Ajker Patrika

অটিজম ও করণীয়

ড. তামান্না তাসকীন
তামান্না তাসকীন। ছবি: সংগৃহীত
তামান্না তাসকীন। ছবি: সংগৃহীত

প্রতিবছরের মতো এবারও ২ এপ্রিল পালিত হলো বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়নের সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে গিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ২০০৭ সালের অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ পালনের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল, সেই মোতাবেক প্রতিবছরই জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলো এই দিবস পালন করে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় এ বছর ১৮তম বারের মতো পালিত হওয়া বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল—‘স্নায়ুবৈচিত্র্যের অগ্রগতি এবং জাতিসংঘের উন্নয়ন’। এর মধ্য দিয়ে মূলত জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে (এসডিজি) এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি, শিক্ষা ও অধিকার সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করার মাধ্যমে সমাজে তাদের উন্নয়ন ও অবদানকে উৎসাহিত করা হয়েছে।

বিশ্বজুড়ে অটিজম এখন একটি সামাজিক আন্দোলনের নাম। এই আন্দোলনে অটিজম বা নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটিতে আক্রান্ত ব্যক্তির সামাজিক যোগাযোগের সীমাবদ্ধতার ওপর জোর দেওয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগ বলতে এমন এক ধরনের দক্ষতা ও সক্ষমতাকে বোঝায় যেখানে ব্যক্তি তার সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে লাভ করা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এবং সেই অনুযায়ী যথোপযুক্ত আচরণ করতে পারে। এখানেই অটিজম আক্রান্ত বা অটিস্টিক ব্যক্তিদের অপারগতা প্রকাশ পায়। অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিরা আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো অন্যের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগে দক্ষতা দেখাতে পারে না। বিশেষ করে দ্বিমুখী যোগাযোগের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেমন কারও সঙ্গে আলোচনা শুরু করা, কথোপকথনের মাঝে প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখে প্রতিউত্তর করা, বিষয়ের মধ্যে থাকা, নিজের বক্তব্য অপর পক্ষকে বুঝিয়ে বলা বা ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আনন্দ, রাগ, চাওয়া-পাওয়ার মতো বিভিন্ন ধরনের আবেগ প্রকাশ করা ইত্যাদি। এসব বিষয়ের অপারগতার কারণে বা সামাজিক যোগাযোগের সীমাবদ্ধতার কারণে অটিস্টিক ব্যক্তিকে অনেকেইে প্রতিবন্ধী বলে আখ্যায়িত করে এবং তাদের অসামাজিক বলেও চিহ্নিত করে থাকে।

প্রকৃতপক্ষে অটিজম হলো মস্তিষ্কের বিকাশজনিত এক ধরনের ত্রুটি বা বৈকল্য যা শিশু মাতৃগর্ভে থাকাকালীন বহন করে নিয়ে আসে। বর্তমানে বিশ্বে প্রতি ৩৬ জনে একজন অটিজমে আক্রান্ত বলে জানিয়েছে সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)। অন্যদিকে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের মধ্যে অটিজমে আক্রান্তের হার বেশি যা প্রতি ৪ জনে ১ জন। বাংলাদেশে প্রকৃত অটিজম আক্রান্তের পরিসংখ্যানিক চিত্র বা কোনো আলাদা ডেটাবেজ নেই। তাই অন্যান্য রোগের সঙ্গে এক করে প্রতিবন্ধীর কাতারে অটিস্টিক ব্যক্তির যে সংখ্যা রয়েছে তা এখানে আলোচনা না করাই শ্রেয়। কেননা অটিজম কোনো রোগ বা প্রতিবন্ধিতা নয়। এটি এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা, যার ফলে একজন অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তি তার দৈনন্দিন কাজগুলো স্বাভাবিক নিয়মে না করে নিজেদের মতো করে। তা ছাড়া অটিজমের কারণ এখনো অনাবিষ্কৃত থাকায় ঠিক কী কারণে অটিজম হয় তার সর্বজনীন কোনো ব্যাখ্যাও নেই। এটি রোগ নয় বলে এর কোনো ওষুধও নেই। তবে জীবনব্যাপী চলমান এই প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠার জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরনের কৌশল, যার আরেক নাম থেরাপি। এই থেরাপি একেকজনের জন্য একেক রকম হয়ে থাকে।

অটিজমের বিভিন্ন ধরনের প্রকারভেদ হয়ে থাকে। প্রকারভেদের ধরনের ভিন্নতা ছাড়াও অটিস্টিক ব্যক্তির আচরণের প্রকাশভঙ্গি বা বৈশিষ্ট্যের মধ্যেও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। ফলে প্রত্যেকের জন্য থেরাপিউটিক পরিকল্পনার ভিন্নতা রয়েছে। জন্মের তিন বছরের মধ্যেই শিশুর সামাজিক আচরণে অটিজমের লক্ষণ প্রকাশ পায়। পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ, আঁখি সংযোগের সমস্যা, নাম ধরে ডাকলে সাড়া না দেওয়া, নিজের মতো থাকা বা আত্মকেন্দ্রিকতা, সমবয়সীদের সঙ্গে মিশতে না পারা, ঘুর্ণনশীল কোনো বস্তুর দিকে দীর্ঘ সময় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা, গাড়ি বা খেলনাকে লাইন দিয়ে সাজিয়ে রাখা, শব্দ, স্পর্শ, গন্ধ ইত্যাদির প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা, একই রুটিনে বা নিয়মে চলা বা পরিবর্তন পছন্দ না করা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য কমবেশি প্রায় সব ধরনের অটিজম আক্রান্তদের মধ্যে দেখা যায়।

পুরো জীবনব্যাপী চলমান এই প্রক্রিয়ায় অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুকে দৈনন্দিন কর্ম পরিচালনার মাধ্যমে নিজের কাজগুলো ঠিকভাবে করার মতো দক্ষ করে তোলার জন্য যত তাড়াতাড়ি অটিজম শনাক্ত ও বিশেষ স্কুলে পাঠানোসহ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে কাজ করবে, তত তাড়াতাড়ি সামাজিক যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। অটিজম যেহেতু স্থান, কাল, সময়, পাত্র বা ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গভেদে যে কারোরই হতে পারে, তাই এ সমস্যাকে সমাধান করার জন্য সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রকে অটিজম আক্রান্ত পরিবারের পাশে কার্যকরভাবে দাঁড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে আর্থিক ও মানসিক উভয় সহায়তার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। সমাজে বসবাসরত প্রতিটি নাগরিককে তার জায়গা থেকে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে। অটিস্টিক ব্যক্তিকে পাগল, প্রতিবন্ধী বা যেকোনো ধরনের নেতিবাচক শব্দে সম্বোধন করা যাবে না। একজন অটিস্টিক শিশুর পিতামাতার কাছে এই শব্দগুলো ভীষণ কষ্টের পরিচয় বহন করে। মনে রাখতে হবে যে অটিস্টিক শিশুরা সবকিছু দেখতে পারে ও বুঝতে পারে, তবে তা তাদের নিজেদের মতো করে। রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে তারও সব ধরনের সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। অটিজমকে শুধু একটি দিবসের গণ্ডিতে পালন না করে সত্যিকার অর্থে প্রতিদিনকে তাদের জন্য উৎসবময় করে তোলা উচিত। আমরা বিশেষ শিশুদের জন্য একটি সুন্দর ও সম্ভাবনাময় নতুন বাংলাদেশ রেখে যেতে চাই। এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

পরামর্শ দিয়েছেন: সহকারী অধ্যাপক, সমাজকর্ম, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত