হাসনাত কাইয়ুম সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি। হাওরের মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে কারাভোগ করেছেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাকালীন সহসভাপতি এবং বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহার নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা।
মাসুদ রানা
সম্প্রতি হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সন্ত্রাসবিরোধী আইন ব্যবহার করে নতুন করে দমন-পীড়ন চালানোর অভিযোগ তুলেছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বক্তব্যের অনেকাংশের সত্যতা আছে। আবার তারা কোন মানদণ্ডে ব্যাপারগুলোকে দেখছে, সেটা আমার কাছে পরিষ্কার না। তবে এটা সত্য যে দুই ধরনের অভিযোগ এই সরকারের বিরুদ্ধে তোলা যায়। একটা হলো, অনেক ক্ষেত্রে সক্রিয়তার জায়গায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় থাকতে দেখা যাচ্ছে। যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য সরকারের সক্রিয়তা থাকা দরকার, সেখানে কোনো ধরনের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। আবার অন্য ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার মতো করে ব্যবহার করা হচ্ছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের অভিযোগ অনুযায়ী, অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক আলোচনা সভা বা শান্তিপূর্ণ সমাবেশকে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে কি এমন কোনো অস্পষ্টতা আছে, যা এর অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করছে?
সন্ত্রাসবিরোধী আইনে কোনো অস্পষ্টতা বলে কিছু নেই। এই আইনটা নিজেই এমন যে এর অপব্যবহার করা সহজ। উল্টোভাবে বললে এ আইনটি অব্যবহার না করলেই নয়। বরং এর ব্যবহার করে রাজনৈতিক আলোচনা সভা বা শান্তিপূর্ণ সমাবেশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। কারণ, এই আইনটা করা হয়েছিল রাজনৈতিক পরিসরে মানুষ যখন ক্ষোভ থেকে আন্দোলন করে এবং নিজ অভিব্যক্তির জায়গা থেকে প্রতিবাদ করে, তখন আইনশৃঙ্খলাবিরোধী এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে। এ আইনটাকে এখনো অগণতান্ত্রিকভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে দমন করার জন্য আইনি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এইচআরডব্লিউর এই অভিযোগ সেই প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় কি?
সেটা তো অবশ্যই সাংঘর্ষিক। কারণ, সম্প্রতি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রতি যেভাবে হামলা করা হলো এবং শিক্ষকদের সঙ্গে যে আচরণটা করা হলো, মিছিলে যেভাবে জলকামান ব্যবহার করা হলো এবং তাঁদের ওপর পুলিশ যেভাবে চড়াও হয়েছে, নির্যাতন করেছে, যেভাবে শিক্ষকদের টেনেহিঁচড়ে আটক করেছে, সেটাকে কী বলা যায়? কোনো মানুষ এ ধরনের আচরণকে সমর্থন করতে পারে না।
এই সরকার যে মানবিক মর্যাদা, মানবাধিকার কিংবা আইনের শাসনের ক্ষেত্রে আগের সরকারের মতো হবে না—এই অঙ্গীকার করেছিল। সেটা তো শিক্ষকদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রেই বোঝা গেল। এগুলো তো হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ব্যাপার না শুধু। আমরা তো সবাই এসব দেখছি। এই সরকারের প্রধান সমস্যা, যেটা আমি প্রথম থেকেই বলে আসছি, যেখানে যেটা করার কথা না, সেখানে সেটাই করা হচ্ছে। শিক্ষকদের ওপর বলপ্রয়োগের কথা না, কিন্তু সেটাই করা হলো। যখন রাষ্ট্রের যেকোনো সেক্টরের পেশাজীবী মানুষ তাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে উত্থাপন করার জন্য আসছে, তাদের ওপরই বলপ্রয়োগ করা হচ্ছে।
আর যারা মানুষের জান-মালের ক্ষতি করছে, মানুষের নিরাপত্তা নষ্ট করছে, তাদের বেলায় পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। এখন পুলিশকে ন্যায়ের পক্ষে নিষ্ক্রিয় হতে আর অন্যায়ের পক্ষে সক্রিয় হতে দেখা যাচ্ছে। ক্ষমতায় আসার পর অন্তর্বর্তী সরকার যে অঙ্গীকার করেছিল, সেটার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
এর কারণ কী?
প্রধানত তিনটা কারণে এসব হচ্ছে। প্রথমত, এ সরকারের অদক্ষতা। দেশ আসলে কীভাবে পরিচালনা করতে হয় এবং কীভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় এবং এর জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে হয়—এসব তারা জানে না। দ্বিতীয়ত, ফ্যাসিস্ট সরকারের হাতে যে বাহিনী ছিল তাদের কোনো ধরনের সংস্কার না করে এবং তাদের কোনো ধরনের সংস্কারের আওতায় না এনে, সেই বাহিনীর মনোবল ফেরানোর কথা বলা হচ্ছে। তার মানে দাঁড়ায়, এই বাহিনীকে আগের মতোই আচরণ করার কথা বলা হচ্ছে। এ কারণেই তারা অনেক ক্ষেত্রে আগের মতোই আচরণ করছে। পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের নতুনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া ও গাইড করা হয়নি। এ কারণে তারা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যে জনগণের প্রতি মানবিক হওয়া দরকার, সে বিষয়ে কোনো ধরনের জ্ঞান, ধারণা ও ট্রেনিং নেই। যখন আবার এই বাহিনীকে দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে, তখনই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এ ধরনের ঘটনা ঘটছে মূলত সরকারের অদক্ষতা এবং এই বাহিনীর সদস্যদের চরিত্রের অসংগতির কারণে। আর এই বাহিনী হলো চরিত্রগতভাবেই স্বৈরাচার।
সরকার তো পুলিশ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিল।
অন্তর্বর্তী সরকারের পরবর্তী সময়ে অপরাধ হিসেবে সামনে আসবে পুলিশের সংস্কার ঠিকমতো না করা। আমাদের দেশে সবচেয়ে জটিল হলো পুলিশের সংস্কার। কিন্তু এবার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল এর সংস্কার করার। এর আগে সব সময় পুলিশকে সাধারণ মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। জুলাই আন্দোলনের পর পুলিশের সাধারণ সদস্যরা দাবি তুলেছিলেন এ বাহিনীর সংস্কার করার জন্য। পুলিশ যেন আর কোনো সরকারের বাহিনী হিসেবে ব্যবহৃত না হতে পারে। কিন্তু এ সরকার কোনোভাবেই এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারল না। এই দায়িত্ব পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে দেওয়া হলো। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী যে নতুন বাংলাদেশ হওয়ার কথা ছিল, সেই ব্যর্থতার প্রথম এবং প্রধান কারণ হলো পুলিশ বাহিনীকে ঠিকমতো সংস্কার করতে না পারা।
অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের অনেকের বিরুদ্ধেই শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তাহলে এ সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা কী থাকল?
সত্যি সত্যি যেটা দরকার ছিল—যাকে যে অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, সেটা নিশ্চিত করা। ধরুন, কেউ একজন ছিলেন ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, অর্থ আত্মসাৎকারী, অন্য দলের প্রতি বা অন্য ব্যক্তির প্রতি জুলুমকারী—এখন তাঁদের যদি খুনের মামলার আসামি করা হয়, তখন বুঝতে হবে তাঁদের ভুল মামলার আসামি করা হয়েছে। যদিও তাঁরা খুনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। পুলিশ ও আইন সরকারের নিয়ন্ত্রণে না থাকার কারণে গড়ে সব ধরনের আসামিকে গ্রেপ্তার করার জন্য হত্যা মামলা ব্যবহার করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। তাতে সরকার নিজেই ন্যায়বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং মানুষ ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেখানো গেছে, যারা নির্দিষ্ট কোনো অপরাধে অপরাধী না, সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে নির্দোষ বলা হচ্ছে। ধরেন, একজন খুনের মামলার আসামি না, কিন্তু তিনি চুরি মামলার আসামি। যখন এক মামলার অপরাধে অন্য মামলায় আসামি করা হচ্ছে, তখন কিন্তু চুরির অপরাধটাও নাই হয়ে যাচ্ছে এবং তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হচ্ছেন। এই ধরনের একটা প্রক্রিয়া এখানে শুরু হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার কারণে প্রকৃত অপরাধীর যেমন বিচার হবে না, তেমনি খুনের মামলারও ঠিকমতো বিচার হবে না। জনগণও ঠিকমতো বিচার পাবে না। কিন্তু এ সরকারকে একধরনের অবিচারের দায় নিয়ে বিদায় নিতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার যদি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করার সাহস দেখাতে পারে, সন্ত্রাসবিরোধী আইন বা ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন বহাল তবিয়তে রেখেছে কেন?
সন্ত্রাসবিরোধী আইন যখন করা হয়, তখন এ আইন বাতিলের দাবিতে অনেক আন্দোলন হয়েছে। এ আইন করার জন্য মামলা হয়েছে। ওই সময় এ আইনের মেয়াদ দুই বছর পরপর বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু এখন এটা স্থায়ী করা হয়েছে। এখানে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট নামে একটা আইন আছে। এটা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কালাকানুন নাম দিয়ে তা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু এই সরকার তো এই আইনগুলো বাতিল করার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। কোন কোন আইন বাতিল করতে হবে, তার জন্য তারা তো কোনো আইন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করার প্রয়োজন বোধ করেনি। আইন বাতিলের কোনো তালিকাও করেনি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ঘাড়ের ওপর দাঁড়ানো ছিল। কারণ, আন্দোলনকারীরা কম-বেশি এ আইন দিয়ে নির্যাতিত হয়েছেন অথবা এ আইনের কারণে কথা বলা থেকে বিরত থেকেছেন—এসব কারণে এই আইন বাতিলের চাপ ছিল। সে কারণে সরকার এটা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এ আইনটাকে ধরে এখন সন্ত্রাসবিরোধী আইন বা ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনকেও অপব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে। অহিংস গণ-অভ্যুত্থান নামে একটা সংগঠন আছে। তারা দেশের লুটপাট, পাচারের টাকা ফেরত এনে সাধারণ মানুষকে যেন বিনা সুদে দেওয়া হয়, সে জন্য আন্দোলন করেছে। সেই আন্দোলনকারীদের দমন করার জন্য ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করা হয়েছে। এর চেয়ে ভয়াবহ আর কী হতে পারে?
রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সঙ্গে নাগরিকের মৌলিক অধিকার এবং মানবাধিকারের ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। কিন্তু রক্ত ঝরা আন্দোলনের মাধ্যমে গঠিত এ সরকার কি সেই দায়িত্ব অবহেলা করতে পারে?
এটা তো আসলে আন্দোলনকারীদেরও ব্যর্থতা। আবার এই সরকার তো অসম্ভব রকমের অদক্ষ সরকার। তারা কী কারণে রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়েছে, সেটা আমিও বুঝতে পারি না। এই সরকার তো কোনো কেয়ারটেকার সরকার না। এ সরকারের তিন মাসের মধ্যে একটা নির্বাচন দিয়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল। এ সরকারের দায়িত্ব ছিল স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তির আইনকানুন ও প্রতিষ্ঠানের সংস্কার করা। সেসবের হোমওয়ার্ক নেই, তারা বাংলাদেশের আইনকানুন, সমাজ সম্পর্কে কোনো ধারণা না রেখেই কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে।
এই সরকারের অদক্ষতার জায়গা হলো, কারা এসব নিয়ে কাজ করেছে, সেটা তারা জানে না। জানলেও তারা তাদের সঙ্গে পরামর্শ নেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করেনি। তবে সরকার যখন বেকায়দায় পড়েছে, তখন সবাইকে ডেকেছে। তারা বলতে চেয়েছে, সব রাজনৈতিক দল আমাদের সঙ্গে আছে। যদিও এই অভ্যুত্থানের পরাজিত শক্তি যদি ফিরে এসে আরও ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করতে না পারে, সে জন্য এ সরকারকে আমরা এখনো সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।
সম্প্রতি হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সন্ত্রাসবিরোধী আইন ব্যবহার করে নতুন করে দমন-পীড়ন চালানোর অভিযোগ তুলেছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বক্তব্যের অনেকাংশের সত্যতা আছে। আবার তারা কোন মানদণ্ডে ব্যাপারগুলোকে দেখছে, সেটা আমার কাছে পরিষ্কার না। তবে এটা সত্য যে দুই ধরনের অভিযোগ এই সরকারের বিরুদ্ধে তোলা যায়। একটা হলো, অনেক ক্ষেত্রে সক্রিয়তার জায়গায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় থাকতে দেখা যাচ্ছে। যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য সরকারের সক্রিয়তা থাকা দরকার, সেখানে কোনো ধরনের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। আবার অন্য ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার মতো করে ব্যবহার করা হচ্ছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের অভিযোগ অনুযায়ী, অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক আলোচনা সভা বা শান্তিপূর্ণ সমাবেশকে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে কি এমন কোনো অস্পষ্টতা আছে, যা এর অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করছে?
সন্ত্রাসবিরোধী আইনে কোনো অস্পষ্টতা বলে কিছু নেই। এই আইনটা নিজেই এমন যে এর অপব্যবহার করা সহজ। উল্টোভাবে বললে এ আইনটি অব্যবহার না করলেই নয়। বরং এর ব্যবহার করে রাজনৈতিক আলোচনা সভা বা শান্তিপূর্ণ সমাবেশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। কারণ, এই আইনটা করা হয়েছিল রাজনৈতিক পরিসরে মানুষ যখন ক্ষোভ থেকে আন্দোলন করে এবং নিজ অভিব্যক্তির জায়গা থেকে প্রতিবাদ করে, তখন আইনশৃঙ্খলাবিরোধী এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে। এ আইনটাকে এখনো অগণতান্ত্রিকভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে দমন করার জন্য আইনি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এইচআরডব্লিউর এই অভিযোগ সেই প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় কি?
সেটা তো অবশ্যই সাংঘর্ষিক। কারণ, সম্প্রতি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রতি যেভাবে হামলা করা হলো এবং শিক্ষকদের সঙ্গে যে আচরণটা করা হলো, মিছিলে যেভাবে জলকামান ব্যবহার করা হলো এবং তাঁদের ওপর পুলিশ যেভাবে চড়াও হয়েছে, নির্যাতন করেছে, যেভাবে শিক্ষকদের টেনেহিঁচড়ে আটক করেছে, সেটাকে কী বলা যায়? কোনো মানুষ এ ধরনের আচরণকে সমর্থন করতে পারে না।
এই সরকার যে মানবিক মর্যাদা, মানবাধিকার কিংবা আইনের শাসনের ক্ষেত্রে আগের সরকারের মতো হবে না—এই অঙ্গীকার করেছিল। সেটা তো শিক্ষকদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রেই বোঝা গেল। এগুলো তো হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ব্যাপার না শুধু। আমরা তো সবাই এসব দেখছি। এই সরকারের প্রধান সমস্যা, যেটা আমি প্রথম থেকেই বলে আসছি, যেখানে যেটা করার কথা না, সেখানে সেটাই করা হচ্ছে। শিক্ষকদের ওপর বলপ্রয়োগের কথা না, কিন্তু সেটাই করা হলো। যখন রাষ্ট্রের যেকোনো সেক্টরের পেশাজীবী মানুষ তাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে উত্থাপন করার জন্য আসছে, তাদের ওপরই বলপ্রয়োগ করা হচ্ছে।
আর যারা মানুষের জান-মালের ক্ষতি করছে, মানুষের নিরাপত্তা নষ্ট করছে, তাদের বেলায় পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। এখন পুলিশকে ন্যায়ের পক্ষে নিষ্ক্রিয় হতে আর অন্যায়ের পক্ষে সক্রিয় হতে দেখা যাচ্ছে। ক্ষমতায় আসার পর অন্তর্বর্তী সরকার যে অঙ্গীকার করেছিল, সেটার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
এর কারণ কী?
প্রধানত তিনটা কারণে এসব হচ্ছে। প্রথমত, এ সরকারের অদক্ষতা। দেশ আসলে কীভাবে পরিচালনা করতে হয় এবং কীভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় এবং এর জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে হয়—এসব তারা জানে না। দ্বিতীয়ত, ফ্যাসিস্ট সরকারের হাতে যে বাহিনী ছিল তাদের কোনো ধরনের সংস্কার না করে এবং তাদের কোনো ধরনের সংস্কারের আওতায় না এনে, সেই বাহিনীর মনোবল ফেরানোর কথা বলা হচ্ছে। তার মানে দাঁড়ায়, এই বাহিনীকে আগের মতোই আচরণ করার কথা বলা হচ্ছে। এ কারণেই তারা অনেক ক্ষেত্রে আগের মতোই আচরণ করছে। পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের নতুনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া ও গাইড করা হয়নি। এ কারণে তারা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যে জনগণের প্রতি মানবিক হওয়া দরকার, সে বিষয়ে কোনো ধরনের জ্ঞান, ধারণা ও ট্রেনিং নেই। যখন আবার এই বাহিনীকে দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে, তখনই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এ ধরনের ঘটনা ঘটছে মূলত সরকারের অদক্ষতা এবং এই বাহিনীর সদস্যদের চরিত্রের অসংগতির কারণে। আর এই বাহিনী হলো চরিত্রগতভাবেই স্বৈরাচার।
সরকার তো পুলিশ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিল।
অন্তর্বর্তী সরকারের পরবর্তী সময়ে অপরাধ হিসেবে সামনে আসবে পুলিশের সংস্কার ঠিকমতো না করা। আমাদের দেশে সবচেয়ে জটিল হলো পুলিশের সংস্কার। কিন্তু এবার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল এর সংস্কার করার। এর আগে সব সময় পুলিশকে সাধারণ মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। জুলাই আন্দোলনের পর পুলিশের সাধারণ সদস্যরা দাবি তুলেছিলেন এ বাহিনীর সংস্কার করার জন্য। পুলিশ যেন আর কোনো সরকারের বাহিনী হিসেবে ব্যবহৃত না হতে পারে। কিন্তু এ সরকার কোনোভাবেই এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারল না। এই দায়িত্ব পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে দেওয়া হলো। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী যে নতুন বাংলাদেশ হওয়ার কথা ছিল, সেই ব্যর্থতার প্রথম এবং প্রধান কারণ হলো পুলিশ বাহিনীকে ঠিকমতো সংস্কার করতে না পারা।
অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের অনেকের বিরুদ্ধেই শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তাহলে এ সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা কী থাকল?
সত্যি সত্যি যেটা দরকার ছিল—যাকে যে অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, সেটা নিশ্চিত করা। ধরুন, কেউ একজন ছিলেন ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, অর্থ আত্মসাৎকারী, অন্য দলের প্রতি বা অন্য ব্যক্তির প্রতি জুলুমকারী—এখন তাঁদের যদি খুনের মামলার আসামি করা হয়, তখন বুঝতে হবে তাঁদের ভুল মামলার আসামি করা হয়েছে। যদিও তাঁরা খুনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। পুলিশ ও আইন সরকারের নিয়ন্ত্রণে না থাকার কারণে গড়ে সব ধরনের আসামিকে গ্রেপ্তার করার জন্য হত্যা মামলা ব্যবহার করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। তাতে সরকার নিজেই ন্যায়বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং মানুষ ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেখানো গেছে, যারা নির্দিষ্ট কোনো অপরাধে অপরাধী না, সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে নির্দোষ বলা হচ্ছে। ধরেন, একজন খুনের মামলার আসামি না, কিন্তু তিনি চুরি মামলার আসামি। যখন এক মামলার অপরাধে অন্য মামলায় আসামি করা হচ্ছে, তখন কিন্তু চুরির অপরাধটাও নাই হয়ে যাচ্ছে এবং তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হচ্ছেন। এই ধরনের একটা প্রক্রিয়া এখানে শুরু হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার কারণে প্রকৃত অপরাধীর যেমন বিচার হবে না, তেমনি খুনের মামলারও ঠিকমতো বিচার হবে না। জনগণও ঠিকমতো বিচার পাবে না। কিন্তু এ সরকারকে একধরনের অবিচারের দায় নিয়ে বিদায় নিতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার যদি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করার সাহস দেখাতে পারে, সন্ত্রাসবিরোধী আইন বা ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন বহাল তবিয়তে রেখেছে কেন?
সন্ত্রাসবিরোধী আইন যখন করা হয়, তখন এ আইন বাতিলের দাবিতে অনেক আন্দোলন হয়েছে। এ আইন করার জন্য মামলা হয়েছে। ওই সময় এ আইনের মেয়াদ দুই বছর পরপর বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু এখন এটা স্থায়ী করা হয়েছে। এখানে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট নামে একটা আইন আছে। এটা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কালাকানুন নাম দিয়ে তা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু এই সরকার তো এই আইনগুলো বাতিল করার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। কোন কোন আইন বাতিল করতে হবে, তার জন্য তারা তো কোনো আইন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করার প্রয়োজন বোধ করেনি। আইন বাতিলের কোনো তালিকাও করেনি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ঘাড়ের ওপর দাঁড়ানো ছিল। কারণ, আন্দোলনকারীরা কম-বেশি এ আইন দিয়ে নির্যাতিত হয়েছেন অথবা এ আইনের কারণে কথা বলা থেকে বিরত থেকেছেন—এসব কারণে এই আইন বাতিলের চাপ ছিল। সে কারণে সরকার এটা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এ আইনটাকে ধরে এখন সন্ত্রাসবিরোধী আইন বা ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনকেও অপব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে। অহিংস গণ-অভ্যুত্থান নামে একটা সংগঠন আছে। তারা দেশের লুটপাট, পাচারের টাকা ফেরত এনে সাধারণ মানুষকে যেন বিনা সুদে দেওয়া হয়, সে জন্য আন্দোলন করেছে। সেই আন্দোলনকারীদের দমন করার জন্য ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করা হয়েছে। এর চেয়ে ভয়াবহ আর কী হতে পারে?
রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সঙ্গে নাগরিকের মৌলিক অধিকার এবং মানবাধিকারের ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। কিন্তু রক্ত ঝরা আন্দোলনের মাধ্যমে গঠিত এ সরকার কি সেই দায়িত্ব অবহেলা করতে পারে?
এটা তো আসলে আন্দোলনকারীদেরও ব্যর্থতা। আবার এই সরকার তো অসম্ভব রকমের অদক্ষ সরকার। তারা কী কারণে রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়েছে, সেটা আমিও বুঝতে পারি না। এই সরকার তো কোনো কেয়ারটেকার সরকার না। এ সরকারের তিন মাসের মধ্যে একটা নির্বাচন দিয়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল। এ সরকারের দায়িত্ব ছিল স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তির আইনকানুন ও প্রতিষ্ঠানের সংস্কার করা। সেসবের হোমওয়ার্ক নেই, তারা বাংলাদেশের আইনকানুন, সমাজ সম্পর্কে কোনো ধারণা না রেখেই কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে।
এই সরকারের অদক্ষতার জায়গা হলো, কারা এসব নিয়ে কাজ করেছে, সেটা তারা জানে না। জানলেও তারা তাদের সঙ্গে পরামর্শ নেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করেনি। তবে সরকার যখন বেকায়দায় পড়েছে, তখন সবাইকে ডেকেছে। তারা বলতে চেয়েছে, সব রাজনৈতিক দল আমাদের সঙ্গে আছে। যদিও এই অভ্যুত্থানের পরাজিত শক্তি যদি ফিরে এসে আরও ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করতে না পারে, সে জন্য এ সরকারকে আমরা এখনো সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।
জুলাই সনদ ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রশ্নে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভূমিকা, জোট রাজনীতি, নারীনীতি, নির্বাচনী প্রতীক ইস্যু থেকে শুরু করে ফান্ডিং ও ‘মেধা বনাম কোটার’ বিতর্ক—এসব বিষয়ে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা..
৪ ঘণ্টা আগেআমরা এমন এক যুগে বসবাস করছি, যেখানে মানুষের মূল্য আর তার চিন্তার গভীরতা, সততা বা মেধার ওপর নির্ভর করে না, বরং নির্ভর করে সে কতটা ‘ভাইরাল’ হতে পারে তার ওপর। ‘ভাইরাল’ এখন শুধু একটি শব্দ নয়, এটি এক প্রজন্মের মানদণ্ড, এক সমাজের সফলতার পরিমাপক।
৬ ঘণ্টা আগেবিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির একজন সদস্য ও বরিশাল-২ (বানারীপাড়া-উজিরপুর) আসনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী এক নেতার একটি ভিডিও সম্প্রতি প্রকাশিত হওয়ার পর তা ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। যদিও স্থানীয় নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ভিডিওটি এডিট করা, তবু যে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে শোনা গেছে এই নেতাকে...
৬ ঘণ্টা আগেআমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হিন্দু-মুসলমান বিরোধ প্রসঙ্গে গালাগালিকে গলাগলিতে রূপান্তরিত করতে বলেছিলেন একদা। তাঁর এই পরামর্শ কতটা কাজে লেগেছে, তা নিয়ে আর মন্তব্য না করাই ভালো। ন্যূনতম সহনশীলতারও মৃত্যু হয়েছে কি না, তা নিয়েও ভাবছে মানুষ। রাজনীতির মাঠে প্রতিপক্ষকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি...
১ দিন আগে