Ajker Patrika

নির্মম পৃষ্ঠপোষকতা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সাতচল্লিশের দেশভাগকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িকতা ক্রমাগত তীব্র হলো। রক্তপাত ঘটল। পরে যখন স্বাধীন হলো ভারতবর্ষ, তখন একটির জায়গায় দুটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটল। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার সমস্যার সমাধান হলো না; না পাকিস্তানে, না ভারতে। পাকিস্তানের সব ধর্মাবলম্বীকে বলা হলো রাজনৈতিকভাবে নিজ নিজ ধর্মমত ভুলে গিয়ে খাঁটি পাকিস্তানিতে পরিণত হতে। জিন্নাহ ধর্মীয় রাষ্ট্র চাননি, আধুনিক রাষ্ট্রই চেয়েছিলেন।

কিন্তু ধর্মের ভিত্তিটা তো রয়েই গেল রাষ্ট্রের মূলে। তা ছাড়া পাকিস্তান দ্রুত পরিণত হলো একটি আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে। সামরিক-বেসামরিক আমলারা রাষ্ট্র পরিচালনার কর্তৃত্ব দখল করে নিল। নিজেরা যদিও মোটেই ধার্মিক ছিল না, তথাপি তারা ধর্মকে ব্যবহার করতে চাইল, ঠিক সেই পুরোনো কারণেই। শ্রেণিবিভাজনকে অস্পষ্ট করে দেওয়ার জন্য। সেই সঙ্গে উগ্র ভারতবিদ্বেষ সৃষ্টি এবং সংখ্যাগুরু জনগণকে ধর্মচর্চার স্বাধীনতা (আসলে একমাত্র স্বাধীনতা) দিয়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর নিপীড়নমূলক চরিত্রকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করল।

তখনকার পূর্ব বাংলা এতে সন্তুষ্ট হয়নি। অভিজ্ঞতা সেখানকার মানুষকে দ্রুত বলে দিয়েছে যে ধর্মীয় বিভাজন যদিও মিথ্যা হয়, তবু তার চেয়ে অনেক বড় সত্য ভাষার বিভাজন। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের জায়গায় তাই নতুন চেতনা গড়ে উঠল, সেটি ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। ১৯৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলার প্রথম ব্যাপক রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলন। ভাষা পুরোপুরি ইহজাগতিক, ভাষা আন্দোলনও ছিল তাই। এখানে ধর্মের জন্য কোনো জায়গা ছিল না। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। ওই আন্দোলন ক্রমাগত তীব্র হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত তা স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। পাকিস্তানিরা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের আওয়াজ থামায়নি। একাত্তরে যুদ্ধের সময় গণহত্যায় উদ্বুদ্ধকরণের প্রয়োজনে ব্যক্তিগতভাবে সর্বপ্রকার পাপাচারে লিপ্ত জেনারেলরা ইসলাম রক্ষার কথাই বলেছিল তাদের সৈন্যদের।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে। সেগুলো হলো জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। কিন্তু এই মূলনীতিগুলো বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেটি একটি মর্মান্তিক সত্য। রাষ্ট্রের হওয়ার কথা ছিল সম্পূর্ণরূপে ধর্মনিরপেক্ষ অর্থাৎ ইহজাগতিক। কিন্তু রাষ্ট্র তা হয়নি, কেন যে হয়নি তার কারণগুলো বেশ স্পষ্ট। প্রথম সত্য হলো এই যে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থটাই শাসকশ্রেণির কাছে পরিষ্কার ছিল না। এমনকি তাঁদের কাছেও নয়, যাঁরা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এবং ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারীদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে তাঁরা ইহলৌকিকতা বোঝাননি, বোঝাননি এই প্রয়োজনটা যে ধর্ম ও রাষ্ট্রকে আলাদা করে ফেলতে হবে পরস্পর থেকে। বরং উল্টো বুঝিয়েছেন, সব ধর্মের সমান অধিকার এবং পারলে আরও বেশি ধর্মচর্চা করা। দ্বিতীয় সত্য এই যে শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা এসেছে, তারা অনেকেই ছিল পাকিস্তানপন্থী। পাকিস্তানের প্রতি দুর্বলতা ছাড়াও তাদের ভেতর আরেকটি প্রবণতা ছিল। সেটি হলো বাংলাদেশকে একটি আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করা। তাদের প্রভু ও সমমনারা একদা যেমন করেছিল পাকিস্তানকে। তবে প্রয়োজনটা বাইরে থেকে আসেনি, উৎপন্ন হয়েছে ভেতরের প্রয়োজন থেকেই। সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রই দেশ শাসন করবে, বিশেষ করে শেখ মুজিবের পর থেকে, তারা রাষ্ট্রকে তাদের মনের মতো করে তৈরি করে নেবে এটাই স্বাভাবিক। সেই ঘটনাই পুনরায় ঘটছে বাংলাদেশে। আর লেজ টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের আবশ্যকতাটাও ফিরে এসেছে। যার ফলে দেখা গেল দেশের সংবিধান থেকে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান স্বয়ং ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র কেটে বাদ দিয়ে দিলেন। গণতন্ত্র তো ছিলই না। সামরিক আমলাদের শাসন চলছিল; বাঙালি জাতীয়তাবাদও গেল। সে জায়গায় আনা হলো বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। এরশাদ ব্যাপারটাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলেন। তিনি সংবিধানকে আরও একবার রক্তাক্ত করে দিয়ে রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তন করলেন। সময় পেলে হয়তো রাষ্ট্রের নামই বদলে দেওয়ার পদক্ষেপ নিতেন। সময় পাননি। যার পাঁয়তারা এখন আমরা দেখতে পারছি।

জিয়ার সময় রুশ-ভারত বিরোধিতার একটা আওয়াজ উঠেছিল। জিয়াই তুলে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের বামপন্থীদের একাংশ ওই আওয়াজে আকৃষ্ট হয়ে জিয়ার সঙ্গে সহযোগিতায় মেতে উঠেছিল। তাতে রুশ-ভারতের ক্ষতি-বৃদ্ধি যা-ই হোক না কেন, জিয়াউর রহমানের বেশ সুবিধা হয়েছিল। তাঁর শক্ত হাত আরও শক্ত হয়ে উঠেছিল। তারই ধারাবাহিকতা বর্তমানে দেখা যাচ্ছে।

জিয়ার পরে জেনারেল এরশাদ এলেন। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তাঁর ক্ষীণতম সম্পর্কও ছিল না। তিনি ছিলেন উল্টো দিকে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন জনগণকে শান্তি এনে দেবেন। দিতে পারলেন না। প্রতিশ্রুতি ছিল দুর্নীতি দমনের, পারেননি তো বটেই, বরং তাঁর প্রশ্রয়ে দুর্নীতি বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষানীতি থেকে শুরু করে সাইকেলে চড়ে অফিসে যাওয়ার নীতি পর্যন্ত তাঁর সব নীতিই চরমভাবে ব্যর্থ হয়ে গেছে। ফলে আর কিছু না পেয়ে তিনি ধর্ম দিলেন। রাষ্ট্রীয় ধর্ম প্রবর্তন করলেন, সেই পাকিস্তানি শাসকদের কায়দায়।

২. সংস্কারের প্রয়োজনে অন্তর্বর্তী সরকার ১১টি কমিশন গঠন করেছে, কিন্তু তারা শিক্ষা সংস্কারের লক্ষ্যে যে কোনো কমিশন গঠন করেনি, এ জন্য অবশ্যই প্রশংসা দাবি করতে পারে। আমাদের মূল ধারার শিক্ষাব্যবস্থা এমনিতেই নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে, তার মধ্যে আবার সংস্কারের ধাক্কাধাক্কি সে বেচারাকে নতুন জ্বালাতনের মধ্যে ফেলুক, এটা মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। অতীতে দেখা গেছে যে যখনই কোনো ‘বৈপ্লবিক’ সরকারের আগমন ঘটে, তখনই সঙ্গে সঙ্গেই, তারা শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি ঘটানোর জন্য ব্যস্তসমস্ত হয়ে পড়ে এবং মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থা একটা ধাক্কা খায়। পরবর্তী ‘বিপ্লবী’ সরকার আবার নতুন সংস্কারে হাত লাগিয়ে ব্যবস্থাটাকে আরেকটা ধাক্কা দেয়। মূল যে সংস্কার প্রয়োজন, সেটা হলো একটি অভিন্ন ব্যবস্থা চালু করা, রাষ্ট্রপরিচালকেরা সে ব্যাপারটাকে বিবেচনার মধ্যেই আনেন না। বৈষম্যনির্ভর পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা আগের মতোই সহাস্যে টিকে থাকে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকার সংস্কারের নাম করে কয়েকটি অতিরিক্ত পাবলিক পরীক্ষার সংযোজন ঘটিয়ে মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি সাধনে তৎপর হয়েছিল। তাতে দুর্বল ব্যবস্থাটা আরও একটা ঝুঁকির মুখে পড়েছিল। বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ ওঠায় তারা অতিরিক্ত পরীক্ষা রদ করেছে। কিন্তু ২০১৭ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড যে তাদের নিজেদের প্রণীত বাংলা পাঠ্যপুস্তক থেকে আচমকা ১১টি কবিতা, ৫টি গল্প ও প্রবন্ধ বাদ দিয়ে দিল, সেই বৈপ্লবিক কাজটি কেন করা হলো তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তাদের অনেক নৃশংসতা, অপকর্ম ও দুর্নীতির তদন্ত করা হচ্ছে এবং হতে থাকবে, কিন্তু পাঠ্যপুস্তকের ওপর নির্মম ও ক্ষতিকর হামলাটি কেন ঘটেছিল, সে বিষয়ে কোনো তদন্ত হয়নি। তদন্ত হওয়াটা কিন্তু আবশ্যক। জানা দরকার শিক্ষার ওপর অমন হস্তক্ষেপটি কারা এবং কীভাবে ঘটিয়েছিল। কাজটা বর্তমান সরকার শিক্ষাকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে সেটা জানার ব্যাপারেও সহায়ক হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

ভালো কথা, বিগত সরকার দেশে যে ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণ করেছিল, তার জন্য অর্থ ও অনুপ্রেরণা কোথা থেকে এসেছিল সে ব্যাপারে জনমনে বড় রকমের একটা জিজ্ঞাসা রয়ে গেছে। শোনা গিয়েছিল যে টাকাটা এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে; এমনও ধারণা ছিল যে ওই তহবিল মধ্যপ্রাচ্যের মাধ্যমে এসেছে ঠিকই, কিন্তু প্রেরক হচ্ছে সিআইএ; এখন নাকি প্রকাশ পেয়েছে টাকা অন্য কেউ দেয়নি, দিয়েছে সরকার নিজেই। একসময়ে ঢাকা শহরকে বলা হতো মসজিদের শহর। সেই সুখ্যাতি এখন বিলক্ষণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে; শুধু ঢাকা শহর নয়, বাংলাদেশের কোথাও মসজিদের কোনো অভাব নেই। মসজিদ প্রতিষ্ঠার নামে সরকারি জায়গা দখল করা হয়েছে, এমন অভিযোগও বিস্তর শোনা গেছে। তার মধ্যে হঠাৎ করে আবার মডেল মসজিদ তৈরির আবশ্যকতা কেন দেখা দিল। বিগত সরকার দেশব্যাপী মডেল সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে এমন খবর কিন্তু আমাদের জানা নেই। তাহলে?

এসব হলো রাজনৈতিক ঘটনা। পাশাপাশি এ সত্যও তো রয়ে গেছে যে উপমহাদেশের যে সাংস্কৃতিক ভূমি ধর্মবাদিতা ও ধর্মভীরুতার বিকাশের পক্ষে অত্যন্ত উপযোগী, সে ভূমি বাংলাদেশেও বিদ্যমান। বাংলাদেশে তার উর্বরাশক্তি বরং বেশি। কেননা দেশটি অনেক বেশি দরিদ্র, অনেক বেশি পশ্চাৎপদ। দীর্ঘকাল এ ভূমি পরাধীন ছিল। আজও সে স্বাধীন নয়। আজও সে বিশ্ব পুঁজিবাদের অধীন। কাজেই মানুষ এখানে আত্মসমর্পণে অভ্যস্ত। সে আত্মসমর্পণ করেছে বিদেশি শাসকের কাছে, করেছে ভাগ্যের কাছে। তার আত্মবিশ্বাস নেই। তার জন্য খুবই প্রয়োজন পারলৌকিক আশ্রয়ের। যে জন্য ধর্মবাদিতা ও সাম্প্রদায়িকতা দুটোই টিকে আছে এবং সুযোগ পেয়ে এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, এ দেশে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জয়া আহসানকে নিয়ে খেপেছেন তৃণমূল নেত্রী, টালিউডে বাংলাদেশিদের নিষিদ্ধের দাবি

এনবিআর চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কুৎসা, বরখাস্ত নিরাপত্তাপ্রহরী

অবৈধ অভিবাসী বিষয়ে কঠোর মালয়েশিয়া, ফেরত পাঠাচ্ছে বিমানবন্দর থেকেই

এনসিপির পদযাত্রা ঘিরে গোপালগঞ্জে পুলিশের গাড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগ

ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপি ঐক্য, পাত্তা দিচ্ছে না বিএনপি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত