জাতীয় ঐকমত্য কমিশন
চিররঞ্জন সরকার
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় ‘জাতীয় ঐকমত্য’ শব্দটি যেমন তাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এর বাস্তব প্রয়োগ অত্যন্ত জটিল ও বিতর্কিত। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক সংস্কার ও রাষ্ট্র পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে একাধিক পর্বে সংলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। নিয়মিত বৈঠক, আলোচ্য বিষয়ের তালিকা, সময়সীমা নির্ধারণ এবং ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়নের মতো কাঠামোগত প্রয়াস গ্রহণ করে কমিশন এক অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতির পথে হাঁটছে। এতে মৌলিক অধিকার, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতার মতো বিষয় সামনে এসেছে, যা রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে সাত সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়। অধ্যাপক আলী রীয়াজসহ কমিশনের বাকি সদস্যরা এসেছেন বিচার বিভাগ, পুলিশ, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, সংবিধান সংস্কার, দুর্নীতি দমন ইত্যাদি খাতভিত্তিক সংস্কার কমিশনের প্রধানদের মধ্য থেকে। তাদের মূল কাজ হচ্ছে এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা এবং একটি ‘জাতীয় সনদ’ বা ‘জুলাই চার্টার’ প্রণয়ন করা, যা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতিতে বাস্তবায়িত হবে।
কমিশনের মেয়াদ মাত্র ছয় মাস। এই সময়সীমার মধ্যে তাদের লক্ষ্য ২০টি বিষয়ের ওপর আলোচনার মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিমালা দাঁড় করানো। এর মধ্যে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, মৌলিক অধিকার, ন্যায়পাল, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, স্থানীয় সরকার সংস্কার, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, পুলিশ কমিশন প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এই সব আয়োজন ও কাঠামোর মধ্যেও প্রধান প্রশ্ন থেকেই যায়—এই প্রক্রিয়া কতটা কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য হবে? দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) শুরু থেকেই এই প্রক্রিয়ায় দ্বিধান্বিতভাবে যুক্ত। প্রথম দিকে তারা সংশয় প্রকাশ করলেও পরবর্তী পর্যায়ে লিখিত মতামত জমা দেয় এবং কয়েকটি আলোচনায় প্রতিনিধিত্ব করে। বিএনপি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, ১০০টি নারী আসন সংরক্ষণ, বিরোধীদলীয় ডেপুটি স্পিকার, রাষ্ট্রপতির অভিশংসন ব্যবস্থা, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য ও ন্যায়পাল নিয়োগে সমর্থন জানিয়েছে।
পক্ষান্তরে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ আইন, গণভোট ব্যবস্থা, সংবিধানের মূলনীতি সংশোধন এবং ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার—এতে তারা আপত্তি জানিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নিরপেক্ষ নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বড় মতপার্থক্য রয়ে গেছে। ছোট ও মাঝারি দলের অংশগ্রহণ এবং মতামত গুরুত্বপূর্ণ হলেও তারা জাতীয় ঐক্যের পূর্ণ প্রতিচ্ছবি নয়। কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ সম্প্রতি জানান, আলোচ্য ২০টি বিষয়ের মধ্যে ১০টিতে আপাতদৃষ্টিতে ঐকমত্য এসেছে—কিন্তু এর বেশির ভাগেই ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা দ্বিমতের সংযোজন রয়েছে। সাতটি বিষয়ে এখনো মতৈক্য হয়নি এবং তিনটি আলোচনা অসমাপ্ত। অর্থাৎ, কমিশনের ভেতরেই মতবিভেদ বিরাজমান।
এই মুহূর্তে মূল প্রশ্ন হচ্ছে: কমিশনের ‘ঐকমত্য’ কি বাস্তবিক অর্থেই জাতীয় ঐক্যের প্রতিফলন? কারণ, আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত দুই রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে একটি—আওয়ামী লীগ এই প্রক্রিয়ায় নেই, অন্যদিকে বিএনপি এখনো দ্বিধার মধ্যে। ফলে অন্য ছোট ও মাঝারি দলগুলোর অংশগ্রহণ, যেটি কমিশনের অন্যতম সাফল্য হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে, তা সামগ্রিক রাজনৈতিক সম্মতির প্রতীক হয়ে উঠছে না। বরং কমিশনের বিভিন্ন সভায় ‘নোট অব ডিসেন্ট’ তথা ভিন্নমত, অসমাপ্ত আলোচনা এবং মৌলিক বিষয়গুলোতে মতবিরোধ এই আংশিক ঐকমত্যের সীমাবদ্ধতাকে স্পষ্ট করেছে।
