Ajker Patrika
সাক্ষাৎকার

কোটা তুলে দিলে নারীদের খুঁজেও পাওয়া যাবে না

সামান্তা শারমিন। ছবি: আজকের পত্রিকা

জুলাই সনদ ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রশ্নে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভূমিকা, জোট রাজনীতি, নারীনীতি, নির্বাচনী প্রতীক ইস্যু থেকে শুরু করে ফান্ডিং ও ‘মেধা বনাম কোটার’ বিতর্ক—এসব বিষয়ে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন খোলাখুলি কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার সঙ্গে। আসন্ন নির্বাচনে এনসিপির কৌশল এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও উঠে এসেছে এই দীর্ঘ আলাপচারিতায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অর্চি হক

আপডেট : ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ১২: ১৯

আজকের পত্রিকা: জুলাই সনদকে অনেকে বাংলাদেশের নতুন ‘রাজনৈতিক চুক্তি’ বলে অভিহিত করছেন। আপনি কি মনে করেন, এই সনদ বাস্তবায়নযোগ্য?

সামান্তা শারমিন: বাস্তবায়ন তো সেটা করবেন, যেটা বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কে সকলে একমত এবং সকলে ইচ্ছুক, উদ্‌গ্রীব। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করার পদ্ধতি নিয়ে সকলেরই কমবেশি কনফিউশন আছে এবং নিজস্ব মতামত আছে, যেটা হয়তো অন্যান্য দলের সঙ্গে মিলছে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে অংশটা বলতে হবে, জুলাই সনদের সঙ্গে মানুষের সংযোগের জায়গা খুব একটা নেই। জুলাই সনদকে শ্রেণি-পেশার ঊর্ধ্বে উঠে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জায়গা তৈরি করা হয়নি। ঐকমত্য কমিশনের যে আলাপগুলো হয়েছে, সেগুলো মোটাদাগে রাজনৈতিক দলকেন্দ্রিক। বাংলাদেশ এমন এক সিস্টেমে এসে দাঁড়িয়েছে যে রাজনৈতিক দলগুলো ধারণা করে, বাংলাদেশের জনগণ তাদেরকে ম্যান্ডেট দিয়েছে যেকোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের পরে আমাদের এইটুকু রাজনৈতিক বোঝাপড়া প্রয়োজন—শুধু রাজনৈতিক দল সকল জনগণের মতামত গ্রহণ করতে পারে না; ধারণ করতে পারে না। আমার কাছে মনে হয়, জুলাই সনদের যে বাস্তবায়ন পদ্ধতি, সেটার বিষয়ে যে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে, এই মতপার্থক্য কমিয়ে আনার জন্য ঐকমত্য কমিশন যে ধরনের ভূমিকা নিয়েছে, এই ভূমিকার চেয়ে আমরা দেখতে চেয়েছিলাম, আমূল পরিবর্তন এবং গুণগত পরিবর্তনের দিকে ঐকমত্য কমিশনের একধরনের ঝোঁক থাকবে। সেটার বদলে আমরা দেখতে পেয়েছি, বাহাত্তরের সংবিধানকে অবিকল রেখে গণ-অভ্যুত্থানকে বাহাত্তরের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার একধরনের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এই গণ-অভ্যুত্থান বাহাত্তরের সংবিধানকে অমান্য করে করা হয়েছে। সেই জায়গা থেকে অবশ্যই এই গণ-অভ্যুত্থানকে যেকোনো সংবিধানের ঊর্ধ্বে গণমানুষের চাওয়া, গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে স্থায়ীকরণ করা প্রয়োজন।

আজকের পত্রিকা: জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক হিসেবে আপনি জুলাই আন্দোলন-পরবর্তী সহিংসতা ও অস্থিরতার জন্য রাজনৈতিকভাবে কতটা দায় অনুভব করেন?

সামান্তা শারমিন: গত দুই মাসে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের, বিএনপির নিজস্ব নেতা-কর্মীর অন্তঃকোন্দলে নিহত হয়েছে ২০০ জন। আমি প্রতিটি শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। কিন্তু বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক বাস্তবতা পরিবর্তনের জন্য এই রাজনৈতিক দলগুলো কোনো লড়াই করছে না। বারবার আমরা রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের কথা বলেছি। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, দলগুলো তাদের পুরাতন যে ব্যবস্থা, সেটার মধ্যেই কমফোর্ট ফিল করছে। এই রাজনৈতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য যা কিছু করা লাগে, যে ধরনের ষড়যন্ত্র করা লাগে, সেগুলোতে লিপ্ত থাকতে তারা দ্বিধাবোধ করছে না। সেই জায়গা থেকে প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর যে ধরনের মতবাদ এবং তাদের যে অ্যাকশনগুলো আমরা দেখে থাকি, সেই জায়গা থেকে অবশ্যই পুরাতন রাজনৈতিক দলগুলোকে দায় নিতে হবে।

আজকের পত্রিকা: আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটের বিষয়ে কিছু ভাবছেন?

সামান্তা শারমিন: বিএনপি ও জামায়াত—দুটিই পুরোনো রাজনৈতিক দল। দুটিই এর আগে ক্ষমতায় ছিল। বাংলাদেশের মানুষ এই দুটি পার্টির শাসনামল দেখেছে। কী অস্থিরতার মধ্যে, কী পরিমাণ আইনশৃঙ্খলার অবনতির মধ্যে, কী ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতার মধ্য দিয়ে সেই দিনগুলো পার করতে হয়েছে, সেই ইতিহাস কারও অজানা নয়। বিএনপি-জামায়াতের যদি কোনো রিফর্ম হতো, রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের কোনো রিফর্ম আমরা দেখতাম, তাহলে হয়তো ভাবা যেত। কিন্তু পুরোনো রাজনৈতিক ধারায় দালালি, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি এবং দখলদারির যে ব্যবস্থা আছে, এই ব্যবস্থার পুনর্মূল্যায়ন তারা করেনি। আপনারা এটাও দেখেছেন, বিএনপি কখনোই এককভাবে সরকারে যেতে পারেনি। তাদের সব সময় জোট গঠন করতে হয়েছে। এটা তাদের রাজনৈতিক ঐক্যের একটা বহিঃপ্রকাশ বলে আমি মনে করি। একই সঙ্গে, জামায়াত আসলে কোনো ধরনের গণমানুষের দল নয়। গণমানুষের মধ্যে তার যে এক্সেপটেন্স, সেটা যথেষ্টই প্রশ্নবিদ্ধ। এবং এটাও প্রশ্ন থেকে যায়, জামায়াত যদি ক্ষমতায় আসে, জামায়াত যদি এটা মনে করে, তারা ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য ভালো, তাহলে তারা ভুল করছে। কারণ, জামায়াত এবং আওয়ামী লীগকে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ হিসেবেই আমরা দেখে এসেছি। নিজেরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কখনো কখনো জামায়াত আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করেছে। আওয়ামী লীগ জামায়াতকে ব্যবহার করেছে। আর এবার আমরা দেখতে পাচ্ছি, জামায়াত আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করছে। কিন্তু প্রসঙ্গটা এখানেই যে যদি জামায়াত ক্ষমতায় আসে, তাহলে আওয়ামী লীগ ফিরে আসার একটা সম্ভাবনা তৈরি হবে। বাংলাদেশের এবং বাইরের অনেক শক্তি এটা দেখানোর চেষ্টা করবে, বাংলাদেশ ইসলামিস্টের হাতে চলে যাচ্ছে। এভাবে আওয়ামী লীগ তার প্রাসঙ্গিকতা তৈরি করবে। সিভিল সোসাইটিতে আওয়ামী লীগের পক্ষের অনেকে সোচ্চার, আওয়ামী লীগের পক্ষের ভোট কোথায় যাবে। জামায়াত চেষ্টা করে যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের ভোটারদের অ্যাট্রাক্ট করতে, আওয়ামী লীগের ভোটটা যাতে তাদের থাকে। আমি মনে করি, এই দুটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের কোনোটির সঙ্গেই এনসিপির যে রাষ্ট্রকল্প, এনসিপির যে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, সেটার কোনো মিল নেই। এ কারণে এনসিপি এই পুরোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে কোনোভাবে কমপ্লাই করতে বাধ্য নয়। আমরা নিজেদের জোট গঠনের চেষ্টা করব অথবা আমরা নিজেদের সক্ষমতা এই নির্বাচনেই পরখ করে দেখতে চাই।

আজকের পত্রিকা: গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে আপনাদের একীভূত হওয়ার আলোচনাটা কি একেবারেই ভেস্তে গেছে?

সামান্তা শারমিন: আমরা তরুণদের রাজনীতিটা ওউন করি। আমরা মনে করি, এটা বাংলাদেশের জন্য পজিটিভ একটা এনফোর্সমেন্ট। তরুণেরা যদি সংসদে না যায়, এটা কোনো ভারসাম্য বা স্থিতিশীল সংসদ হবে না। সেই সঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের সাবেক অনেক কর্মী কিন্তু আমাদের দলে আছেন। তাঁরা কাজ করছেন। তাঁরা এনসিপির যে রাজনৈতিক প্রকল্প রাষ্ট্রকল্প, সেটাকে ওউন করে নিয়ে কাজ করছেন। গণঅধিকার পরিষদ একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল। তাদের সঙ্গে আমাদের নানান ফরমেটে আলাপ হয়েছে, কিন্তু একীভূত হওয়ার সুযোগটা আর নেই। তবে আমরা রাজনৈতিকভাবে একসঙ্গে কাজ করতে উদ্যমী আছি এবং সে বিষয়ে তাদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে।

আজকের পত্রিকা: নির্বাচনী প্রতীকের প্রশ্নে আপনারা শাপলা প্রতীকের ওপর এত জোর দিচ্ছেন কেন? আপনাদের দ্বিতীয় পছন্দ ছিল কলম। এখন কলম প্রতীক না নিয়ে শুধু শাপলাতে অনড় থেকে আপনারা আসলে কী বার্তা দিতে চাচ্ছেন?

সামান্তা শারমিন: আমরা বার্তা দিতে চাচ্ছি না; বরং শাপলা প্রতীকটা এনসিপিকে না দিয়ে ইসি (নির্বাচন কমিশন) একটা বার্তা দিতে চাচ্ছে। বার্তাটা এই যে এনসিপির যে তরুণদের রাজনৈতিক শক্তি, সেটা তাদের মনে একটা ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের যেই পক্ষ পরিবর্তন চায় না, মৌলিক পরিবর্তন চায় না, তারা তরুণদেরকে কোনোভাবেই একটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে আসা দল এবং যেটা অর্গানিকভাবে উঠে আসছে, সে রকম একটা পরিস্থিতিতে দেখতে চায় না। শাপলার ব্যাপারে প্রথম দিকে যখন ইসির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে, সিইসির (প্রধান নির্বাচন কমিশনার) সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে, তখন কোনো মিটিংয়েই তাঁরা আপত্তি জানাননি। প্রথম দিকে শাপলা প্রতীক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল লিস্টে। তখন তাঁরা আপত্তি জানাননি। বলেছেন, এটা কোনো সমস্যা নয়। এখন কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে, প্রতীকের লিস্টে নেই। আমরা যখন জুলাই পদযাত্রায় ছিলাম, আমরা দেখেছি, পুরো বাংলাদেশে মানুষের উচ্ছ্বাস। তার আগেও আমরা পার্টি গঠনের আগে যে মতামত গ্রহণ করেছি, যে জরিপ চালিয়েছিলাম, সেখানেও শাপলা প্রতীক নিয়ে মানুষের উচ্ছ্বাস দেখেছি। এই যে দেশব্যাপী একটি অর্গানিক উচ্ছ্বাস, যেটার ব্যাপারে এনসিপি ক্যাম্পেইন আকারে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেয়নি, তারপরও মানুষের যে উচ্ছ্বাস—এটা অনেকের মনে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। তারা মনে করছে, এই প্রতীক যদি এই দল পায়, তাহলে সে প্রথম অবস্থাতে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবে। এটা অনেকে ফেস করতে চাচ্ছে না। প্রতিষ্ঠিত যে রাজনৈতিক দলগুলো, প্রতিষ্ঠিত যে রাজনৈতিক-রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো, তারা চায়, তাদের নিজেদের যে সক্ষমতা এবং তাদের যে কর্তৃত্ব, সেটা বজায় থাকুক। কোনো রাজনৈতিক দল সেই কর্তৃত্বকে প্রশ্ন করবে, সে অথরিটিকে চ্যালেঞ্জ করে নিজেদের রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলবে, এটা তারা চাচ্ছে না।

আমরা কলম প্রতীক দ্বিতীয় ভাগে রেখেছিলাম। কিন্তু যেহেতু মানুষের কাছ থেকে আমরা রেসপন্স পেয়েছি, আমাদের সেই গুরুত্বটা দিতে হবে। আমরা যদি সেই গুরুত্বটা না দিই, তাহলে গণমানুষের এবং জনতার রাজনীতির দল হিসেবে নিজেদের দাবি করার কোনো জায়গা নেই। তাঁরা যে বক্তব্য দিয়েছেন, মানে মানুষের যে আগ্রহ শাপলা নিয়ে, তাদের যে এক্সেপটেন্স শাপলার প্রতি—সেটাকে আমাদের গ্রহণ করতে হবে। আমরা সেটা গ্রহণ করেছিলাম এবং এ কারণেই আমরা শাপলার যেকোনো ধরনের ফরমেশনের ব্যাপারে আপত্তি জানাইনি। আমরা লাল শাপলাও বলেছি। আপনি শুধু শাপলা দিতে পারেন। সাদা শাপলাও দিতে পারেন। কিংবা শাপলার যে ডিজাইন, সেটা পরিবর্তন করেও দেওয়া সম্ভব। কোনো যুক্তিতর্কের তোয়াক্কা না করে ইসি তার পজিশন নিয়েছে। একটা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এভাবে রাজনৈতিক পজিশন নিতে পারে কি না, এটা আমার প্রশ্ন। শাপলা প্রতীক আমাদের প্রাপ্য। সেই লড়াইটা আমরা জারি রাখব।

আজকের পত্রিকা: এনসিপির নারীনীতি কী? আপনারা সরকারে গেলে নারীরা কী ধরনের স্বাধীনতা পাবে? সবক্ষেত্রে অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা কি তারা পাবে?

সামান্তা শারমিন: বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিক আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, আমি মনে করি, বাংলাদেশের নারীদের প্রতিটি ক্ষেত্রে—চাকরি ক্ষেত্র থেকে শুরু করে পড়াশোনা, তার সামাজিক অবস্থান—সব জায়গায় অনিরাপত্তার বলয় আছে। এই বলয়টাকে আমরা মনে করি, বাংলাদেশের নারীদের রাজনীতিতে আসা, সক্রিয় ভূমিকা পালন করা, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের ভূমিকা—এই বিষয়গুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায় অনেক সময়। আমরা সে ক্ষেত্রে মনে করি, বাংলাদেশের রাজনীতির যদি মৌলিক পরিবর্তন করতে হয়, তাহলে নারীদের অংশগ্রহণ কোনোভাবে বাদ দিয়ে এটা করা যাবে না। ঐকমত্য কমিশনে আমরা দেখলাম, নারীদের আসন নিয়ে সেই ৫ পারসেন্ট সংরক্ষিত বলয়ে আটকে থাকতে বাধ্য হলাম। এখান থেকে অনেক রাজনৈতিক বাস্তবতা আমাদের বলা হলো, দেখানো হলো। কিন্তু এই রাজনৈতিক বাস্তবতাগুলো কারা তৈরি করেছে? এই রাজনৈতিক বাস্তবতাগুলো তৈরি করেছে পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো। এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনো যেভাবে শক্তি প্রদর্শনের যে প্রক্রিয়া আছে, সে প্রক্রিয়ায় অর্থ এবং অস্ত্র—দুটিই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামনের নির্বাচনে আমরা অস্ত্রকে কী ভূমিকায় দেখতে পাব, অর্থকে কী ভূমিকায় দেখতে পাব—এগুলো পরিষ্কার নয়। এ রকম একটি অনিরাপদ রাজনৈতিক পরিসরে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এনসিপির একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি এবং গুরুত্বপূর্ণ কার্যপরিধির অংশ। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের জনসংখ্যার যে অধিকাংশই নারী, সেই প্রতিফলনটা আমরা রাজনীতিতে দেখতে পাব, ক্লাসরুমে দেখতে পাব, যেকোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠানে দেখতে পাব, সেটা আমরা আশা করি।

আজকের পত্রিকা: ক্লাসরুম, রাজনীতি বা কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের প্রতিফলন দেখতে আরও কত বছর লাগতে পারে? তত দিন পর্যন্ত নারীদের কোটা দেওয়া উচিত বলে মনে করেন কি?

সামান্তা শারমিন: নারীদের কোটা ব্যবস্থা তুলে দেওয়া তাদের জন্য হুমকিস্বরূপ। তারা যতটুকু কর্মক্ষেত্রে, রাজনীতির ক্ষেত্রে আসতে পারছে, কোটা তুলে দিলে তাদেরকে খুঁজেও পাওয়া যাবে না। অনিরাপত্তা, সামাজিক পরিস্থিতিসহ নানা কারণে উঠে আসতে তারা বাধার সম্মুখীন হয়। আমি মনে করি, নারীদের ক্ষেত্রে অবশ্যই কোটা ব্যবস্থা থাকা উচিত, যাতে করে তাদেরকে আমরা নিয়ে আসতে পারি সামনের দিকে বা চাকরির ক্ষেত্রে। কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা, যেটাকে আমরা টোকেনিজম বলি, নারীদের শুধু সামনে রেখে শো করা যে আমাদের সঙ্গে ফোরামে এতজন নারী আছে। এটার পরিবর্তন দরকার।

আজকের পত্রিকা: অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে আমরা নারী ফুটবল দলের একাধিক ম্যাচ স্থগিত হতে দেখেছি। প্রকাশ্যে নারীদের হেনস্তার শিকার হতে দেখেছি। হেনস্তাকারীদের থানা থেকে সংবর্ধনা দিয়ে বের করে আনতে দেখেছি। এসব ঘটনায় এনসিপিকে সক্রিয় অবস্থানে দেখা যায়নি কেন?

সামান্তা শারমিন: আমার ধারণা, আপনার তথ্যে কিছুটা ঘাটতি আছে। যখন আক্রমণ করে মেয়েদের ম্যাচ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তখন আমাদের পার্টি হয়েছে কি না, মনে পড়ছে না। সম্ভবত নাগরিক কমিটি ছিল সে সময়। আমাদের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন আমাদের নেতারা। ফেসবুকে, সোশ্যাল মিডিয়ায় জানিয়েছেন। একই সঙ্গে আমরা সংগঠনগত জায়গা থেকে প্রেস রিলিজ দিয়েছি। আমরা পার্টিগত জায়গা থেকে মনে করি, মেয়েদের খেলার স্বাধীনতা আছে, মেয়েদের চলাফেরার স্বাধীনতা আছে এবং তার যে স্বাভাবিক অভিগমন, এটাকে বাধা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

আজকের পত্রিকা: আপনাদের দলের ফান্ডিং বা অর্থায়নের উৎস কীভাবে পরিচালিত হয়? কারা এখানে অর্থ দেয়? কীভাবে এখানে স্বচ্ছতা বজায় রাখেন?

সামান্তা শারমিন: একটা রাজনৈতিক দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তার অ্যাকাউন্টেবিলিটি (জবাবদিহি) এবং জনগণের কাছে তার অর্থের উৎস সম্পর্কে পরিষ্কার মনোভাব থাকা। এটা আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে মানুষ আসলে কিছু আশা করে না, আমাদের কাছ থেকে করে। এই কারণে এই প্রশ্নগুলো এনসিপির কাছে বেশি আসে, যেটাকে আমরা খুবই ইতিবাচকভাবে দেখি। আমরা একটি ওয়েবসাইট লঞ্চ করেছি। কীভাবে আমাদের অর্থায়ন হয়, সেটার একটা পরিষ্কার নীতিমালা আমরা পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন করেছিলাম। সে সময় অনেক সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন এবং আমরা জনতার কাছে সেটা উন্মুক্ত করেছি। আমাদের ডোনেশনগুলো এই মারফতই হয়ে থাকে এবং আমরা অর্থের উৎস এবং অর্থের যে জবাবদিহি, সেটার ক্ষেত্রে চেষ্টা করি যতটুকু সম্ভব একটা নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিষ্কার করতে। আমাদের অনেক ফ্যাসিলিটি ক্রিয়েট করতে হচ্ছে। সেটার জায়গা থেকে আমরা গ্রোয়িং একটা জায়গায় আছি। আমরা মনে করি না, এটাই সর্বোচ্চ জবাবদিহি। মনে করি, প্রতিটি পয়সা কীভাবে খরচ হচ্ছে, এটা জানার অধিকার মানুষের আছে। আমরা আমাদের দলের ফান্ডিং, ওয়েবসাইট এবং আমাদের নানা ধরনের প্রসেস আছে—বিদেশ থেকে পাঠালে এক রকমের প্রসেস, দেশের অভ্যন্তরে নানা রকমের প্রসেস আছে। এগুলো উন্মুক্ত করা আছে। এই মোতাবেকই আপাতত এই দলটা চলছে।

আজকের পত্রিকা: এনসিপি কবে নাগরিকদের সামনে আয়-ব্যয়ের পূর্ণাঙ্গ হিসাব প্রকাশ করবে?

সামান্তা শারমিন: ইনশা আল্লাহ, আমরা ইলেকশনের আগেই আমাদের দলের এখন পর্যন্ত যত খরচ হয়েছে এবং প্রোগ্রামে আমাদের খরচ কীভাবে হয়েছে—এসব বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট, একই সঙ্গে আমাদের ভবিষ্যৎ অর্থ জোগানের নিয়মটা প্রকাশ করতে পারব।

আজকের পত্রিকা: কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর থেকে ‘মেধা বনাম কোটার’ প্রশ্নে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। আপনি কি মনে করেন, বর্তমানে চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার যথাযথ মূল্যায়ন হচ্ছে?

সামান্তা শারমিন: না, এটা হচ্ছে না। বাংলাদেশে এই সিস্টেমটাই নেই। আমাদের পরীক্ষাপদ্ধতি, এমনকি শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করেছে আওয়ামী লীগ। চাকরির ব্যবস্থাও ধ্বংস করেছে। চাকরির ক্ষেত্রে যে প্রশ্নগুলো, যেভাবে যেভাবে নিয়োগ হয়, এটা পুরোপুরি প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, বাবর সাহেব (বিএনপি নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর) রিসেন্টলি একটা বক্তব্যে বলেছেন, ‘ভালো করে পড়াশোনা করেন। পরীক্ষাটা দেন। ভাইভাটা ফেস করেন। তারপরে আমার যতটুকু সম্ভব, আমি দেখব।’ এটা লাস্ট কে বলেছিল, আপনার মনে আছে? জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। উনি বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ যারা করবে, যুবলীগ যারা করবে, তারাই চাকরি পাবে, আর কে চাকরি পাবে?’ আমরা এত দিন বলে আসছি, বিএনপি আওয়ামী লীগের রাস্তায় হাঁটছে; বিএনপি আওয়ামী লীগের মতো করে কথা বলছে; ভারতপন্থী কথা বলছে। চাকরির ক্ষেত্রে ছোট একটা বিষয়ের মন্তব্য এভাবে মিলে যাচ্ছে! বড় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে আপনি তাদের (বিএনপি) ওপর কীভাবে ডিপেন্ড করবেন?

আজকের পত্রিকা: আপনি নির্বাচনে অংশ নেবেন? যদি নেন, তাহলে কোন আসন থেকে?

সামান্তা শারমিন: কী ধরনের সংস্কার হচ্ছে এবং কী ধরনের রাজনৈতিক এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্যে আমরা নির্বাচন করতে যাচ্ছি, এটা আমার কাছে অনেক বেশি জরুরি। আসলে আসনকেন্দ্রিক কখনোই কাজ করিনি। আমি সংগঠনকে বিস্তৃত করার জন্য বাংলাদেশের সব জায়গায় কাজ করতে আগ্রহী এবং করেছিও। সংগঠন আমাকে যেভাবে কাজ করতে দিতে চায়, আমি সেটা কমপ্লাই করব। আসনভিত্তিক যে একধরনের কামড়াকামড়ি আছে, একধরনের টেনশন আছে এবং অস্থিরতা আছে, এটা আমি মনে করি না, আমার নিজেরও করা দরকার।

আজকের পত্রিকা: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

সামান্তা শারমিন: আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত