জাহীদ রেজা নূর
সেই উনিশ শ সাতাশি সালের এক শীতের সকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রাসনাদার শহরে ক্যাম্পাসের সামনে জড়ো হয়েছিল একদল বিদেশি শিক্ষার্থী। কুবান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল এরা। ছুটির দিনে ভ্রমণে যাচ্ছিল। দুটো বাস প্রস্তুত। কয়েকজন শিক্ষক আর অনেকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে বাস ছুটল তাগানরোগের দিকে। রুশ ভাষার শিক্ষক ইরিনা ভ্লাদিমিরোভনা চুপিচুপি বললেন, ‘আমরা আন্তন চেখভের জন্মস্থানে যাচ্ছি!’
সেদিন আর বরফ পড়ছিল না রুশ ফেডারেশনের একেবারে দক্ষিণের এই শহরটিতে। কিন্তু রাস্তায়, উদ্যানে, গাছের পাতায় ছিল শুভ্র তুষারের উপস্থিতি। জ্যাকেট বা ওভারকোটে শরীর ঢেকে নিয়ে চলেছে সবাই। শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে বাস যখন হাজির হলো হাইওয়েতে, তখন দুই পাশে শুধু যৌথ খামারের জমি। বহু দূরে বাড়ির আভাস। বরফের চাদর মুড়ি দিয়ে যেন শুয়ে আছে জমিগুলো।
সেই শিক্ষার্থীদের দলে আমিও ছিলাম। রুশ ভাষা ও সাহিত্য পড়ব বলে কুবান বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু করেছি তখন। পুশকিন, লেরমন্তভ, গোগল, তুর্গিয়েনেভ, দস্তইয়েভ্স্কি, তলস্তয় আর চেখভকে ক্লাসের ভেতরে-বাইরে জানব, চিনব—এ রকম একটি আশা নিয়েই দিন কাটছে তখন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল এই আয়োজন। সবাইকে চিনি না, কিন্তু হইহুল্লোড়, গানে মাতিয়ে রাখা ছেলেমেয়েগুলোকে খুব দ্রুত ভালোবেসে ফেললাম।
ঢাকা ছাড়ার আগে প্রগতি আর রাদুগা প্রকাশনের বদৌলতে আমরা রুশ সাহিত্যিকদের লেখালেখির সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠছিলাম। খুব কম দামে মনকাড়া বইগুলো পাওয়া যেত ঢাকায়। স্ট্যান্ডার্ড পাবলিকেশনসের বিশাল শোরুমে গেলেই কোনো না কোনো আকর্ষণীয় বই কিনে ফেলা যেত। রুশ স্বর্ণালি যুগের এই লেখকদের ব্যাপারে তাই কৌতূহল ছিল। তাঁদেরই একজন, আন্তন চেখভের বাড়ি দেখতে যাচ্ছি, তাতে উৎফুল্ল হব না কেন?
ছোটগল্প দিয়েই চেখভ মন কেড়েছিলেন আমাদের। তাঁর নাটকগুলো তখনো পড়া হয়নি। ‘বহুরূপী’ নামের গল্পটিতে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে তেলবাজির যে দৃষ্টান্ত দেখা গিয়েছিল, তাতে আমোদ পেয়েছি প্রচুর। আর ‘কেরানীর মৃত্যু’ তো এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। নাটক দেখতে বসে হাঁচি দেওয়া সেই কেরানি সামনে বসা টেকো অফিসারের কাছে কতবার ক্ষমা চাইলেন, অথচ তিনি সরাসরি ক্ষমা করলেন না, যার পরিণতিতে মরে গেলেন সেই কেরানি! কী এক মর্মান্তিক সমাপ্তি গল্পের!
প্রথমে বুঝতাম না, এভাবে কেন শেষ হবে একটা গল্প! বুঝতে সময় লেগেছে, কেরানিকে ক্ষমা করা না হলে তারা বারবার ক্ষমা চাইতেই থাকে। সরাসরি ক্ষমা না করলে মৃত্যুই তার একমাত্র সমাধান!
ছোট ছোট ব্যঙ্গধর্মী গল্পগুলো চেখভ লিখতেন স্রেফ বেঁচে থাকার রসদ জোগানোর জন্য। কিন্তু কি অসাধারণ এক-একটা সৃষ্টি হয়ে উঠত তা! রুশ সমাজের নিচুতলার মানুষের জীবনের কত না সূক্ষ্ম দিক ফুটে উঠত তাঁর লেখায়! কতটা মমতা নিয়েই না তিনি দেখতেন মানুষকে!
আমরা যখন তাগানরোগ শহরে পৌঁছালাম, তখন চোখের সামনে আজভ সাগর! সিঁড়ির পর সিঁড়ি নেমে গিয়ে মিশে গেছে সাগরের জলে। আমরা ভেসে থাকা শেষ সিঁড়িটায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। সাগরের ঢেউয়ের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে মিলিয়ে নিলাম নিজেদের। এবং তারপরই আমরা হাজির হলাম এক জিমনেসিয়ামে। এই বিদ্যায়তনেই পড়তেন শিশু চেখভ। একটি শ্রেণিকক্ষে ঢোকার পর সারি সারি বসার চেয়ার-টেবিলের দিকে আঙুল উঁচিয়ে ইরিনা ভ্লাদিমিরোভনা বললেন, ‘বলো তো, কোন চেয়ারটায় চেখভ বসতেন?’
কাউকেই বলে দিতে হলো না, সারির মাঝামাঝি যে চেয়ারটা ঢেকে রাখা হয়েছে ভারী প্লাস্টিকের আবরণ দিয়ে, সেটাই শিশু চেখভের বসার জায়গা ছিল।
আমরা গোল হয়ে সেই চেয়ারটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। ‘এই চেয়ারে বিখ্যাত লেখক আন্তন চেখভ বসতেন’—রুশ ভাষায় এই লেখাটির দিকে চোখ গেল আমাদের।
সে কবেকার কথা! স্মৃতিগুলো এখনো তাজা হয়ে রয়ে গেছে। ১৫ জুলাই চেখভকে মনে পড়ল তাঁর মৃত্যুদিনে!
লেকখ: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
সেই উনিশ শ সাতাশি সালের এক শীতের সকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রাসনাদার শহরে ক্যাম্পাসের সামনে জড়ো হয়েছিল একদল বিদেশি শিক্ষার্থী। কুবান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল এরা। ছুটির দিনে ভ্রমণে যাচ্ছিল। দুটো বাস প্রস্তুত। কয়েকজন শিক্ষক আর অনেকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে বাস ছুটল তাগানরোগের দিকে। রুশ ভাষার শিক্ষক ইরিনা ভ্লাদিমিরোভনা চুপিচুপি বললেন, ‘আমরা আন্তন চেখভের জন্মস্থানে যাচ্ছি!’
সেদিন আর বরফ পড়ছিল না রুশ ফেডারেশনের একেবারে দক্ষিণের এই শহরটিতে। কিন্তু রাস্তায়, উদ্যানে, গাছের পাতায় ছিল শুভ্র তুষারের উপস্থিতি। জ্যাকেট বা ওভারকোটে শরীর ঢেকে নিয়ে চলেছে সবাই। শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে বাস যখন হাজির হলো হাইওয়েতে, তখন দুই পাশে শুধু যৌথ খামারের জমি। বহু দূরে বাড়ির আভাস। বরফের চাদর মুড়ি দিয়ে যেন শুয়ে আছে জমিগুলো।
সেই শিক্ষার্থীদের দলে আমিও ছিলাম। রুশ ভাষা ও সাহিত্য পড়ব বলে কুবান বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু করেছি তখন। পুশকিন, লেরমন্তভ, গোগল, তুর্গিয়েনেভ, দস্তইয়েভ্স্কি, তলস্তয় আর চেখভকে ক্লাসের ভেতরে-বাইরে জানব, চিনব—এ রকম একটি আশা নিয়েই দিন কাটছে তখন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল এই আয়োজন। সবাইকে চিনি না, কিন্তু হইহুল্লোড়, গানে মাতিয়ে রাখা ছেলেমেয়েগুলোকে খুব দ্রুত ভালোবেসে ফেললাম।
ঢাকা ছাড়ার আগে প্রগতি আর রাদুগা প্রকাশনের বদৌলতে আমরা রুশ সাহিত্যিকদের লেখালেখির সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠছিলাম। খুব কম দামে মনকাড়া বইগুলো পাওয়া যেত ঢাকায়। স্ট্যান্ডার্ড পাবলিকেশনসের বিশাল শোরুমে গেলেই কোনো না কোনো আকর্ষণীয় বই কিনে ফেলা যেত। রুশ স্বর্ণালি যুগের এই লেখকদের ব্যাপারে তাই কৌতূহল ছিল। তাঁদেরই একজন, আন্তন চেখভের বাড়ি দেখতে যাচ্ছি, তাতে উৎফুল্ল হব না কেন?
ছোটগল্প দিয়েই চেখভ মন কেড়েছিলেন আমাদের। তাঁর নাটকগুলো তখনো পড়া হয়নি। ‘বহুরূপী’ নামের গল্পটিতে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে তেলবাজির যে দৃষ্টান্ত দেখা গিয়েছিল, তাতে আমোদ পেয়েছি প্রচুর। আর ‘কেরানীর মৃত্যু’ তো এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। নাটক দেখতে বসে হাঁচি দেওয়া সেই কেরানি সামনে বসা টেকো অফিসারের কাছে কতবার ক্ষমা চাইলেন, অথচ তিনি সরাসরি ক্ষমা করলেন না, যার পরিণতিতে মরে গেলেন সেই কেরানি! কী এক মর্মান্তিক সমাপ্তি গল্পের!
প্রথমে বুঝতাম না, এভাবে কেন শেষ হবে একটা গল্প! বুঝতে সময় লেগেছে, কেরানিকে ক্ষমা করা না হলে তারা বারবার ক্ষমা চাইতেই থাকে। সরাসরি ক্ষমা না করলে মৃত্যুই তার একমাত্র সমাধান!
ছোট ছোট ব্যঙ্গধর্মী গল্পগুলো চেখভ লিখতেন স্রেফ বেঁচে থাকার রসদ জোগানোর জন্য। কিন্তু কি অসাধারণ এক-একটা সৃষ্টি হয়ে উঠত তা! রুশ সমাজের নিচুতলার মানুষের জীবনের কত না সূক্ষ্ম দিক ফুটে উঠত তাঁর লেখায়! কতটা মমতা নিয়েই না তিনি দেখতেন মানুষকে!
আমরা যখন তাগানরোগ শহরে পৌঁছালাম, তখন চোখের সামনে আজভ সাগর! সিঁড়ির পর সিঁড়ি নেমে গিয়ে মিশে গেছে সাগরের জলে। আমরা ভেসে থাকা শেষ সিঁড়িটায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। সাগরের ঢেউয়ের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে মিলিয়ে নিলাম নিজেদের। এবং তারপরই আমরা হাজির হলাম এক জিমনেসিয়ামে। এই বিদ্যায়তনেই পড়তেন শিশু চেখভ। একটি শ্রেণিকক্ষে ঢোকার পর সারি সারি বসার চেয়ার-টেবিলের দিকে আঙুল উঁচিয়ে ইরিনা ভ্লাদিমিরোভনা বললেন, ‘বলো তো, কোন চেয়ারটায় চেখভ বসতেন?’
কাউকেই বলে দিতে হলো না, সারির মাঝামাঝি যে চেয়ারটা ঢেকে রাখা হয়েছে ভারী প্লাস্টিকের আবরণ দিয়ে, সেটাই শিশু চেখভের বসার জায়গা ছিল।
আমরা গোল হয়ে সেই চেয়ারটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। ‘এই চেয়ারে বিখ্যাত লেখক আন্তন চেখভ বসতেন’—রুশ ভাষায় এই লেখাটির দিকে চোখ গেল আমাদের।
সে কবেকার কথা! স্মৃতিগুলো এখনো তাজা হয়ে রয়ে গেছে। ১৫ জুলাই চেখভকে মনে পড়ল তাঁর মৃত্যুদিনে!
লেকখ: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
জোসেফ গোয়েবলস ছিলেন হিটলারের নাৎসি জার্মানির তথ্য ও প্রচারবিষয়ক মন্ত্রী। তিনি ছিলেন মিথ্যাকে ‘সত্য’ বানানোর এক ভয়ংকর কৌশলের রূপকার। গোয়েবলস বিশ্বাস করতেন, ‘একটি বড় মিথ্যাকে বারবার বললে মানুষ একসময় সেটিকে সত্য বলে মেনে নেয়।’ তাঁর এই নীতি দিয়েই নাৎসি জার্মানি কোটি মানুষের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করেছিল...
৯ ঘণ্টা আগেগত বছর জুলাইয়ের আন্দোলনে একটি স্লোগান শুনে আমি পুলকিত বোধ করেছিলাম। স্লোগানটা ছিল—‘কোটা না মেধা মেধা, মেধা মেধা’। এই স্লোগানের আরেকটি সমার্থক প্রবাদ বাক্য আছে আমাদের সমাজে—‘জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো’। আপনি কার ছেলে বা মেয়ে, কার নাতি বা নাতনি অর্থাৎ পিতা-মাতা বা দাদা-দাদির পরিচয় সূত্রে আপনি...
৯ ঘণ্টা আগেরাজধানী ঢাকায় সাম্প্রতিক সময়ে অপরাধপ্রবণতার উদ্বেগজনক বৃদ্ধি জনমনে গভীর দুশ্চিন্তার সৃষ্টি করেছে। ২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসে খুন, অপহরণ, ছিনতাই ও ডাকাতি আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৮২.৫ শতাংশ বেশি। এ নিয়ে ১৩ জুলাই আজকের পত্রিকায় একটা সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
৯ ঘণ্টা আগেমিটফোর্ড এলাকায় একজন ব্যবসায়ীকে জনসম্মুখে পাথর দিয়ে থেঁতলে হত্যা করা হলো। ঘটনাটি যেমন নির্মম, তেমনই মর্মান্তিক। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যেটি আঘাত করে, তা হলো—ঘটনার সময় আশপাশে থাকা মানুষের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। কেউ বাধা দিল না, কেউ ‘থামো’ বলল না, কেউ ওই বিপন্ন মানুষটার জীবন রক্ষার শেষ
১ দিন আগে