কমিশনের সংলাপের অনেক অংশই সংবাদমাধ্যমে অপ্রকাশিত থেকে গেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্যের একটি বড় অংশও অদৃশ্য। এই স্বচ্ছতার অভাব জন-আস্থা তৈরির পথে বড় অন্তরায়। জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রক্রিয়া যদি গোপনীয় থাকে, তবে তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। কমিশনের উচিত সমস্ত আলোচনা, মতবিরোধ এবং প্রস্তাবগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করা, যাতে তা নিয়ে সমাজে বিতর্ক এবং মতামত তৈরি হয়, যা প্রকৃতপক্ষে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করে।
সংস্কার বাস্তবায়ন নিয়েও বড় ধরনের বিভাজন স্পষ্ট। এনসিপি ও জামায়াতের মতো দলগুলো বলছে, মৌলিক বিষয়গুলোর সংস্কার না হলে তারা ‘জুলাই সনদ’-এ সম্মতি দেবে না। অন্যদিকে কয়েকটি দল বলছে, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে, আর বাকি বিষয়গুলোর মীমাংসা ভবিষ্যতের নির্বাচনী ইশতেহারে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে হোক। এই দ্বৈত অবস্থান কমিশনের প্রস্তাবগুলোকে দুর্বল করে তুলছে।
কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেছেন, তাঁরা ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে সংলাপ সম্পন্ন করতে চান এবং সেই লক্ষ্যেই ‘জুলাই সনদের’ খসড়া প্রণয়ন করছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মাত্র ছয় মাসের মধ্যে এত গুরুত্বপূর্ণ ২০টি বিষয়ের ওপর পূর্ণাঙ্গ ঐকমত্য গড়ে তোলা আদৌ সম্ভব কি না?
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এক অর্থে একটি সাহসী এবং কাঠামোগত উদ্যোগ, বিশেষত এমন এক সময়ে যখন বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে বিভাজন, অনাস্থা ও সহিংসতার মধ্যে বন্দী। তবে এই উদ্যোগকে সফল করতে হলে চাই বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সত্যিকারের অংশগ্রহণ, স্বচ্ছ আলোচনা এবং পারস্পরিক রাজনৈতিক সদিচ্ছা। নইলে এই কমিশনও একসময় পরিণত হবে আরেকটি ‘সৌজন্যমূলক বৈঠক বা রাজনৈতিক উপস্থাপনার অনুশীলনে’, যার বাস্তব ফলাফল তেমন কিছু থাকবে না। এবং সে ক্ষেত্রে জনগণের চোখে এটি একটি রাজনৈতিক প্রহসন বা সরকারের একতরফা বৈধতা অর্জনের উপায় বলেই মনে হবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ‘জাতীয় ঐকমত্য’ শব্দটি একদিকে যেমন আবেগতাড়িত, অনুপ্রেরণাদায়ী এবং গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়, তেমনি বাস্তব অভিজ্ঞতায় এটি বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে রাজনৈতিক কৌশলের হাতিয়ার হিসেবে। ফলে শব্দটির চারপাশে তৈরি হয়েছে একধরনের দ্ব্যর্থতা। এটি যেমন আশাবাদের প্রতীক হতে পারে, তেমনি হতে পারে একটি কৌশলগত মোড়ক, যার ভেতরে থাকে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার লড়াই এবং রাষ্ট্রক্ষমতা নিশ্চিত করার কৌশলগত প্রয়াস।
এই বাস্তবতায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সেই শব্দবন্ধকে নতুন অর্থ দিতে পারবে কি না, তা নির্ভর করছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তির সক্রিয়, আন্তরিক অংশগ্রহণ এবং খোলামেলা সংলাপের ওপর। দলগুলো যদি পারস্পরিক অবিশ্বাসের জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বাস্তবসম্মত সমঝোতায় পৌঁছাতে পারে, তবেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম কেবল একটি ‘নথি প্রণয়ন’ নয়, বরং একটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ও সামাজিক চুক্তির রূপ নিতে পারে, যা ভবিষ্যতের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ভিত রচনায় সহায়ক হবে।
কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিক অংশগ্রহণ ও সম্মতিকে যথার্থভাবে প্রতিফলিত করতে পারবে কি না, তা নিয়েও তৈরি হয়েছে যৌক্তিক সংশয়। কারণ, সাংবিধানিক সংস্কার, নির্বাচনী ব্যবস্থা, পুলিশ ও বিচার বিভাগীয় স্বচ্ছতা এবং নাগরিক অধিকারের মতো বিষয়ে কোনো দায়সারা ঐকমত্য বা গড়পড়তা ভাষায় তৈরি নীতিপত্র কার্যত জাতির আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে না।
এই মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো—নিজেদের স্বল্পমেয়াদি নির্বাচনী কৌশল নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা, গণতান্ত্রিক ভিত্তি ও জনগণের সম্মিলিত প্রত্যাশাকে অগ্রাধিকার দেওয়া। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যদি সত্যিকার অর্থে অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ ও ন্যায়সংগত আলোচনার মধ্য দিয়ে একটি যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য সনদ তৈরি করতে পারে, তবে এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে ইতিহাসে স্থান পাবে।
অন্যথায়, এটি পরিণত হবে আরেকটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার নামমাত্র প্রদর্শনীতে, যার উদ্দেশ্য বাস্তব পরিবর্তনের বদলে বাহ্যিক সৌজন্য রক্ষা এবং আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলার একরকম কৌশলগত প্রয়োগ মাত্র।
সুতরাং, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কি এই ‘জুলাই সনদ’-এর মাধ্যমে এক নতুন ঐকমত্যের পথে অগ্রসর হবে, নাকি তা আবারও বৃহত্তর রাজনৈতিক সংগ্রাম ও গণ-ম্যান্ডেটের তীব্র দাবি ঘিরে গড়ে উঠবে—এটাই এখন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অনিশ্চিত প্রশ্ন। সময়ের চাকা দ্রুত ঘুরছে এবং জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে সব পক্ষের সম্মিলিত দায়িত্ব ও বিবেকবোধের এখনই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় ‘জাতীয় ঐকমত্য’ শব্দটি যেমন তাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এর বাস্তব প্রয়োগ অত্যন্ত জটিল ও বিতর্কিত। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক সংস্কার ও রাষ্ট্র পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে একাধিক পর্বে সংলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। নিয়মিত বৈঠক, আলোচ্য বিষয়ের তালিকা, সময়সীমা নির্ধারণ এবং ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়নের মতো কাঠামোগত প্রয়াস গ্রহণ করে কমিশন এক অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতির পথে হাঁটছে। এতে মৌলিক অধিকার, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতার মতো বিষয় সামনে এসেছে, যা রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে সাত সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়। অধ্যাপক আলী রীয়াজসহ কমিশনের বাকি সদস্যরা এসেছেন বিচার বিভাগ, পুলিশ, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, সংবিধান সংস্কার, দুর্নীতি দমন ইত্যাদি খাতভিত্তিক সংস্কার কমিশনের প্রধানদের মধ্য থেকে। তাদের মূল কাজ হচ্ছে এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা এবং একটি ‘জাতীয় সনদ’ বা ‘জুলাই চার্টার’ প্রণয়ন করা, যা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতিতে বাস্তবায়িত হবে।
কমিশনের মেয়াদ মাত্র ছয় মাস। এই সময়সীমার মধ্যে তাদের লক্ষ্য ২০টি বিষয়ের ওপর আলোচনার মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিমালা দাঁড় করানো। এর মধ্যে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, মৌলিক অধিকার, ন্যায়পাল, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, স্থানীয় সরকার সংস্কার, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, পুলিশ কমিশন প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এই সব আয়োজন ও কাঠামোর মধ্যেও প্রধান প্রশ্ন থেকেই যায়—এই প্রক্রিয়া কতটা কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য হবে? দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) শুরু থেকেই এই প্রক্রিয়ায় দ্বিধান্বিতভাবে যুক্ত। প্রথম দিকে তারা সংশয় প্রকাশ করলেও পরবর্তী পর্যায়ে লিখিত মতামত জমা দেয় এবং কয়েকটি আলোচনায় প্রতিনিধিত্ব করে। বিএনপি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, ১০০টি নারী আসন সংরক্ষণ, বিরোধীদলীয় ডেপুটি স্পিকার, রাষ্ট্রপতির অভিশংসন ব্যবস্থা, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য ও ন্যায়পাল নিয়োগে সমর্থন জানিয়েছে।
পক্ষান্তরে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ আইন, গণভোট ব্যবস্থা, সংবিধানের মূলনীতি সংশোধন এবং ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার—এতে তারা আপত্তি জানিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নিরপেক্ষ নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বড় মতপার্থক্য রয়ে গেছে। ছোট ও মাঝারি দলের অংশগ্রহণ এবং মতামত গুরুত্বপূর্ণ হলেও তারা জাতীয় ঐক্যের পূর্ণ প্রতিচ্ছবি নয়। কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ সম্প্রতি জানান, আলোচ্য ২০টি বিষয়ের মধ্যে ১০টিতে আপাতদৃষ্টিতে ঐকমত্য এসেছে—কিন্তু এর বেশির ভাগেই ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা দ্বিমতের সংযোজন রয়েছে। সাতটি বিষয়ে এখনো মতৈক্য হয়নি এবং তিনটি আলোচনা অসমাপ্ত। অর্থাৎ, কমিশনের ভেতরেই মতবিভেদ বিরাজমান।
এই মুহূর্তে মূল প্রশ্ন হচ্ছে: কমিশনের ‘ঐকমত্য’ কি বাস্তবিক অর্থেই জাতীয় ঐক্যের প্রতিফলন? কারণ, আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত দুই রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে একটি—আওয়ামী লীগ এই প্রক্রিয়ায় নেই, অন্যদিকে বিএনপি এখনো দ্বিধার মধ্যে। ফলে অন্য ছোট ও মাঝারি দলগুলোর অংশগ্রহণ, যেটি কমিশনের অন্যতম সাফল্য হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে, তা সামগ্রিক রাজনৈতিক সম্মতির প্রতীক হয়ে উঠছে না। বরং কমিশনের বিভিন্ন সভায় ‘নোট অব ডিসেন্ট’ তথা ভিন্নমত, অসমাপ্ত আলোচনা এবং মৌলিক বিষয়গুলোতে মতবিরোধ এই আংশিক ঐকমত্যের সীমাবদ্ধতাকে স্পষ্ট করেছে।
কমিশনের সংলাপের অনেক অংশই সংবাদমাধ্যমে অপ্রকাশিত থেকে গেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্যের একটি বড় অংশও অদৃশ্য। এই স্বচ্ছতার অভাব জন-আস্থা তৈরির পথে বড় অন্তরায়। জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রক্রিয়া যদি গোপনীয় থাকে, তবে তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। কমিশনের উচিত সমস্ত আলোচনা, মতবিরোধ এবং প্রস্তাবগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করা, যাতে তা নিয়ে সমাজে বিতর্ক এবং মতামত তৈরি হয়, যা প্রকৃতপক্ষে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করে।
সংস্কার বাস্তবায়ন নিয়েও বড় ধরনের বিভাজন স্পষ্ট। এনসিপি ও জামায়াতের মতো দলগুলো বলছে, মৌলিক বিষয়গুলোর সংস্কার না হলে তারা ‘জুলাই সনদ’-এ সম্মতি দেবে না। অন্যদিকে কয়েকটি দল বলছে, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে, আর বাকি বিষয়গুলোর মীমাংসা ভবিষ্যতের নির্বাচনী ইশতেহারে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে হোক। এই দ্বৈত অবস্থান কমিশনের প্রস্তাবগুলোকে দুর্বল করে তুলছে।
কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেছেন, তাঁরা ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে সংলাপ সম্পন্ন করতে চান এবং সেই লক্ষ্যেই ‘জুলাই সনদের’ খসড়া প্রণয়ন করছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মাত্র ছয় মাসের মধ্যে এত গুরুত্বপূর্ণ ২০টি বিষয়ের ওপর পূর্ণাঙ্গ ঐকমত্য গড়ে তোলা আদৌ সম্ভব কি না?
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এক অর্থে একটি সাহসী এবং কাঠামোগত উদ্যোগ, বিশেষত এমন এক সময়ে যখন বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে বিভাজন, অনাস্থা ও সহিংসতার মধ্যে বন্দী। তবে এই উদ্যোগকে সফল করতে হলে চাই বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সত্যিকারের অংশগ্রহণ, স্বচ্ছ আলোচনা এবং পারস্পরিক রাজনৈতিক সদিচ্ছা। নইলে এই কমিশনও একসময় পরিণত হবে আরেকটি ‘সৌজন্যমূলক বৈঠক বা রাজনৈতিক উপস্থাপনার অনুশীলনে’, যার বাস্তব ফলাফল তেমন কিছু থাকবে না। এবং সে ক্ষেত্রে জনগণের চোখে এটি একটি রাজনৈতিক প্রহসন বা সরকারের একতরফা বৈধতা অর্জনের উপায় বলেই মনে হবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ‘জাতীয় ঐকমত্য’ শব্দটি একদিকে যেমন আবেগতাড়িত, অনুপ্রেরণাদায়ী এবং গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়, তেমনি বাস্তব অভিজ্ঞতায় এটি বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে রাজনৈতিক কৌশলের হাতিয়ার হিসেবে। ফলে শব্দটির চারপাশে তৈরি হয়েছে একধরনের দ্ব্যর্থতা। এটি যেমন আশাবাদের প্রতীক হতে পারে, তেমনি হতে পারে একটি কৌশলগত মোড়ক, যার ভেতরে থাকে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার লড়াই এবং রাষ্ট্রক্ষমতা নিশ্চিত করার কৌশলগত প্রয়াস।
এই বাস্তবতায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সেই শব্দবন্ধকে নতুন অর্থ দিতে পারবে কি না, তা নির্ভর করছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তির সক্রিয়, আন্তরিক অংশগ্রহণ এবং খোলামেলা সংলাপের ওপর। দলগুলো যদি পারস্পরিক অবিশ্বাসের জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বাস্তবসম্মত সমঝোতায় পৌঁছাতে পারে, তবেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম কেবল একটি ‘নথি প্রণয়ন’ নয়, বরং একটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ও সামাজিক চুক্তির রূপ নিতে পারে, যা ভবিষ্যতের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ভিত রচনায় সহায়ক হবে।
কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিক অংশগ্রহণ ও সম্মতিকে যথার্থভাবে প্রতিফলিত করতে পারবে কি না, তা নিয়েও তৈরি হয়েছে যৌক্তিক সংশয়। কারণ, সাংবিধানিক সংস্কার, নির্বাচনী ব্যবস্থা, পুলিশ ও বিচার বিভাগীয় স্বচ্ছতা এবং নাগরিক অধিকারের মতো বিষয়ে কোনো দায়সারা ঐকমত্য বা গড়পড়তা ভাষায় তৈরি নীতিপত্র কার্যত জাতির আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে না।
এই মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো—নিজেদের স্বল্পমেয়াদি নির্বাচনী কৌশল নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা, গণতান্ত্রিক ভিত্তি ও জনগণের সম্মিলিত প্রত্যাশাকে অগ্রাধিকার দেওয়া। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যদি সত্যিকার অর্থে অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ ও ন্যায়সংগত আলোচনার মধ্য দিয়ে একটি যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য সনদ তৈরি করতে পারে, তবে এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে ইতিহাসে স্থান পাবে।
অন্যথায়, এটি পরিণত হবে আরেকটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার নামমাত্র প্রদর্শনীতে, যার উদ্দেশ্য বাস্তব পরিবর্তনের বদলে বাহ্যিক সৌজন্য রক্ষা এবং আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলার একরকম কৌশলগত প্রয়োগ মাত্র।
সুতরাং, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কি এই ‘জুলাই সনদ’-এর মাধ্যমে এক নতুন ঐকমত্যের পথে অগ্রসর হবে, নাকি তা আবারও বৃহত্তর রাজনৈতিক সংগ্রাম ও গণ-ম্যান্ডেটের তীব্র দাবি ঘিরে গড়ে উঠবে—এটাই এখন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অনিশ্চিত প্রশ্ন। সময়ের চাকা দ্রুত ঘুরছে এবং জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে সব পক্ষের সম্মিলিত দায়িত্ব ও বিবেকবোধের এখনই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
‘বাবা, মামলা করি কী হইবে, পুলিশ থাকিয়াও হামার জীবনে নিরাপত্তা নাই’—রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার আলদাতপুর ছয়আনি হিন্দুপল্লির ৪৮ বছরের কোনিকা রানী যখন এই কথাগুলো বলেন, তখন তার কণ্ঠে ছিল আতঙ্ক আর চোখেমুখে উৎকণ্ঠার ছাপ। কথাগুলো কি আমাদের কারও জন্য খুব স্বস্তির? এক দেশ, এক রাষ্ট্র, এক সংবিধান নিয়ে আমরা যারা
৩ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জুলাই অভ্যুত্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। এই অভ্যুত্থান রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থার এক সংকটময় পটভূমিতে ঘটেছে, যার পরিণতিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় এবং শুরু হয় রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক সংস্কারের এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রচেষ্টা।
৭ ঘণ্টা আগেআমি মাইলস্টোন স্কুল ছেড়ে এসেছি বেশি দিন হয়নি। এখনো অনেক সহকর্মী আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আছেন। আমি তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু এখন যা দেখছি, তা নিয়ে চুপ থাকা অন্যায় হবে।
৯ ঘণ্টা আগেসাড়ে তিন বছর হতে চলল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের। শুরু হওয়ার এক বছর পর থেকেই বিভিন্ন মহল বিভিন্নভাবে এই যুদ্ধ বন্ধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। যুদ্ধ বন্ধে কয়েক মাসের মাথায় ইস্তাম্বুলে রাশিয়া ও ইউক্রেন কর্তৃপক্ষের মধ্যে একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল।
১২ ঘণ্টা আগে