Ajker Patrika

অন্যদের এগোতে দেখেও উল্টো পথেই চলব

আজাদুর রহমান চন্দন
আপডেট : ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০৯: ৫২
আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম তিন বছরের মধ্যে এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে। ছবি: আজকের পত্রিকা
আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম তিন বছরের মধ্যে এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে। ছবি: আজকের পত্রিকা

দেশের সংবিধান, পুলিশ, স্থানীয় সরকার, নির্বাচন, বিচারব্যবস্থাসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কারের নানা আলাপ হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু এই সময়ে অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়ে খুব বেশি কিছু করা হয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারেরই গঠন করা শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, এই (অন্তর্বর্তী) সরকার গত (আওয়ামী লীগ) সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাসহ মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা স্থগিত করেছে। কিন্তু এর বিপরীতে কোনো মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়নি। এ কারণে বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছেন না। এমনকি যে নীতিগুলো এখন নেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর ধারাবাহিকতা থাকবে কি না, তা নিয়েও তাঁরা সংশয়ে আছেন। সবারই জানা, একটি নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগপর্যন্ত দেশে উল্লেখযোগ্য হারে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে না। সমাজেও ফিরবে না স্থিতিশীলতা। উপদেষ্টারা মাঝেমধ্যে হাঁকডাক ছাড়লেও মব-সন্ত্রাস কিন্তু থামছে না। সরকার ও প্রশাসনের ওপর এখন নানা রাজনৈতিক শক্তির প্রভাব লক্ষণীয়। কাকে রেখে কাকে তুষ্ট করবেন, সে নিয়ে সারাক্ষণ দোটানায় থাকতে হয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের। প্রশাসন কার পক্ষে বেশি ভূমিকা রাখছে, সে নিয়েও বিতর্ক দেখা যাচ্ছে খোদ প্রভাব বিস্তারকারী দলগুলোর মধ্যেই। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা নাহিদ ইসলামের দাবি, প্রশাসন বিএনপির পক্ষে কাজ করছে। পাল্টা অভিযোগ করে বিএনপি বলেছে, প্রশাসনের সঙ্গে ‘বৈষম্যবিরোধীদেরই’ সখ্য সবচেয়ে বেশি। যদিও ফাঁকতালে মজা লুটছে অন্য একাধিক দল।

ছাত্র-জনতার ব্যাপক আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয় শেখ হাসিনার সরকার। অর্থনৈতিক বৈষম্য, দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাট আর ভোটের নামে তামাশার কারণেই যে সর্বস্তরের মানুষ জুলাই আন্দোলনে শামিল হয়েছিল, সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। আগের সরকারের সময়ে অর্থনৈতিক সুবিধা হিসাব না করেই অনেক বিনিয়োগ করা হয়েছিল; প্রকল্পের ব্যয় বহুগুণ বাড়ানো হয়েছিল। অথচ উন্নয়ন বাজেটের প্রায় পুরোটাই ছিল ঋণনির্ভর। উন্নয়ন প্রকল্প থেকে অর্থ লোপাট করা হয়েছেই, নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে সেই অর্থ বিদেশে পাচার করে ফতুর করে দেওয়া হয়েছে অনেক ব্যাংক। শেখ হাসিনা ও তাঁর অনুগামীরা তখন বাজারে ছেড়েছিলেন ‘কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন’ তত্ত্ব। ‘দিনের ভোট রাতে’ এবং ‘আমি আর ডামি’ জাতীয় নির্বাচনের নাটক করতেও তাঁদের বাধেনি। এসব কারণেই জনতা রুষ্ট হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের পর মানুষ প্রত্যাশা করেছিল—সব ধরনের বৈষম্য বিলোপের পাশাপাশি বাজারে সিন্ডিকেটের অবসান ঘটবে, দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে আসবে। কিন্তু বাস্তবে এসবের কিছুই ঘটছে না।

সংবাদমাধ্যমের সুবাদে এরই মধ্যে দেশবাসীর জানা হয়ে গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম তিন বছরের মধ্যে এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে। অথচ দেশের বাজারে এই তেল বিক্রি হচ্ছে তুলনামূলক উচ্চ দামে। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা যদিও দাবি করছেন, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং যথাসময়ে ব্যাংকের সহায়তা না পাওয়ায় বিশ্ববাজারে দর কমার সুফল পাচ্ছেন না দেশের ভোক্তারা। তবে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) যাবতীয় ব্যয় পর্যালোচনা করে জানিয়েছে, এটি ব্যবসায়ীদের অজুহাত মাত্র। ক্যাবের হিসাবে, বোতলজাত সয়াবিনের দাম সর্বশেষ ১৪ টাকা বাড়ানোর পর ব্যবসায়ীদের লাভ হচ্ছে লিটারে অন্তত ১২ টাকা।

শ্রীলঙ্কা ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়ার পর বাংলাদেশকেও তেমন পরিণতি বরণ করতে হতে পারে বলে কয়েক মাস আগেও অনেকেই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতেন। শ্রীলঙ্কায় ক্রমান্বয়ে খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চরম ঘাটতি দেখা দিলে জনমনে সরকারের প্রতি ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। ব্যাপক জনরোষের তোড়ে ২০২২ সালের জুলাই মাসে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন দেশটির তখনকার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। এরপর রনিল বিক্রমাসিংহে এসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ২৯০ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা নিয়ে দেউলিয়া হওয়া অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে কর ও মূল্যবৃদ্ধির মতো পদক্ষেপ নেন। কিন্তু গত সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে বিদায় নিয়েছেন বিক্রমাসিংহে। সেই নির্বাচনে চমক দেখিয়ে বিজয়ী হন বামপন্থী অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে। এক মাসের কম সময়ের মধ্যে তিনি সব ধরনের পণ্যের দাম কমিয়ে রেকর্ড গড়েন। অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত শ্রীলঙ্কা ২৯ বছরে প্রথমবার দ্রব্যমূল্য কমতে দেখল অনূঢ়া দিশানায়েকের সুবাদে।

বাংলাদেশে দুর্নীতিগ্রস্ত যে সরকারকে শ্রীলঙ্কার মতো পরিণতির ভয় দেখানো হচ্ছিল, ব্যাপক জনরোষের তোপে সেই সরকারের পতন হয়েছে সাড়ে আট মাস আগে। এত দিনেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালে আসেনি। বারবার বলে আসছি, সাবেকি সাপ্লাই চেইন বা পণ্য সরবরাহ ও বাজারব্যবস্থা বহাল রেখে কেবল শুল্ক ছাড় দেওয়া আর অন্যকে দোষারোপ করে বাজার সামাল দেওয়া যাবে না। সর্বজনীন স্থায়ী রেশন পদ্ধতি এবং কৃষিপণ্যের সমবায়ভিত্তিক বাজারব্যবস্থা চালু করা ছাড়া সিন্ডিকেট ভাঙা যাবে না। এ কথা কে না জানে যে বাজারে সিন্ডিকেট গড়ে মূলত বড় কিছু ব্যবসায়ী ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান। গণ-অভ্যুত্থানের নায়কেরাও যদি সেই লুটেরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়েই নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম করতে চান, তাহলে গণমুখী বাজারব্যবস্থা তো সুদূর পরাহত থাকতেই বাধ্য।

বিএনপিসহ দায়িত্বশীল অনেক ছোট দলও যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে। কোনো কোনো মহল থেকে এর সমালোচনা করে বলা হচ্ছে, রাষ্ট্র সংস্কার এবং ফ্যাসিস্টদের বিচার শেষ না করে নির্বাচনের দাবি জানানোটা গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। কিন্তু সংস্কার ও বিচারের গতি কি খুব স্বাভাবিক? বিচার বিভাগ সংস্কারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ধাপ হলো স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠা। আট মাস কেটে গেছে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করতেই। স্থানীয় সরকার ও নির্বাচনী সংস্কারের সুপারিশ দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা অনেক বছর ধরে এ নিয়ে কাজ করে আসছেন। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাবও তাদের জানা। চাইলে অনেক আগেই প্রতিবেদন দিতে পারতেন তাঁরা। কিছুটা দেরিতে হলেও সব কটি কমিশনের সুপারিশ জমা পড়েছে। এর পরবর্তী ধাপ হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপও চলছে। এই গতিতে রাশ না টানলে উল্লেখযোগ্য সংস্কার সেরেই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করা অসম্ভব নয়। এটিও ভুলে গেলে চলবে না যে সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ ছাড়া সংস্কার তথা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের যে বয়ান হাজির করা হচ্ছে, তাতে একাত্তর, বায়ান্ন, বাঙালিয়ানা—এসব বাতিলের চেষ্টা ছাড়া অন্য নতুনত্ব কিছু চোখে পড়ছে না।

২০২৬ সালের জুন মাসে নির্বাচন আয়োজনের ওপর এতটা জোর দেওয়ায় সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দেওয়া অমূলক নয়। কারণ, জুনে নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে আবহাওয়া বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। ডিসেম্বরে একান্তই সম্ভব না হলে ফেব্রুয়ারিতে করতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। নির্বাচন কমিশনও এরই মধ্যে তাদের প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করেছে। তা সত্ত্বেও বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা চলছে কি না, সেই সন্দেহ আছে অনেকের মনে। ড. ইউনূসকে আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় রাখা উচিত বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে প্রচারাভিযান চলছে, তার কারণে সেই সন্দেহ-অনিশ্চয়তা আরও বেড়ে গেছে।

জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে কথাবার্তা এত দিন বক্তৃতা-বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা উঠে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির আলোচনায়ও। ১৬ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ বিষয়ে স্পষ্ট হতে চেয়েছিল বিএনপি। প্রায় দুই ঘণ্টার বৈঠকেও দলটি সে বিষয়ে স্পষ্ট হতে পারেনি। বরং আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে—প্রধান উপদেষ্টার এমন বক্তব্যে হতাশা প্রকাশ করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘তাঁর (প্রধান উপদেষ্টা) বক্তব্যে আমরা একেবারেই সন্তুষ্ট নই।’ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের যে উদ্বেগ, তার ছাপ দেখা যাচ্ছে না তৃণমূল নেতাদের কথাবার্তায়। ‘এই বেশ ভালো আছি’—এমন ভাব স্পষ্ট তাদের কথায় ও কাজে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত