চিররঞ্জন সরকার
জোসেফ গোয়েবলস ছিলেন হিটলারের নাৎসি জার্মানির তথ্য ও প্রচারবিষয়ক মন্ত্রী। তিনি ছিলেন মিথ্যাকে ‘সত্য’ বানানোর এক ভয়ংকর কৌশলের রূপকার। গোয়েবলস বিশ্বাস করতেন, ‘একটি বড় মিথ্যাকে বারবার বললে মানুষ একসময় সেটিকে সত্য বলে মেনে নেয়।’ তাঁর এই নীতি দিয়েই নাৎসি জার্মানি কোটি মানুষের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করেছিল, উসকে দিয়েছিল যুদ্ধ, ঘৃণা আর ধ্বংস। ভাবুন তো, এমন একজন মানুষ যদি পেতেন বর্তমানের ফেসবুক, টুইটার বা ইউটিউবের মতো সামাজিক মাধ্যমের হাতিয়ার—তাহলে কী হতে পারত?
আমরা আজ যে সময়ে বাস করছি, তা যেন গোয়েবলসের সেই কল্পনারই বাস্তব রূপ। প্রতিদিন আমাদের সামনে ভেসে আসে মিথ্যার ঢেউ। কখনো তা রাজনৈতিক, কখনো পারিবারিক, কখনো আবার সাংস্কৃতিক বা ব্যক্তিগত। সামাজিক মাধ্যম এখন আর শুধুই যোগাযোগের মাধ্যম নয়—এটি হয়ে উঠেছে বিভ্রান্তি, মিথ্যা প্রচার এবং বিভাজনের সবচেয়ে শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম।
ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স (আগের টুইটার)—এইসব সামাজিক মাধ্যম এখন আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এগুলোকে আধুনিক যুগের চায়ের দোকান বললে ভুল হবে না। পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে যেমন হরেক রকম মানুষ ভিড় করে, দেশের খবর থেকে শুরু করে পাড়ার গসিপ পর্যন্ত সব আলোচনা হয়, তেমনি এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতেও সব শ্রেণির মানুষের আনাগোনা। এখানে কেউ নিজেকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করে জ্ঞান বিতরণ করছে, কেউ নীতি ও আদর্শের ধারক সেজে উপদেশ দিচ্ছে, আবার কেউ কেবল কৌতুকপ্রেমী দর্শক হয়ে অন্যের পোস্ট দেখছে আর লাইক-শেয়ার করছে। কিন্তু এই ডিজিটাল চায়ের দোকানে একটা বড় সমস্যা হলো, খবরের সত্যতা যাচাইয়ের কোনো বালাই নেই। এখানে ভাবনার গভীরতার চেয়ে মন্তব্যের দ্রুততা আর প্রতিক্রিয়ার প্রতিযোগিতাটাই মুখ্য। কে কতটা দ্রুত একটা খবর ছড়াতে পারল, সেটাই যেন বড় বিষয়। ফলে যা ইচ্ছে তা-ই লেখা হচ্ছে, বলা হচ্ছে, আর মানুষ যাচাই না করেই তা বিশ্বাস করে ফেলছে।
এই খোলামেলা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের একদিকে যেমন ভালো কথা, শিক্ষামূলক বিষয়বস্তু বা মানবিক উদ্যোগের খবর ছড়ায়, তেমনি এর উল্টো পিঠে রয়েছে ভয়ংকর মিথ্যা, কুৎসা আর চরিত্রহননের অবাধ বিচরণ। এখানে ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতে বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে সহজেই মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। অনেক পুরোনো ছবিকে বর্তমানের ছবি হিসেবে ব্যবহার করে এই গুজবকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা হয়। কে বা কারা এই মিথ্যা খবরটি প্রথম ছড়িয়েছিল, তা হয়তো আমরা জানতেও পারিনি, কিন্তু হাজার হাজার মানুষ কোনো রকম যাচাই-বাছাই না করেই চোখ বন্ধ করে তা বিশ্বাস করে ছড়িয়ে দিতে শুরু করে। আর একবার যখন মিথ্যা ছড়িয়ে পড়ে, তখন তা ফিরিয়ে আনা বা তার ক্ষতি পূরণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এটাই আমাদের বর্তমান সামাজিক মাধ্যমের বাস্তবতা। এখানে সত্যের তুলনায় মিথ্যার গতি অনেক বেশি। কেউ যদি চায়, সহজেই কারও সম্মান নষ্ট করে দিতে পারে। কারণ, এখানে দায় নেই, জবাবদিহি নেই। কেউ ভুল কিছু পোস্ট করলে সেটি একবার ভাইরাল হয়ে গেলে আর ফেরানো যায় না। খবরের কাগজে ভুল হলে সংশোধনী ছাপা যায়, টিভিতে ভুল হলে ক্ষমা চাওয়া যায়—কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভুল পোস্টের পরিণতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
মিথ্যার এক ভয়ংকর জালে আটকে যাচ্ছে আমাদের পরিবার, সমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। কিশোর-কিশোরীরা এখন রাতে ঘুমায় না—রিল দেখে, লাইকের নেশায় ছুটে চলে, অচেনা পরিচয়ের মোহে গড়ে তোলে সম্পর্ক, আর ধোঁয়াটে এক ‘পর্দার সুখ’-কে বাস্তব ভেবে মজে যায় অবাস্তবের জগতে। একেকটা রঙিন ফ্রেমে বন্দী হয়ে ভেঙে পড়ছে বাস্তব জীবন। ঘর ভাঙছে, সম্পর্ক ভাঙছে, ভালোবাসা বদলে যাচ্ছে সাময়িক উত্তেজনায়। মা সন্তান ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে, স্বামী নীরবে দ্বিতীয় বিয়ে করছে। এই নকল সুখ খুঁজতে গিয়ে মানুষ হারিয়ে ফেলছে জীবনের আসল মানে—শান্তি, দায়িত্ব আর মূল্যবোধ।
‘রিলস’ এখন এক ভয়ংকর ডিজিটাল মাদক। একবার যার নেশায় পড়লে সময়, বিচারবুদ্ধি, বাস্তবতা—সব হারিয়ে যায়। এখানে সত্য-মিথ্যার কোনো বাছাই নেই, যা খুশি তা-ই পোস্ট—গল্প হোক বা গুজব, অপমান হোক বা উসকানি। সামাজিক অনুশাসন, পারিবারিক মূল্যবোধ, নৈতিকতার দেয়াল ভেঙে পড়ছে মুহূর্তে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, বুদ্ধিমান-নির্বোধ, মানবিক-অমানবিক—সবাই দাঁড়িয়ে পড়েছে এক মঞ্চে, যেখানে বিভ্রান্তি আর উগ্রতা হয়ে উঠেছে বিনোদনের অংশ।
মিথ্যা, কুৎসা, চরিত্রহনন মানুষের পুরোনো অভ্যাস হলেও এখন তার বিস্তার আগুনের মতো—তীব্র, দ্রুত, নিয়ন্ত্রণহীন। অতীতে এমন দ্রুতগতির ও শক্তিশালী মাধ্যম ছিল না। যৌথ পরিবার ভেঙে গিয়ে মানুষ এমনিতেই নিঃসঙ্গ, সামাজিক মাধ্যম সেই একাকিত্বে ঢেলে দিচ্ছে আরও বিষ। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম—বাড়ির ভেতর আটকে থাকা এই প্রজন্ম সামাজিক মাধ্যমকে আঁকড়ে ধরছে জীবনের বিকল্প হিসেবে। দারিদ্র্যপীড়িত, স্বপ্নভঙ্গ হওয়া মধ্যবিত্ত-গরিবের কাছে এখন মোবাইল ফোনই একমাত্র সঙ্গী। পেটে ক্ষুধা থাকলেও হাতে মোবাইল ফোন থাকে, ফেসবুক স্ক্রল হয়—আর তাতেই জীবনের চালচিত্র বদলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, কিন্তু ভয়ংকরভাবে।
আর সবচেয়ে বিপদের দিক হলো, সামাজিক মাধ্যম এখন রাজনীতিরও প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। মিথ্যা খবর ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রতিপক্ষকে হেয় করতে। ধর্মীয় উসকানিমূলক পোস্ট দিয়ে দাঙ্গার চেষ্টা চলছে। বিদেশি ঘটনার ভিডিওকে দেশের বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যে কেউ, যেকোনো কিছু লিখে দিচ্ছে—কেউ সাংবাদিক না হয়েও ‘সংবাদ’ দিচ্ছে, কেউ সত্য যাচাই না করেই ‘বিশ্লেষণ’ করছে। এতটাই ভয়াবহ হয়েছে অবস্থা যে, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য প্রায় বিলুপ্ত।
ভাবুন, যদি গোয়েবলসের হাতে থাকত আজকের এই ফেসবুক বা ইউটিউব—তাহলে তিনি কী করতে পারতেন? হয়তো বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতেন মানবজাতির জন্য। কারণ গোয়েবলস জানতেন, মিথ্যা দিয়ে একে একে সত্যকে দমন করা যায়। তবে তিনি এটাও জানতেন—বিদ্রোহ হলে তিনিই সবার আগে মরবেন। তাই হিটলারের মৃত্যুর পরপরই নিজের স্ত্রী ও ছয় সন্তানকে হত্যা করে আত্মহত্যা করেন।
আমাদের বর্তমান সমাজেও ‘গোয়েবলস’ আছে। তাদের চেহারা আলাদা, কিন্তু উদ্দেশ্য একই—মিথ্যা বলো, আবার বলো, যতক্ষণ না সেটি কেউ বিশ্বাস করে। এই প্রতারণার জালে আটকা পড়ছে সাধারণ মানুষ। আর সেটিকে সহায়তা করছে প্রযুক্তি, যেটি আসলে আমাদের জীবন সহজ করার কথা ছিল।
অবশ্য স্মার্টফোনের সুফল অস্বীকার করা যায় না। ঘরে বসে ব্যাংকিং, কেনাকাটা, যোগাযোগ, এমনকি কাজও করা যায়। কিন্তু সেই সুযোগের পাশাপাশি এসেছে ভয়ংকর একটি আসক্তি—অবিরাম স্ক্রলিং, রিল দেখা, নিজেকে সব সময় প্রকাশ করার তাড়া। এই নেশা এমন যে, সময় কেটে যায়, জীবনের মূল্যবান মুহূর্ত হারিয়ে যায়।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে—এ অবস্থা থেকে মুক্তির পথ কী? শক্ত আইন নিশ্চয়ই দরকার। যেমন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘ডিজিটাল সার্ভিস অ্যাক্ট’ অনেকটাই মিথ্যা রটনা নিয়ন্ত্রণে এনেছে। ফ্যাক্ট চেকিং বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে মিথ্যা শনাক্ত করার প্রযুক্তি চালু হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে কী হচ্ছে? আমরা কি এভাবেই চলতে থাকব?
সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো—এই মিথ্যার বাজারে অনেক সময় রাষ্ট্র নিজেই সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক সুবিধার জন্য তথ্য বিকৃতি, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গুজব ছড়ানো কিংবা বিরুদ্ধস্বরে কুৎসা ছড়ানো যেন এক অঘোষিত কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক বিষাক্ত চক্রের মুখোমুখি—যেখানে রাষ্ট্র, প্রযুক্তি ও জনমন একসঙ্গে ব্যবহৃত হচ্ছে অসত্যের পক্ষে। এককথায়, ‘শর্ষের মধ্যেই ভূতের বাস’।
এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে দায় ঘাড়ে নিতে হবে প্রত্যেক নাগরিকের। আমাদের প্রত্যেককে প্রশ্ন করতে হবে—আমি কি যাচাই করে তথ্য শেয়ার করছি? আমি কি সত্য জানতে চাই, না শুধু নিজের বিশ্বাসকে সন্তুষ্ট করতে চাই? যতক্ষণ না সাধারণ মানুষ সচেতন হয়ে ওঠে, ততক্ষণ প্রযুক্তি মুক্তির চাবিকাঠি নয়, বরং ধ্বংসের তির।
সতর্ক না হলে, এই মিথ্যার ফুলঝুরি একদিন এমন এক আগুন ছড়াবে, যা সমাজকে শুধু ভেঙে ফেলবে না—ভেতর থেকে সম্পূর্ণভাবে গলিয়ে দেবে। তখন আর কারও কিছু করার থাকবে না। তাই এখনই সময়, সত্যকে আঁকড়ে ধরার। নয়তো প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি মোবাইল ফোন আর প্রতিটি পোস্ট একেকটি ‘ছোট গোয়েবল্স’ হয়ে এই সমাজকেই কফিনে পুরে ফেলবে—আর আমরা নিজেদের ধ্বংস নিজের হাতে ডেকে আনব।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
জোসেফ গোয়েবলস ছিলেন হিটলারের নাৎসি জার্মানির তথ্য ও প্রচারবিষয়ক মন্ত্রী। তিনি ছিলেন মিথ্যাকে ‘সত্য’ বানানোর এক ভয়ংকর কৌশলের রূপকার। গোয়েবলস বিশ্বাস করতেন, ‘একটি বড় মিথ্যাকে বারবার বললে মানুষ একসময় সেটিকে সত্য বলে মেনে নেয়।’ তাঁর এই নীতি দিয়েই নাৎসি জার্মানি কোটি মানুষের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করেছিল, উসকে দিয়েছিল যুদ্ধ, ঘৃণা আর ধ্বংস। ভাবুন তো, এমন একজন মানুষ যদি পেতেন বর্তমানের ফেসবুক, টুইটার বা ইউটিউবের মতো সামাজিক মাধ্যমের হাতিয়ার—তাহলে কী হতে পারত?
আমরা আজ যে সময়ে বাস করছি, তা যেন গোয়েবলসের সেই কল্পনারই বাস্তব রূপ। প্রতিদিন আমাদের সামনে ভেসে আসে মিথ্যার ঢেউ। কখনো তা রাজনৈতিক, কখনো পারিবারিক, কখনো আবার সাংস্কৃতিক বা ব্যক্তিগত। সামাজিক মাধ্যম এখন আর শুধুই যোগাযোগের মাধ্যম নয়—এটি হয়ে উঠেছে বিভ্রান্তি, মিথ্যা প্রচার এবং বিভাজনের সবচেয়ে শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম।
ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স (আগের টুইটার)—এইসব সামাজিক মাধ্যম এখন আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এগুলোকে আধুনিক যুগের চায়ের দোকান বললে ভুল হবে না। পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে যেমন হরেক রকম মানুষ ভিড় করে, দেশের খবর থেকে শুরু করে পাড়ার গসিপ পর্যন্ত সব আলোচনা হয়, তেমনি এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতেও সব শ্রেণির মানুষের আনাগোনা। এখানে কেউ নিজেকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করে জ্ঞান বিতরণ করছে, কেউ নীতি ও আদর্শের ধারক সেজে উপদেশ দিচ্ছে, আবার কেউ কেবল কৌতুকপ্রেমী দর্শক হয়ে অন্যের পোস্ট দেখছে আর লাইক-শেয়ার করছে। কিন্তু এই ডিজিটাল চায়ের দোকানে একটা বড় সমস্যা হলো, খবরের সত্যতা যাচাইয়ের কোনো বালাই নেই। এখানে ভাবনার গভীরতার চেয়ে মন্তব্যের দ্রুততা আর প্রতিক্রিয়ার প্রতিযোগিতাটাই মুখ্য। কে কতটা দ্রুত একটা খবর ছড়াতে পারল, সেটাই যেন বড় বিষয়। ফলে যা ইচ্ছে তা-ই লেখা হচ্ছে, বলা হচ্ছে, আর মানুষ যাচাই না করেই তা বিশ্বাস করে ফেলছে।
এই খোলামেলা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের একদিকে যেমন ভালো কথা, শিক্ষামূলক বিষয়বস্তু বা মানবিক উদ্যোগের খবর ছড়ায়, তেমনি এর উল্টো পিঠে রয়েছে ভয়ংকর মিথ্যা, কুৎসা আর চরিত্রহননের অবাধ বিচরণ। এখানে ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতে বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে সহজেই মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। অনেক পুরোনো ছবিকে বর্তমানের ছবি হিসেবে ব্যবহার করে এই গুজবকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা হয়। কে বা কারা এই মিথ্যা খবরটি প্রথম ছড়িয়েছিল, তা হয়তো আমরা জানতেও পারিনি, কিন্তু হাজার হাজার মানুষ কোনো রকম যাচাই-বাছাই না করেই চোখ বন্ধ করে তা বিশ্বাস করে ছড়িয়ে দিতে শুরু করে। আর একবার যখন মিথ্যা ছড়িয়ে পড়ে, তখন তা ফিরিয়ে আনা বা তার ক্ষতি পূরণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এটাই আমাদের বর্তমান সামাজিক মাধ্যমের বাস্তবতা। এখানে সত্যের তুলনায় মিথ্যার গতি অনেক বেশি। কেউ যদি চায়, সহজেই কারও সম্মান নষ্ট করে দিতে পারে। কারণ, এখানে দায় নেই, জবাবদিহি নেই। কেউ ভুল কিছু পোস্ট করলে সেটি একবার ভাইরাল হয়ে গেলে আর ফেরানো যায় না। খবরের কাগজে ভুল হলে সংশোধনী ছাপা যায়, টিভিতে ভুল হলে ক্ষমা চাওয়া যায়—কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভুল পোস্টের পরিণতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
মিথ্যার এক ভয়ংকর জালে আটকে যাচ্ছে আমাদের পরিবার, সমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। কিশোর-কিশোরীরা এখন রাতে ঘুমায় না—রিল দেখে, লাইকের নেশায় ছুটে চলে, অচেনা পরিচয়ের মোহে গড়ে তোলে সম্পর্ক, আর ধোঁয়াটে এক ‘পর্দার সুখ’-কে বাস্তব ভেবে মজে যায় অবাস্তবের জগতে। একেকটা রঙিন ফ্রেমে বন্দী হয়ে ভেঙে পড়ছে বাস্তব জীবন। ঘর ভাঙছে, সম্পর্ক ভাঙছে, ভালোবাসা বদলে যাচ্ছে সাময়িক উত্তেজনায়। মা সন্তান ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে, স্বামী নীরবে দ্বিতীয় বিয়ে করছে। এই নকল সুখ খুঁজতে গিয়ে মানুষ হারিয়ে ফেলছে জীবনের আসল মানে—শান্তি, দায়িত্ব আর মূল্যবোধ।
‘রিলস’ এখন এক ভয়ংকর ডিজিটাল মাদক। একবার যার নেশায় পড়লে সময়, বিচারবুদ্ধি, বাস্তবতা—সব হারিয়ে যায়। এখানে সত্য-মিথ্যার কোনো বাছাই নেই, যা খুশি তা-ই পোস্ট—গল্প হোক বা গুজব, অপমান হোক বা উসকানি। সামাজিক অনুশাসন, পারিবারিক মূল্যবোধ, নৈতিকতার দেয়াল ভেঙে পড়ছে মুহূর্তে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, বুদ্ধিমান-নির্বোধ, মানবিক-অমানবিক—সবাই দাঁড়িয়ে পড়েছে এক মঞ্চে, যেখানে বিভ্রান্তি আর উগ্রতা হয়ে উঠেছে বিনোদনের অংশ।
মিথ্যা, কুৎসা, চরিত্রহনন মানুষের পুরোনো অভ্যাস হলেও এখন তার বিস্তার আগুনের মতো—তীব্র, দ্রুত, নিয়ন্ত্রণহীন। অতীতে এমন দ্রুতগতির ও শক্তিশালী মাধ্যম ছিল না। যৌথ পরিবার ভেঙে গিয়ে মানুষ এমনিতেই নিঃসঙ্গ, সামাজিক মাধ্যম সেই একাকিত্বে ঢেলে দিচ্ছে আরও বিষ। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম—বাড়ির ভেতর আটকে থাকা এই প্রজন্ম সামাজিক মাধ্যমকে আঁকড়ে ধরছে জীবনের বিকল্প হিসেবে। দারিদ্র্যপীড়িত, স্বপ্নভঙ্গ হওয়া মধ্যবিত্ত-গরিবের কাছে এখন মোবাইল ফোনই একমাত্র সঙ্গী। পেটে ক্ষুধা থাকলেও হাতে মোবাইল ফোন থাকে, ফেসবুক স্ক্রল হয়—আর তাতেই জীবনের চালচিত্র বদলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, কিন্তু ভয়ংকরভাবে।
আর সবচেয়ে বিপদের দিক হলো, সামাজিক মাধ্যম এখন রাজনীতিরও প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। মিথ্যা খবর ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রতিপক্ষকে হেয় করতে। ধর্মীয় উসকানিমূলক পোস্ট দিয়ে দাঙ্গার চেষ্টা চলছে। বিদেশি ঘটনার ভিডিওকে দেশের বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যে কেউ, যেকোনো কিছু লিখে দিচ্ছে—কেউ সাংবাদিক না হয়েও ‘সংবাদ’ দিচ্ছে, কেউ সত্য যাচাই না করেই ‘বিশ্লেষণ’ করছে। এতটাই ভয়াবহ হয়েছে অবস্থা যে, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য প্রায় বিলুপ্ত।
ভাবুন, যদি গোয়েবলসের হাতে থাকত আজকের এই ফেসবুক বা ইউটিউব—তাহলে তিনি কী করতে পারতেন? হয়তো বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতেন মানবজাতির জন্য। কারণ গোয়েবলস জানতেন, মিথ্যা দিয়ে একে একে সত্যকে দমন করা যায়। তবে তিনি এটাও জানতেন—বিদ্রোহ হলে তিনিই সবার আগে মরবেন। তাই হিটলারের মৃত্যুর পরপরই নিজের স্ত্রী ও ছয় সন্তানকে হত্যা করে আত্মহত্যা করেন।
আমাদের বর্তমান সমাজেও ‘গোয়েবলস’ আছে। তাদের চেহারা আলাদা, কিন্তু উদ্দেশ্য একই—মিথ্যা বলো, আবার বলো, যতক্ষণ না সেটি কেউ বিশ্বাস করে। এই প্রতারণার জালে আটকা পড়ছে সাধারণ মানুষ। আর সেটিকে সহায়তা করছে প্রযুক্তি, যেটি আসলে আমাদের জীবন সহজ করার কথা ছিল।
অবশ্য স্মার্টফোনের সুফল অস্বীকার করা যায় না। ঘরে বসে ব্যাংকিং, কেনাকাটা, যোগাযোগ, এমনকি কাজও করা যায়। কিন্তু সেই সুযোগের পাশাপাশি এসেছে ভয়ংকর একটি আসক্তি—অবিরাম স্ক্রলিং, রিল দেখা, নিজেকে সব সময় প্রকাশ করার তাড়া। এই নেশা এমন যে, সময় কেটে যায়, জীবনের মূল্যবান মুহূর্ত হারিয়ে যায়।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে—এ অবস্থা থেকে মুক্তির পথ কী? শক্ত আইন নিশ্চয়ই দরকার। যেমন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘ডিজিটাল সার্ভিস অ্যাক্ট’ অনেকটাই মিথ্যা রটনা নিয়ন্ত্রণে এনেছে। ফ্যাক্ট চেকিং বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে মিথ্যা শনাক্ত করার প্রযুক্তি চালু হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে কী হচ্ছে? আমরা কি এভাবেই চলতে থাকব?
সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো—এই মিথ্যার বাজারে অনেক সময় রাষ্ট্র নিজেই সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক সুবিধার জন্য তথ্য বিকৃতি, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গুজব ছড়ানো কিংবা বিরুদ্ধস্বরে কুৎসা ছড়ানো যেন এক অঘোষিত কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক বিষাক্ত চক্রের মুখোমুখি—যেখানে রাষ্ট্র, প্রযুক্তি ও জনমন একসঙ্গে ব্যবহৃত হচ্ছে অসত্যের পক্ষে। এককথায়, ‘শর্ষের মধ্যেই ভূতের বাস’।
এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে দায় ঘাড়ে নিতে হবে প্রত্যেক নাগরিকের। আমাদের প্রত্যেককে প্রশ্ন করতে হবে—আমি কি যাচাই করে তথ্য শেয়ার করছি? আমি কি সত্য জানতে চাই, না শুধু নিজের বিশ্বাসকে সন্তুষ্ট করতে চাই? যতক্ষণ না সাধারণ মানুষ সচেতন হয়ে ওঠে, ততক্ষণ প্রযুক্তি মুক্তির চাবিকাঠি নয়, বরং ধ্বংসের তির।
সতর্ক না হলে, এই মিথ্যার ফুলঝুরি একদিন এমন এক আগুন ছড়াবে, যা সমাজকে শুধু ভেঙে ফেলবে না—ভেতর থেকে সম্পূর্ণভাবে গলিয়ে দেবে। তখন আর কারও কিছু করার থাকবে না। তাই এখনই সময়, সত্যকে আঁকড়ে ধরার। নয়তো প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি মোবাইল ফোন আর প্রতিটি পোস্ট একেকটি ‘ছোট গোয়েবল্স’ হয়ে এই সমাজকেই কফিনে পুরে ফেলবে—আর আমরা নিজেদের ধ্বংস নিজের হাতে ডেকে আনব।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
গত বছর জুলাইয়ের আন্দোলনে একটি স্লোগান শুনে আমি পুলকিত বোধ করেছিলাম। স্লোগানটা ছিল—‘কোটা না মেধা মেধা, মেধা মেধা’। এই স্লোগানের আরেকটি সমার্থক প্রবাদ বাক্য আছে আমাদের সমাজে—‘জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো’। আপনি কার ছেলে বা মেয়ে, কার নাতি বা নাতনি অর্থাৎ পিতা-মাতা বা দাদা-দাদির পরিচয় সূত্রে আপনি...
১০ ঘণ্টা আগেসেই উনিশ শ সাতাশি সালের এক শীতের সকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রাসনাদার শহরে ক্যাম্পাসের সামনে জড়ো হয়েছিল একদল বিদেশি শিক্ষার্থী। কুবান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল এরা। ছুটির দিনে ভ্রমণে যাচ্ছিল। দুটো বাস প্রস্তুত। কয়েকজন শিক্ষক আর অনেকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে বাস ছুটল তাগানরোগের দিকে...
১০ ঘণ্টা আগেরাজধানী ঢাকায় সাম্প্রতিক সময়ে অপরাধপ্রবণতার উদ্বেগজনক বৃদ্ধি জনমনে গভীর দুশ্চিন্তার সৃষ্টি করেছে। ২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসে খুন, অপহরণ, ছিনতাই ও ডাকাতি আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৮২.৫ শতাংশ বেশি। এ নিয়ে ১৩ জুলাই আজকের পত্রিকায় একটা সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগেমিটফোর্ড এলাকায় একজন ব্যবসায়ীকে জনসম্মুখে পাথর দিয়ে থেঁতলে হত্যা করা হলো। ঘটনাটি যেমন নির্মম, তেমনই মর্মান্তিক। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যেটি আঘাত করে, তা হলো—ঘটনার সময় আশপাশে থাকা মানুষের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। কেউ বাধা দিল না, কেউ ‘থামো’ বলল না, কেউ ওই বিপন্ন মানুষটার জীবন রক্ষার শেষ
১ দিন আগে