মুহান্নাদ আয়্যাশ
২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে দেওয়া এক সাক্ষ্যে তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মার্কিন আইনপ্রণেতাদের বলেছিলেন, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে বিজয় অর্জন এবং ইরাক ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর হাতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র পৌঁছাতে না দেওয়ার জন্য ইরাকে আক্রমণ চালানো জরুরি। তিনি আরও দাবি করেন, এই যুদ্ধ দ্রুত শেষ হবে এবং এটি শুধু ইরাকেই নয়, বরং পুরো অঞ্চলে, এমনকি ইরানেও পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্রের একটি নতুন যুগের সূচনা করবে। এ দুটি দাবির কোনোটিই সত্য হয়নি।
২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসন শুরুর আগেই বহু বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তার জানা ছিল যে সাদ্দাম হোসেনের সরকারের কাছে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র ছিল না। আল-কায়েদার সঙ্গেও তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এই যুদ্ধ যে ব্যাপক ধ্বংস, অস্থিতিশীলতা, নিরাপত্তাহীনতা, অকল্পনীয় দুর্ভোগ, বিশৃঙ্খলা ও শাসনব্যবস্থার পতন ডেকে আনবে, তা অনেকটাই অনিবার্য ছিল। এবং ঠিক সেটাই ঘটেছে। আজকের ইরাক সর্বোচ্চভাবে এক ভঙ্গুর রাষ্ট্র, যেখানে ব্যাপক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট বিরাজ করছে।
চলতি মাসের মাঝামাঝিতে প্রথমে ইসরায়েল এবং পরে যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরানে হামলা চালায়, তখন অনেক বিশ্লেষক মন্তব্য করেছিলেন যে এ দুই অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু মনে হয় ইরাক যুদ্ধ থেকে কোনো শিক্ষা নেয়নি। ইরানেও এখন তারা একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করছে। এই বিশ্লেষণগুলো সঠিক হতো যদি ২০০৩ সালের আগ্রাসনের প্রকৃত লক্ষ্য হতো গণবিধ্বংসী অস্ত্রের বিস্তার ঠেকানো এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উদ্দেশ্য তা ছিল না।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের জন্য সেই যুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল ছিল এমন একটি ইরাক, যা ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি বসতি স্থাপন-ঔপনিবেশিক প্রকল্প এবং ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব বিস্তারে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। আজ ইরানের ক্ষেত্রেও তাদের লক্ষ্য একই।
যেমনটি ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল, ঠিক তেমনই ‘পরমাণু অস্ত্র তৈরি করার দ্বারপ্রান্তে’ ইরান রয়েছে—এই দাবিরও কোনো ভিত্তি নেই। তেহরান আসলেই পরমাণু সক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, এমন কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ আজ পর্যন্ত উপস্থাপন করেনি তারা। এর পরিবর্তে আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে এক চরম ভণ্ডামি ও মিথ্যাচার।
এখানে আমাদের সামনে এমন একটি পরিস্থিতি রয়েছে, যেখানে রয়েছে দুটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। যার একটি হচ্ছে ইতিহাসে একমাত্র দেশ, যে একবার নয়, দুইবার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে। আর অন্যটি এমন একটি দেশ, যা পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে (এনপিটি) সই করতে অস্বীকার করেছে এবং যার পরমাণু নীতিতে গণহত্যা-আত্মঘাতী ধরনের কৌশল রয়েছে। তারা তথাকথিত পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধের অজুহাতে অবৈধ ‘প্রত্যাঘাতমূলক’ আগ্রাসনে লিপ্ত হয়েছে।
স্পষ্ট করে বললে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের লক্ষ্য ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নয়। ইরানের বিরুদ্ধে যৌথ হামলার উদ্দেশ্য হলো ওই অঞ্চলজুড়ে আধিপত্য নিশ্চিত করার জন্য বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা। তাদের আসল লক্ষ্য হলো, ইরানকে একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে দমন করা। সেই কারণেই ‘শাসন পরিবর্তন’-এর কথা ইতিমধ্যে প্রকাশ্যে এসেছে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ এবং অন্যান্য ইসরায়েলি কর্মকর্তার একাধিক বক্তব্যের পাশাপাশি মার্কিন সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম ও টেড ক্রুজও ইরানে সরকার উৎখাতের ডাক দিয়েছেন। গত রোববার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও সামাজিকমাধ্যমে একটি পোস্টের মাধ্যমে ইরানে শাসন পরিবর্তনের বক্তব্যে শামিল হয়েছেন।
ইরানি জনগণকে এখন ‘অধিকার’ ও ‘স্বাধীনতার’ জন্য রুখে দাঁড়াতে এবং লড়াই করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কিন্তু ইরানে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আসল লক্ষ্য নয়। কেন? কারণ একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক ইরান কখনোই তাদের স্বার্থ রক্ষা করবে না এবং পাশের অঞ্চলে চলমান নির্মম বসতি স্থাপন-ঔপনিবেশিক প্রকল্পকে মেনে নেবে না।
তারা বরং চাইবে ইরান ফিরে যাক সহিংস ও স্বৈরতান্ত্রিক পাহলভি রাজবংশের শাসনে, যা ১৯৭৯ সালে এক গণবিপ্লবের মাধ্যমে উৎখাত হয়েছিল। অথবা এমন কোনো রাজনৈতিক শক্তির অধীনে, যারা তাদের নির্দেশ মেনে চলতে রাজি থাকবে।
যদি সেটাও না ঘটে, তাহলে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র বরং একটি বিভক্ত, দুর্বল, বিশৃঙ্খল ও অস্থিতিশীল ইরান পছন্দ করবে, যেখানে গৃহযুদ্ধ চলছে। এটি তাদের স্বার্থের সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেমনটি যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক ছিল।
মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে দুর্বল করা এবং ধ্বংসাত্মক ষড়যন্ত্র ও আগ্রাসনের মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে দেওয়া একটি সুপ্রতিষ্ঠিত নীতিগত লক্ষ্য, যা ১৯৯০-এর দশক থেকে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অভিজাতরা যৌথভাবে গ্রহণ করেছেন।
১৯৯৬ সালে সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী রিচার্ড পার্ল এবং অন্য নব্য রক্ষণশীলদের দ্বারা রচিত ‘ক্লিন ব্রেক’ নামক একটি নীতি দলিলে এই কৌশলটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যেখানে গণবিধ্বংসী অস্ত্র বিস্তার রোধের অজুহাতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ওপর হামলা চালিয়ে ইসরায়েলের কৌশলগত স্বার্থ সুরক্ষিত করার পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে।
পার্ল ও তাঁর সহযোগীরা কোনো নতুন কিছু আবিষ্কার করেননি; তাঁরা কেবল সুপরিচিত সাম্রাজ্যবাদী কৌশলকে ভিত্তি করে কাজ করেছেন, যা হলো বিভাজন ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী শাসনকে সহজতর করা।
কিন্তু এই কৌশল ঝুঁকিমুক্ত নয়। যেমন ইরাকের রাষ্ট্র পতনের ফলে সহিংস অবৈধ বাহিনীর উদ্ভব হয়েছে এবং ইরান তার অবস্থান শক্তিশালী করে একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে মার্কিন ও ইসরায়েলি স্বার্থকে চ্যালেঞ্জ করেছে, তেমনি একটি দুর্বল বা বিভক্ত ইরানি রাষ্ট্র একই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
সারা বিশ্বের দৃষ্টিতে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের কার্যক্রম আরও অনেক দেশকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের দিকে উৎসাহিত করছে। ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলি আগ্রাসন থেকে দেশগুলো যে শিক্ষা নিচ্ছে, তা হলো এই ধরনের হামলা রোধের জন্য পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন অপরিহার্য। তাই, এই যুদ্ধে আমরা কম নয়, বরং আরও বিস্তৃত পারমাণবিক অস্ত্র প্রসারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি বলেই প্রতিভাত হচ্ছে।
ইসরায়েলি রাষ্ট্র পরমাণু অস্ত্র বিস্তার নিয়ে তেমন উদ্বিগ্ন বলে মনে হয় না, যতক্ষণ না পর্যন্ত এটি অঞ্চলে যে বিশৃঙ্খলা ও ধ্বংস ছড়ায় তা তার কৌশলগত লক্ষ্য পূরণে বাধা দিচ্ছে, যা আদতে ফিলিস্তিনি সংগ্রামকে সম্পূর্ণরূপে দমন করা এবং তার বসতি-ঔপনিবেশিক প্রকল্পের বিরুদ্ধে সব প্রতিরোধ শেষ করা। সংক্ষেপে, ইসরায়েল চায় পুরো অঞ্চলকে পিছু হটাতে এবং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সে কোনো বাধা মানবে না। এর কারণ হলো, ওই অঞ্চলের অস্থিতিশীলতার দায় ও ব্যয় তাকে বহন করতে হয় না।
অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্য যখন বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে, তখন সরাসরি আঘাত লাগে মার্কিন স্বার্থে। একটি অকার্যকর ইরাক বা দুর্বল ইরান স্বল্প মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রকে সুবিধা দিলেও, দীর্ঘ মেয়াদে এই অস্থিতিশীলতা তার বৃহত্তর পরিকল্পনা, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি মার্কেট নিয়ন্ত্রণ এবং চীনকে ঘিরে রাখার উদ্যোগকে ব্যাহত করতে পারে।
অননুমোদিত এই আগ্রাসনের প্রভাব বিশ্বের অন্যান্য অংশেও অনুভূত হবে, যেমনটি ২০০৩ সালের ইরাকে আগ্রাসনের পর ঘটেছিল।
সেই যুদ্ধের নির্মম ও দশকব্যাপী পরিণতি বিবেচনায়, ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের আগ্রাসনের প্রতি বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া আত্মঘাতী বলেই মনে হয়েছে। কিছু ইউরোপীয় দেশ এই হামলা সমর্থন করেছে, যদিও এর ফলে তারা নানা নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাবের সম্মুখীন হতে পারে।
যদি সরকারগুলো সত্যিই পৃথিবীকে আরও নিরাপদ জায়গা করতে চায়, তবে সাম্রাজ্যবাদের সহিংসতার সঙ্গেই তাদের উদাসীনতাকে বন্ধ করতে হবে। সময় এসেছে তাদের স্বচ্ছন্দ স্বার্থসিদ্ধি ভেঙে এটা উপলব্ধি করা যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল তাদের বর্ণবৈষম্যমূলক ঔপনিবেশিক নকশা অনুযায়ী ধ্বংস ও বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে পৃথিবীতে আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে।
ইসরায়েলি বসতি-ঔপনিবেশিক প্রকল্প হলো বাস্তুচ্যুতি, উৎখাত এবং গণহত্যার একটি নিরসনাতীত প্রকল্প; মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ হলো মানুষের সম্পদ, মর্যাদা ও সার্বভৌমত্ব ছিনিয়ে নেওয়ার একটি অন্যায় প্রকল্প।
মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বের যা করা উচিত:
১. ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের বসতি-ঔপনিবেশিক প্রকল্প পরিত্যাগ করানো এবং ঔপনিবেশমুক্ত ফিলিস্তিনে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সম-অধিকারের ভিত্তিতে সহাবস্থান গড়ে তোলা;
২. যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের লৌহমুষ্টি বা আয়রন গ্রিপ ছাড়তে বাধ্য করা, যাতে এই অঞ্চলের মানুষ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে জীবনযাপন করতে পারে।
এটাই একমাত্র উপায় চিরস্থায়ী বিশৃঙ্খলা, অস্থিতিশীলতা, দুর্ভোগ ও যন্ত্রণা এড়িয়ে চলার।
(আল জাজিরা থেকে নেওয়া লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)
লেখক: অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান, মাউন্ট রয়্যাল ইউনিভার্সিটি, কানাডা
২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে দেওয়া এক সাক্ষ্যে তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মার্কিন আইনপ্রণেতাদের বলেছিলেন, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে বিজয় অর্জন এবং ইরাক ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর হাতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র পৌঁছাতে না দেওয়ার জন্য ইরাকে আক্রমণ চালানো জরুরি। তিনি আরও দাবি করেন, এই যুদ্ধ দ্রুত শেষ হবে এবং এটি শুধু ইরাকেই নয়, বরং পুরো অঞ্চলে, এমনকি ইরানেও পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্রের একটি নতুন যুগের সূচনা করবে। এ দুটি দাবির কোনোটিই সত্য হয়নি।
২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসন শুরুর আগেই বহু বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তার জানা ছিল যে সাদ্দাম হোসেনের সরকারের কাছে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র ছিল না। আল-কায়েদার সঙ্গেও তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এই যুদ্ধ যে ব্যাপক ধ্বংস, অস্থিতিশীলতা, নিরাপত্তাহীনতা, অকল্পনীয় দুর্ভোগ, বিশৃঙ্খলা ও শাসনব্যবস্থার পতন ডেকে আনবে, তা অনেকটাই অনিবার্য ছিল। এবং ঠিক সেটাই ঘটেছে। আজকের ইরাক সর্বোচ্চভাবে এক ভঙ্গুর রাষ্ট্র, যেখানে ব্যাপক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট বিরাজ করছে।
চলতি মাসের মাঝামাঝিতে প্রথমে ইসরায়েল এবং পরে যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরানে হামলা চালায়, তখন অনেক বিশ্লেষক মন্তব্য করেছিলেন যে এ দুই অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু মনে হয় ইরাক যুদ্ধ থেকে কোনো শিক্ষা নেয়নি। ইরানেও এখন তারা একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করছে। এই বিশ্লেষণগুলো সঠিক হতো যদি ২০০৩ সালের আগ্রাসনের প্রকৃত লক্ষ্য হতো গণবিধ্বংসী অস্ত্রের বিস্তার ঠেকানো এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উদ্দেশ্য তা ছিল না।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের জন্য সেই যুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল ছিল এমন একটি ইরাক, যা ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি বসতি স্থাপন-ঔপনিবেশিক প্রকল্প এবং ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব বিস্তারে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। আজ ইরানের ক্ষেত্রেও তাদের লক্ষ্য একই।
যেমনটি ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল, ঠিক তেমনই ‘পরমাণু অস্ত্র তৈরি করার দ্বারপ্রান্তে’ ইরান রয়েছে—এই দাবিরও কোনো ভিত্তি নেই। তেহরান আসলেই পরমাণু সক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, এমন কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ আজ পর্যন্ত উপস্থাপন করেনি তারা। এর পরিবর্তে আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে এক চরম ভণ্ডামি ও মিথ্যাচার।
এখানে আমাদের সামনে এমন একটি পরিস্থিতি রয়েছে, যেখানে রয়েছে দুটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। যার একটি হচ্ছে ইতিহাসে একমাত্র দেশ, যে একবার নয়, দুইবার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে। আর অন্যটি এমন একটি দেশ, যা পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে (এনপিটি) সই করতে অস্বীকার করেছে এবং যার পরমাণু নীতিতে গণহত্যা-আত্মঘাতী ধরনের কৌশল রয়েছে। তারা তথাকথিত পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধের অজুহাতে অবৈধ ‘প্রত্যাঘাতমূলক’ আগ্রাসনে লিপ্ত হয়েছে।
স্পষ্ট করে বললে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের লক্ষ্য ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নয়। ইরানের বিরুদ্ধে যৌথ হামলার উদ্দেশ্য হলো ওই অঞ্চলজুড়ে আধিপত্য নিশ্চিত করার জন্য বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা। তাদের আসল লক্ষ্য হলো, ইরানকে একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে দমন করা। সেই কারণেই ‘শাসন পরিবর্তন’-এর কথা ইতিমধ্যে প্রকাশ্যে এসেছে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ এবং অন্যান্য ইসরায়েলি কর্মকর্তার একাধিক বক্তব্যের পাশাপাশি মার্কিন সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম ও টেড ক্রুজও ইরানে সরকার উৎখাতের ডাক দিয়েছেন। গত রোববার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও সামাজিকমাধ্যমে একটি পোস্টের মাধ্যমে ইরানে শাসন পরিবর্তনের বক্তব্যে শামিল হয়েছেন।
ইরানি জনগণকে এখন ‘অধিকার’ ও ‘স্বাধীনতার’ জন্য রুখে দাঁড়াতে এবং লড়াই করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কিন্তু ইরানে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আসল লক্ষ্য নয়। কেন? কারণ একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক ইরান কখনোই তাদের স্বার্থ রক্ষা করবে না এবং পাশের অঞ্চলে চলমান নির্মম বসতি স্থাপন-ঔপনিবেশিক প্রকল্পকে মেনে নেবে না।
তারা বরং চাইবে ইরান ফিরে যাক সহিংস ও স্বৈরতান্ত্রিক পাহলভি রাজবংশের শাসনে, যা ১৯৭৯ সালে এক গণবিপ্লবের মাধ্যমে উৎখাত হয়েছিল। অথবা এমন কোনো রাজনৈতিক শক্তির অধীনে, যারা তাদের নির্দেশ মেনে চলতে রাজি থাকবে।
যদি সেটাও না ঘটে, তাহলে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র বরং একটি বিভক্ত, দুর্বল, বিশৃঙ্খল ও অস্থিতিশীল ইরান পছন্দ করবে, যেখানে গৃহযুদ্ধ চলছে। এটি তাদের স্বার্থের সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেমনটি যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক ছিল।
মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে দুর্বল করা এবং ধ্বংসাত্মক ষড়যন্ত্র ও আগ্রাসনের মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে দেওয়া একটি সুপ্রতিষ্ঠিত নীতিগত লক্ষ্য, যা ১৯৯০-এর দশক থেকে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অভিজাতরা যৌথভাবে গ্রহণ করেছেন।
১৯৯৬ সালে সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী রিচার্ড পার্ল এবং অন্য নব্য রক্ষণশীলদের দ্বারা রচিত ‘ক্লিন ব্রেক’ নামক একটি নীতি দলিলে এই কৌশলটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যেখানে গণবিধ্বংসী অস্ত্র বিস্তার রোধের অজুহাতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ওপর হামলা চালিয়ে ইসরায়েলের কৌশলগত স্বার্থ সুরক্ষিত করার পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে।
পার্ল ও তাঁর সহযোগীরা কোনো নতুন কিছু আবিষ্কার করেননি; তাঁরা কেবল সুপরিচিত সাম্রাজ্যবাদী কৌশলকে ভিত্তি করে কাজ করেছেন, যা হলো বিভাজন ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী শাসনকে সহজতর করা।
কিন্তু এই কৌশল ঝুঁকিমুক্ত নয়। যেমন ইরাকের রাষ্ট্র পতনের ফলে সহিংস অবৈধ বাহিনীর উদ্ভব হয়েছে এবং ইরান তার অবস্থান শক্তিশালী করে একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে মার্কিন ও ইসরায়েলি স্বার্থকে চ্যালেঞ্জ করেছে, তেমনি একটি দুর্বল বা বিভক্ত ইরানি রাষ্ট্র একই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
সারা বিশ্বের দৃষ্টিতে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের কার্যক্রম আরও অনেক দেশকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের দিকে উৎসাহিত করছে। ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলি আগ্রাসন থেকে দেশগুলো যে শিক্ষা নিচ্ছে, তা হলো এই ধরনের হামলা রোধের জন্য পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন অপরিহার্য। তাই, এই যুদ্ধে আমরা কম নয়, বরং আরও বিস্তৃত পারমাণবিক অস্ত্র প্রসারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি বলেই প্রতিভাত হচ্ছে।
ইসরায়েলি রাষ্ট্র পরমাণু অস্ত্র বিস্তার নিয়ে তেমন উদ্বিগ্ন বলে মনে হয় না, যতক্ষণ না পর্যন্ত এটি অঞ্চলে যে বিশৃঙ্খলা ও ধ্বংস ছড়ায় তা তার কৌশলগত লক্ষ্য পূরণে বাধা দিচ্ছে, যা আদতে ফিলিস্তিনি সংগ্রামকে সম্পূর্ণরূপে দমন করা এবং তার বসতি-ঔপনিবেশিক প্রকল্পের বিরুদ্ধে সব প্রতিরোধ শেষ করা। সংক্ষেপে, ইসরায়েল চায় পুরো অঞ্চলকে পিছু হটাতে এবং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সে কোনো বাধা মানবে না। এর কারণ হলো, ওই অঞ্চলের অস্থিতিশীলতার দায় ও ব্যয় তাকে বহন করতে হয় না।
অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্য যখন বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে, তখন সরাসরি আঘাত লাগে মার্কিন স্বার্থে। একটি অকার্যকর ইরাক বা দুর্বল ইরান স্বল্প মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রকে সুবিধা দিলেও, দীর্ঘ মেয়াদে এই অস্থিতিশীলতা তার বৃহত্তর পরিকল্পনা, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি মার্কেট নিয়ন্ত্রণ এবং চীনকে ঘিরে রাখার উদ্যোগকে ব্যাহত করতে পারে।
অননুমোদিত এই আগ্রাসনের প্রভাব বিশ্বের অন্যান্য অংশেও অনুভূত হবে, যেমনটি ২০০৩ সালের ইরাকে আগ্রাসনের পর ঘটেছিল।
সেই যুদ্ধের নির্মম ও দশকব্যাপী পরিণতি বিবেচনায়, ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের আগ্রাসনের প্রতি বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া আত্মঘাতী বলেই মনে হয়েছে। কিছু ইউরোপীয় দেশ এই হামলা সমর্থন করেছে, যদিও এর ফলে তারা নানা নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাবের সম্মুখীন হতে পারে।
যদি সরকারগুলো সত্যিই পৃথিবীকে আরও নিরাপদ জায়গা করতে চায়, তবে সাম্রাজ্যবাদের সহিংসতার সঙ্গেই তাদের উদাসীনতাকে বন্ধ করতে হবে। সময় এসেছে তাদের স্বচ্ছন্দ স্বার্থসিদ্ধি ভেঙে এটা উপলব্ধি করা যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল তাদের বর্ণবৈষম্যমূলক ঔপনিবেশিক নকশা অনুযায়ী ধ্বংস ও বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে পৃথিবীতে আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে।
ইসরায়েলি বসতি-ঔপনিবেশিক প্রকল্প হলো বাস্তুচ্যুতি, উৎখাত এবং গণহত্যার একটি নিরসনাতীত প্রকল্প; মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ হলো মানুষের সম্পদ, মর্যাদা ও সার্বভৌমত্ব ছিনিয়ে নেওয়ার একটি অন্যায় প্রকল্প।
মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বের যা করা উচিত:
১. ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের বসতি-ঔপনিবেশিক প্রকল্প পরিত্যাগ করানো এবং ঔপনিবেশমুক্ত ফিলিস্তিনে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সম-অধিকারের ভিত্তিতে সহাবস্থান গড়ে তোলা;
২. যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের লৌহমুষ্টি বা আয়রন গ্রিপ ছাড়তে বাধ্য করা, যাতে এই অঞ্চলের মানুষ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে জীবনযাপন করতে পারে।
এটাই একমাত্র উপায় চিরস্থায়ী বিশৃঙ্খলা, অস্থিতিশীলতা, দুর্ভোগ ও যন্ত্রণা এড়িয়ে চলার।
(আল জাজিরা থেকে নেওয়া লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)
লেখক: অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান, মাউন্ট রয়্যাল ইউনিভার্সিটি, কানাডা
বাংলাদেশে আর যা কিছুরই অভাব থাক না কেন রাজনৈতিক দলের কোনো অভাব নেই। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলে শতাধিক রাজনৈতিক দল আছে। সব দলের নাম যেমন সবার জানা নেই, তেমনি সব দলের নেতাদের নামও বেশির ভাগ মানুষের কাছে অজানা। ছোট দেশ, কিন্তু মানুষের সংখ্যা অনেক। সব মানুষ আবার এক চিন্তার নয়। তাই ১৭-১৮ কোটি মানুষের...
৬ ঘণ্টা আগেএই দৃশ্য কল্পনা করুন—একজন বয়স্ক মানুষ, যিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, যিনি একসময় রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন, যিনি সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত ছিলেন দেশ ও জনগণের সেবায়—আজ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন গলায় জুতার মালা ঝুলিয়ে। তাঁর চোখে অপমান, তাঁর শরীরে আতঙ্ক, আর চারপাশে রক্তচক্ষু নিক্ষেপকারী জনতা...
৭ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া দলটি ‘নতুন বন্দোবস্তের’ স্লোগান দিয়ে নিজেদের নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারক হিসেবে তুলে ধরেছে। বিশেষ করে, নারীর নেতৃত্ব, অংশগ্রহণ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রশ্নে এনসিপির বাণীতে
১ দিন আগেসমাপ্তপ্রায় অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসের তথ্য বিশ্লেষণপূর্বক বাংলাদেশ ব্যাংক জানাচ্ছে, এ সময়ে দেশে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে ২৮.৭৯ শতাংশ ও মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে ২৫.৫৬ শতাংশ। প্রায় একই ধরনের অর্থনৈতিক প্রবণতার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যরোও (বিবিএস)।
১ দিন আগে