বাংলাদেশকে অনেকটা বাইপাস করে কলকাতা থেকে সিত্তে পর্যন্ত নৌপথকে জাহাজ চলাচলের উপযুক্ত করেছে ভারত। কলকাতা থেকে প্রথমে সমুদ্রপথে মিয়ানমারের সিত্তে বন্দর, তারপর কালাদান নদীপথে পালতোয়া, সেখান থেকে সড়কপথে ভারতের মিজোরাম অর্থাৎ উত্তর-পূর্বাঞ্চল—এই হলো কালাদান মাল্টিমোডাল প্রজেক্টের রুট। ভারত রাখাইনের এমন অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মধ্যেই আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। আরাকান আর্মি তাদের ভবিষ্যৎ স্বার্থের কথা চিন্তা করে ভারতের কালাদান প্রকল্পের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকার কথা জানিয়েছে এবং তারা প্রকল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। যদিও আরাকান আর্মির সঙ্গে ভারতের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই। উভয় পক্ষই নিজেদের স্বার্থে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আরাকান আর্মির ওপর চীনের প্রভাব থাকায় ভারতের এ উদ্যোগে কতটুকু সফল হবে, সে প্রশ্ন দেখা দিতেই পারে। কারণ, ওই অঞ্চলে চীনেরও স্বার্থ নিহিত আছে। রাখাইনে ভারত-চীনের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ বিপরীতমুখী। তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, দুই পক্ষের স্বার্থ থাকায় রাখাইনে স্থিতিশীলতা আনতে চীন ও ভারত মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেই সমঝোতায় আসতে পারে। চীন ও ভারত যদি জাতীয় স্বার্থে সমঝোতা করতে পারে, তাহলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ কেন ভারসাম্য কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথে এগোতে পারবে না?
রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্থাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশকে এর পূর্ণ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। আরাকান আর্মিই শুধু নয়, মিয়ানমারের সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে। মূল উদ্দেশ্যই হবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো।
খলিলুর রহমানকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি নিয়োগ যথাযথ হয়েছে বলে মনে হয়। ইতিপূর্বে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে একজন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগের জন্য দেশের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তা পূরণ হয়েছে। নবনিযুক্ত উপদেষ্টার ওপর এখন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। আশা করি, তিনি সব পক্ষের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে সক্ষম হবেন।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
গত সপ্তাহে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আশাজাগানিয়া একটি খবর প্রচারিত হওয়ার পর দেশব্যাপী বেশ আলোচনা চলছে। ৫ এপ্রিল থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী ইউ থান শিউ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমানকে বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়ার যোগ্য বলে জানিয়েছেন। মূলত এ তথ্যটি প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজে পোস্ট দেওয়ার পর চারদিকে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে আরও জানা যায়, বাংলাদেশের দেওয়া তালিকায় থাকা ৮ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে মিয়ানমার ১ লাখ ৮০ হাজার প্রত্যাবাসনের জন্য যোগ্য বিবেচিত হলেও চূড়ান্ত যাচাই-বাছাইয়ের পর্যায়ে ৭০ হাজার রোহিঙ্গার নাম ও ছবি আরও ভালোভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এর বাইরে আরও সাড়ে ৫ লাখ রোহিঙ্গার যাচাই-বাছাইয়ের কাজ জরুরি ভিত্তিতে করবে বলে জান্তা সরকার জানিয়েছে।
২০১৮-২০ সালে বাংলাদেশ মোট ছয় ধাপে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের তালিকা দেয়। ওই তালিকা দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালে ১ হাজার ১০০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্পও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটি সফল হয়নি। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে চীনের মধ্যস্থতায় রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল মিয়ানমার। চুক্তি স্বাক্ষরের দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর কথাও ছিল। এ চুক্তি নিয়ে তখন ব্যাপক সমালোচনাও হয়েছিল। কারণ, তখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান ও নিজ বাস্তুভিটায় ফেরার ব্যাপারে মিয়ানমার জান্তার পক্ষে কোনো পজিটিভ সাড়া না পাওয়ায় প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হয়নি। ফিরে যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গা শরণার্থীরা তখন আট দফা দাবি পেশ করেছিল। সেসব বিষয়েও কোনো মীমাংসা হয়নি সে সময়ে। সুতরাং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে এত দিন নিশ্চুপ থাকার পর হঠাৎ এভাবে মিয়ানমার সরকারের ঘুম ভাঙার খবরে সবাই যেন নড়চড়ে বসেছে। তাদের সবারই অভিমত, রাখাইনে আরাকান আর্মির কাছে জান্তা বাহিনী উপর্যুপরি মার খাওয়ার পর ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা ফেরতযোগ্য ঘোষণা, মিয়ানমার সরকারের কোনো অপকৌশল কি না ভেবে দেখতে হবে।
মিয়ানমারের এই ঘোষণা কূটনৈতিক কৌশল হিসেবেই দেখছেন দেশের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা। রাখাইন অঞ্চল এখন আর মিয়ানমার জান্তার নিয়ন্ত্রণে নেই। ওই অঞ্চলের অধিকাংশ ভূখণ্ড এখন আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রণ করছে। এমতাবস্থায় জান্তা গোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের কোথায় পুনর্বাসন করবে, তা নিয়ে আছে ধোঁয়াশা। কারও কারও অভিমত যে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার এখন তাদের ইতিবাচক ভাবমূর্তি রক্ষায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আলোচনা করছে। তারা কিন্তু আগের কোনো প্রতিশ্রুতিই রক্ষা করেনি। এসব হলো তাদের রাজনৈতিক অর্থহীন কথাবার্তা, যার কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই। মনে রাখতে হবে, জান্তা সরকার রাজি হলেও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন আদৌ সম্ভব কি না, তা ভেবে দেখতে হবে। আরাকান আর্মিকে পাশ কাটিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। রাখাইনের যেসব এলাকায় রোহিঙ্গাদের বসতি, সেগুলো এখন আরাকান আর্মির দখলে। রাখাইনের জনসংখ্যা ৩০ লাখের বেশি। সেখানকার মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ বৌদ্ধ এবং ৩৫ শতাংশ মুসলিম রোহিঙ্গা। জনসংখ্যার বিচারে রোহিঙ্গাদের অবস্থান নেহাত কম নয়। তারপরও কথা থেকে যায়। কয়েক বছর যাবৎ আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে মিয়ানমার জান্তা কৌশলে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করেছে। ফলে রোহিঙ্গাদের ওপর আরাকান আর্মির ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক। এই বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।
কয়েক বছর আগে আরাকান আর্মির প্রধান মেজর জেনারেল তোয়াই ম্রা নাইং ঢাকার এক সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি ও পূর্ণ মর্যাদায় তাদের গ্রহণ করার কথা বলেছিলেন। রাখাইন তখন জান্তা সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল। আরাকান আর্মি রাখাইনকে স্বাধীন করতে তখন আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছিল। রোহিঙ্গাদের প্রতি যেহেতু আন্তর্জাতিক মহল সহানুভূতিশীল, কাজেই তাদের সমর্থন পেতে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হওয়ার কথা বলেছিল। তারা ভেবেছিল, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব স্বীকার করে নিয়ে পুনর্বাসনের অঙ্গীকার করলে তারা হয়তো যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন পাবে। সে কারণে সেই সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেছিলেন, ধর্ম বিবেচ্য নয়, জন্মসূত্রেই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। রোহিঙ্গাদের জন্মভূমিতে ফিরিয়ে এনে যত দ্রুত সম্ভব নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা উচিত। ১৯৮২ সালের যে আইনের বলে মিয়ানমার সামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব হরণ করেছিল; তারা সেই আইন সংশোধন/বিলোপের অঙ্গীকারও করেছিল।
তবে মিয়ানমার জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরাকান আর্মি তখন অনানুষ্ঠানিকভাবে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সহায়তা কামনা করেছিল। শেখ হাসিনা সরকার তাদের সে অনুরোধে কর্ণপাত করেনি। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আরাকান আর্মির কোনো যোগাযোগ ঘটেছে কি না, জিজ্ঞেস করলে উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি নানান সময়। প্রত্যাশিত সাড়া পেয়েছি বলতে পারব না। আমার দিক থেকে সিদ্ধান্ত রয়েছে, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনার। আমরা যথাযথ সাড়ার অপেক্ষা করছি।’ এরপর বাংলাদেশের গোয়েন্দা সদস্য পর্যায়ে কিছুটা যোগাযোগের চেষ্টা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কারণ, গোয়েন্দা সদস্যরা তো বাংলাদেশের কোনো অথরিটি নয়। এভাবে কয়েক বছর যোগাযোগ রক্ষা করা হলেও বাংলাদেশের তৎকালীন সরকারের আন্তরিকতার অভাবে এ বিষয়ে আর অগ্রগতি হয়নি।
অথচ মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও ভারত নিজ স্বার্থে আরাকান আর্মির সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। সর্বশেষ এক তথ্যে জানা গেছে, আরাকান আর্মির উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা সম্প্রতি দিল্লি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। রাখাইন প্রদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের অর্থায়নে কালাদান মাল্টিমোডাল প্রকল্পের কাজ চলছে। বাংলাদেশকে অনেকটা বাইপাস করে কলকাতা থেকে সিত্তে পর্যন্ত নৌপথকে জাহাজ চলাচলের উপযুক্ত করেছে ভারত। কলকাতা থেকে প্রথমে সমুদ্রপথে মিয়ানমারের সিত্তে বন্দর, তারপর কালাদান নদীপথে পালতোয়া, সেখান থেকে সড়কপথে ভারতের মিজোরাম অর্থাৎ উত্তর-পূর্বাঞ্চল—এই হলো কালাদান মাল্টিমোডাল প্রজেক্টের রুট। ভারত রাখাইনের এমন অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মধ্যেই আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। আরাকান আর্মি তাদের ভবিষ্যৎ স্বার্থের কথা চিন্তা করে ভারতের কালাদান প্রকল্পের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকার কথা জানিয়েছে এবং তারা প্রকল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। যদিও আরাকান আর্মির সঙ্গে ভারতের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই। উভয় পক্ষই নিজেদের স্বার্থে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আরাকান আর্মির ওপর চীনের প্রভাব থাকায় ভারতের এ উদ্যোগে কতটুকু সফল হবে, সে প্রশ্ন দেখা দিতেই পারে। কারণ, ওই অঞ্চলে চীনেরও স্বার্থ নিহিত আছে। রাখাইনে ভারত-চীনের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ বিপরীতমুখী। তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, দুই পক্ষের স্বার্থ থাকায় রাখাইনে স্থিতিশীলতা আনতে চীন ও ভারত মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেই সমঝোতায় আসতে পারে। চীন ও ভারত যদি জাতীয় স্বার্থে সমঝোতা করতে পারে, তাহলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ কেন ভারসাম্য কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথে এগোতে পারবে না?
রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্থাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশকে এর পূর্ণ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। আরাকান আর্মিই শুধু নয়, মিয়ানমারের সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে। মূল উদ্দেশ্যই হবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো।
খলিলুর রহমানকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি নিয়োগ যথাযথ হয়েছে বলে মনে হয়। ইতিপূর্বে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে একজন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগের জন্য দেশের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তা পূরণ হয়েছে। নবনিযুক্ত উপদেষ্টার ওপর এখন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। আশা করি, তিনি সব পক্ষের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে সক্ষম হবেন।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
আশেকা ইরশাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং সাবেক চেয়ারপারসন। তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র জেন্ডার, ভূ-কৌশলগত ও আঞ্চলিক সম্পর্ক নিয়ে। ফিলিস্তিন পরিস্থিতিতে আরব বিশ্বের ভূমিকা...
১৯ ঘণ্টা আগেরাজনীতি যদি মানুষের আশা-ভরসার প্রতীক হয়, তবে তা শুধু ঢাকার পিচঢালা রাস্তায় নয়, প্রতিটি ইউনিয়নের মাটির পথে প্রতিফলিত হতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনীতি যেন একটি দূরবর্তী বিষয়—শুধু খবরের কাগজে থাকে, জীবনের ভেতরে তা প্রবেশ করে না।
২০ ঘণ্টা আগেবেছে বেছে এ বিষয়টি নিয়ে সম্পাদকীয় লেখার একটা বিশেষ কারণ আছে। ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি কী করে আমাদের হয়েছিল, সে কথা প্রত্যেকে বুঝতে পারলে ভালো হতো। দুঃখের বিষয় হলো, সেটা সবাই বুঝতে পারে না।
২০ ঘণ্টা আগেসমগ্র বাংলাদেশ এখন স্বপ্ন দেখছে। আমূল বদলে যাওয়ার স্বপ্ন। বাংলাদেশকে এই স্বপ্ন দেখাচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, এই স্বপ্ন দেখাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁকে কেন্দ্র করেই স্বপ্নগুলো আবর্তিত হতে শুরু করেছে।
২ দিন আগে