Ajker Patrika

পাড়ায় পাড়ায় রাজনীতি নিয়ে গল্প

জাহীদ রেজা নূর
পয়লা বৈশাখে এনসিপি আয়োজিত সভায় অডিয়েন্স বলতে ছিল খবর সংগ্রহে যাওয়া অল্প কিছু সাংবাদিক। ছবি: ফোকাস বাংলা
পয়লা বৈশাখে এনসিপি আয়োজিত সভায় অডিয়েন্স বলতে ছিল খবর সংগ্রহে যাওয়া অল্প কিছু সাংবাদিক। ছবি: ফোকাস বাংলা

রাস্তাঘাটে, চায়ের দোকানে, পাড়ার আড্ডায় এখন যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, তার অনেকগুলোই রাজনীতিকেন্দ্রিক। তবে সব কথা অকুণ্ঠচিত্তে মানুষ বলে না। বোঝা যায়, একধরনের সেলফ সেন্সরশিপও আছে। ‘দেয়ালেরও কান আছে’—এ রকম যদি কেউ ভেবে থাকেন, তাহলে তাঁকে দোষ দেওয়া যাবে না।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিয়ে মানুষের যে আলোচনাগুলো রয়েছে, তার অনেক কিছুরই উৎস ফেসবুক বা ইউটিউবে পাওয়া খবরগুলো। তথ্য সঠিক বলে প্রমাণিত হলে আলোচনা তীব্রতা পায়।

এ মুহূর্তে জনগণের আগ্রহ আছে নতুন দল এনসিপি নিয়ে। দলটি যে রকম আওয়াজ দিয়ে রাজনীতির মাঠ দখল করতে চেয়েছিল, সে রকম প্রত্যাশিত কোনো শক্তি হিসেবে তারা এখনো মানুষের মনে ঠাঁই পায়নি। বরং দল গঠনের আগে-পরে এই দল-সংশ্লিষ্ট নেতাদের কারও কারও আচরণে এমন কিছু উপাদান দৃশ্যমান হয়েছে, যা নিয়ে বিব্রত হওয়ার মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আগস্ট মাসে এই ছাত্রনেতাদের ডাকে যে রকম গণজোয়ারের দেখা মিলত, এখন যেন তা ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে। এখন তাঁরা ডাকলেই আবার জেগে উঠবে জনগণ অথবা শিক্ষার্থীরা, এ রকমটা না-ও হতে পারে। কারণ, যে প্রত্যাশা নিয়ে গণ-আন্দোলন হয়েছিল, সে প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির রয়েছে যোজন যোজন দূরত্ব।

এনসিপি দলের কোনো কোনো নেতার হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাওয়ার খবর যখন আসে, তখন তাঁদের প্রতি আস্থায় ছেদ পড়ে। বাংলাদেশের সব শিক্ষায়তনের শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে যে আন্দোলন করেছে, তার প্রতি কতটা কমিটমেন্ট রাখতে পারছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা, সে প্রশ্ন এড়ানো যাবে না। অনেকেই বলছেন, লাভের গুড় খেয়ে নিচ্ছে কতিপয় সুযোগসন্ধানী। এ কারণেই কি পয়লা বৈশাখে এনসিপি আয়োজিত সভায় অডিয়েন্স বলতে ছিল খবর সংগ্রহে যাওয়া অল্প কিছু সাংবাদিক? গুটিকয় সমর্থক যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সংখ্যার দিকে তাকিয়ে এনসিপি নেতারা লজ্জা পেতে পারেন। একইভাবে এখন বিশাল কোনো জমায়েত করতে চাইলে দেখা যায় দলটি ভুগছে কর্মীহীনতায়। এখন পর্যন্ত নিবন্ধনের পথ মাড়ায়নি এই দল। তাদের রাজনৈতিক আদর্শও খোলাসা করেনি। কিন্তু এরই মধ্যে এদের অনেক নেতার মধ্যে বিলাসিতার দেখা পাচ্ছে জনগণ। সারজিস আলম আর হান্নান মাসউদের মোটর শোভাযাত্রার ঘটনাকে সাধারণ মানুষ সমালোচনার দৃষ্টিতেই দেখছে। এ ছাড়া এনসিপিরই এক নেত্রীর প্রশ্নের জবাবে সারজিস আলম রাজনীতির মাঠ নিয়ে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সেটাও হতাশ করেছে সাধারণ মানুষকে। তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে, মুখে যতই সংস্কারের কথা বলা হোক না কেন, নির্বাচনের মাঠে ওই সংস্কারবিহীন কৌশলগুলোর ওপরই আস্থা রাখবেন তাঁরা। সংস্কারের আগে নির্বাচন নয়—এ রকম একটি অবস্থান তাঁরা কেন নিচ্ছেন, তা নিয়ে ‘পাবলিক পারসেপশন’ হচ্ছে, আগে তাঁরা দল গুছিয়ে নেবেন, তারপরই কেবল নির্বাচনের কথা ভাববেন।

এই জায়গায় এসে অনেকেই প্রশ্ন করছেন, এনসিপি কি কিংস পার্টি হিসেবে ক্ষমতায় আসার কথাই ভাবছে? অর্থাৎ নির্বাচনের মাঠটি নিজেদের আয়ত্তে না আসা পর্যন্ত তারা নির্বাচনের কথা ভাববে না? প্রধান উপদেষ্টা নিজেই বলেছেন, এই ছাত্ররাই তাঁকে ক্ষমতায় বসিয়েছে অর্থাৎ এরাই প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগকারী। সেই হিসেবে ছাত্রদের দলটি কি প্রধান উপদেষ্টার ছায়ায় থেকে ক্ষমতার স্বাদ পেতে চাইছে? তাহলে কি সংস্কারের চেয়ে ক্ষমতার প্রতি আকর্ষণই তাদের লক্ষ্য? এই লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যেতে চাইলে তা কি নির্বাচনের মাঠে তাদের গ্রহণযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়াতে দেবে? রাজনীতির মাঠ বড্ড পিচ্ছিল। গণ-অভ্যুত্থানে বড় ভূমিকা পালন করলেই জনগণের মন জয় করা যায় না। ধারাবাহিকভাবে তাদের কাজগুলো ঠিক হচ্ছে কি না, সেদিকেও জনগণ চোখ রাখে।

নতুন দলের নেতাদের একটা বড় শত্রু হচ্ছে তাঁদের নিজেদের ফেসবুক পেজ। মাঝে মাঝেই তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন সব পোস্ট করেন, যেগুলো পরে সমালোচনার মুখে উঠিয়ে নিতে হয়। জাতীয় নেতা হওয়ার জন্যই তাঁরা রাজনীতিতে এসেছেন, সুতরাং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু লেখার সময় নিজেদের পরিপক্বতার পরিচয় দিতে হবে, এ রকম কথা শোনা যায় ঘনিষ্ঠজনদের ছোটখাটো আড্ডায়।

নতুন দলকে এখনো সময় দিতে হবে। কিন্তু তাদের শুরুটা ভালো হয়নি। দ্বান্দ্বিক বিষয়গুলোয় তাদের ব্যাখ্যাগুলোও পরিপক্বতার পরিচয় দেয় না। সেই সঙ্গে নিয়োগ-বাণিজ্যসহ নানা রকম অপ্রীতিকর ব্যাপারে তাদের সংযুক্তির যে খবরগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে ভার্চুয়াল দুনিয়ায়, সেগুলো অস্বীকার করলেই মানুষ কি তা বিশ্বাস করবে? তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করাই এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ নতুন এই দলটির। সচিবালয়ে গিয়ে নিয়োগ-বদলি নিয়ে তাদের যে বদনাম রটেছে, তার কিছু তো ঘটেছেই। এই তদবিরবাজির পথটি ক্ষমতার পথ। এটা পরিহার করা না হলে দলটি বেড়ে উঠতে পারবে না।

২. আওয়ামী লীগের পতনের পর ক্ষমতার লড়াইয়ে সবচেয়ে বড় দল হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপিরই সম্ভাবনা ছিল প্রবল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে নানা ঘটনায় মনে হতে থাকে, এই সরকার কি মাইনাস টু ফর্মুলাকে বাস্তবায়ন করতে চাইছে? বিএনপি নেতাদের একের পর এক মামলা খারিজ হয়ে গেছে এই সরকারের আমলে। আওয়ামী লীগের সভায় গ্রেনেড হামলার মামলাটিকেও বিদায় দেওয়া হয়েছে। বিএনপির মূল কান্ডারি তারেক রহমানের সব মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারেক রহমান এ রকম এক অবারিত মাঠেও কেন নামছেন না, সে প্রশ্ন আছে জনগণের মনে।

বিএনপির পক্ষ থেকে যে ব্যাখ্যাই দেওয়া হোক না কেন, মনে হয় গোপনে দলটি এখনো মনে করে, তারেক রহমান দেশে ফিরলে এমন কোনো ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হতে পারেন, যা রাজনীতির মাঠকে জটিল করে তুলবে, বিএনপি পড়বে বেকায়দায়—এ রকম ভাবছেন কেউ কেউ।

জনগণ এটাও খেয়াল করেছে, আওয়ামী দোসর তকমা দিয়ে প্রশাসনে বদলি ও পদায়নের ব্যাপারে ছাত্রদের প্রতিনিধিরা সক্রিয় হলেও প্রশাসনে থাকা বিএনপি ও জামায়াতের আমলারাই মূলত শূন্যস্থান পূরণ করেছেন। নিয়োগ-বাণিজ্য কাকে বলে, কারা এতে কীভাবে অংশ নেন, সে কথা এখন উৎসুক সবাই জানেন। এবং বিস্মিত হন এই কথা ভেবে যে, এত টাকা এরা কোথায় পায়? এত টাকা তারা কোথায় পায়, তার একটি উত্তর এমন—তাঁরা নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে এই পদগুলো কিনে নেন না। তাঁরা পদে বসলে যাঁরা লাভবান হবেন, তাঁরাই এই টাকার জোগান দেন। দুশ্চিন্তার ব্যাপার হলো, এসব ক্ষেত্রে কেউ বলেকয়ে ঘুষ খান না, ঘুষ দেন না। সুতরাং কেউ নিজে থেকে না বললে ঘুষ-বাণিজ্য হচ্ছে কি হচ্ছে না, সেটার প্রমাণ মেলে না। প্রশাসনে এভাবে বিএনপি-সমর্থক একটি অংশ জায়গা করে নিয়েছে বলে মনে করা যায়।

বিএনপির প্রধান মুশকিলের জায়গা হলো, দখলবাজ, পেশিশক্তির অধিকারী, মাস্তান কর্মীদের বশ করতে না পারা। বিএনপির উচ্চপর্যায়ের নেতারা বহিষ্কার করাসহ নানা ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা করছেন বটে, কিন্তু ক্ষমতালোভী কর্মীদের তাঁরা ঠেকাতে পারছেন না। এমনকি এলাকার দলীয় সুস্থ রাজনীতির ধারক-বাহকেরাও এদের পথে আনতে পারছেন না। কেউ কেউ বলে থাকেন, বিএনপির জনপ্রিয়তা কমানোর জন্য সরকারের একটি অংশ বিএনপির এইসব সদস্যকে নির্দ্বিধায় মারপিট, ঘুষ, চাঁদাবাজি, মাস্তানি করতে দিচ্ছে। এতে কিংস পার্টির সুবিধা হবে।

৩. জামায়াতে ইসলামী রাজনীতির মাঠে এখন যথেষ্ট শক্তিশালী দল। অনুকূল পরিবেশ পেয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধের নতুন বয়ান তৈরি করতে চাইছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ছাত্ররাজনীতিবিদদের একটি অংশও জামায়াতের এই নতুন বয়ানে মজেছে এবং তাদের কিছু কিছু মন্তব্যে দেখা গেছে, এরাও একাত্তরকে জামায়াতের পোশাক পরেই দেখতে চায়।

একাত্তর নিয়ে তারা যে সাহসী বক্তব্য দিচ্ছে, তার সঙ্গে ইতিহাসের কোনো মিল নেই। নিজেদের উপযোগী করে তারা মুক্তিযুদ্ধটাকেই পরিহাসে পরিণত করতে চাইছে। আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ঘটা নানা অনিয়মের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের মূল আকাঙ্ক্ষাকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। জামায়াতে ইসলামী যদি একাত্তরে তাদের নৃশংস, বর্বর ভূমিকার জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে রাজনীতি করত, তাহলে এই দেশের মানুষের হয়ে কথা বলার মতো প্ল্যাটফর্ম পেত। কিন্তু তারা এখনো বাজিয়ে চলেছে তাদের পুরোনো ভাঙা রেকর্ড। তাদের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, বর্তমান প্রজন্ম ইতিহাস পাঠের নামে বিভিন্ন দলীয় ব্যাখ্যাই পেয়েছে। কথার সঙ্গে কাজের অমিল পেয়েছে। রেফারেন্স বই হিসেবে কোন বইটা বেছে নেবে, সে পরামর্শও কেউ তাদের দেয়নি। তাই, একাত্তরকে ঠিকভাবে উপলব্ধি না করেই তারা যেকোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারে। এ ব্যাপারে সতর্ক না হলে জামায়াত ক্রমেই তাদের গ্রাস করবে।

রকে-রেস্তোরাঁয় মানুষ আরও অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। এর মধ্যে মব সন্ত্রাস, ইচ্ছে হলেই রাস্তা বন্ধ করে দাবি আদায়, মিথ্যে মামলায় কাউকে ঢুকিয়ে দিয়ে টুপাইস কামানো, আগস্টে পটপরিবর্তনের পর শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মুক্ত করে দেওয়াসহ কত যে গল্প ঘুরে বেড়ায়!

দেশের মানুষকে আশার আলো দেখাতে পারে, এমন মানুষ বা মানব সমষ্টিকে দরকার এখন। কিন্তু পরিস্থিতি আর পরিবেশ এখনো কুয়াশাচ্ছন্ন। এখনো জনগণ আশাবাদী হতে পারছে না—এটাই এ মুহূর্তে সবচেয়ে বিপদের জায়গা।

লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত