Ajker Patrika

কথা রাখতে পারলেন না ট্রাম্প

আব্দুর রাজ্জাক 
পুতিন ও জেলেনস্কির সঙ্গে আলাপ করেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে পারলেন না ট্রাম্প
পুতিন ও জেলেনস্কির সঙ্গে আলাপ করেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে পারলেন না ট্রাম্প

সাড়ে তিন বছর হতে চলল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের। শুরু হওয়ার এক বছর পর থেকেই বিভিন্ন মহল বিভিন্নভাবে এই যুদ্ধ বন্ধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। যুদ্ধ বন্ধে কয়েক মাসের মাথায় ইস্তাম্বুলে রাশিয়া ও ইউক্রেন কর্তৃপক্ষের মধ্যে একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। দুই পক্ষ মুখোমুখি বসে অনেক কথা হয়েছিল, সবাই আশায় বুক বেঁধেছিল, হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই এই যুদ্ধ বন্ধ হবে।

কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। তারপর মানুষ আবার আশায় বুক বেঁধেছিল ট্রাম্পের কথা শুনে। ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমি ক্ষমতায় থাকলে এই যুদ্ধ হতো না।’ এ রকম একটা আভাস ট্রাম্প দিয়েছিলেন বিশ্ববাসীসহ আমেরিকার জনগণকে যে—ডেমোক্রেটিক পার্টি যুদ্ধবাজ, তারা সারা বিশ্বে যুদ্ধ লাগায়। ট্রাম্পের সেই যুদ্ধ বন্ধ করতে হয়। আমেরিকাসহ সারা বিশ্বে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। ডেমোক্র্যাটদের মানুষ কুনজরে দেখতে শুরু করল। ট্রাম্পের বিখ্যাত উক্তি, ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ ও যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতির কারণে ভূমিধস বিজয় পেলেন ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট হলেন রেকর্ডসংখ্যক ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে। কংগ্রেসে ও সিনেটে রিপাবলিকানদের বিজয়। এত ক্ষমতা এর আগে কোনো আমেরিকান প্রেসিডেন্ট পেয়েছেন বলে মনে হয় না। সবাই একবাক্যে বলেছিল, এবার ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ বন্ধ হবেই হবে।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে যথারীতি ওয়াশিংটনে ডেকে পাঠালেন ট্রাম্প। জেলেনস্কি তাঁর স্বভাবসুলভ যুদ্ধকালীন পোশাক পরে ওয়াশিংটনে হাজির হলেন। ট্রাম্প তাঁর বেশভূষা-কথাবার্তা শুনে ধমকের ওপর ধমক দিলেন। এমনকি সৌজন্যমূলকভাবে যে চা চক্রের আয়োজন করা হয়েছিল, সেই আপ্যায়ন পর্যন্ত করলেন না। সম্পূর্ণ নিয়মনীতি ভেঙে অতিথি প্রেসিডেন্টকে মোটামুটি ছোটখাটো অপমান করার মতো করেই বিদায় করলেন। তখন সবাই মনে করতে লাগল, এবার ইউক্রেনের বারোটা বেজে গেছে—জেলেনস্কি এবার ফাঁদে পড়েছেন, যুদ্ধ বন্ধ করতে রাজি হবেন! কিসের কী! যুদ্ধ চলতে থাকল আগের মতোই, বা তার চেয়ে একটু জোরেশোরেই।

এদিকে ভ্লাদিমির পুতিন ট্রাম্পের কথায় আশ্বস্ত হওয়ার অভিনয় করলেন। ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। রুশ ভূখণ্ডের কুরস্ক অঞ্চলের যে ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গা ইউক্রেন দখল করে নিয়েছিল, তা অল্প দিনের মধ্যেই উদ্ধার করল রাশিয়া। শুধু উদ্ধার নয়, সেখানে ইউক্রেন ৩৭ হাজার সেনা হারাল। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হলো দেশটি। রাশিয়ার মধ্যেই ইউক্রেন গুপ্তচরের মাধ্যমে অস্ত্র মজুত করে রাশিয়ার মুরমানস্ক অঞ্চলে হঠাৎ হামলা

করে রাশিয়ার বেশ কয়েকটি বিমান ধ্বংস করে দিল। সঙ্গে ধ্বংস করল দুটি বিমানঘাঁটি। রাশিয়া অবশ্য বলেছে, সোভিয়েত আমলের যেসব বিমান ধ্বংস করেছে, বর্তমানে এইসব বিমান তারা খুব একটা ব্যবহার করে না। ব্যাপারটা তারা আমলেই নিতে চাইল না!

সবচেয়ে মজার বিষয়—রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মাসখানেক আগে ঘোষণা করলেন, রুশ সেনারা যেখানে তাদের বুটের জুতা দিয়ে অতিক্রম করবে, সেইসব জায়গা রাশিয়ার। এই কথা অনুসরণ করে রুশ সেনাদল পশ্চিম দিকে অগ্রসর হওয়া অব্যাহত রেখেছে। দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক নিয়ে দনবাস অঞ্চল গঠিত। দোনেৎস্ক এখন পুরাপুরি রাশিয়ার দখলে। লুহানস্কের কিছু অঞ্চল দখল করা বাকি। গত ১০ দিনে ইউক্রেনের পাঁচটি ছোট ছোট শহর দখল করেছে রাশিয়া। তার মধ্যে দুটি বেশ উল্লেখযোগ্য এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শহর দুটি হলো পোকরোভ্স্ক ও কনস্তান্তিনোভা।

গত এক সপ্তাহে রাশিয়া কিয়েভসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরে ৮২৬টি ড্রোন ও মিসাইল নিক্ষেপ করেছে। রাশিয়া ইউক্রেনের সামরিক স্থাপনায় ও অস্ত্র মজুতের ডিপোতে প্রধানত হামলাগুলো চালিয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, ইউক্রেনের সামরিক স্থাপনা ও গোলাবারুদ মজুতের গোডাউন রাশিয়ার নখদর্পণে। এইসব ড্রোন ও মিসাইল আক্রমণে হতাহত কম হয়। ধ্বংস হয় সামরিক স্থাপনা ও সামরিক সরঞ্জাম।

রাশিয়ার পক্ষ থেকে যে কথাটা বলা হচ্ছে, সেটা হলো, তারা ইউক্রেনের কোনো জায়গা দখল করে না। ওই অঞ্চলের মানুষ রাশিয়ার পক্ষে থাকতে চায়, ইউক্রেনের হাতে বন্দী থাকতে চায় না, তাই রাশিয়া তাদের স্বাধীনতা দিচ্ছে। অর্থাৎ রাশিয়া দখলদার না, তারা দখলদারের হাত থেকে মুক্ত করছে ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চল। খোঁজখবর নিয়ে এটা অবশ্য অনেকেই নিশ্চিত করেছে, রাশিয়া যেসব শহর-গ্রাম দখল করছে, সেই সব অঞ্চলের মানুষ রাশিয়ার সেনাদের স্বাগত জানিয়েছে, তারা এটাকে ভালোভাবেই মেনে নিয়েছে। এর একটা কারণ হলো অর্থনৈতিক। ইউক্রেনে থাকা অবস্থায় তারা যে অঙ্কের পারিশ্রমিকে কাজ করত, রাশিয়া সেই অঞ্চল ‘মুক্ত’ করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পারিশ্রমিক দ্বিগুণের বেশি হয়ে গেছে। জীবনযাত্রার মান সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে, তাই ওইসব মুক্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ এটাকে স্বাগত জানিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।

ট্রাম্প অল্প কিছুদিন আগে ঘোষণা করলেন, আমেরিকার যে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমানবিধ্বংসী মিসাইল আছে ইসরায়েলে, সেগুলো অচিরেই ইউক্রেনে স্থানান্তর করবে, ইসরায়েলকে নতুন করে তারা আবার প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র দেবে। এই কথায় সবাই বুঝে নিয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ হোক, তা ট্রাম্পও চান না। ট্রাম্প যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নির্বাচনের আগে, বিশ্ববাসীর বিরাট আস্থা অর্জন করেছিলেন, পর্যায়ক্রমে দেখা গেল সেইসব প্রতিশ্রুতির কোনো কিছুই এখন আর মানছেন না। শান্তিকামী নিরীহ মানুষ ধীরে ধীরে হতাশ হয়ে পড়ছেন।

দুই সপ্তাহ আগে শোনা গিয়েছিল, ভ্লাদিমির পুতিন ও জেলেনস্কি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন, যুদ্ধের ইতি ঘটবে। আপাতত কোনো আশার বাণী নেই, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না, বৈঠকের কোনো লক্ষণ নেই। প্রতিনিয়ত ভূখণ্ড হারাচ্ছে ইউক্রেন। দুর্বল হয়ে যাচ্ছে সবদিক থেকে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আশ্বাস দিচ্ছে ইউক্রেনকে, ন্যাটো সামরিক শক্তি বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে, সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, অবিরাম দিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধ বন্ধ করার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না কেউই। সবকিছু বিবেচনা করলে মনে হয় আমেরিকা, ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে আন্তরিক নয়। রাশিয়ার যে নীতি—রুশ সেনারা যে ভূখণ্ড অতিক্রম করবে সেই ভূখণ্ড রাশিয়ার—এই নীতি আপাতত বলবৎ আছে। দেখার বিষয়, অদূর ভবিষ্যতে এর পরিণতি কী হয় আর কত দূর গড়ায়।

লেখক: আব্দুর রাজ্জাক, প্রকৌশলী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টেলিগ্রামে সংগঠিত হচ্ছে আ.লীগ, হাসিনার সঙ্গে কথা বলতে টাকা নিচ্ছেন ওবায়দুল কাদের

আগামী ১১ দিন নৈরাজ্যের আশঙ্কা, ঠেকাতে এসপিদের এসবির চিঠি

প্রাথমিকে পাঠদান: বাইরের ২০ কাজের চাপে শিক্ষক

প্রেস কাউন্সিলের সদস্য হলেন মাহফুজ আনাম, নূরুল কবীরসহ ১২ জন

‘মামলা করি কী হইবে, পুলিশ থাকিয়াও হামার জীবনে নিরাপত্তা নাই’

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত